فَقَالَ ٱلْمَلَؤُا۟ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ مِن قَوْمِهِۦ مَا هَـٰذَآ إِلَّا بَشَرٌۭ مِّثْلُكُمْ يُرِيدُ أَن يَتَفَضَّلَ عَلَيْكُمْ وَلَوْ شَآءَ ٱللَّهُ لَأَنزَلَ مَلَـٰٓئِكَةًۭ مَّا سَمِعْنَا بِهَـٰذَا فِىٓ ءَابَآئِنَا ٱلْأَوَّلِينَ
তার সম্প্রদায়ের যেসব সরদার তার কথা মেনে নিতে অস্বীকার করলো তারা বলতে লাগলো, “এ ব্যক্তি আর কিছুই নয় কিন্তু তোমাদেরই মতো একজন মানুষ। ২৬ এর লক্ষ্য হচ্ছে তোমাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা। ২৭ আল্লাহ পাঠাতে চাইলে ফেরেশতা পাঠাতেন। ২৭(ক) একথা তো আমরা আমাদের বাপদাদাদের আমলে কখনো শুনিনি (যে, মানুষ রসূল হয়ে আসে) ।
২৬
মানুষ নবী হতে পারে না এবং নবী মানুষ হতে পারে না, এ চিন্তাটি সর্বকালের পথভ্রষ্ট লোকদের একটি সম্মিলিত ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। কুরআন বারবার এ জাহেলী ধারণাটির উল্লেখ করে এর প্রতিবাদ করেছে এবং পুরোপুরি জোর দিয়ে একথা বর্ণনা করেছে যে, সকল নবীই মানুষ ছিলেন এবং মানুষদের জন্য মানুষের নবী হওয়া উচিত। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, আল আরাফ, ৬৩-৬৯; ইউনুস, ২; হূদ ২৭-৩১; ইউসুফ, ১০৯; আর রা’দ, ৩৮; ইবরাহীম, ১০-১১; আন নাম্ল, ৪৩; বনী ইসরাঈল, ৯৪-৯৫; আল কাহাফ, ১১০; আল আম্বিয়া ৩-৩৪; আল মু’মিনূন, ৩৩-৩৪ ও ৪৭; আল ফুরকান, ৭-২০; আশ্শুআরা, ১৫৪-১৮৪; ইয়াসীন, ১৫ ও হা-মীম আস্ সাজ্দাহ, ৬ আয়াত এবং এই সঙ্গে টীকাগুলোও।)
২৭
এটাও সত্য বিরোধীদের একটি পুরাতন অস্ত্র। যে কেউ সংস্কারমূলক কাজের কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে আসার চেষ্টা করে সঙ্গে সঙ্গেই তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আনা হয়। বলা হয়, এর উদ্দেশ্য শুধু ক্ষমতা দখল করা। এ অভিযোগটিই ফেরাউন হযরত মূসা ও হারুনের বিরুদ্ধে এনেছিল। সে বলেছিল, তোমরা দেশে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করার জন্য এসেছোঃ
تَكُونَ لَكُمَا الْكِبْرِيَاءُ فِي الْأَرْضِ (يونس : 78) এ অভিযোগ হযরত ঈসা আলাইহিসসালামের বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল। বলাহয়েছিলঃ এ ব্যক্তি ইহুদিদের বাদশাই হতে চায়। আর কুরাইশ সরদাররাও নবী ﷺ সম্পর্কেও এ একই সন্দেহ পোষণ করতো। এ জন্য কয়েকবারই তারা তাঁর সাথে এভাবে সওদাবাজী করতে চেয়েছে যে, যদি তুমি কর্তৃত্ব লাভ করতে চাও, তাহলে “বিরোধী” দল ছেড়ে দিয়ে “সরকারী” দলে এসে যাও। তোমাকে আমরা বাদশাহ বানিয়ে নেবো। আসলে যারা সারা জীবন দুনিয়া ও তার বৈষয়িক স্বার্থ এবং তার গৌরব ও বাহ্যিক চাকচিক্য লাভ করার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে থাকে তাদের পক্ষে একথা কল্পনা করা কঠিন বরং অসম্ভব হয় দাঁড়ায় যে, এ দুনিয়ায় এমন কোন মানুষ থাকতে পারে। তারা নিজেরাই যেহেতু নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তারের জন্য প্রতিদিন হৃদয়গ্রাহী শ্লোগান ও সংস্কারের মিথ্যা দাবী পেশ করতে থাকে তাই এ প্রতারণা ও জালিয়াতী তাদের দৃষ্টিতে হয় একবারেই একটি স্বাভাবিক জিনিস। তারা মনে করে সংস্কার কথাটা প্রতারণা ওজালিয়াতি ছাড়া কিছু নয়। সততা ও আন্তরিকতার সাথে কখনো সংস্কারমূলক কোনো কাজ করা যেতে পারে না। যে ব্যক্তিই এ নামটি উচ্চারণ করে সে নিশ্চয়ই তাদেরই মত ধোঁকাবাজ। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে সংস্কারকদের বিরুদ্ধে “ক্ষমতা লোভের” এ অপবাদ চিরকাল ক্ষমতাসীন লোকেরা ও তাদের তোষামোদী গোষ্ঠীই লাগিয়ে এসেছে। অর্থাৎ তারা যেন একথা বলতে চায় যে, তারা নিজেরা ও তাদের মহান প্রভুরা যে ক্ষমতা লাভ করেছেতা যেন তাদের জন্মগত অধিকার। তা অর্জন করার ও তা দখল করে রাখার জন্য তারা কোনক্রমে অভিযুক্ত হতে পারে না। তবে এ “খাদ্যে” যাদের জন্মগত অধিকার ছিল না এবং এখন যারা নিজেদের মধ্যে এর “ক্ষুধা” অনুভব করছে তারা চরমভাবে নিন্দাবাদ লাভের যোগ্য। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য ৩৬ টীকা দেখুন)।
এখানে একথাটিও ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে যে, প্রচলিত জীবন ব্যবস্থার দোষ ত্রুটিগুলো দূর করার জন্য যে ব্যক্তিই অগ্রসর হবে এবং এর মোকাবিলায় সংস্কারমূলক মতাদর্শ ও ব্যবস্থা পেশ করবে তার জন্য অবশ্যই সংস্কারের পথে যেসব শক্তিই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে তাদেরকে সরিয়ে দেবার জন্য প্রচেষ্টা চালানো এবং যেসব শক্তিসংস্কারমূলক মতাদর্শ ও ব্যবস্থাকে কার্যত প্রবর্তিত করতে পারবে তাদেরকে ক্ষমতাসীন করা অপিরহার্য হয়ে পড়বে। তাছাড়া এ ধরনের লোকের দাওয়াত যখনই সফল হবে, তার স্বাভাবিক পরিণতিতে সে জনগণের ইমাম ও নেতায় পরিণত হবে এবং নতুন ব্যবস্থায় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের চাবিকাঠি হয় তার নিজের হাতে থাকবে নয়তো তার সমর্থক ও অনুসারীরা জনগণের ওপর কর্তৃত্বশীল হবে। দুনিয়ায় এমন কোন্নবী ও সংস্কারক ছিলেন যিনি নিজের দাওয়াতকে কার্যত প্রতিষ্ঠিত করা যার প্রচেষ্টারউদ্দেশ্য ছিল না? আর এমন কে আছেন যার দাওয়াতের সাফল্য তাঁকে যথার্থই নেতায়পরিণতকরেনি? তারপর এ বিষয়টি কি সত্যিই কারো বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উত্থাপন করার জন্য যথেষ্ট যে, সে আসলে ক্ষমতা লোভী ছিল এবং তার আসল উদ্দেশ্য ছিল নেতৃত্ব লাভ এবং তা সে অর্জন করেছিল? অসৎ প্রকৃতির সত্যের দুশমনরা ছাড়া কেউ এ প্রশ্নের জবাবে হাঁ বলবে না। আসলে ক্ষমতার জন্যই ক্ষমতা কাংখিত হওয়া এবং কোন সৎ উদ্দেশ্যে ক্ষমতা কাংখিত হওয়ারমধ্যে রয়েছে যমীন আসমান ফারাক। এটা এত বড় ফারাক যেমন ফারাক আছে ডাক্তারের ছুরির ও ডাকাতের ছুরির মধ্যে। ডাক্তার ও ডাকাত উভয়ই ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষের পেটে ছুরি চালায় এবং এর ফলে অর্থ লাভ করে যদি কোন ব্যক্তি শুধুমাত্র এ কারণে উভয়কে একাকার করে ফেলে তাহলে এটা হবে নিছক তার নিজেরই চিন্তা বা মনের ভুল। নয়তো উভয়ের নিয়ত, কর্মপদ্ধতি ও সামগ্রীক কর্মকাণ্ডের মধ্যে এত বেশী পার্থক্য থাকে যে, কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি ডাকাতকে ডাক্তার এবং ডাক্তারকে ডাকাত মনে করার মতো ভুল করতে পারে না।
২৭(ক)
নূহের সম্প্রদায় আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করতো না এবং তারা একথাও অস্বীকার করতো না যে, তিনিই বিশ্ব-জাহানের প্রভু এবং সমস্ত ফেরেশতা তাঁর নির্দেশের অনুগত, এ বক্তব্য তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। শির্ক বা আল্লাহকে অস্বীকার করা এ জাতির আসল ভ্রষ্টতা ছিল না বরং তারা আল্লাহর গুণাবলী ও ক্ষমতা এবং তাঁর অধিকারে অন্যকে শরীক করতো।