এ হুকুম এসে যাবার পর নবী ﷺ যেসব মামলার ফায়সালা দেন সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ হাদীসের কিতাবগুলোতে লিখিত আকারে সংরক্ষিত রয়েছে এবং সেগুলোই লি’আন সংক্রান্ত বিস্তারিত আইনগত কার্যধারার উৎস।
হেলাল ইবনে উমাইয়ার মামলার যে বিস্তারিত বিবরণ সিহাহে সিত্তা ও মুসনাদে আহমাদ এবং তাফসীরে ইবনে জারিরে ইবনে আব্বাস ও আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হয়েছে তাতে বলা হয়েছেঃ এ আয়াত নাযিল হবার পর হেলাল ও তার স্ত্রী দু’জনকে নবীর আদালতে হাযির করা হয়। রসূলুল্লাহ্ ﷺ প্রথমে আল্লাহর হুকুম শুনান। তারপর বলেন, “খুব ভালভাবে বুঝে নাও, আখেরাতের শাস্তি দুনিয়ার শাস্তির চাইতে কঠিন।” হেলাল বলেন, “আমি এর বিরুদ্ধে একদম সত্য অভিযোগ দিয়েছি।” স্ত্রী বলে, “এ সম্পূর্ণ মিথ্যা।” রসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেন, “বেশ, তাহলে এদের দু’জনের মধ্যে লি’আন করানো হোক।” তদনুসারে প্রথমে হেলাল উঠে দাঁড়ায়। তিনি কুরআনী নির্দেশ অনুযায়ী কসম খাওয়া শুরু করেন। এ সময় নবী ﷺ বারবার বলতে থাকেন, “আল্লাহ্ জানেন তোমাদের মধ্যে অবশ্যই একজন মিথ্যেবাদী। তারপর কি তোমাদের মধ্য থেকে কেউ তাওবা করবে?” পঞ্চম কসমের পূর্বে উপস্থিত লোকেরা হেলালকে বললো, “আল্লাহকে ভয় করো। দুনিয়ার শাস্তি পরকালের শাস্তির চেয়ে হালকা। এ পঞ্চম কসম তোমার ওপর শাস্তি ওয়াজিব করে দেবে।” কিন্তু হেলাল বলেন, যে আল্লাহ এখানে আমার পিঠ বাঁচিয়েছেন তিনি পরকালেও আমাকে শাস্তি দেবেন না। একথা বলে তিনি পঞ্চম কসমও খান। তারপর তার স্ত্রী ওঠে। সেও কসম খেতে শুরু করে। পঞ্চম কসমের পূর্বে তাকেও থামিয়ে বলা হয়, “আল্লাহকে ভয় করো, আখেরাতের আযাবের তুলনায় দুনিয়ার আযাব বরদাশত করে নেয়া সহজ। এ শেষ কসমটি তোমার ওপর আল্লাহর আযাব ওয়াজিব করে দেবে।” একথা শুনে সে কিছুক্ষণ থেমে যায় এবং ইতস্তত করতে থাকে। লোকেরা মনে করে নিজের অপরাধ স্বীকার করতে চাচ্ছে। কিন্তু তারপর সে বলতে থাকে। “আমি চিরকালের জন্য নিজের গোত্রকে লাঞ্ছিত করবো না।” তারপর সে পঞ্চম কসমটিও খায়। অতঃপর নবী ﷺ তাদের উভয়ের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করে দেন এবং ফায়সালা দেন, এর সন্তান (যে তখন মাতৃগর্ভে ছিল) মায়ের সাথে সম্পর্কিত হবে। বাপের সাথে সম্পর্কিত করে তার নাম ডাকা হবে না। তার বা তার সন্তানের প্রতি অপবাদ দেবার অধিকার কারোর থাকবে না। যে ব্যক্তি তার বা তার সন্তানের প্রতি অপবাদ দেবে সে মিথ্যা অপবাদের (কাযাফ) শাস্তির অধিকারী হবে। ইদ্দতকালে তার খোরপোশ ও বাসস্থান লাভের কোন অধিকার হেলালের ওপর বর্তায় না। কারণ তাকে তালাক বা মৃত্যু ছাড়াই স্বামী থেকে আলাদা করা হচ্ছে। তারপর তিনি লোকদের বলেন, তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর দেখো সে কার মতো হয়েছে। যদি এ আকৃতির হয় তাহলে হেলালের হবে। আর যদি ঐ আকৃতির হয়, তাহলে যে ব্যক্তির সাথে মিলিয়ে একে অপবাদ দেয়া হয়েছে এ তার হবে। শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পর দেখা গেলো সে শেষোক্ত ব্যক্তির আকৃতি পেয়েছে। এ অবস্থায় নবী ﷺ বলেন, لو لا الايمان অর্থাৎ যদি কসমসমূহ না হতো (অথবা বর্ণনান্তরে لَكَانَ لِى وَلَهَا شَأْنٌ (لَوْلاَ مَا مَضَى مِنْ كِتَابِ اللَّهِ) আল্লাহর কিতাব প্রথমেই ফায়সালা না করে দিতো) তাহলে আমি এ মেয়েটির সাথে কঠোর ব্যবহার করতাম।
‘উওয়াইমির আজলানীর মামলার বিবরণ পাওয়া যায় বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ ও মুসনাদে আহমাদ। সাহল ইবনে সা’দ সা’ঈদী ও ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে এগুলো বর্ণিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছেঃ উওয়াইমির ও তার স্ত্রী উভয়কে মসজিদে নববীতে ডাকা হয়। তারা নিজেদের ওপর ‘লি’আন’ করার আগে রসূলুল্লাহ্ ﷺ তাদেরকেও সতর্ক করে দিয়ে তিনবার বলেন, “আল্লাহ্ খুব ভালভাবেই জানেন তোমাদের একজন অবশ্যই মিথ্যাবাদী। তাহলে কি তোমাদের কেউ তাওবা করবে?” দু’জনের কেউ যখন তাওবা করলো না তখন তাদের ‘লি’আন’ করানো হয়। এরপর ‘উওয়াইমির বলেন, “হে আল্লাহর রসূল! যদি আমি এ স্ত্রীকে রেখে দেই তাহলে মিথ্যুক হবো।” একথা বলেই রসূলুল্লাহ্ ﷺ তাকে হুকুম দেয়া ছাড়াই তিনি তিন তালাক দিয়ে দেন। সাহল ইবনে সা’দ বলেন, “রসূলুল্লাহ্ ﷺ এ তালাক জারি করেন, তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করে দেন এবং বলেন, “যে দম্পতি লি’আন করবে তাদের জন্য এ ছাড়াছাড়ি।” লি’আনকারী স্বামী-স্ত্রীকে আলাদা করে দেবার এ সুন্নত কায়েম হয়ে যায়। এরপর তারা আর কখনো একত্র হতে পারবে না। সাহল ইবনে সা’দ একথাও বর্ণনা করেন যে, স্ত্রী গর্ভবতী ছিল এবং ‘উওয়াইমির বলেন, এ গর্ভ আমার ঔরসজাত নয়। এজন্য শিশুকে মায়ের সাথে সম্পর্কিত করা হয় এবং এ সুন্নত জারি হয় যে, এ ধরনের সন্তান মায়ের উত্তরাধিকারী হবে এবং মা তার উত্তরাধিকারী হবে।
এ দু’টি মামলা ছাড়া হাদীসের কিতাবগুলোতে আমরা এমন বহু রেওয়ায়াত পাই যেগুলো থেকে এ মামলাগুলো কাদের সাথে জড়িত ছিল তা সুস্পষ্টভাবে জানা যায় না। হতে পারে সেগুলোর কোন কোনটি এ দু’টি মামলার সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু কয়েকটিতে অন্য কিছু মামলার কথা বলা হয়েছে এবং সেগুলো থেকে লি’আন আইনের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলোকপাত হয়।
ইবনে উমর একটি মামলার বিবরণ দিয়েছেন। তিনি বলেন, স্বামী-স্ত্রী লি’আন শেষ করার পর নবী ﷺ তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করে দেন। (বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ, আহমাদ ও ইবনে জারীর) ইবনে উমরের অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, এক ব্যক্তি ও তার স্ত্রীর মধ্যে লি’আন করানো হয়। তারপর স্বামীটি গর্ভের সন্তান অস্বীকার করে। নবী ﷺ তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করে দেন এবং ফায়সালা শুনিয়ে দেন, সন্তান হবে শুধুমাত্র মায়ের। (সিহাহে সিত্তা ও আহমাদ) ইবনে উমরেরই আর একটি রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে, উভয়ের লি’আন করার পরে রসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেন, “তোমাদের হিসাব এখন আল্লাহর জিম্মায়। তোমাদের একজন অবশ্যই মিথ্যুক।” তারপর তিনি পুরুষটিকে বলেন, لَا سَبِيلَ لَكَ عَلَيْهَا (অর্থ এখন এ আর তোমার নয়। তুমি এর ওপর নিজের কোন অধিকার দেখাতে পারো না। এর ওপর কোনরকম হস্তক্ষেপও করতে পারো না। অথবা এর বিরুদ্ধে অন্য কোন প্রকার প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার অধিকারও আর তোমার নেই)। পুরুষটি বলে হে আল্লাহর রসূল! আর আমার সম্পদ? (অর্থাৎ যে মোহরানা আমি তাকে দিয়েছিলাম তা আমাকে ফেরত দেবার ব্যবস্থা করুন)। রসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেনঃ
لاَ مَالَ لَكَ ، إِنْ كُنْتَ صَدَقْتَ عَلَيْهَا ، فَهْوَ بِمَا اسْتَحْلَلْتَ مِنْ فَرْجِهَا ، وَإِنْ كُنْتَ كَذَبْتَ عَلَيْهَا ، فَذَاكَ أَبْعَدُ وأَبْعَدُ لَكَ منها-
“সম্পদ ফেরত নেবার কোন অধিকার তোমার নেই। যদি তুমি তার ওপর সত্য অপবাদ দিয়ে থাকো তাহলে ঐ সম্পদ সে আনন্দ উপভোগের প্রতিদান যা তুমি হালাল করে তার থেকে লাভ করেছো। আর যদি তুমি তার ওপর মিথ্যা অপবাদ দিয়ে থাকো। তাহলে সম্পদ তোমার কাছ থেকে আরো অনেক দূরে চলে গেছে। তার তুলনায় তোমার কাছ থেকে তা বেশী দূরে রয়েছে।” (বুখারী, মুসলিম ও আবু দাউদ)।
দারুকুত্নী আলী ইবনে আবু তালেব ও ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুমার উক্তি উদ্ধৃত করেছে। তাতে বলা হয়েছেঃ “সুন্নাত এটিই নির্ধারিত হয়েছে যে, লি’আনকারী স্বামী-স্ত্রী পরবর্তী পর্যায়ে আর কখনো একত্র হতে পারে না।” (অর্থাৎ দ্বিতীয়বার আর কোনদিন তাদের মধ্যে বিয়ে হতে পারে না)। আবার এ দারুকত্নী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, নবী ﷺ বলেন, এরা দু’জন আর কখনো একত্র হতে পারে না।
কাবীসাহ ইবনে যুওয়াইব বর্ণনা করেছেন, হযরত উমরের আমলে এক ব্যক্তি নিজের স্ত্রীর গর্ভের সন্তানকে অবৈধ গণ্য করে তারপর আবার তা নিজের বলে স্বীকার করে নেয়। তারপর সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর বলতে থাকে, এ শিশু আমার নয়। ব্যাপারটি হযরত উমরের আদালতে পেশ হয়। তিনি তার ওপর কাযাফের শাস্তি জারি করেন এবং ফায়সালা দেন, শিশু তার সাথেই সম্পর্কিত হবে। (দারুকুত্নী বাইহাকী)।
ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন, এক ব্যক্তি হাযির হয়ে বলে, আমার একটি স্ত্রী আছে, আমি তাকে ভীষণ ভালবাসি। কিন্তু তার অবস্থা হচ্ছে এই যে, সে কোন স্পর্শকারীর হাত ঠেলে দেয় না। (উল্লেখ্য, এটি একটি রূপক ছিল। এর অর্থ যিনাও হতে পারে আবার যিনার কম পর্যায়ের নৈতিক দুর্বলতাও হতে পারে।) নবী ﷺ বলেন, তালাক দিয়ে দাও। সে বলে, আমি তাকে ছাড়া থাকতে পারি না। জবাব দেন, তুমি তাকে রেখে দাও। (অর্থাৎ তিনি তার কাছ থেকে তার ইঙ্গিতের ব্যাখ্যা নেননি এবং তার উক্তিকে যিনার অপবাদ হিসেবে গণ্য করে লি’আন করার হুকুম দেননি।) ---নাসাঈ।
আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেছেন, এক ব্যক্তি হাজির হয়ে বলে, আমার স্ত্রী কালো ছেলে জন্ম দিয়েছে। আমি তাকে আমার সন্তান বলে মনে করি না। (অর্থাৎ নিছক শিশু সন্তানের গায়ের রং তাকে সন্দেহের মধ্যে নিক্ষেপ করেছিল। নয়তো তার দৃষ্টিতে স্ত্রীর ওপর যিনার অপবাদ লাগাবার অন্য কোন কারণ ছিল না।) রসূলুল্লাহ্ ﷺ জিজ্ঞেস করেন, তোমার তো কিছু উট আছে? সে বলে, হ্যাঁ, আছে। জিজ্ঞেস করেন, সেগুলোর রং কি? জবাব দেয় লাল। জিজ্ঞেস করেন, তাদের মধ্যে কোনটা কি খাকি রংয়ের আছে? জবাব দেয়, জি হ্যাঁ, কোন কোনটা এমনও আছে। জিজ্ঞেস করেন, এ রংটি কোথায় থেকে এলো? জবাব দেয়, হয়তো কোন শিরা টেনে নিয়ে গেছে। (অর্থাৎ তাদের বাপ-দাদাদের কেউ এ রংয়ের থেকে থাকবে এবং তার প্রভাব এর মধ্যে এসে গেছে।) তিনি বলেন, “সম্ভবত এ শিশুটিকেও কোন শিরা টেনে নিয়ে গেছে।” তারপর তিনি তাকে সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করার অনুমতি দেননি। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ ও আবুদ দাউদ।)
আবু হুরাইরার (রাঃ) অন্য একটি রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে, নবী ﷺ লি’আন সম্পর্কিত আয়াত আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, “যে স্ত্রী কোন বংশে এমন সন্তান প্রবেশ করায় যে ঐ বংশের নয় (অর্থাৎ হারামের শিশু গর্ভে ধারণ করে স্বামীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়) তার আল্লাহর সাথে কোন সম্পর্ক নেই। আল্লাহ তাকে কখ্খনো জান্নাতে প্রবেশ করাবেন না। আর যে পুরুষ নিজের সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করে অথচ সন্তান তাকে দেখছে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাকে পর্দা করবেন এবং পূর্বের ও পরের সমস্ত সৃষ্টির সামনে তাকে লাঞ্ছিত করবেন। (আবু দাউদ, নাসাঈ ও দারেমী।)
লি’আনের আয়াত এবং এ হাদীসগুলো, নজিরসমূহ ও শরীয়াতের সাধারণ মূলনীতিগুলোই হচ্ছে ইসলামের লি’আনের আইনের উৎস। এগুলোর আলোকে ফকীহগণ লি’আনের বিস্তারিত আইন-কানুন তৈরী করেছেন। এ আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো হচ্ছেঃ
একঃ যে ব্যক্তি স্ত্রীর ব্যভিচার স্বচক্ষে দেখে লি’আনের পথ অবলম্বন না করে হত্যা করে বসে তার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। একটি দল বলে, তাকে হত্যা করা হবে। কারণ নিজের উদ্যোগে ‘হদ’ জারি করার তথা আইন হাতে তুলে নেয়ার অধিকার তার ছিল না। দ্বিতীয় দল বলে, তাকে হত্যা করা হবে না এবং তার কর্মের জন্য তাকে জবাবদিহিও করতে হবে না, তবে এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে তার দাবীর সত্যতা প্রমাণিত হতে হবে (অর্থাৎ যথার্থই সে তার যিনার কারণে এ কাজ করেছে)। ইমাম আহমাদ ও ইসহাক ইবনে রাহ্ওয়াইহ্ বলেন, এটিই হত্যার কারণ এ মর্মে তাকে দু’জন সাক্ষী আনতে হবে। মালেকীদের মধ্যে ইবনুল কাসেম ও ইবনে হাবীব এ মর্মে অতিরিক্ত শর্ত আরোপ করেন যে, যাকে হত্যা করা হয়েছে সেই যিনাকারীর বিবাহিত হতে হবে। অন্যথায় কুমার যিনাকারীকে হত্যা করলে তার কাছ থেকে কিসাস নেয়া হবে। কিন্তু অধিকাংশ ফকীহের মতে তাকে কিসাস থেকে শুধুমাত্র তখনই মাফ করা হবে যখন সে যিনার চারজন সাক্ষী পেশ করবে অথবা নিহত ব্যক্তি মরার আগে নিজ মুখে একথা স্বীকার করে যাবে যে, সে তার স্ত্রীর সাথে যিনা করছিল এবং এ সঙ্গে নিহত ব্যক্তিকে বিবাহিতও হতে হবে। (নাইলুল আওতার, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ২২৮ পৃষ্ঠা)।
দুইঃ ঘরে বসে লি’আন হতে পারে না। এজন্য আদালতে যাওয়া জরুরী। তিনঃ লি’আন দাবী করার অধিকার শুধু স্বামীর নয়, স্ত্রীরও। স্বামী যখন তার ওপর যিনার অপবাদ দেয় অথবা তার শিশুর বংশধারা মেনে নিতে অস্বীকার করে তখন স্ত্রী আদালতে গিয়ে লি’আন দাবী করতে পারে।
চারঃ সব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কি লি’আন হতে পারে অথবা এজন্য তাদের দু’জনের মধ্যে কিছু শর্ত পাওয়া যেতে হবে? এ বিষয়ে ফকীহদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। ইমাম শাফেঈ বলেন, যার কসম আইনের দিক দিয়ে নির্ভরযোগ্য এবং যার তালাক দেবার ক্ষমতা আছে সে লি’আনের যোগ্যতা সম্পন্ন হবার জন্য যথেষ্ট। এক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী মুসলিম বা কাফের, গোলাম বা স্বাধীন, গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্যের অধিকারী হোক বা না হোক এবং মুসলিম স্বামীর স্ত্রী মুসলমান বা জিম্মি যেই হোক না কেন তাতে কিছু আসে যায় না। প্রায় একই ধরণের অভিমত ইমাম মালেক ও ইমাম আহমাদেরও। কিন্তু হানাফীগণ বলেন, লি’আন শুধুমাত্র এমন স্বাধীন মুসলমান স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হতে পারে যারা কাযাফের অপরাধে শাস্তি পায়নি। যদি স্বামী ও স্ত্রী দু’জনই কাফের, গোলাম বা কাযাফের অপরাধে পূর্বেই শাস্তি প্রাপ্ত হয়ে থাকে, তাহলে তাদের মধ্যে লি’আন হতে পারে না। এছাড়াও যদি স্ত্রী এর আগেও কখনো হারাম বা সন্দেহযুক্ত পদ্ধতিতে কোন পুরুষের সাথে মাখামাখি করে থাকে, তাহলে এক্ষেত্রেও লি’আন ঠিক হবে না। হানাফীগনের এর শর্তগুলো আরোপ করার কারণ হচ্ছে এই যে, তাদের মতে লি’আন ও কাযাফের আইনের মধ্যে এছাড়া আর কোন পার্থক্য নেই যে, অন্য ব্যক্তি যদি ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ দেয় তাহলে তার জন্য রয়েছে ‘হদ’ আর স্বামী এ অপবাদ দিলে সে লি’আন করে অব্যাহতি লাভ করতে পারে। বাকি অন্যান্য সবদিক দিয়ে লি’আন ও কাযাফ একই জিনিস। এ দেবার যোগ্যতা নেই এমন কোন ব্যক্তিকে তারা এর অনুমতি দেয় না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাপারে হানাফীদের অভিমত দুর্বল এবং ইমাম শাফেঈ যে কথাটি বলেছেন সেটিই সঠিক। এর প্রথম কারণ হচ্ছে, কুরআন স্ত্রীর বিরুদ্ধে কাযাফের ব্যাপারটিকে কাযাফের আয়াতের একটি অংশে পরিণত করেনি বরং সেজন্য একটি স্বতন্ত্র আইন বর্ণনা করেছেন তাই তাকে কাযাফের আয়াতের শব্দাবলী থেকে আলাদা এবং উভয় হুকুমও ভিন্ন। তাই লি’আনের আয়াত থেকেই লি’আনের বিধান গ্রহণ করা উচিত। কাযাফের আয়াত থেকে নয়। যেমন কাযাফের আয়াতের শাস্তি লাভের যোগ্য হচ্ছে এমন লোক যে সতী সাধ্বী স্ত্রীর শর্ত আরোপ করা হয়নি। একটি মেয়ে কোন সময় হয়তো পাপ কাজ করেছিল, যদি পরবর্তীকালে সে তাওবা করে কোন পুরুষকে বিয়ে করে এবং তারপর তার স্বামী তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেয়, তাহলে লি’আনের আয়াত একথা বলে না যে, এ মেয়ের স্বামীকে এর বিরুদ্ধে অপবাদ দেবার বা এর সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করার ব্যাপক অনুমতি দিয়ে দাও, কারণ এর জীবন এক সময় কলুষিত ছিল। দ্বিতীয় এবং ঠিক একই পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে এই যে, স্ত্রীর বিরুদ্ধে কাযাফ ও অপরিচিতার বিরুদ্ধে কাযাফের মধ্যে আসমান যমীন ফারাক। এদের উভয়ের ব্যাপারে আইনের প্রকৃতি এক হতে পারে না। পরনারীর সাথে অন্য পুরুষের আবেগ-অনুভূত, ইজ্জত-আব্রু, সমাজ-সংস্কৃতি ও বংশ গোত্রগত কোন সম্পর্ক হতে পারে না। তার চালচলনের ব্যাপারে যদি কোন ব্যক্তির খুব বেশী আগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে তাহলে তা হবে তার সমাজকে চরিত্রহীনতা মুক্ত দেখার আবেগ থেকে। পক্ষান্তরে নিজের স্ত্রীর সাথে মানুষের সম্পর্ক এক ধরনের নয়, কয়েক ধরনের এবং অত্যন্ত গভীর। সে একাধারে তার বংশধারা, ধন-সম্পদ ও গৃহের আমানতদার। তার জীবন সঙ্গিনী। তার গোপনীয়তার সংরক্ষক। তার অত্যন্ত গভীর ও সংবেদনশীল আবেগ-অনুভূতি তার সাথে জড়িত। তার খারাপ চালচলনে মানুষের আত্মমর্যাদা, ইজ্জত, স্বার্থ ও ভবিষ্যত বংশধরদের পর সুগভীর আঘাত আসে। এ দু’টি ব্যাপার কোন্ দিক দিয়ে এক, যার ফলে উভয়ের জন্য আইনের একই প্রকৃতি হতে হবে? একজন জিম্মি অথবা গোলাম কিংবা সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্য তার স্ত্রীর ব্যাপার কি কোন স্বাধীন সাক্ষ্যদানের যোগ্য মুসলমানের ব্যাপার থেকে সামান্যতম ভিন্ন অথবা গুরুত্ব ও ফলাফলের দিক দিয়ে একটুখানিও কম? সে যদি নিজের চোখের নিজের স্ত্রীকে কারোর সাথে ডলাডলি করতে দেখতো অথবা সে যদি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতো যে, তার স্ত্রী অন্য কারোর সংস্পর্শে গর্ভবতী হয়ে গেছে, তাহলে তাকে লি’আন করার অধিকার না দেবার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে কি? আর এ অধিকার তার থেকে ছিনিয়ে নেবার পর আমাদের আইনে তার জন্য আর কি পথ আছে? কুরআন মজীদের উদ্দেশ্য তো পরিষ্কার জানা যায়। বিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে স্ত্রীর যথার্থ ব্যভিচার বা অবৈধ গর্ভধারণের ফলে একজন স্বামী এবং স্বামীর মিথ্যা অপবাদ বা সন্তানের বংশ অযথা অস্বীকারের ফলে একজন স্বামী এবং স্বামীর মিথ্যা অপবাদ বা সন্তানের বংশ অযথা অস্বীকারের ফলে একজন স্ত্রী যে জটিল সমস্যায় ভুগতে থাকে কুরআন তাদেরকে তা থেকে উদ্ধার করার জন্য একটি উপায় বের করতে চায়। এ প্রয়োজন শুধুমাত্র সাক্ষ্যদানের যোগ্য স্বাধীন মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট নয় এবং কুরআনের শব্দাবলীর মধ্যেও এমন কোন জিনিস নেই যা এ প্রয়োজনটি শুধুমাত্র তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে। তবে কুরআন লি’আনের কসমকে সাক্ষ্যদান হিসেবে গণ্য করেছে তাই সাক্ষ্যদানের শর্তাবলী এখানে আরোপিত হবে, এ যুক্তি পেশ করলে এর দাবী হবে, ন্যায়নিষ্ঠ গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্যের অধিকারী স্বামী যদি কসম খায় এবং স্ত্রী কসম খেতে ইতস্তত করে তাহলে স্ত্রীকে রজম করা হবে। কারণ ব্যভিচারের ওপর সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। কিন্তু বিস্ময়কর হচ্ছে, এ অবস্থায় হানাফীগণ রজম করার হুকুম দেন না। তারা নিজেরাই যে এ কসমগুলোকে হুবহু সাক্ষ্যের মর্যাদা দান করেন না এটা তারই সুস্পষ্ট প্রমাণ। বরং সত্য বলতে কি স্বয়ং কুরআনও এ কসমগুলোকে সাক্ষ্য শব্দের মাধ্যমে ব্যক্ত করল এগুলোকে সাক্ষ্য গণ্য করে না। নয়তো স্ত্রীকে চারটি কসমের পরিবর্তে আটটি কসম খাবার হুকুম দিতো।
পাঁচঃ নিছক ইশারা-ইঙ্গিত, রূপক, উপমা বা সন্দেহ-সংশয় প্রকাশের ফলে লি’আন অনিবার্য হয়ে পড়ে না। বরং কেবলমাত্র এমন অবস্থায় তা অনিবার্য হয় যখন স্বামী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় যিনার অপবাদ দেয় অথবা সুস্পষ্ট ভাষায় সন্তানকে নিজের বলে মেনে নিতে অস্বীকার করে। ইমাম মালেক ও লাইস ইবনে সা’দ এর ওপর আরো এ শর্তটি বাড়ান যে, কসম খাবার সময় স্বামীকে বলতে হবে, সে নিজের চোখে স্ত্রীকে ব্যভিচারে রত থাকতে দেখেছে। কিন্তু এটি একটি ভিত্তিহীন শর্ত। কুরআনে এর কোন ভিত্তি নেই, হাদীসেও নেই।
ছয়ঃ যদি অপবাদ দেবার পর স্বামী কসম খেতে ইতস্তত করে বা ছলনার আশ্রয় নেয় তাহলে ইমাম আবু হানীফা ও তাঁর সহযোগীগণ বলেন, তাকে বন্দী করতে হবে এবং যতক্ষণ সে লি’আন না করে অথবা নিজের অপবাদকে মিথ্যা বলে না মেনে নেয় ততক্ষণ তাকে মুক্তি দেয়া হবে না। আর মিথ্যা বলে মেনে নিলে তার বিরুদ্ধে কাযাফের দণ্ড জারি হয়ে যাবে। এর বিপরীতপক্ষে ইমাম মালেক, শাফেঈ, হাসান ইবনে, সালেহ ও লাইস ইবনে সা’দের মতে, লি’আন করতে ইতস্তত করার ব্যাপারটি নিজেই মিথ্যার স্বীকারোক্তি। তাই কাযাফের হদ্ ওয়াজিব হয়ে যায়।
সাতঃ স্বামীর কসম খাওয়ার পর স্ত্রী যদি লি’আন করতে ইতস্তত করে, তাহলে হানাফীদের মতে তাকে বন্দী করতে হবে এবং ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে মুক্তি দেয়া যাবে না যতক্ষণ না সে লি’আন করবে অথবা তারপর যিনার স্বীকারোক্তি না করে নেবে। অন্যদিকে উপরোক্ত ইমামগণ বলেন, এ অবস্থায় তাকে রজম করে দেয়া হবে। তারা কুরআনের ঐ উক্তি থেকে পেশ করেন যে, একমাত্র কসম খাওয়ার পরই স্ত্রী শাস্তি মুক্ত হবে। এখন যেহেতু সে কসম খাচ্ছে না, তাই নিশ্চিতভাবেই সে শাস্তি যোগ্য হবে। কিন্তু এ যুক্তির দুর্বলতা হচ্ছে, কুরআন এখানে “শাস্তির’ ধরণ বলে দেয়নি বরং সাধারণভাবে শাস্তির কথা বলছে। যদি বলা হয়, শাস্তি মানে এখানে যিনার শাস্তিই হতে পারে, তাহলে এর জবাব হচ্ছে, যিনার শাস্তির জন্য কুরআন সুস্পষ্ট ভাষায় চার জন সাক্ষীর শর্ত আরোপ করেছে। নিছক এক জনের চারটি কসম এ শর্ত পূরা করতে পারে না। স্বামীর কসম তো তার নিজের কাযাফের শাস্তি থেকে বেঁচে যাওয়া এবং স্ত্রীর ওপর লি’আনের বিধান প্রবর্তিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট কিন্তু তার মাধ্যমে স্ত্রীর বিরুদ্ধে যিনার অপবাদ প্রমাণিত হবার জন্য যথেষ্ট নয়। স্ত্রীর জবাবী কসম খেতে অস্বীকার করার ফলে অবশ্যই সন্দেহ সৃষ্টি করে দেয় এবং বড়ই গভীর সন্দেহ সৃষ্টি করে সত্য কিন্তু সন্দেহের ভিত্তিতে হদ জারী করা যেতে পারে না। এ বিষয়টিকে পুরুষের কাযাফের হদের সাথে তুলনা করা উচিত নয়। কারণ তার কাযাফ তো প্রমাণিত, এ কারণেই তাকে লি’আন করতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু এর বিপরীতে স্ত্রীর ওপর যিনার অপবাদ প্রমাণিত হয়। কারণ তার নিজের স্বীকারোক্তি অথবা চারজন স্বচক্ষে প্রত্যক্ষকারী সাক্ষীর সাক্ষ্য ছাড়া তা প্রমাণিত হতে পারে না।
আটঃ যদি লি’আনের সময় স্ত্রী গর্ভবর্তী থাকে তাহলে ইমাম আহমাদের মতে স্বামী গর্ভস্থিত সন্তানকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করুক বা না করুক স্বামীর গর্ভস্থিত সন্তানের দায়মুক্ত হবার এবং সন্তান তার ঔরসজাত গণ্য না হবার জন্য লি’আন নিজেই যথেষ্ট। ইমাম শাফেঈ বলেন, স্বামীর যিনার অপবাদ ও গর্ভস্থিত সন্তানের দায়িত্ব অস্বীকার করা এক জিনিস নয়। এজন্য স্বামী যতক্ষণ গর্ভস্থিত সন্তানের দায়িত্ব গ্রহণ করতে সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার না করবে ততক্ষণ তা যিনার অপবাদ সত্ত্বেও তার ঔরসজাত গণ্য হবে। কারণ স্ত্রী যিনাকারীনী হওয়ার ফলেই বর্তমান গর্ভজাত সন্তানটি যে, যিনার কারণে জন্ম নিয়েছে, এটা অপরিহার্য নয়।
নয়ঃ ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমাদ স্ত্রীর গর্ভধারণকালে স্বামীকে গর্ভস্থিত সন্তান অস্বীকার করার অনুমতি দিয়েছেন এবং এরই ভিত্তিতে লি’আনকে বৈধ বলেন। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা বলেন, যদি স্বামীর অপবাদের ভিত্তি যিনা না হয়ে থাকে বরং শুধু এটাই হয়ে থাকে যে, সে স্ত্রীকে এমন অবস্থায় গর্ভবতী পেয়েছ যখন তার মতে এ গর্ভস্থিত সন্তান তার হতে পারে না তখন এ অবস্থায় লি’আনের বিষয়টিকে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত মূলতবী করে দেয়া উচিত। কারণ অনেক সময় কোন কোন রোগের ফলে গর্ভ সঞ্চার হয়েছে বলে সন্দেহ দেখা দেয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গর্ভসঞ্চার হয় না।
দশঃ যদি পিতা সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করে তাহলে লি’আন অনিবার্য হয় পড়ে, এ ব্যাপারে সবাই একমত। আবার এ ব্যাপারেও সবাই একমত যে, একবার সন্তানকে গ্রহণ করে নেবার পর (সে গ্রহণ করাটা যে কোন পর্যায়েরই হোক না কে, সুস্পষ্ট শব্দাবলী ও বাক্যের মাধ্যমে গ্রহণ করা হোক অথবা এমন কাজ করা হোক যাতে মনে হয় শিশুকে গ্রহণ করে নেয়া হয়েছে যেমন, জন্মের পর মোবারকবাদ গ্রহণ করা অথবা শিশুর সাথে পিতৃসুলভ স্নেহপূর্ণ ব্যবহার করা কিংবা তার প্রতিপালনের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করা) পিতার পক্ষে আর তার বংশধারা অস্বীকার করার অধিকার থাকে না। এ অবস্থায় পিতা বংশধারা অস্বীকার করলে কাযাফের শাস্তির অধিকারী হবে। তবে পিতা কতক্ষণ পর্যন্ত বংশধারা অস্বীকার করার অধিকার রাখে, এ ব্যাপারে মতভেদ আছে। ইমাম মালেকের মতে, স্ত্রী যে সময় গর্ভবতী ছিল সে সময় যদি স্বামী গৃহে উপস্থিত থেকে থাকে তাহলে গর্ভসঞ্চারের সময় থেকে নিয়ে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত সময়-কালের মধ্যে স্বামীর জন্য সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করার সুযোগ আছে। এরপর তার অস্বীকার করার অধিকার নেই। তবে এ সময় যদি সে অনুপস্থিত থেকে থাকে এবং তার অসাক্ষাতে সন্তান জন্ম নিয়ে থাকে তাহলে যখনই সে জানবে তখন তাকে অস্বীকার করে তাহলে লি’আন করে সন্তানের দায়িত্ব মুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু যদি এক-দু’বছর পরে অস্বীকার করে তাহলে লি’আন হবে ঠিকই কিন্তু সন্তানের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হতে পারবে না। ইমাম আবু ইউসুফের মতে, শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পরে বা জন্ম সম্পর্ক জানার পরে চল্লিশ দিনের মধ্যে পিতার বংশধারা অস্বীকার করার অধিকার আছে। এরপর এ অধিকার বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু এ চল্লিশ দিনের শর্ত অর্থহীন। সঠিক কথা সেটিই যেটি ইমাম আবু হানীফা বলেছেন। অর্থাৎ জন্মের পর বা জন্মের কথা জানার পর এক-দু’দিনের মধ্যেই বংশধারা অস্বীকার করা যেতে পারে। তবে যদি এক্ষেত্রে কোন বাধা থাকে, যাকে যথার্থ বাধা বলে স্বীকার করে নেয়া যেতে পারে, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা।
এগারঃ যদি স্বামী তালাক দেবার পর সাধারণভাবে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর বিরুদ্ধে যিনার অপবাদ দেয় তাহলে ইমাম আবু হানীফার মতে লি’আন হবে না। বরং তার বিরুদ্ধে কাযাফের মামলা দায়ের করা হবে। কারণ লি’আন হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর জন্য। আর তালাকপ্রাপ্তা নারীটি তার স্ত্রী নয়। তবে যদি রজ’ঈ তালাক হয় এবং রুজু (স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেবার) করার সময়-কালের মধ্যে সে অপবাদ দেয়, তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু ইমাম মালেকের মতে, এটি শুধুমাত্র এমন অবস্থায় কাযাফ হবে যখন কোন গর্ভস্থিত বা ভূমিষ্ঠ সন্তানের বংশধারা গ্রহণ করা বা না করার সমস্যা মাঝখানে থাকবে না। অন্যথায় বায়েন তালাক দেবার পরও পুরুষের লি’আন করার অধিকার থাকে। কারণ সে স্ত্রী লোককে বদনাম করার জন্য নয় বরং নিজেই এমন এক শিশুর দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি লাভের উদ্দেশ্যে লি’আন করছে যাকে সে নিজের বলে মনে করে না। ইমাম শাফেঈ প্রায় এই একই মত দিয়েছেন।
বারঃ লি’আনের আইনগত ফলাফলের মধ্য থেকে কোনটার ব্যাপারে সবাই একমত আবার কোনটার ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছে।
যেসব ফলাফলের ব্যাপারে মতৈক্য হয়েছে সেগুলো হচ্ছেঃ স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই কোন শাস্তি লাভের উপযুক্ত হয় না। স্বামী যদি সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করে তাহলে সন্তান হবে একমাত্র মায়ের। সন্তান বাপের সাথে সম্পর্কিত হবে না এবং তার উত্তরাধিকারীও হবে না। মা তার উত্তরাধিকারী হবে এবং সে মায়ের উত্তরাধিকারী হবে। নারীকে ব্যভিচারিণী এবং তার সন্তানকে জারজ সন্তান বলার অধিকার কারোর থাকবে না। যদিও লি’আনের সময় তার অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যার ফলে তার ব্যভিচারিণী হবার ব্যাপারে কারোর মনে সন্দেহ না থাকে তবুও তার সন্তানের বিরুদ্ধে আগের অপবাদের পুনরাবৃত্তি করবে সে ‘হদে’র যোগ্য হবে। নারীর মোহরানা বাতিল হয়ে যাবে না। ইদ্দত পালনকালে নারী পুরুষের থেকে খোরপোশ ও বাসস্থানের সুবিধা লাভের হকদার হবে না। নারী ঐ পুরুষের জন্য হারাম হয়ে যাবে।
দু’টি বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। এক, লি’আনের পরে পুরুষ ও নারী কিতাবে আলাদা হবে? দুই, লি’আনের ভিত্তিতে আলাদা হয়ে যাবার পর কি তাদের উভয়ের আবার মিলিত হওয়া সম্ভব? প্রথম বিষয়ে ইমাম শাফেঈ বলেন, যখনই পুরুষ লি’আন শেষ করবে, নারী জবাবী লি’আন করুক বা না করুক তখনই সঙ্গে সঙ্গেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। ইমাম মালেক, লাইস ইবনে সা’দ ও যুফার বলেন, পুরুষ ও নারী উভয়েই যখন লি’আন শেষ করে তখন ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। অন্যদিকে ইমাম আবু হানিফা, আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ বলেন, লি’আনের ফলে ছাড়াছাড়ি আপনা আপনি হয়ে যায় না বরং আদালত ছাড়াছাড়ি করে দেবার ফলেই ছাড়াছাড়ি হয়। যদি স্বামী নিজেই তালাক দিয়ে দেয় তাহলে ভালো, অন্যথায় আদালতের বিচারপতি তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করার কথা ঘোষণা করবেন। দ্বিতীয় বিষয়টিতে ইমাম মালেক, আবু ইউসুফ, যুফার, সুফিয়ান সওরী, ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ, শাফেঈ, আহমেদ ইবনে হাম্বল ও হাসান ইবনে যিয়াদ বলেন, লি’আনের মাধ্যমে যে স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে গেছে তারা এরপর থেকে চিরকালের জন্য পরস্পরের ওপর হারাম হয়ে যাবে। তারা পুনর্বার পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইলেও কোন অবস্থাতেই পারবে না। হযরত উমর (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদও (রাঃ) একই মত পোষণ করেন। বিপরীতপক্ষে সা’ঈদ ইবনে মুসাইয়েব, ইবরাহীম নাখঈ, শা’বী, সাঈদ ইবনে জুবাইর, আবু হানীফা ও মুহাম্মাদ রাহেমাহুমুল্লাহর মতে, যদি স্বামী নিজের মিথ্যা স্বীকার করে নেয় এবং তার ওপর কাযাফের হদ জারি হয়ে যায় তাহলে তাদের দু’জনের মধ্যে পুনর্বার বিয়ে হতে পারে। তারা বলেন, তাদের উভয়কে পরস্পরের জন্য হারামকারী জিনিস হচ্ছে লি’আন। যতক্ষণ তারা এর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে ততক্ষণ হারামও প্রতিষ্ঠিত থাকবে কিন্তু যখনই স্বামী নিজের মিথ্যা স্বীকার করে নিয়ে শাস্তি লাভ করবে তখনই লি’আন খতম হয়ে যাবে এবং হারামও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।