আল বাকারাহ

২৮৬ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
২৬১ ) যারা ২৯৮ নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে ২৯৯ তাদের ব্যয়ের দৃষ্টান্ত হচ্ছেঃ যেমন একটি শস্যবীজ বপন করা হয় এবং তা থেকে সাতটি শীষ উৎপন্ন হয়, যার প্রত্যেকটি শীষে থাকে একশতটি করে শস্যকণা। এভাবে আল্লাহ‌ যাকে চান, তার কাজে প্রাচুর্য দান করেন। তিনি মুক্তহস্ত ও সর্বজ্ঞ। ৩০০
مَّثَلُ ٱلَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمْوَٰلَهُمْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنۢبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِى كُلِّ سُنۢبُلَةٍ مِّا۟ئَةُ حَبَّةٍ وَٱللَّهُ يُضَٰعِفُ لِمَن يَشَآءُ وَٱللَّهُ وَٰسِعٌ عَلِيمٌ ٢٦١
২৬২ ) যারা নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহ‌র পথে ব্যয় করে এবং ব্যয় করার পর নিজেদের অনুগ্রহের কথা বলে বেড়ায় না আর কাউকে কষ্টও দেয় না, তাদের প্রতিদান রয়েছে তাদের রবের কাছে এবং তাদের কোন দুঃখ, মর্মবেদনা ও ভয় নেই। ৩০১
ٱلَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمْوَٰلَهُمْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ ثُمَّ لَا يُتْبِعُونَ مَآ أَنفَقُوا۟ مَنًّا وَلَآ أَذًى لَّهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ ٢٦٢
২৬৩ ) একটি মিষ্টি কথা এবং কোন অপ্রীতিকর ব্যাপারে সামান্য উদারতা ও ক্ষমা প্রদর্শন এমনি দানের চেয়ে ভালো, যার পেছনে আসে দুঃখ ও মর্মজ্বালা। মূলত আল্লাহ‌ করো মুখাপেক্ষী নন, সহনশীলতাই তাঁর গুণ। ৩০২
قَوْلٌ مَّعْرُوفٌ وَمَغْفِرَةٌ خَيْرٌ مِّن صَدَقَةٍ يَتْبَعُهَآ أَذًى وَٱللَّهُ غَنِىٌّ حَلِيمٌ ٢٦٣
২৬৪ ) হে ঈমানদারগণ!তোমরা অনুগ্রহের কথা বলে বেড়িয়ে ও কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান খয়রাতকে সেই ব্যক্তির মতো নষ্ট করে দিয়ো না যে নিছক লোক দেখাবার জন্য নিজের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, অথচ সে আল্লাহর ওপর ঈমান রাখে না এবং পরকালেও বিশ্বাস করে না। ৩০৩ তার ব্যয়ের দৃষ্টান্ত হচ্ছেঃ একটি মসৃণ পাথরখন্ডের ওপর মাটির আস্তর জমেছিল। প্রবল বর্ষণের ফলে সমস্ত মাটি ধুয়ে গেলো। এখন সেখানে রয়ে গেলো শুধু পরিষ্কার পাথর খন্ডটি। ৩০৪ এই ধরনের লোকেরা দান – খয়রাত করে যে নেকী অর্জন করে বলে মনে করে তার কিছুই তাদের হাতে আসে না। আর কাফেরদের সোজা পথ দেখানো আল্লাহর নিয়ম নয়। ৩০৫
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تُبْطِلُوا۟ صَدَقَٰتِكُم بِٱلْمَنِّ وَٱلْأَذَىٰ كَٱلَّذِى يُنفِقُ مَالَهُۥ رِئَآءَ ٱلنَّاسِ وَلَا يُؤْمِنُ بِٱللَّهِ وَٱلْيَوْمِ ٱلْءَاخِرِ فَمَثَلُهُۥ كَمَثَلِ صَفْوَانٍ عَلَيْهِ تُرَابٌ فَأَصَابَهُۥ وَابِلٌ فَتَرَكَهُۥ صَلْدًا لَّا يَقْدِرُونَ عَلَىٰ شَىْءٍ مِّمَّا كَسَبُوا۟ وَٱللَّهُ لَا يَهْدِى ٱلْقَوْمَ ٱلْكَٰفِرِينَ ٢٦٤
২৬৫ ) বিপরীত পক্ষে যারা পূর্ণ মানসিক একাগ্রতা ও অবিচলতা সহকারে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষে তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তাদের এই ব্যয়ের দৃষ্টান্ত হচ্ছেঃ কোন উচ্চ ভূমিতে একটি বাগান, প্রবল বৃষ্টিপাত হলে সেখানে দ্বিগুণ ফলন হয়। আর প্রবল বৃষ্টিপাত না হলে সামান্য হালকা বৃষ্টিপাতই তার জন্য যথেষ্ট। ৩০৬ আর তোমরা যা কিছু করো সবই আল্লাহর দৃষ্টি সীমার মধ্যে রয়েছে।
وَمَثَلُ ٱلَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمْوَٰلَهُمُ ٱبْتِغَآءَ مَرْضَاتِ ٱللَّهِ وَتَثْبِيتًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ كَمَثَلِ جَنَّةٍۭ بِرَبْوَةٍ أَصَابَهَا وَابِلٌ فَـَٔاتَتْ أُكُلَهَا ضِعْفَيْنِ فَإِن لَّمْ يُصِبْهَا وَابِلٌ فَطَلٌّ وَٱللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ ٢٦٥
২৬৬ ) তোমাদের কেউ কি পছন্দ করে, তার একটি সবুজ শ্যামল বাগান থাকবে, সেখানে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হবে, খেজুর, আঙ্গুর ও সব রকম ফলে পরিপূর্ণ থাকবে এবং বাগানটি ঠিক এমন এক সময় প্রবল উষ্ণ বায়ু প্রবাহে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে সে নিজে বৃদ্ধ হয়ে গেছে এবং তার সন্তানরাও তখনো যোগ্য হয়ে উঠেনি? ৩০৭ এভাবেই আল্লাহ‌ তাঁর কথা তোমাদের সামনে বর্ণনা করেন, যেন তোমরা চিন্তা-ভাবনা করতে পারো।
أَيَوَدُّ أَحَدُكُمْ أَن تَكُونَ لَهُۥ جَنَّةٌ مِّن نَّخِيلٍ وَأَعْنَابٍ تَجْرِى مِن تَحْتِهَا ٱلْأَنْهَٰرُ لَهُۥ فِيهَا مِن كُلِّ ٱلثَّمَرَٰتِ وَأَصَابَهُ ٱلْكِبَرُ وَلَهُۥ ذُرِّيَّةٌ ضُعَفَآءُ فَأَصَابَهَآ إِعْصَارٌ فِيهِ نَارٌ فَٱحْتَرَقَتْ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ ٱللَّهُ لَكُمُ ٱلْءَايَٰتِ لَعَلَّكُمْ تَتَفَكَّرُونَ ٢٦٦
২৬৭ ) হে ঈমানদারগণ! যে অর্থ তোমরা উপার্জন করেছো এবং যা কিছু আমি জমি থেকে তোমাদের জন্য বের করে দিয়েছি, তা থেকে উৎকৃষ্ট অংশ আল্লাহ‌র পথে ব্যয় করো। তাঁর পথে ব্যয় করার জন্য তোমরা যেন সবচেয়ে খারাপ জিনিস বাছাই করার চেষ্টা করো না। কারণ ঐ জিনিসই যদি কেউ তোমাদের দেয়, তাহলে তোমরা কখনো তা নিতে রাজি হও না, যদি না তা নেবার ব্যাপারে তোমরা চোখ বন্ধ করে থাকো। তোমাদের জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ‌ কারো মুখাপেক্ষী নন এবং তিনি সর্বোত্তম গুণে গুণান্বিত। ৩০৮
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ أَنفِقُوا۟ مِن طَيِّبَٰتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّآ أَخْرَجْنَا لَكُم مِّنَ ٱلْأَرْضِ وَلَا تَيَمَّمُوا۟ ٱلْخَبِيثَ مِنْهُ تُنفِقُونَ وَلَسْتُم بِـَٔاخِذِيهِ إِلَّآ أَن تُغْمِضُوا۟ فِيهِ وَٱعْلَمُوٓا۟ أَنَّ ٱللَّهَ غَنِىٌّ حَمِيدٌ ٢٦٧
২৬৮ ) শয়তান তোমাদের দারিদ্রের ভয় দেখায় এবং লজ্জাকর কর্মনীতি অবলম্বন করতে প্রলুব্ধ করে কিন্তু আল্লাহ‌ তোমাদেরকে তাঁর ক্ষমা ও অনুগ্রহের আশ্বাস দেন। আল্লাহ‌ বড়ই উদারহস্ত ও মহাজ্ঞানী।
ٱلشَّيْطَٰنُ يَعِدُكُمُ ٱلْفَقْرَ وَيَأْمُرُكُم بِٱلْفَحْشَآءِ وَٱللَّهُ يَعِدُكُم مَّغْفِرَةً مِّنْهُ وَفَضْلًا وَٱللَّهُ وَٰسِعٌ عَلِيمٌ ٢٦٨
২৬৯ ) তিনি যাকে চান, হিকমত দান করেন। আর যে ব্যক্তি হিকমত লাভ করে সে আসলে বিরাট সম্পদ লাভ করেছে। ৩০৯ এই কথা থেকে কেবলমাত্র তারাই শিক্ষা লাভ করে যারা বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী।
يُؤْتِى ٱلْحِكْمَةَ مَن يَشَآءُ وَمَن يُؤْتَ ٱلْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِىَ خَيْرًا كَثِيرًا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّآ أُو۟لُوا۟ ٱلْأَلْبَٰبِ ٢٦٩
২৭০ ) তোমরা যা কিছু ব্যয় করেছো এবং যা মানতও করেছো আল্লাহ‌ তা সবই জানেন। আর জালেমদের কোন সাহায্যকারী নেই। ৩১০
وَمَآ أَنفَقْتُم مِّن نَّفَقَةٍ أَوْ نَذَرْتُم مِّن نَّذْرٍ فَإِنَّ ٱللَّهَ يَعْلَمُهُۥ وَمَا لِلظَّٰلِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ ٢٧٠
২৯৮.
ইতিপূর্বে ৩২ রুকূ’তে যে বিষয়বস্তুর ওপর আলোচনা চলেছিল এখানে আবার সেই একই প্রসঙ্গে ফিরে আসা হয়েছে। সেখানে সূচনা পূর্বেই ঈমানদারদের প্রতি আহবান জানানো হয়েছিল, যে মহান উদ্দেশ্যের প্রতি তোমরা ঈমান এনেছ, তার জন্য ধন-প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত কোন দলের অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোন সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে নিজের দলগত বা জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে নিছক একটি উন্নত পর্যায়ের নৈতিক উদ্দেশ্য সম্পাদনে অকাতরে অর্থ ব্যয় করতে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে না। বৈষয়িক ও ভোগবাদী লোকেরা, যারা কেবলমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্য জীবন ধারণ করে, এক একটি পয়সার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত হয়ে যায় এবং লাভ-লোকসানের খতিয়ানের প্রতি সবসময় শ্যেন দৃষ্টি রেখে চলে, তারা কখনো মহান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের জন্য কিছু করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না। আপাত দৃষ্টিতে মহৎ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের জন্য তারা কিছু অর্থ ব্যয় করে ঠিকই কিন্তু এক্ষেত্রেও তারা নিজেদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, বংশীয় বা জাতীয় বৈষয়িক লাভের হিসেব-নিকেশটা আগেই সেরে নেয়। এই মানসিকতা নিয়ে এমন একটি দ্বীনের পথে মানুষ এক পাও অগ্রসর হতে পারবে না, যার দাবী হচ্ছে, পার্থিব লাভ-ক্ষতির পরোয়া না করে নিছক আল্লাহর কালেমাকে বুলন্দ করার উদ্দেশ্যে নিজের সময়, শক্তি ও অর্থ ব্যয় করতে হবে। এই ধরনের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ভিন্নতর নৈতিক বৃত্তির প্রয়োজন। এ জন্য প্রসারিত দৃষ্টি, বিপুল মনোবল ও উদার মানিসকতা বিশেষ করে আল্লাহর নির্ভেজাল সন্তুষ্টি অর্জনের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশী। আর এই সঙ্গে সমাজ জীবনে এমন ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন, যার ফলে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ভোগবাদী ও বস্তুবাদী নৈতিকতার পরিবর্তে উপরোল্লিখিত নৈতিক গুণাবলীর বিকাশ সাধিত হবে। তাই এখান থেকে নিয়ে পরবর্তী তিন রুকূ’ পর্যন্ত এই মানসিকতা সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় বিধান দেয়া হয়েছে।
২৯৯.
ধন-সম্পদ যদি নিজের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য ব্যয় করা হয় অথবা পরিবার-পরিজন ও সন্তান সন্ততির ভরণ-পোষনের বা আত্মীয়-স্বজনের দেখাশুনা করার জন্য অথবা অভাবীদের সাহায্যার্থে বা জনকল্যাণমূলক কাজে এবং জিহাদের উদ্দেশ্যে, যে কোনভাবেই ব্যয় করা হোক না কেন, তা যদি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ব্যয় করা হয় তাহলে তা আল্লাহর পথে ব্যয় করার মধ্যে গণ্য হবে।
৩০০.
অর্থাৎ যে পরিমাণ আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও গভীর আবেগ-উদ্দীপনা সহকারে মানুষ আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করবে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার প্রতিদানও তত বেশী ধার্য হবে। যে আল্লাহ‌ একটি শস্যকণায় এত বিপুল পরিমাণ বরকত দান করেন যে, তা থেকে সাতশোটি শস্যকণা উৎপন্ন হতে পারে, তাঁর পক্ষে মানুষের দান-খয়রাতের মধ্যে এমনভাবে বৃদ্ধি ও ক্রমবৃদ্ধি দান করা যার ফলে এক টাকা ব্যয় করলে তা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে প্রতিদানে সাতশো গুণ হয়ে ফিরে আসবে, মোটেই কোন অভাবনীয় ও কঠিন ব্যাপার নয়। এই বাস্তব সত্যটি বর্ণনা করার পর আল্লাহর দু’টি গুণাবলীর উল্লেখ করা হয়েছে। একটি গুণ হচ্ছে, তিনি মুক্তহস্ত। তাঁর হাত সংকীর্ণ নয়। মানুষের কাজ প্রকৃতপক্ষে যতটুকু উন্নতি, বৃদ্ধি ও প্রতিদান লাভের যোগ্য, তা তিনি দিতে অক্ষম, এমনটি হতে পারে না। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তিনি সর্বজ্ঞ। অর্থাৎ তিনি কোন বিষয়ে বেখবর নন। যা কিছু মানুষ ব্যয় করে এবং যে মনোভাব, আবেগ ও প্রেরণা সহকারে ব্যয় করে, সে সম্পর্কে তিনি অনবহিত থাকবেন, ফলে মানুষ যথার্থ প্রতিদান লাভে বঞ্চিত হবে, এমনটিও হতে পারে না।
৩০১.
অর্থাৎ যাদের প্রতিদান নষ্ট হবার কোন ভয় নেই এবং তারা নিজেদের এই অর্থ ব্যয়ের কারণে লজ্জিত হবে, এমন ধরনের কোন অবস্থারও সৃষ্টি হবে না।
৩০২.
এই একটি বাক্যের মধ্যে দু’টি কথা বলা হয়েছে। এক, আল্লাহ‌ তোমাদের দান-খয়রাতের মুখাপেক্ষী নন। দুই, আল্লাহ‌ নিজেই যেহেতু সহনশীল, তাই তিনি এমন লোকেদের পছন্দ করেন যারা নীচ ও সংকীর্ণমনা নন বরং বিপুল সাহস ও হিম্মতের অধিকারী এবং সহিষ্ণু। যে আল্লাহ‌ তোমাদের দান করেছেন জীবনের অগণিত উপায়-উপকরণ এবং বহুবিধ ভুল-ত্রুটি করার পরও তোমাদের বারবার মাফ করে দিচ্ছেন, তিনি কেমন করে এমন লোকদের পছন্দ করতে পারেন, যারা কোন গরীবকে এক মুঠো ভাত খাওয়াবার পর বারবার নিজের অনুগ্রহের কথা সাড়ম্বরে তার সামনে প্রকাশ করে তার আত্মমর্যাদাকে ধুলায় লুটিয়ে দেয়? এ জন্যই হাদীসে বলা হয়েছে, মহান আল্লাহ‌ কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তির সাথে কথা বলবেন না এবং তার প্রতি অনুগ্রহের দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন না, যে মানুষকে কিছু দান করে তাকে অনুগৃহীত করা হয়েছে বলে তার কাছে প্রকাশ করে এবং একথা উল্লেখ করে মনে খোঁচা দেয়।
৩০৩.
আল্লাহ‌ ও আখেরাতের প্রতি তার যে বিশ্বাস নেই, তার রিয়াকারিতাই এর প্রমাণ। নিছক লোক দেখাবার জন্য সে যেসব কাজ করে সেগুলো সুস্পষ্টভাবে একথাই প্রকাশ করে যে, সৃষ্টিকেই সে আল্লাহ‌ মনে করে এবং তার কাছ থেকেই নিজের কাজের প্রতিদান চায়। আল্লাহর কাছ থেকে সে প্রতিদানের আশা করে না। একদিন সমস্ত কাজের হিসেব-নিকেশ করা হবে এবং প্রতিদান দেয়া হবে, একথাও সে বিশ্বাস করে না।
৩০৪.
এই উপমায় প্রবল বর্ষণ বলতে দান খয়রাতকে এবং পাথরখণ্ড বলতে যে নিয়ত ও প্রেরণার গলদসহ দান খয়রাত করা হয়েছে, তাকে বুঝানো হয়েছে। মাটির আস্তর বলতে নেকী ও সৎকর্মের বাইরের কাঠামোটি বুঝানো হয়েছে, যার নীচে লুকিয়ে আছে নিয়তের গলদ। এই বিশ্লেষণের পর দৃষ্টান্তটি সহজেই বোধগম্য হতে পারে। বৃষ্টিপাতের ফলে মাটি স্বাভাবিকভাবেই সরস ও সতেজ হয় এবং তাতে চারা জন্মায়। কিন্তু যে মাটিতেই সরসতা সৃষ্টি হয় তার পরিমাণ যদি হয় নামমাত্র এবং তা কেবল ওপরিভাগেই লেপটে থাকে আর তার তলায় থাকে মসৃণ পাথর, তাহলে বৃষ্টির পানি এক্ষেত্রে তার জন লাভজনক হবার পরিবর্তে বরং ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়। অনুরূপভাবে দান-খয়রাত যদিও নেকী ও সৎকর্মকে বিকশিত করার ক্ষমতাসম্পন্ন কিন্তু তা লাভজনক হবার জন্য সদুদ্দেশ্য, সৎসংকল্প ও সৎনিয়তের শর্ত আরোপিত হয়েছে। নিয়ত সৎ না হলে করুণার বারিধারা নিছক অর্থ ও সম্পদের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।
৩০৫ .
এখানে ‘কাফের’ শব্দটি অকৃতজ্ঞ ও অনুগ্রহ অস্বীকারকারী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যে ব্যক্তি আল্লাহর দেয়া নেয়ামতকে তাঁর পথে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ব্যয় করার পরিবর্তে মানুষের সন্তুষ্টি লাভের জন্য ব্যয় করে অথবা আল্লাহর পথে কিছু অর্থ ব্যয় করলে ব্যয় করার সাথে কষ্টও দিয়ে থাকে, সে আসলে অকৃতজ্ঞ এবং আল্লাহর অনুগ্রহ বিস্মৃত বান্দা। আর সে নিজেই যখন আল্লাহর সন্তুষ্টি চায় না তখন তাকে অযথা নিজের সন্তুষ্টির পথ দেখাবার আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।
৩০৬.
প্রবল বৃষ্টিপাত বলতে এমন দান-খয়রাতকে বুঝানো হয়েছে যার পেছনে থাকে চরম কল্যাণাকাংখা ও পূর্ণ সদিচ্ছা। আর হাল্‌কা বৃষ্টিপাত বলতে কল্যাণ আকাংখার তীব্রতাবিহীন দান-খয়রাতকে বুঝানো হয়েছে।
৩০৭.
অর্থাৎ তোমাদের সারা জীবনের উপার্জনের এমন এক সংকটকালে ধ্বংস হয়ে যাওয়া তোমরা পছন্দ করো না যখন তা থেকে লাভবান হবার তোমাদের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন হয় এবং নতুন করে অর্থোপার্জনের সুযোগই তোমাদের থাকে না। ঠিক তেমনি দুনিয়ায় জীবনভর কাজ করার পর আখেরাতের জীবনে প্রবেশ করে তোমরা অকস্মাৎ যদি জানতে পারো তোমাদের দুনিয়ার জীবনের সমস্ত কর্মকাণ্ড এখানে মূল্যহীন হয়ে গেছে, যা কিছু তোমরা দুনিয়ায় উপার্জন করেছিলে তা দুনিয়ায় রয়ে গেছে, আখেরাতের জন্য তোমরা এমন কিছু উপার্জন করে আনতে পরোনি যার ফল এখানে ভোগ করতে পারো, তাহলে তা তোমরা কেমন করে পছন্দ করতে পারবে? সেখানে তোমরা নতুন করে আখেরাতের জন্য উপার্জন করার সুযোগ পাবে না। এই দুনিয়াতেই আখেরাতের জন্য কাজ করার সবটুকু সুযোগ রয়েছে। এখানে যদি তোমরা আখেরাতের চিন্তা না করে সারা জীবন দুনিয়ার ধ্যানে মগ্ন থাকো এবং বৈষয়িক স্বার্থ লাভের পেছনে নিজের সমস্ত শক্তি ও প্রচেষ্টা নিয়োজিত করো, তাহলে জীবনসূর্য অস্তমিত হবার পর তোমাদের অবস্থা হবে ঠিক সেই বৃদ্ধের মতো করুণ, যার সারা জীবনের উপার্জন এবং জীবনের সহায় সম্বল ছিল একটি মাত্র বাগান। বৃদ্ধ বয়সে তার এই বাগানটি ঠিক এমন এক সময় পুড়ে ছাই হয়ে গেলো যখন তার নতুন করে বাগান তৈরি করার সামর্থ্য ছিল না এবং তার সন্তানদের একজনও তাকে সাহায্য করার যোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি।
৩০৮.
যিনি নিজের উৎকৃষ্ট গুণাবলীর অধিকারী তিনি কখনো নিকৃষ্ট গুণের অধিকারীদের পছন্দ করতে পারেন না, একথা সবাই জানে। মহান আল্লাহ‌ নিজেই পরম দাতা এবং সর্বক্ষণ নিজের সৃষ্টির ওপর দান-দাক্ষিণ্যের ধারা প্রবাহিত করছেন। কাজেই তাঁর পক্ষে কেমন করে সংকীর্ণ দৃষ্টি, স্বল্প সাহস ও নিম্নমানের নৈতিক চারিত্রিক গুণাবলীর অধিকারী লোকদেরকে ভালোবাসা সম্ভব?
৩০৯.
হিকমত অর্থ হচ্ছে, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার শক্তি। এখানে একথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, হিকমতের সম্পদ যে ব্যক্তির কাছে থাকবে সে কখনো শয়তানের দেখানো পথে চলতে পারবে না। বরং সে আল্লাহর দেখানো প্রশস্ত পথ অবলম্বন করবে। শয়তানের সংকীর্ণমনা অনুসারীদের দৃষ্টিতে নিজের ধন-সম্পদ আঁকড়ে ধরে রাখা এবং সবসময় সম্পদ আহরণের নতুন নতুন ফন্দি-ফিকির করাই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। কিন্তু যারা আল্লাহর কাছ থেকে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেছে, তাদের মতে এটা নেহাত নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের মতে, মানুষ যা কিছু উপার্জন করবে, নিজের মাঝারী পর্যায়ের প্রয়োজন পূর্ণ করার পর সেগুলো প্রাণ খুলে সৎকাজে ব্যয় করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। দুনিয়ার এই হাতে গোণা কয়েকদিনের জীবনে প্রথম ব্যক্তি দ্বিতীয় জনের তুলনায় হয়তো অনেক বেশী প্রাচুর্যের অধিকারী হতে পারে। কিন্তু মানুষের জন্য এই দুনিয়ার জীবনটিই সম্পূর্ণ জীবন নয়। বরং এটি আসল জীবনের একটি সামান্যতম অংশ মাত্র। এই সামান্য ও ক্ষুদ্রতম অংশের সমৃদ্ধি ও সচ্ছলতার বিনিময়ে যে ব্যক্তি বৃহত্তম ও সীমাহীন জীবনের অসচ্ছলতা, দারিদ্র ও দৈন্যদশা কিনে নেয় সে আসলে নিরেট বোকা ছাড়া আর কিছুই নয়। যে ব্যক্তি এই সংক্ষিপ্ত জীবনকালের সুযোগ গ্রহণ করে মাত্র সামান্য পুঁজির সহায়তায় নিজের ঐ চিরন্তন জীবনের সমৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে সে-ই আসলে বুদ্ধিমান।
৩১০.
আল্লাহর পথে ব্যয় করা হোক বা শয়তানের পথে, আল্লাহর জন্য মানত করা হোক বা গায়রুল্লাহর জন্য, উভয় অবস্থায়ই মানুষের নিয়ত ও তার কাজ সম্পর্কে আল্লাহ‌ ভালোভাবেই জানেন। যারা আল্লাহর জন্য ব্যয় করে থাকে এবং তাঁর জন্যই মানত করে তারা তাদের প্রতিদান পাবে। আর যেসব জালেম শয়তানের পথে ব্যয় করে থাকে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদের জন্য মানত করে, তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করার সাধ্য কারো নেই।

মানত বলা হয় নজরানাকে। কোন একটি মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হলে মানুষ যখন নিজের ওপর এমন কোন ব্যয়ভার বা সেবাকে ফরয করে নেয়, যা তার ওপর ফরয নয় তখন তাকে মানত বলে। এই মনোবাঞ্ছা যদি কোন হালাল জিনিস সম্পর্কিত হয় এবং তা আল্লাহর কাছে চাওয়া হয়ে থাকে আর তা পূর্ণ হবার পর যে কাজ করার অঙ্গীকার করা হয় তা আল্লাহর জন্যই হয়ে থাকে, তাহলে এই ধরণের নজরানা ও মানত হবে আল্লাহর আনুগত্যের অধীন। এই মানত পূর্ণ করলে সওয়াব ও প্রতিদান লাভ করা যাবে। যদি এই ধরনের মানত না হয়, তাহলে তা নিজেই নিজের ওপর আরোপিত গোনাহের কারণ হয়ে দাঁড়াবে এবং তা পূর্ণ করলে অবশ্যি আযাবের অংশীদার হতে হবে।

অনুবাদ: