لَّوْلَآ إِذْ سَمِعْتُمُوهُ ظَنَّ ٱلْمُؤْمِنُونَ وَٱلْمُؤْمِنَـٰتُ بِأَنفُسِهِمْ خَيْرًۭا وَقَالُوا۟ هَـٰذَآ إِفْكٌۭ مُّبِينٌۭ
যখন তোমরা এটা শুনেছিলে তখনই কেন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারীরা নিজেদের সম্পর্কে সুধারণা করেনি ১২ এবং কেন বলে দাওনি এটা সুস্পষ্ট মিথ্যা দোষারোপ? ১৩
১২
অন্য একটি অনুবাদ এও হতে পারে, নিজেদের লোকদের অথবা নিজেদের সমাজের লোকদের ব্যাপারে ভালো ধারণা করোনি কেন? আয়াতের শব্দাবলী দু’ধরনের অর্থের অবকাশ রাখে। আর এ দ্ব্যর্থবোধক বাক্য ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে একটি গভীর তত্ত্ব। এটি ভালোভাবে অনুধাবন করতে হবে। হযরত আয়েশা (রাঃ) ও সাফ্ওয়ান ইবনে মু’আত্তালের (রাঃ) মধ্যে যে ব্যাপারটি ঘটে গিয়েছিল তা তো এই ছিল যে, কাফেলার এক ভদ্র মহিলা (তিনি নবী পত্নী ছিলেন একথা বাদ দিলেও) ঘটনাক্রমে পেছনে থেকে গিয়েছিলেন। আর কাফেলারই এক ব্যক্তি যিনি ঘটনাক্রমে পেছনে থেকে গিয়েছিলেন, তিনি তাঁকে নিজের উটের পিঠে বসিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। এখন যদি কেউ বলে, নাউযুবিল্লাহ্ এরা দু’জন নিজেদেরকে একান্তে পেয়ে গোনাহে লিপ্ত হয়ে গেছেন, তাহলে তার একথার বাহ্যিক শব্দাবলীর আড়ালে আরো দু’টো কাল্পনিক কথাও রয়ে গেছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, বক্তা (পুরুষ হোক বা নারী) যদি নিজেই ঐ জায়গায় হতেন, তাহলে কখনোই গোনাহ না করে থাকতেন না। কারণ তিনি যদি গোনাহ থেকে বিরত থেকে থাকেন তাহলে এটা শুধু এজন্য যে, বিপরীত লিংগের কেউ এ পর্যন্ত এভাবে একান্তে তার নাগালে আসেনি নয়তো এমন সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারাবার লোক তিনি নন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, যে সমাজের তিনি একজন সদস্য, তার নৈতিক অবস্থা সম্পর্কে তার ধারণা হচ্ছে, এখানে এমন একজন নারী ও পুরুষ নেই যিনি এ ধরনের সুযোগ পেয়ে গোনাহে লিপ্ত হননি। এতো শুধুমাত্র তখনকার ব্যাপার যখন বিষয়টি নিছক একজন পুরুষ ও একজন নারীর সাথে জড়িত থাকে। আর ধরুন যদি সে পুরুষ ও নারী উভয়ই এক জায়গার বাসিন্দা হন এবং যে মহিলাটি ঘটনাক্রমে কাফেলা থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন তিনি ঐ পুরুষটির কোন বন্ধু, আত্মীয় বা প্রতিবেশীর স্ত্রী, বোন বা মেয়ে হয়ে থাকেন তাহলে ব্যাপারটি আরো গুরুতর হয়ে যায়। এক্ষেত্রে এর অর্থ এ দাঁড়ায় যে, বক্তা নিজেই নিজের ব্যক্তি সত্ত্বা সম্পর্কেও এমন জঘন্য ধারণা পোষণ করেন যার সাথে ভদ্রতা ও সৌজন্যবোধের দূরতম সম্পর্কও নেই। কে এমন সজ্জন আছেন যিনি একথা চিন্তা করতে পারেন যে, তার কোন বন্ধু, প্রতিবেশী বা পরিচিত ব্যক্তির গৃহের কোন মহিলার সাথে বিপদগ্রস্ত অবস্থায় তার পথে দেখা হয়ে যাবে এবং প্রথম অবস্থায়ই তিনি তার ইজ্জত লুটে নেবার কাজ করবেন তারপর তাকে গৃহে পৌঁছিয়ে দেবার কথা চিন্তা করবেন। কিন্তু এখানে তো ব্যাপার ছিল এর চেয়ে হাজার গুণ গুরুতর মহিলা অন্য কেউ ছিলেন না, তিনি ছিলেন স্বয়ং রসূলুল্লাহ্ ﷺ এর স্ত্রী, যাঁদেরকে প্রত্যেকটি মুসলমান নিজের মায়ের চেয়েও বেশী সম্মানের যোগ্য মনে করতো এবং যাঁদেরকে আল্লাহ নিজেই প্রত্যেক মুসলমানের ওপর নিজের মায়ের মতই হারাম গণ্য করেছিলেন। পুরুষটি কেবলমাত্র ঐ কাফেলার একজন সদস্য, ঐ সেনাদলের একজন সৈন্য এবং ঐ শহরের একজন অধিবাসীই ছিলেন না বরং তিনি মুসলমানও ছিলেন। ঐ মহিলার স্বামীকে তিনি আল্লাহর রসূল এবং নিজের নেতা ও পথপ্রদর্শক বলে মেনে নিয়েছিলেন আর তাঁর হুকুমে প্রাণ উৎসর্গ করে দেয়ার জন্য বদরের যুদ্ধের মতো ভয়াবহ জিহাদে অংশ নিয়েছিলেন। এ অবস্থায় তো এ উক্তির মানসিক প্রেক্ষাপট জঘন্যতার এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যার চেয়ে নোংরা ও ঘৃণা কোন প্রেক্ষাপটের কথা চিন্তাই করা যায় না। তাই মহান আল্লাহ বলছেন, মুসলিম সমাজের যেসব ব্যক্তি একথা তাদের কণ্ঠে উচ্চারণ করেছে অথবা কমপক্ষে একে সন্দেহযোগ্য মনে করেছে তারা নিজেদের মন-মানসিকতারও খুবই খারাপ ধারণা দিয়েছে এবং নিজেদের সমাজের লোকদেরকেও অত্যন্ত হীন চরিত্র ও নিকৃষ্ট নৈতিকবৃত্তির অধিকারী মনে করেছে।
১৩
অর্থাৎ একথাতো বিবেচনার যোগ্যই ছিল না। একথা শোনার সাথে সাথেই প্রত্যেক মুসলমানের একে সুস্পষ্ট মিথ্যাচার, মিথ্যা ও বানোয়াট কথা ও অপবাদ আখ্যা দেয়া উচিত ছিল। সম্ভবত কেউ এখানে প্রশ্ন করতে পারে, একথাই যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে স্বয়ং রসূলুল্লাহ্ ﷺ ও আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহুই বা প্রথম দিনই একে মিথ্যা বলে দিলেন না কেন? কেন তারা একে এতটা গুরুত্ব দিলেন? এর জবাব হচ্ছে, স্বামী ও পিতার অবস্থা সাধারণ লোকদের তুলনায় ভিন্ন ধরনের হয়। যদিও স্ত্রীকে স্বামীর চেয়ে বেশী কেউ চিনতে বা জানতে পারে না এবং একজন সৎ, ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত স্ত্রী সম্পর্কে কোন সুস্থ বুদ্ধি সম্পন্ন স্বামী লোকদের অপবাদের কারণে খারাপ ধারণা করতে পারে না, তবুও যদি তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া হয় তাহলে তখন সে এমন এক ধরনের সংকটের মুখোমুখি হয় যার ফলে সে একে মিথ্যা অপবাদ বলে প্রত্যাখ্যান করলে প্রচারণাকারীদের মুখ বন্ধ হবে না বরং তারা নিজেদের কণ্ঠ আরো এক ডিগ্রী উঁচুতে চড়িয়ে বলতে থাকবে, দেখো, বউ কেমন স্বামীর বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, সবকিছু করে যাচ্ছে আর স্বামী মনে করছে আমার স্ত্রী বড়ই সতী সাধ্বী। এ ধরনের সংকট মা-বাপের ক্ষেত্রেও দেখা দেয়। সে বেচারারা নিজেদের মেয়ের সতীত্বের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদের প্রতিবাদে যদি মুখ খোলেও তাহলে মেয়ের অবস্থান পরিষ্কার হয় না। প্রচারণাকারীরা একথাই বলবে, মা-বাপ তো, কাজেই নিজের মেয়ের পক্ষ সমর্থন করবে না তো আর কি করবে। এ জিনিসটিই রসূলুল্লাহ্ ﷺ এবং হযরত আবু বকর ও উম্মে রুমানকে ভিতরে ভিতরে শোকে-দুঃখে জর্জরিত ও বিহবল করে চলছিল। নয়তো আসলে তাদের মনে কোন সন্দেহ ছিল না। রসূলুল্লাহ্ ﷺ তো তাঁর ভাষণে পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন, আমি আমার স্ত্রীর মধ্যে কোন খারাপ জিনিস দেখিনি এবং যে ব্যক্তির সম্পর্কে এ অপবাদ দেয়া হচ্ছে তার মধ্যেও না।