একঃ অপবাদের ঘটনার পরপরই এ বিধান বর্ণনা করা পরিষ্কারভাবে একথাই ব্যক্ত করে যে, রসূলের স্ত্রীর ন্যায় মহান ও উন্নত ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে এত বড় একটি ডাহা মিথ্যা অপবাদের এভাবে সমাজের অভ্যন্তরে ব্যাপক প্রচার লাভকে আল্লাহ আসলে একটি যৌন কামনা তাড়িত পরিবেশের উপস্থিতির ফল বলে চিহ্নিত করেছেন। আল্লাহর দৃষ্টিতে এ যৌন কামনা তাড়িত পরিবেশ বদলানোর একমাত্র উপায় এটাই ছিল যে, লোকদের পরস্পরের গৃহে নিঃসংকোচে আসা যাওয়া বন্ধ করতে হবে, অপরিচিত নারী-পুরুষদের পরস্পর দেখা-সাক্ষাত ও স্বাধীনভাবে মেলামেশার পথরোধ করতে হবে, মেয়েদের একটি অতি নিকট পরিবেশের লোকজন ছাড়া গায়ের মুহাররাম আত্মীয়-স্বজন ও অপরিচিতদের সামনে সাজসজ্জা করে যাওয়া নিষিদ্ধ করতে হবে, পতিতাবৃত্তির পেশাকে চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে, পুরুষদের ও নারীদের দীর্ঘকাল অবিবাহিত রাখা যাবে না, এমনকি গোলাম ও বাঁদীদেরও বিবাহ দিতে হবে। অন্য কথায় বলা যায়, মেয়েদের পর্দাহীনতা ও সমাজে বিপুল সংখ্যক লোকের অবিবাহিত থাকাই আল্লাহর জ্ঞান অনুযায়ী এমন সব মৌলিক কার্যকারণ যেগুলোর মাধ্যমে সামাজিক পরিবেশ একটি অননুভূত যৌন কামনা সর্বক্ষণ প্রবাহমান থাকে এবং এ যৌন কামনার বশবর্তী হয়ে লোকদের চোখ, কান, কণ্ঠ, মন-মানস সবকিছুই কোন বাস্তব বা কাল্পনিক কেলেংকারিতে (Scandal) জড়িত হবার জন্য সবসময় তৈরী থাকে। এ দোষ ও ত্রুটি সংশোধন করার জন্য আলোচ্য পর্দার বিধিসমূহের চেয়ে বেশী নির্ভুল, উপযোগী ও প্রভাবশালী অন্য কোন কর্মপন্থা আল্লাহর জ্ঞান-ভাণ্ডারে ছিল না। নয়তো তিনি এগুলো বাদ দিয়ে অন্য বিধান দিতেন।
দুইঃ এ সুযোগে দ্বিতীয় যে কথাটি বুঝে নিতে হবে সেটি হচ্ছে এই যে, আল্লাহর শরীয়াত কোন অসৎকাজ নিছক হারাম করে দিয়ে অথবা তাকে অপরাধ গণ্য করে তার জন্য শাস্তি নির্ধারিত করে দেয়াই যথেষ্ট মনে করে না বরং যেসব কার্যকারণ কোন ব্যক্তিকে ঐ অসৎকাজে লিপ্ত হতে উৎসাহিত করে অথবা তার জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় কিংবা তাকে তা করতে বাধ্য করে, সেগুলোকেও নিশ্চিহ্ন করে দেয়। তাছাড়া শরীয়াত অপরাধের সাথে সাথে অপরাধের কারণ, অপরাধের উদ্যোক্তা ও অপরাধের উপায়-উপকরণাদির ওপরও বিধি-নিষেধ আরোপ করে। এভাবে আসল অপরাধের ধারে কাছে পৌঁছার আগেই অনেক দূর থেকেই মানুষকে রুখে দেয়া হয়। মানুষ সবসময় অপরাধের কাছ দিয়ে ঘোরাফেরা করতে থাকবে এবং প্রতিদিন পাকড়াও হতে ও শাস্তি পেতে থাকবে, এটাও সে পছন্দ করে না। সে নিছক একজন অভিযুক্তই (Prosecutor) নয় বরং একজন সহানুভূতিশীল সহযোগী, সংস্কারকারী ও সাহায্যকারীও। তাই সে মানুষকে অসৎকাজ থেকে নিষ্কৃতি লাভের ক্ষেত্রে সাহায্য করার উদ্দেশ্যেই সকল প্রকার শিক্ষামূলক, নৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা অবলম্বন করে।
একঃ নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যক্তিগত গোপনীয়তার এ অধিকারটিকে কেবলমাত্র গৃহের চৌহদ্দীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং একে একটি সাধারণ অধীকার গণ্য করেন। এ প্রেক্ষিতে অন্যের গৃহে উঁকি ঝুঁকি মারা, বাহির থেকে চেয়ে দেখা এমনকি অন্যের চিঠি তার অনুমতি ছাড়া পড়ে ফেলা নিষিদ্ধ। হযরত সওবান (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আজাদ করা গোলাম) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম ﷺ বলেনঃ
اذا دخل البصر فلا اذن
“দৃষ্টি যখন একবার প্রবেশ করে গেছে তখন আর নিজের প্রবেশ করার জন্য অনুমতি নেবার দরকার কি?” (আবু দাউদ)
হযরত হুযাইল ইবনে শুরাহবীল বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এলেন এবং ঠিক তাঁর দরজার ওপর দাঁড়িয়ে অনুমতি চাইলেন। নবী (সা) তাকে বললেন, هكذا عنك , فائما الاستيذان من النظر “পিছনে সরে গিয়ে দাঁড়াও, যাতে দৃষ্টি না পড়ে সে জন্যই তো অনুমতি চাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’ (আবু দাউদ) নবী করীমের ﷺ নিজের নিয়ম ছিল এই যে, যখন কারোর বাড়িতে যেতেন, দরজার ঠিক সামনে কখনো দাঁড়াতেন না। কারণ সে যুগে ঘরের দরজায় পরদা লটকানো থাকতো না। তিনি দরজার ডান পাশে বা বাম পাশে দাঁড়িয়ে অনুমতি চাইতেন। (আবু দাউদ) রসূলুল্লাহর ﷺ খাদেম হযরত আনাস বলেন, এক ব্যক্তি বাইরে থেকে রসূলের ﷺ কামরার মধ্যে উঁকি দিলেন। রসূলুল্লাহর ﷺ হাতে সে সময় একটি তীর ছিল। তিনি তার দিকে এভাবে এগিয়ে এলেন যেন তীরটি তার পেটে ঢুকিয়ে দেবেন। (আবু দাউদ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন, নবী (সা.) বলেছেনঃ
مَنْ نَظَرَ فِى كِتَابِ أَخِيهِ بِغَيْرِ إِذْنِهِ فَإِنَّمَا يَنْظُرُ فِى النَّارِ
“যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া তার পত্রে চোখ বুলালো সে যেন আগুনের মধ্যে দৃষ্টি ফেলছে।” (আবুদ দাউদ)
বুখারী ও মুসলিমে উদ্ধৃত হয়েছে, নবী (সা.) বলেছেনঃ
لَوْ أَنَّ امْرَأً اطَّلَعَ عَلَيْكَ بِغَيْرِ إِذْنٍ فَخَذَفْتَهُ بِحَصَاةٍ ، فَفَقَأْتَ عَيْنَهُ مَا كَانَ عَلَيْكَ جُنَاحٌ
“যদি কোন ব্যক্তি তোমার গৃহে উঁকি মারে এবং তুমি একটি কাঁকর মেরে তার চোখ কানা করে দাও, তাহলে তাতে কোন গোনাহ হবে না।”
এ বিষয়বস্তু সম্বলিত অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ
مَنِ اطَّلَعَ فِى دَارِ قَوْمٍ بِغَيْرِ إِذْنِهِمْ فَفَقَأُوا عَيْنَهُ فَقَدْ هَدَرَتْ عَيْنُهُ
“যে ব্যক্তি কারোর ঘরে উঁকি মারে এবং ঘরের লোকেরা তার চোখ ছেঁদা করে দেয়, তবে তাদের কোন জবাবদিহি করতে হবে না।”
ইমাম শাফঈ এ হাদীসটিকে একদম শাব্দিক অর্থে গ্রহণ করেছেন এবং তিনি কেউ ঘরের মধ্যে উঁকি দিলে তার চোখ ছেঁদা করে দেবার অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু হানাফীগণ এর অর্থ নিয়েছেন এভাবে যে, নিছক দৃষ্টি দেবার ক্ষেত্রে এ হুকুমটি দেয়া হয়নি। বরং এটি এমন অবস্থায় প্রযোজ্য যখন কোন ব্যক্তি বিনা অনুমতিতে গৃহ মধ্যে প্রবেশ করে, গৃহবাসীদের বাধা দেয়ায়ও সে নিরস্ত হয় না এবং গৃহবাসীরা তার প্রতিরোধ করতে থাকে। এ প্রতিরোধ ও সংঘাতের মধ্যে যদি তার চোখ ছেঁদা হয়ে যায় বা শরীরের কোন অংগহানি হয় তাহলে এজন্য গৃহবাসীরা দায়ী হবে না। (আহকামুল কুরআন-জাস্সাস, ৩য় খণ্ড, ৩৮৫ পৃষ্ঠা)
দুইঃ ফকীহগণ শ্রবণ শক্তিকেও দৃষ্টিশক্তির হুকুমের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যেমন অন্ধ ব্যক্তি যদি বিনা অনুমতিতে আসে তাহলে তার দৃষ্টি পড়বে না ঠিকই কিন্তু তার কান তো গৃহবাসীদের কথা বিনা অনুমতিতে শুনে ফেলবে। এ জিনিসটিও দৃষ্টির মতো ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারে অবৈধ হস্তক্ষেপ।
তিনঃ কেবলমাত্র অন্যের গৃহে প্রবেশ করার সময় অনুমতি নেবার হুকুম দেয়া হয়নি। বরং নিজের মা-বোনদের কাছে যাবার সময়ও অনুমতি নিতে হবে। এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলো, আমি কি আমার মায়ের কাছে যাবার সময়ও অনুমতি চাইবো? জবাব দিলেন, হ্যাঁ। সে বললো, আমি ছাড়া তাঁর সেবা কারার আর কেউ নেই। এক্ষেত্রে কি আমি যতবার তাঁর কাছে যাবো প্রত্যেক বার অনুমতি নেবো? জবাব দিলেন, اتحب ان تراها عريانة “তুমি কি তোমার মাকে উলংগ অবস্থায় দেখতে পছন্দ কর?” (ইবনে জারীর এ মুরসাল হাদীসটি আতা ইবনে ইয়াসার থেকে বর্ণনা করেছেন) আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের উক্তি হচ্ছে, عليكم ان تستاذنوا على امهاتكم واخواتكم “নিজেদের মা-বোনদের কাছে যাবার সময়ও অনুমতি নিয়ে যাও।” (ইবনে কাসীর) বরং ইবনে মাসউদ তো বলেন, নিজের ঘরে নিজের স্ত্রীর কাছে যাবার সময়ও অন্ততপক্ষে গলা খাঁকারী দিয়ে যাওয়া উচিত। তাঁর স্ত্রী যয়নবের বর্ণনা হচ্ছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ যখনই গৃহে আসতে থাকেন তখনই আগেই এমন কোন আওয়াজ করে দিতেন যাতেন তিনি আসছেন বলে জানা যেতো। তিনি হঠাৎ ঘরের মধ্যে এসে যাওয়া পছন্দ করতেন না। (ইবনে জারীর)
চারঃ শুধুমাত্র এমন অবস্থায় অনুমতি চাওয়া জরুরী নয় যখন কারোর ঘরে হঠাৎ কোন বিপদ দেখা দেয়। যেমন, আগুন লাগে অথবা কোন চোর ঢোকে। এ অবস্থায় সাহায্য দান করার জন্য বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করা যায়।
পাঁচঃ প্রথম প্রথম যখন অনুমতি চাওয়ার বিধান জারি হয় তখন লোকেরা তার নিয়ম-কানুন জানতো না। একবার এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসে এবং দরজা থেকে চিৎকার করে বলতে থাকে االج (আমি কি ভেতরে ঢুকে যাবো?) নবী ﷺ তাঁর বাঁদী রওযাহকে বলেন, এ ব্যক্তি অনুমতি চাওয়ার নিয়ম জানে না। একটু উঠে গিয়ে তাকে বলে এসো, السلام عليكم اادخل؟ (আসসালামু আলাইকুম, আমি কি ভিতরে আসতে পারি?) বলতে হবে। (ইবনে জারির ও আবু দাউদ) জাবের ইবনে আবদুল্লাহ বলেন, আমি আমার বাবার ঋণের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গেলাম এবং দরজায় করাঘাত করলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে? আমি বললাম, আমি। তিনি দু-তিনবার বললেন, “আমি? আমি?’ অর্থাৎ এখানে আমি বললে কে কি বুঝবে যে, তুমি কে? (আবু দাউদ) কালাদাহ ইবনে হাম্বল নামে এক ব্যক্তি কোন কাজে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গেলেন। সালাম ছাড়াই এমনিই সেখানে গিয়ে বসলেন। তিনি বললেন, বাইরে যাও এবং আস্সালামু আলাইকুম বলে ভেতরে এসো। (আবু দাউদ) অনুমতি চাওয়ার সঠিক পদ্ধতি ছিল, মানুষ নিজের নাম বলে অনুমতি চাইবে। হযরত উমরের (রা.) ব্যাপারে বর্ণিত আছে নবী করীমের ﷺ খিদমতে হাজির হয়ে তিনি বলতেনঃ
السلام عليكم يارسول الله ايدخل عمر؟
“আস্সালামু আলাইকুম, হে আল্লাহর রসূল! উমর কি ভেতরে যাবে?” (আবু দাউদ) অনুমতি নেবার জন্য নবী করীম ﷺ বড় জোর তিনবার ডাক দেবার সীমা নির্দেশ করেছেন এবং বলেছেন যদি তিনবার ডাক দেবার পরও জবাব না পাওয়া যায়, তাহলে ফিরে যাও। (বুখারী মুসলিম, আবু দাউদ) নবী (সা.) নিজেও এ পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। একবার তিনি হযরত সা’দ ইবনে উবাদার বাড়ীতে গেলেন এবং আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ বলে দু’বার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু ভেতর থেকে জবাব এলো না। তৃতীয় বার জবাব না পেয়ে তিনি ফিরে গেলেন। হযরত সা’দ ভেতর থেকে দৌড়ে এলেন এবং বললেনঃ হে আল্লাহর রসূল! আমি আপনার আওয়াজ শুনছিলাম। কিন্তু আমার মন চাচ্ছিল আপনার মুবারক কন্ঠ থেকে আমার জন্য যতবার সালাম ও রহমতের দোয়া বের হয় ততই ভালো, তাই আমি খুব নীচু স্বরে জবাব দিচ্ছিলাম। (আবু দাউদ ও আহমাদ) এ তিনবার ডাকা একের পর এক হওয়া উচিত নয় বরং একটু থেমে হতে হবে। এর ফলে ঘরের লোকেরা যদি কাজে ব্যস্ত থাকে এবং সেজন্য তারা জবাব দিতে না পারে তাহলে সে কাজ শেষ করে জবাব দেবার সুযোগ পাবে।
ছয়ঃ গৃহমালিক বা গৃহকর্তা অথবা এমন এক ব্যক্তির অনুমতি গ্রহণযোগ্য হবে যার সম্পর্কে মানুষ যথার্থই মনে করবে যে, গৃহকর্তার পক্ষ থেকে সে অনুমতি দিচ্ছে। যেমন, গৃহের খাদেম অথবা কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তি। কোন ছোট শিশু যদি বলে, এসে যান, তাহলে তার কথায় ভেতর প্রবেশ করা উচিত নয়।
সাতঃ অনুমতি চাওয়ার ব্যাপারে অযথা পীড়াপীড়ি করা অথবা অনুমতি না পাওয়ায় দরজার ওপর অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জায়েয নয়। যদি তিনবার অনুমতি চাওয়ার পর গৃহকর্তার পক্ষ থেকে অনুমতি না পাওয়া যায় বা অনুমতি দিতে অস্বীকার জানানো হয়, তাহলে ফিরে যাওয়া উচিত।