পারা ১

আল-ফাতিহা ১ - আল-বাকারা ১৪১

পারা ২

আল-বাকারা ১৪২ - আল-বাকারা ২৫২

পারা ৩

আল-বাকারা ২৫৩ - আল-ইমরান ৯২

পারা ৪

আল-ইমরান ৯৩ - আন-নিসা ২৩

পারা ৫

আন-নিসা ২৪ - আন-নিসা ১৪৭

পারা ৬

আন-নিসা ১৪৮ - আল-মায়িদাহ ৮১

পারা ৭

আল-মায়িদাহ ৮২ - আল-আন‘আম ১১০

পারা ৮

আল-আন‘আম ১১১ - আল-আ‘রাফ ৮৭

পারা ৯

আল-আ‘রাফ ৮৮ - আল-আনফাল ৪০

পারা ১০

আল-আনফাল ৪১ - আত-তাওবাহ ৯২

পারা ১১

আত-তাওবাহ ৯৩ - হুদ ৫

পারা ১২

হুদ ৬ - ইউসুফ ৫২

পারা ১৩

ইউসুফ ৫৩ - ইবরাহীম ৫২

পারা ১৪

আল-হিজর ১ - আন-নাহল ১২৮

পারা ১৫

বনী ইসরাঈল ১ - আল-কাহফ ৭৪

পারা ১৬

আল-কাহফ ৭৫ - ত্ব-হা ১৩৫

পারা ১৭

আল-আম্বিয়া ১ - আল-হাজ্জ ৭৮

পারা ১৮

আল-মুমিনুন ১ - আল-ফুরকান ২০

পারা ১৯

আল-ফুরকান ২১ - আন-নামল ৫৫

পারা ২০

আন-নামল ৫৬ - আল-‘আনকাবুত ৪৫

পারা ২১

আল-‘আনকাবুত ৪৬ - আল-আহযাব ৩০

পারা ২২

আল-আহযাব ৩১ - ইয়া-সীন ২৭

পারা ২৩

ইয়া-সীন ২৮ - আয-যুমার ৩১

পারা ২৪

আয-যুমার ৩২ - ফুসসিলাত ৪৬

পারা ২৫

ফুসসিলাত ৪৭ - আল-জাসিয়াহ ৩৭

পারা ২৬

আল-আহকাফ ১ - আয-যারিয়াত ৩০

পারা ২৭

আয-যারিয়াত ৩১ - আল-হাদীদ ২৯

পারা ২৮

আল-মুজাদালাহ ১ - আত-তাহরীম ১২

পারা ২৯

আল-মুলক ১ - আল-মুরসালাত ৫০

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

পারা ৩০

আন-নাবা ১ - আন-নাস ৬

৫৬৪ আয়াত

৫ ) তারপর তাকে উল্টো ফিরিয়ে নীচতমদেরও নীচে পৌঁছিয়ে দিয়েছি
ثُمَّ رَدَدْنَـٰهُ أَسْفَلَ سَـٰفِلِينَ ٥
৬ ) তাদেরকে ছাড়া যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করতে থাকে। কেননা তাদের রয়েছে এমন পুরস্কার যা কোনদিন শেষ হবে না।
إِلَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ فَلَهُمْ أَجْرٌ غَيْرُ مَمْنُونٍۢ ٦
৭ ) কাজেই (হে নবী!) এরপর পুরস্কার ও শাস্তির ব্যাপারে কে তোমাকে মিথ্যাবাদী বলতে পারে?
فَمَا يُكَذِّبُكَ بَعْدُ بِٱلدِّينِ ٧
৮ ) আল্লাহ কি সব শাসকের চাইতে বড় শাসক নন?
أَلَيْسَ ٱللَّهُ بِأَحْكَمِ ٱلْحَـٰكِمِينَ ٨
১ ) পড়ো (হে নবী) , তোমার রবের নামে। যিনি সৃষ্টি করেছেন।
ٱقْرَأْ بِٱسْمِ رَبِّكَ ٱلَّذِى خَلَقَ ١
২ ) জমাট বাঁধা রক্তের দলা থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।
خَلَقَ ٱلْإِنسَـٰنَ مِنْ عَلَقٍ ٢
৩ ) পড়ো এবং তোমার রব বড় মেহেরবান,
ٱقْرَأْ وَرَبُّكَ ٱلْأَكْرَمُ ٣
৪ ) যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান শিখিয়েছেন।
ٱلَّذِى عَلَّمَ بِٱلْقَلَمِ ٤
৫ ) মানুষকে এমন জ্ঞান দিয়েছেন, যা সে জানতো না।
عَلَّمَ ٱلْإِنسَـٰنَ مَا لَمْ يَعْلَمْ ٥
৬ ) কখনই নয়, মানুষ সীমালংঘন করে।
كَلَّآ إِنَّ ٱلْإِنسَـٰنَ لَيَطْغَىٰٓ ٦
৪.
মুফাস্সিরগণ সাধারণত এর দু’টি অর্থ বর্ণনা করেছেন। এক, আমি তাকে বার্ধক্যের এমন এক অবস্থার দিকে ফিরিয়ে দিয়েছি যেখানে সে কিছু চিন্তা করার, বুঝার ও কাজ করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। দুই, আমি তাকে জাহান্নামের সর্বনিম্ন পর্যায়ের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছি। কিন্তু বক্তব্যের যে উদ্দেশ্যটি প্রমাণ করার জন্য এই সূরাটি নাযিল করা হয়েছে এই দু’টি অর্থকে তার জন্য প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করানো যেতে পারে না। সূরাটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, আখেরাতে পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা যে যথার্থ সত্য তা প্রমাণ করা। এদিক দিয়ে মানুষদের মধ্যে থেকে অনেককে চরম দুর্বলতম অবস্থায় পৌঁছিয়ে দেয়া হয় এবং মানুষদের একটি দলকে জাহান্নামে ফেলে দেয়া হবে--- এ দু’টি কথার একটিও এই অর্থের সাথে খাপ খায় না। প্রথম কথাটি শাস্তি ও পুরস্কারের প্রমাণ হতে পারে না। কারণ ভালো ও খারাপ উভয় ধরনের লোক বার্ধক্যের শিকার হয়। কাউকে তার কাজের শাস্তি ভোগ করার জন্য এই অবস্থার শিকার হতে হয় না। অন্যদিকে দ্বিতীয় কথাটি আখেরাতে কার্যকর হবে একে কেমন করে এমন সব লোকের কাছে হিসেবে পেশ করা যেতে পারে যাদের থেকে আখেরাতে শাস্তি ও পুরস্কার লাভের ব্যবস্থার পক্ষে স্বীকৃতি আদায় করার জন্য এই সমস্ত যুক্তি প্রমাণ পেশ করা হচ্ছে? তাই আমার মতে আয়াতের সঠিক অর্থ হচ্ছে, সর্বোত্তম কাঠামোয় সৃষ্টি করার পর যখন মানুষ নিজের দৈহিক ও মানসিক শক্তিগুলোকে দুষ্কৃতির পথে ব্যবহার করে তখন আল্লাহ তাকে দুষ্কৃতিরই সুযোগ দান করেন এবং নিচের দিকে গড়িয়ে দিতে দিতে তাকে এমন নিম্নতম পর্যায়ে পৌঁছিয়ে দেন যে, অন্য কোন সৃষ্টি সেই পর্যায়ে নেমে যেতে পারে না। এটি একটি বাস্তব সত্য। মানুষের সমাজে সচরাচর এমনটি দেখা যায়। লোভ, লালসা, স্বার্থবাদিতা, কামান্ধতা, নেশাখোরী, নীচতা, ক্রোধ এবং এই ধরনের অন্যান্য বদ স্বভাব যেসব লোককে পেয়ে বসে তারা সত্যিই নৈতিক দিক দিয়ে নীচতমদেরও নীচে পৌঁছে যায়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ শুধুমাত্র একটি কথাই ধরা যাক। একটি জাতি যখন অন্য জাতির প্রতি শত্রুতা পোষণ করার ব্যাপারে অন্ধ হয়ে যায় তখন সে হিংস্রতার দুনিয়ায় হিংস্র পশুদেরকেও হার মানায়। একটি হিংস্র পশু কেবলমাত্র নিজের ক্ষুধার খাদ্য যোগাড় করার জন্য অন্য পশু শিকার করে। যে ব্যাপকভাবে পশুদের হত্যা করে চলে না। কিন্তু মানুষ নিজেই নিজের সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদেরকে ব্যাপকভাবে হত্যা করে চলছে। পশুরা কেবলমাত্র নিজেদের নখর ও দাঁত ব্যবহার করে শিকার করে। কিন্তু এই সর্বোত্তম কাঠামোয় সৃষ্ট মানুষ নিজের বুদ্ধির সাহায্যে বন্দুক, কামান, ট্যাংক, বিমান, আণবিক বোমা, উদজান বোমা এবং অন্যান্য অসংখ্য মারণান্ত্র তৈরী করেছে এবং সেগুলোর সাহায্যে মুহূর্তের মধ্যে সুবিশাল জনপদগুলো ধবংস করে দিচ্ছে। পশুরা কেবল আহত বা হত্যা করে। কিন্তু মানুষ নিজেদেরই মতো মানুষকে নির্যাতন করার জন্য এমন সব ভয়াবহ পদ্ধতি আবিস্কার করেছে যেগুলোর কথা পশুরা কোন দিন কল্পনাও করতে পারে না। তারপর নিজেদের শত্রুতা ও প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থ করার জন্য তারা নীচতার শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তারা মেয়েদের উলংগ করে তাদের মিছিল বের করে। এক একজন মেয়ের ওপর দশ বিশ জন ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করে। বাপ, ভাই ও স্বামীদের সামনে তাদের স্ত্রী ও মা-বোনদের শ্লীলতাহানি করে। মা-বাপের সামনে সন্তানদেরকে হত্যা করে। নিজের গর্ভজাত সন্তানদের রক্ত পান করার জন্য মাকে বাধ্য করে। মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে এবং জীবন্ত কবর দেয়। দুনিয়ায় পশুদের মধ্যেও এমন কোন হিংস্রতম গোষ্ঠী নেই যাদের বর্বরতাকে কোন পর্যায়ে মানুষদের এই বর্বরতার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। মানুষের অন্যান্য বড় বড় গুণের ব্যাপারেও এই একই কথা বলা যায়। এগুলোর মধ্য থেকে যেটির দিকে মানুষ মুখ ফিরিয়েছে সেটির ব্যাপারে নিজেকে নিকৃষ্টতম সৃষ্টি প্রমাণ করেছে। এমনকি ধর্ম যা মানুষের কাছে সবচেয়ে পবিত্র, তাকেও সে এমন সংকীর্ণ করে দিয়েছে, যার ফলে সে গাছপালা, জীব-জন্তু ও পাথরের পূজা করতে করতে অবনতির চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে নারী ও পুরুষের লিংগেরও পূজা করতে শুরু করেছে। দেবতাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য ধর্ম মন্দিরে দেবদাসী রাখছে। তাদের সাথে ব্যভিচার করাকে পুণ্যের কাজ মনে করছে। যাদেরকে তারা দেবতা ও উপাস্য গণ্য করেছে তাদের সাথে সম্পর্কিত দেবকাহিনীতে এমন সব কুৎসিত কাহিনী জুড়ে দিয়েছে যা জঘন্য ও নিকৃষ্টতম মানুষের জন্যও লজ্জার ব্যাপার।
৫.
যেসব মুফাস্সির “আসফালা সা-ফেলীন ( اَسْفَلَ سافِلِيْنَ ) ---এর অর্থ করেছেন, বার্ধক্যের এমন একটি অবস্থা যখন মানুষ নিজের চেতনা ও স্বাভাবিক জ্ঞান বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে, তারা এই আয়াতের অর্থ এভাবে বর্ণনা করেছেন, “কিন্তু যারা নিজেদের যৌবনকালে ও সুস্থাবস্থায় ঈমান এনে সৎকাজ করে তাদের জন্য বার্ধক্যের এই অবস্থায়ও সেই নেকী লেখা হবে এবং সেই অনুযায়ী তারা প্রতিদানও পাবে। বয়সের এই পর্যায়েও তারা ঐ ধরনের সৎকাজগুলো করেনি বলে তাদের ভালো প্রতিদান দেবার ক্ষেত্রে কিছুই কম করা হবে না।” আর যেসব মুফাস্সির “আসফালা সাফেলীনের” দিকে উল্টো ফিরিয়ে দিবার অর্থ ‘জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে নিক্ষেপ করা’ করেছেন তাদের মতে এই আয়াতের অর্থ হচ্ছেঃ “ঈমান এনে যারা সৎকাজ করে তারা এর বাহিরে তাদেরকে এই পর্যায়ে উল্টো ফেরানো হবে না। বরং তারা এমন পুরস্কার পাবে যার ধারাবাহিকতা কোনদিন খতম হবে না।” কিন্তু এই সূরায় শাস্তি ও পুরস্কারের সত্যতার পক্ষে যে যুক্তি-প্রমাণ পেশ করা হয়েছে তার সাথে এই উভয় অর্থের কোন মিল নেই। আমার মতে এই আয়াতের সঠিক অর্থ হচ্ছে, মানুষের সমাজে যেমন সাধারণভাবে দেখা যায়, যেসব লোকের নৈতিক অধপতন শুরু হয় তারা অধপাতে যেতে যেতে একেবারে নীচতমদের নীচে চলে যায়, ঠিক তেমনি প্রতি যুগে সাধারণভাবে দেখা যায়, যারা আল্লাহ, রসূল ও আখেরাতের প্রতি ঈমান আনে এবং সৎকাজের কাঠামোয় নিজেদের জীবনকে ঢেলে সাজিয়ে নেয় তারা এই পতনের হাত থেকে বেঁচে গেছে এবং আল্লাহ মানুষকে যে সর্বোত্তম কাঠামোয় সৃষ্টি করেছিলেন তার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। তাই তারা অশেষ শুভ প্রতিদানের অধিকারী। অর্থাৎ তারা এমন পুরস্কার পাবে, যা তাদের যথার্থ পাওনা থেকে কম হবে না এবং যার ধারাবাহিকতা কোনদিন শেষও হবে না।
৬.
এই আয়াতটির আর একটি অনুবাদ এও হতে পারেঃ “কাজেই (হে মানুষ) এরপর কোন্ জিনিসটি তোমাকে শাস্তি ও পুরস্কারের বিষয়টি মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে উদ্বুদ্ধ করে? উভয় অর্থের ক্ষেত্রে লক্ষ্য ও মূল বক্তব্য একই থাকে। অর্থাৎ মানুষের সামাজে প্রকাশ্যে দেখা যায় সর্বোত্তম কাঠামোয় সৃষ্ট মানুষের একটি দল নৈতিক অধপাতে যেতে যেতে একেবারে নীচতমদেরও নীচে পৌঁছে যায় আবার অন্য একটি দল সৎকাজের পথ অবলম্বন করে এই পতনের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করে এবং মানুষকে সর্বোত্তম কাঠামোয় সৃষ্টি করার যে উদ্দেশ্য ছিল তার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। এ অবস্থায় পুরস্কার ও শাস্তিকে কেমন করে মিথ্যা বলা যেতে পারে? বুদ্ধি কি একথা বলে, উভয় ধরনের মানুষের একই পরিণাম হবে? ইনসাফ কি একথাই বলে, অধপাতে যেতে যেতে নীচতমদেরও নীচে যারা পৌঁছে যায় তাদেরকে কোন শাস্তিও দেয়া যাবে না এবং এই অধপতন থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করে যারা পবিত্র জীবন যাপন করে তাদেরকে কোন পুরস্কারও দেয়া যাবে না? এই কথাটিকেই কুরআনের অন্যান্য স্থানে এভাবে বলা হয়েছেঃ

اَفَنَجۡعَلُ الۡمُسۡلِمِيۡنَ كَالۡمُجۡرِمِيۡنَ مَا لَكُمۡ كَيۡفَ تَحۡكُمُوۡنَ‌ۚ

“আমি কি অনুগতদেরকে অপরাধীদের মতো করে দেবো? তোমাদের কি হয়ে গেছে? তোমরা কেমন ফায়সালা করছো? ( আল কলম ৩৫-৩৬ আয়াত)।

اَمۡ حَسِبَ الَّذِيۡنَ اجۡتَرَحُوۡا السَّيِّاٰتِ اَنۡ نَّجۡعَلَهُمۡ كَالَّذِيۡنَ اٰمَنُوۡا وَعَمِلُوۡا الصّٰلِحٰتِ ۙ سَوَآءً مَّحۡيَاهُمۡ وَمَمَاتُهُمۡ‌ؕ سَآءَ مَا يَحۡكُمُوۡنَ

“দুষ্কৃতকারীরা কি একথা মনে করেছে, আমি তাদেরকে এমন লোকদের মতো করে দেবো যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে? উভয়ের জীবন ও মৃত্যু এক রকম হবে? খুবই খারাপ সিদ্ধান্ত যা এরা করছে।” (আল জাসিয়া ২১ আয়াত )

৭.
অর্থাৎ যখন দুনিয়ার ছোট ছোট শাসকদের থেকেও তোমরা চাও এবং আশা করে থাকো যে, তারা ইনসাফ করবে, অপরাধীদেরকে শাস্তি দেবে এবং ভালো কাজ যারা করবে তাদেরকে পুরস্কৃত করবে তখন আল্লাহর ব্যাপারে তোমরা কি মনে করো? তিনি কি সব শাসকের বড় শাসক নন? যদি তোমরা তাঁকে সবচেয়ে বড় শাসক বলে স্বীকার করে থাকো তাহলে কি তাঁর সম্পর্কে তোমরা ধারণা করো যে, তিনি ইনসাফ করবেন না? তাঁর সম্পর্কে কি তোমরা এই ধারণা পোষণ করো যে, তিনি মন্দ ও ভালোকে একই পর্যায়ে ফেলবেন? তোমরা কি মনে করো তাঁর দুনিয়ায় যারা সবচেয়ে খারাপ কাজ করবে আর যারা সবচেয়ে ভালো কাজ করবে তারা সবাই মরে মাটির সাথে মিশে যাবে। কাউকে তার খারাপ কাজের শাস্তি দেয়া হবে না এবং কাউকে তার ভালো কাজের পুরস্কারও দেয়া হবে না?

ইমাম আহমাদ, তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনুল মুনযির, বায়হাকী, হাকেম ও ইবনে মারদুইয়া হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের কেউ যখন “ওয়াত তীনে ওয়ায্যায়তূনে” সূরা পড়তে পড়তে (اَلَيۡسَ اللّٰهُ بِاَحۡكَمِ الۡحٰكِمِيۡنَ ) আয়াতটিতে পৌঁছে তখন যেন সে বলে। (وَاَنًا عاى اج ذالِكَ مِنَ اشَّا هِدِيْنَ ا ) (হ্যাঁ, এবং আমি তার ওপর সাক্ষদানকারীদের একজন)। আবার কোন কোন হাদীসে বলা হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এই আয়াতটি পড়তেন, তিনি বলতেন, (سُبْحانَكَ فَبَآى) (হে আল্লাহ তুমি পবিত্র! আর তুমি এই যা বলছো তা সত্য।)

১.
ইতিপূর্বে ভূমিকায় বলে এসেছি, ফেরেশতা রসূলুল্লাহ ﷺ কে বললেন, পড়ো। তিনি জবাবে দিলেন, আমি পড়া জানি না। এ থেকে জানা যায়, ফেরেশতা অহীর এই শব্দগুলো লিখিত আকারে তাঁর সামনে পেশ করেছিলেন এবং তাঁকে সেগুলো পড়তে বলেছিলেন। কারণ ফেরেশতার কথার অর্থ যদি এই হতো, আমি বলতে থাকি এবং আপনি পড়তে থাকুন তাহলে আমি পড়া জানি না একথা বলা তাঁর প্রয়োজন হতো না।
২.
অর্থাৎ তোমার রবের নাম নিয়ে পড়ো। অন্য কথায়, বিসমিল্লাহ বলো এবং পড়ো। এ থেকে একথাও জানা যায় যে, রসূলুল্লাহ ﷺ এই অহী আসার আগে একমাত্র আল্লাহকেই জানতেন ও মানতেন। এ জন্যই তাঁর রবকে, একথা বলার প্রয়োজন হয়নি বরং বলতে হয়েছে, তোমার রবের নাম নিয়ে পড়ো।
৩.
শুধু বলা হয়েছে, “সৃষ্টি করেছেন।” কাকে সৃষ্টি করেছেন তা বলা হয়নি। এ থেকে আপনা আপনিই এ অর্থ বের হয়ে আসে, সেই রবের নাম নিয়ে পড়ো যিনি স্রষ্টা, যিনি সমগ্র বিশ্ব-জাহান এবং বিশ্ব-জাহানের প্রতিটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন।
৪.
সাধারণ ভাবে বিশ্ব-জাহানের সৃষ্টি কথা বলার পর বিশেষ করে মানুষের কথা বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ‌ কেমন হীন অবস্থা থেকে তার সৃষ্টিপর্ব শুরু করে তাকে পূর্ণাংগ মানুষে রূপান্তরিত করেছেন। আলাক عَلَقٍ‌ۚ‏ হচ্ছে আলাকাহ (عَلَقَه ) শব্দের বহুবচন। এর মানে জমাট বাঁধা রক্ত। গর্ভ সঞ্চারের পর প্রথম কয়েক দিনের মধ্যে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় এটি হচ্ছে সেই প্রাথমিক অবস্থা। তারপর তা গোশতের আকৃতি ধারণ করে। এরপর পর্যায়ক্রমে মানুষের আকৃতি লাভের কার্যক্রম শুরু হয়। (বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল হজ্জ ৫ আয়াত, ৫ থেকে ৭ টীকা)
.
৫.
অর্থাৎ তাঁর অশেষ মেহেরবানী। এই হীণতম অবস্থা থেকে শুরু করে তিনি মানুষকে জ্ঞানের অধিকারী করেছেন এটি সৃষ্টির সবচেয়ে বড় গুণ হিসেবে স্বীকৃত। আর তিনি মানুষকে কেবল জ্ঞানের অধিকারীই করেননি, কলম ব্যবহার করে তাকে লেখার কৌশল শিখিয়েছেন। এর ফলে কলম জ্ঞানের ব্যাপক প্রসার, উন্নতি এবং বংশানুক্রমিক প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। যদি তিনি ইলহামী চেতনায় সাহায্যে মানুষকে কলম ব্যবহার করার ও লেখার কৌশল না শেখাতেন তাহলে মানুষের জ্ঞানগত যোগ্যতা স্তব্ধ ও পংগু হয়ে যেতো। তার বিকশিত ও সম্প্রসারিত হবার এবং বংশানুক্রমিক অগ্রগতি তথা এক বংশের জ্ঞান আর এক বংশে পৌঁছে যাবার এবং সামনের দিকে আরো উন্নতি ও অগ্রগতি লাভ করার সুযোগই তিরোহিত হতো।
৬.
অর্থাৎ মানুষ আসলে ছিল সম্পূর্ণ জ্ঞানহীন। আল্লাহর কাছ থেকে সে যা কিছু জ্ঞান লাভ করেছে। আল্লাহ‌ যে পর্যায়ে মানুষের জন্য জ্ঞানের দরজা যতটুকু খুলতে চেয়েছেন ততটুকুই তার জন্য খুলে গিয়েছে। আয়াতুল কুরসীতে একথাটি এভাবে বলা হয়েছেঃ وَلَا يُحِيۡطُوۡنَ بِشَىۡءٍ مِّنۡ عِلۡمِهٖۤ اِلَّا بِمَا شَآءَ‌‌ۚ“আর লোকেরা তাঁর জ্ঞান থেকে তিনি যতটুকু চান তার বেশী কিছুই আয়ত্ব করতে পারে না।” (আল বাকারাহ ২৫৫) যেসব জিনিসকে মানুষ নিজের তাত্বিক আবিষ্কার বলে মনে করে সেগুলো আসলে প্রথমে তার জ্ঞানের আওতায় ছিল না। আল্লাহ‌ যখন চেয়েছেন তখনই তার জ্ঞান তাকে দিয়েছেন। মানুষ কোনক্রমেই অনুভব করতে পারেনি যে, আল্লাহ‌ তাকে এ জ্ঞান দান করছেন।

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর সর্বপ্রথম যে আয়াতগুলো নাযিল হয়েছিল সেগুলোর আলোচনা এখান পর্যন্ত শেষ। যেমন হযরত আয়েশার (রা.) হাদীস থেকে জানা যায়ঃ এই প্রথম অভিজ্ঞতাটি খুব বেশী কঠিন ছিল। রসূলুল্লাহ ﷺ এর চাইতে বেশী বরদাশত করতে পারতেন না। তাই তখন কেবল এতটুকু বলাই যথেষ্ট মনে করা হয়েছে যে, তিনি যে রবকে প্রথম থেকে জানেন ও মানেন তিনি সরাসরি তাঁকে সম্বোধন করছেন। তাঁর পক্ষ থেকে অহীর সিলসিলা শুরু হয়ে গেছে এবং তাঁকে তিনি নিজের নবী বানিয়ে নিয়েছেন। এর বেশ কিছুকাল পরে সূরা আল মুদদাসসিরের প্রথম দিকের আয়াতগুলো নাযিল হয়। সেখানে তাঁকে বলা হয়েছে, নবুওয়াত লাভ করার পর এখন কি কি কাজ করতে হবে। (আরো ব্যাখ্যার জন্য পড়ুন তাফহীমুল কুরআন আল মুদদাসসিরের ভূমিকা)।

৭.
অর্থাৎ যে মেহেরবান আল্লাহ‌ এত বড় মেহেরবানী করেছেন তাঁর মোকাবেলায় মূর্খতার বশবর্তী হয়ে কখনো এমন কর্মনীতি অবলম্বন করা উচিত নয় যা সামনের দিকে বর্ণনা করা হচ্ছে।
.
অনুবাদ: