আয়াত
৪১ ) তুমি ৭৪ কি দেখনা, আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করেছে যারা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে আছে তারা সবাই এবং যে পাখির ডানা বিস্তার করে আকাশে ওড়ে? প্রত্যেকেই জানে তার নামাযের ও পবিত্রতা বর্ণনা করার পদ্ধতি। আর এরা যা কিছু করে আল্লাহ তা জানেন।
أَلَمْ تَرَ أَنَّ ٱللَّهَ يُسَبِّحُ لَهُۥ مَن فِى ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ وَٱلطَّيْرُ صَٰٓفَّٰتٍ كُلٌّ قَدْ عَلِمَ صَلَاتَهُۥ وَتَسْبِيحَهُۥ وَٱللَّهُ عَلِيمٌۢ بِمَا يَفْعَلُونَ ٤١
৪২ ) আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর রাজত্ব আল্লাহরই এবং তাঁরই দিকে সবাইকে ফিরে যেতে হবে।
وَلِلَّهِ مُلْكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ وَإِلَى ٱللَّهِ ٱلْمَصِيرُ ٤٢
৪৩ ) তুমি কি দেখ না, আল্লাহ মেঘমালাকে ধীর গতিতে সঞ্চালন করেন, তারপর তার খণ্ডগুলোকে পরস্পর সংযুক্ত করেন, তারপর তাকে একত্র করে একটি ঘন মেঘে পরিণত করেন, তারপর তুমি দেখতে পাও তার খোল থেকে বৃষ্টি বিন্দু একাধারে ঝরে পড়ছে। আর তিনি আকাশ থেকে তার মধ্যে সমুন্নত পাহাড়গুলোর বদৌলতে ৭৫ শিলা বর্ষণ করেন, তারপর যাকে চান এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত করেন এবং যাকে চান এর হাত থেকে বাঁচিয়ে নেন। তার বিদ্যুৎ চমক চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।
أَلَمْ تَرَ أَنَّ ٱللَّهَ يُزْجِى سَحَابًا ثُمَّ يُؤَلِّفُ بَيْنَهُۥ ثُمَّ يَجْعَلُهُۥ رُكَامًا فَتَرَى ٱلْوَدْقَ يَخْرُجُ مِنْ خِلَٰلِهِۦ وَيُنَزِّلُ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مِن جِبَالٍ فِيهَا مِنۢ بَرَدٍ فَيُصِيبُ بِهِۦ مَن يَشَآءُ وَيَصْرِفُهُۥ عَن مَّن يَشَآءُ يَكَادُ سَنَا بَرْقِهِۦ يَذْهَبُ بِٱلْأَبْصَٰرِ ٤٣
৪৪ ) তিনিই রাত-দিনের পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন। দৃষ্টি সম্পন্নদের জন্য এর মধ্যে রয়েছে একটি শিক্ষা।
يُقَلِّبُ ٱللَّهُ ٱلَّيْلَ وَٱلنَّهَارَ إِنَّ فِى ذَٰلِكَ لَعِبْرَةً لِّأُو۟لِى ٱلْأَبْصَٰرِ ٤٤
৪৫ ) আর আল্লাহ প্রত্যেক প্রাণ বিশিষ্টকে এক ধরনের পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন। তাদের মধ্য থেকে কেউ চলছে পেটে ভর দিয়ে, কেউ চলছে দু’পায়ে হেঁটে আবার কেউ চারপায়ে ভর দিয়ে। যা কিছু তিনি চান পয়দা করেন, তিনি প্রত্যেক জিনিসের ওপর শক্তিশালী।
وَٱللَّهُ خَلَقَ كُلَّ دَآبَّةٍ مِّن مَّآءٍ فَمِنْهُم مَّن يَمْشِى عَلَىٰ بَطْنِهِۦ وَمِنْهُم مَّن يَمْشِى عَلَىٰ رِجْلَيْنِ وَمِنْهُم مَّن يَمْشِى عَلَىٰٓ أَرْبَعٍ يَخْلُقُ ٱللَّهُ مَا يَشَآءُ إِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ ٤٥
৪৬ ) আমি পরিষ্কার সত্য বিবৃতকারী আয়াত নাযিল করে দিয়েছি তবে আল্লাহই যাকে চান সত্য সরল পথ দেখান।
لَّقَدْ أَنزَلْنَآ ءَايَٰتٍ مُّبَيِّنَٰتٍ وَٱللَّهُ يَهْدِى مَن يَشَآءُ إِلَىٰ صِرَٰطٍ مُّسْتَقِيمٍ ٤٦
৪৭ ) তারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহ ও রসূলের প্রতি এবং আমরা আনুগত্য স্বীকার করেছি কিন্তু এরপর তাদের মধ্য থেকে একটি দল (আনুগত্য থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয়। এ ধরনের লোকেরা কখনোই মু’মিন নয়। ৭৬
وَيَقُولُونَ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَبِٱلرَّسُولِ وَأَطَعْنَا ثُمَّ يَتَوَلَّىٰ فَرِيقٌ مِّنْهُم مِّنۢ بَعْدِ ذَٰلِكَ وَمَآ أُو۟لَٰٓئِكَ بِٱلْمُؤْمِنِينَ ٤٧
৪৮ ) যখন তাদেরকে ডাকা হয় আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দিকে, যাতে রসূল তাদের পরস্পররে মোকদ্দমার ফায়সালা করে দেন ৭৭ তখন তাদের মধ্যকার একটি দল পাশ কাটিয়ে যায়। ৭৮
وَإِذَا دُعُوٓا۟ إِلَى ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ إِذَا فَرِيقٌ مِّنْهُم مُّعْرِضُونَ ٤٨
৪৯ ) তবে যদি সত্য তাদের অনুকূল থাকে, তাহলে বড়ই বিনীত হয়ে রসূলের কাছে আসে। ৭৯
وَإِن يَكُن لَّهُمُ ٱلْحَقُّ يَأْتُوٓا۟ إِلَيْهِ مُذْعِنِينَ ٤٩
৫০ ) তাদের মনে কি (মুনাফিকীর) রোগ আছে? না তারা সন্দেহের শিকার হয়েছে? না তারা ভয় করছে আল্লাহ ও তাঁর রসূল তাদের প্রতি যুলুম করবেন? আসলে তারা নিজেরাই যালেম। ৮০
أَفِى قُلُوبِهِم مَّرَضٌ أَمِ ٱرْتَابُوٓا۟ أَمْ يَخَافُونَ أَن يَحِيفَ ٱللَّهُ عَلَيْهِمْ وَرَسُولُهُۥ بَلْ أُو۟لَٰٓئِكَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ ٥٠
৭৪.
ওপরে বলা হয়েছে, আল্লাহ সমগ্র-জাহানের আলো কিন্তু একমাত্র সৎ মু’মিনরাই এ আলো লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন, বাদবাকি সব লোকেরাই এ পূর্ণাঙ্গ আলোর দ্বারা পরিবেষ্টিত থেকেও ঘোর অন্ধকারে অন্ধের মতো হাতড়ে মরে। এখন এ আলোর দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য অসংখ্য নিদর্শনের মধ্যে নমুনা স্বরূপ মাত্র কয়েকটি এখানে পেশ করা হচ্ছে। মনের চোখ খুলে কেউ সেগুলোর দিকে তাকালে সবসময় সবদিকে আল্লাহকেই সক্রিয় দেখতে পাবে। কিন্তু যাদের মনের চোখ অন্ধ তারা কপালের দুটো চোখ বিস্ফোরিত করে দেখলেও জীববিদ্যা ও প্রাণীবিদ্যার বিভিন্ন রকম বিদ্যা তাদের চোখে ভালমতোই সক্রিয় রয়েছে বলে তাদের চোখে ঠেকবে কিন্তু আল্লাহকে কোথাও সক্রিয় দেখতে পাবে না।
৭৫.
এর অর্থ ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া মেঘপুঞ্জও হতে পারে রূপক অর্থে একেই হয়তো আকাশের পাহাড় বলা হয়েছে। আবার পৃথিবীর পাহাড়ও হতে পারে, যা শূন্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এগুলোর চূড়ায় জমে থাকা বরফের প্রভাবে অনেক সময় বাতাস এত বেশী ঠাণ্ডা হয়ে যায় যে, মেঘমালা জমে গিয়ে শিলা বৃষ্টি হতে থাকে।
৭৬.
অর্থাৎ আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়াই তাদের ঈমানের দাবী মিথ্যা প্রমাণ করে দেয়। তাদের এহেন কার্যকলাপ থেকে বুঝা যায় যে, তারা যখন বলেছে আমরা ঈমান এনেছি ও আনুগত্য স্বীকার করেছি তখন তারা অসত্য বলেছে।
৭৭.
এ শব্দগুলো পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে, রসূলের ফায়সালা হচ্ছে আল্লাহর ফায়সালা এবং তাঁর হুকুম আল্লাহরই হুকুমের নামান্তর মাত্র। রসূলের দিকে আহবান করা নিছক রসূলের দিকেই আহবান করা নয় বরং আল্লাহ ও রসূল উভয়েরই দিকে আহবান করা। তাছাড়া এ আয়াতটি এবং ওপরের আয়াতটি থেকে একথা নিঃসন্দেহে পুরোপুরি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য ছাড়া ঈমানের দাবী অর্থহীন এবং আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্যের এছাড়া আর কোন অর্থ নেই যে, মুসলমান ব্যক্তি ও জাতি হিসেবে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দেয়া আইনের অনুগত হবে। সে যদি এ কর্মনীতি অবলম্বন না করে, তাহলে তার ঈমানের দাবী একটি মুনাফিকী দাবী ছাড়া আর কিছুই নয়। (তুলনামূলক অধ্যয়নের জন্য সূরা নিসা ৫৯-৬১ আয়াত ৮৯-৯২ টীকা সহকারে দেখুন)।
৭৮.
উল্লেখ্য, এ ব্যাপারটি কেবল মাত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনেরই জন্য ছিল না বরং তারপর যিনিই ইসলামী রাষ্ট্রের বিচারকের পদে আসীন থাকেন এবং আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাত অনুযায়ী ফায়সালা দেন তাঁর আদালতের সমন হচ্ছে আসলে আল্লাহ ও রসূলের আদালতের সমন এবং যে ব্যক্তি তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সে মূলত তা থেকে নয় বরং আল্লাহ ও রসূলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি মুরসাল হাদীসে এ বিষয়ে এ ব্যাখ্যাই বর্ণিত হয়েছে। হাসান বস্রী রহমাতুল্লাহে আলাইহে এ হাদীসটি রেওয়ায়াত করেছেন। হাদীসটি হচ্ছেঃ
مَنْ دُعِىَ إِلَى حَاكِمٍ مِنْ حُكَّامِ الْمُسْلِمِينَ فَلَمْ يُجِبْ فَهُوَ ظَالِمٌ لاَ حَقَّ لَهُ
“যে ব্যক্তিকে মুসলমানদের আদালতের বিচারপতিদের মধ্য থেকে কোন বিচারপতির কাছে ডাকা হয় এবং সে হাজির হয় না সে জালেম, তার কোন অধিকার নেই।” (আহকামুল কুরআন-জাস্সাস, ৩ খণ্ড, ৪০৫ পৃষ্ঠা)
অন্য কথায় এ ধরনের লোক শাস্তি লাভের যোগ্য আবার এ সঙ্গে তাকে অন্যায়কারী প্রতিপন্ন করে তার বিরুদ্ধে একতরফা ফায়সালা দিয়ে দেয়াও ন্যায়সঙ্গত।
৭৯.
এ আয়াতটি পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করছে যে, শরীয়াতের লাভজনক কথাগুলোকে যে ব্যক্তি সানন্দে গ্রহণ করে নেয় কিন্তু আল্লাহর শরীয়াতে যা কিছু তার স্বার্থ ও আশা-আকাংখার বিরোধী হয় তাকে সে প্রত্যাখ্যান করে এবং তার মোকাবিলায় দুনিয়ার অন্যান্য আইনকে প্রাধান্য দেয়, সে মু’মিন নয় বরং মুনাফিক। তার ঈমানের দাবী মিথ্যা। কারণ সে আল্লাহ ও রসূলের প্রতি ঈমান রাখে না বরং ঈমান রাখে নিজের স্বার্থ ও প্রবৃত্তির ওপর। এ নীতি অবলম্বন করে এর সাথে সাথে সে যদি আল্লাহর শরীয়াতের কোন অংশকে মেনেও নেয়, তাহলে আল্লাহর দৃষ্টিতে এ ধরনের মেনে নেয়ার কোন মূল্য ও মর্যাদা নেই।
৮০.
অর্থাৎ মানুষের এ কর্মনীতি অবলম্বনের পেছনে তিনটি সম্ভাব্য কারণই থাকতে পারে। এক, যে মানুষটি ঈমানের দাবীদার সে আসলে ঈমানই আনেনি এবং মুনাফিকী পদ্ধতিতে নিছক ধোঁকা দেবার এবং মুসলিম সমাজে প্রবেশ করে অবৈধ স্বার্থলাভের জন্য মুসলমান হয়েছে। দুই, ঈমান আনা সত্ত্বেও তার মনে এ মর্মে সন্দেহ রয়ে গেছে যে, রসূল আসলে আল্লাহর রসূল কি না, কুরআন আল্লাহর কিতাব কি না এবং কেয়ামত সত্যি সত্যিই অনুষ্ঠিত হবে কি না অথবা এগুলো সবই নিছক মুখরোচক গালপল্প বরং আসলে আল্লাহর অস্তিত্ব আছে কি অথবা এটাও নিছক একটা কল্পনা, কোন বিশেষ স্বার্থোদ্বারের উদ্দেশ্যে এ কাল্পনিক বিষয়টি তৈরী করে নেয়া হয়েছে। তিন, সে আল্লাহকে আল্লাহ এবং রসূলকে রসূল বলে মেনে নেবার পরও তাঁদের পক্ষ থেকে জুলুমের আশঙ্কা করে। সে মনে করে আল্লাহর কিতাব অমুক হুকুমটি দিয়ে তো আমাদের বিপদে ফেলে দিয়েছে এবং আল্লাহর রসূলের অমুক উক্তি বা অমুক পদ্ধতি আমাদের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। এ তিনটি কারণের মধ্যে যেটিই সত্য হোক না কেন, মোটকথা এ ধরনের লোকদের জালেম হবার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এ ধরনের চিন্তা সহকারে যে ব্যক্তি মুসলমানদের দলভুক্ত হয়, ঈমানের দাবী করে এবং মুসলিম সমাজের একজন সদস্য সেজে এ সমাজ থেকে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ স্বার্থ হাসিল করতে থাকে, সে একজন বড় দাগাবাজ, বিশ্বাসঘাতক, খেয়ানতকারী ও জালিয়াত। সে নিজের ওপরও জুলুম করে। রাত-দিন মিথ্যাচারের মাধ্যমে নিজেকে সে সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্বভাবের মানুষে পরিণত করতে থাকে। সে এমন ধরনের মুসলমানদের প্রতিও যুলুম করে যারা তার বাহ্যিক কালেমায়ে শাহাদাত পাঠের ওপর নির্ভর করে তাকে এ মিল্লাতের এটি অংশ বলে মেনে নেয় এবং তারপর তার সাথে নানান ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে।