ٱلَّذِى لَهُۥ مُلْكُ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ وَلَمْ يَتَّخِذْ وَلَدًۭا وَلَمْ يَكُن لَّهُۥ شَرِيكٌۭ فِى ٱلْمُلْكِ وَخَلَقَ كُلَّ شَىْءٍۢ فَقَدَّرَهُۥ تَقْدِيرًۭا
যিনি পৃথিবী ও আকাশের রাজত্বের মালিক, ৫ যিনি কাউকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেননি, ৬ যাঁর সাথে রাজত্বে কেউ শরীক নেই, ৭ যিনি প্রত্যেকটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন তারপর তার একটি তাকদীর নির্ধারিত করে দিয়েছেন। ৮
৫
অন্য অনুবাদ এও হতে পারে, “আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্ব তাঁরই জন্য।” অর্থাৎ এটা তাঁরই অধিকার এবং তাঁরই জন্য এটা নির্দিষ্ট। অন্য কারো এ অধিকার নেই এবং এর মধ্যে কারো কোন অংশও নেই।
৬
অর্থাৎ কারো সাথে তাঁর কোন বংশীয় সম্পর্ক নেই এবং কাউকে তিনি দত্তকও নেননি। বিশ্ব-জাহানের এমন কোন সত্তা নেই, আল্লাহর সাথে যার বংশগত সম্পর্ক বা দত্তক সম্পর্কের কারণে সে মাবুদ হবার অধিকার লাভ করতে পারে। তাঁর সত্তা একান্ত একক। কেউ নেই তাঁর সমজাতীয়। আল্লাহর কোন বংশধর নেই যে, নাউযুবিল্লাহ এক আল্লাহর ঔরস থেকে কোন প্রজন্ম চালু হবে এবং একের পর এক বহু আল্লাহর জন্ম নিতে থাকবে। কাজেই যে মুশরিক সমাজ ফেরেশতা, জিন বা কোন কোন মানুষকে আল্লাহর সন্তান মনে করে তাদেরকে দেবতা ও উপাস্য গণ্য করেছে তারা পুরোপুরি মূর্খ, অজ্ঞ ও পথভ্রষ্ট। এভাবে যারা বংশীয় সম্পর্কের ভিত্তিতে না হলেও কোন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে একথা মনে করে নিয়েছে যে, বিশ্ব-জাহানের প্রভু আল্লাহ কোন ব্যক্তিকে নিজের পুত্র বানিয়ে নিয়েছেন তারাও নিরেট মূর্খতা ও ভ্রষ্টতার মধ্যে অবস্থান করছে। “পুত্র করে নেবার” এ ধারণাটিকে যেদিক থেকেই বিশ্লেষণ করা যাবে অত্যন্ত অযৌক্তিক মনে হবে। এর কোন বাস্তব ও ন্যায়সঙ্গত বিষয় হবার প্রশ্নই উঠে না। যারা এ ধারণাটি উদ্ভাবন বা অবলম্বন করে তাদের নিকৃষ্ট মানসিকতা ইলাহী সত্তার শ্রেষ্ঠত্ব কল্পনায় অক্ষম ছিল। তারা এ অমুখাপেক্ষী ও অসমকক্ষ সত্তাকে মানুষের মতো মনে করে, যে একাকীত্ব ও নির্জনতার ভয়ে ভীত হয়ে অন্য কারো শিশুকে কোলে নিয়ে নেয় অথবা স্নেহ-ভালবাসার আবেগে উদ্বেল হয়ে কাউকে নিজের ছেলে করে নেয় কিংবা সবার পরে কেউ তার উত্তরাধিকারী হবে এবং তার নাম ও কাজকে জীবিত রাখবে তাই দত্তক নেবার প্রয়োজন অনুভব করে। এ তিনটি কারণেই মানুষের মনে দত্তক নেবার চিন্তা জাগে। এর মধ্য থেকে যে কারণটিকেই আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হবে তা অবশ্যই মহামূর্খতা বেআদবী ও স্বল্পবুদ্ধিতাই প্রমাণ করবে। (আরো বেশি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কোরআন, সুরা ইউনুস, ৬৬-৬৮ টীকা)
৭
মূলে ملك শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী ভাষায় এ শব্দটি বাদশাহী, রাজত্ব, সর্বময় কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্বের (Sovereignty) অর্থে বলা হয়ে থাকে। এর অর্থ হচ্ছে, মহান আল্লাহই এ বিশ্ব-জাহানের সর্বময় কর্তৃত্বের মালিক এবং তাঁর শাসন ক্ষমতায় কারো সামান্যতমও অংশ নেই। একথার স্বতঃস্ফূর্ত ও অনিবার্য ফল এই যে, তাহলে তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। কারণ, মানুষ যাকেই মাবুদে পরিণত করে একথা মনে করেই করে যে, তার কাছে কোন শক্তি আছে যে সে আমাদের উপকার বা ক্ষতি করতে পারে এবং আমাদের ভাগ্যের উপর ভালো-মন্দ প্রভাব ফেলতে পারে। শক্তিহীন ও প্রভাবহীন সত্ত্বাদেরকে আশ্রয়স্থল করতে কোন একান্ত নির্বোধ ব্যক্তিও রাজি হতে পারে না। এখন যদি একথা জানা যায় যে, মহান আল্লাহ ছাড়া এ বিশ্ব-জাহানে আর কারো কোন শক্তি নেই তাহলে বিনয়-নম্রতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করার জন্য কোন মাথা তাঁর ছাড়া আর কারো সামনে ঝুঁকবে না, কোন হাতও তাঁর ছাড়া আর কারো সামনে নজরানা পেশ করার জন্য এগিয়ে যাবে না, কোন কণ্ঠও তাঁর ছাড়া আর কারো প্রশংসা গীতি গাইবে না বা কারো কাছে প্রার্থনা করবে না ও ভিক্ষা চাইবে না এবং দুনিয়ার কোন নিরেট মূর্খ ও অজ্ঞ ব্যক্তিও কখনো নিজের প্রকৃত ইলাহ ছাড়া আর কারো আনুগত্য ও বন্দেগী করার মতো বোকামী করবে না অথবা কারো স্বয়ংসম্পূর্ণ শাসনাধিকার মেনে নেবে না। “আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্ব তাঁরই এবং তাঁরই জন্য” ওপরের এ বাক্যাংশটি থেকে এ বিষয়বস্তুটি আরো বেশী শক্তি অর্জন করে।
৮
অন্য অনুবাদ এও হতে পারে যে, “প্রত্যেকটি জিনিসকে একটি বিশেষ পরিমাণ অনুযায়ী রেখেছেন।” অথবা প্রত্যেক জিনিসের জন্য যথাযথ পরিমাপ নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু যে কোন অনুবাদই করা হোক না কেন তা থেকে পূর্ণ অর্থ প্রকাশ হয় না। এর পূর্ণ অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ বিশ্ব-জাহানের প্রত্যেকটি জিনিসের কেবল অস্তিত্বই দান করেননি বরং তিনিই প্রত্যেকটি জিনিসকে তার সত্তার সাথে সম্পর্কিত আকার-আকৃতি, দেহ সৌষ্ঠব, শক্তি, যোগ্যতা, গুণাগুণ, বৈশিষ্ট্য, কাজ ও কাজের পদ্ধতি, স্থায়িত্বের সময়-কাল, উত্থান ও ক্রমবিকাশের সীমা এবং অন্যান্য যাবতীয় বিস্তারিত বিষয় নির্ধারণ করেছেন। তারপর যেসব কার্য-কারণ, উপায়-উপকরণ ও সুযোগ-সুবিধার বদৌলতে প্রত্যেকটি জিনিস এখানে নিজ পরিসরে নিজের উপর আরোপিত কাজ করে যাচ্ছে তা বিশ্ব-জগতে তিনিই সৃষ্টি করে দিয়েছেন।
তাওহীদের সমগ্র শিক্ষা এ একটি আয়াতের মধ্যেই ভরে দেয়া হয়েছে। এটি কুরআন মজীদের সর্বাত্মক তাৎপর্যবহ আয়াতগুলোর মধ্যে একটি মহান মর্যাদাপূর্ণ আয়াত। এর মাত্র কয়েকটি শব্দের মধ্যে এত বিশাল বিষয়বস্তু ভরে দেয়া হয়েছে যে, এর ব্যাপ্তি পরিবেষ্টন করার জন্য পুরোপুরি একটি কিতাব যথেষ্ট বিবেচিত হতে পারে না। হাদীসে বলা হয়েছেঃ كان النبى صلى الله عليه وسلم اذا افصح الغلام من بنى عبد المطلب علمه هذه الاية –
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিয়ম ছিল, তাঁর বংশের কোন শিশু যখন কথা বলা শুরু করতো তখন তিনি তাকে এ আয়াতটি শিখিয়ে দিতেন।” (মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক ও মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবাহ। আমর ইবনে শু'আইব তাঁর পিতা থেকে এবং তিনি তাঁর পিতা থেকে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)
এ থেকে জানা যায় মানুষের মনে তাওহীদের পুরোপুরি ধারণা বসিয়ে দেবার জন্য এ আয়াতটি একটি উত্তম মাধ্যম। প্রত্যেক মুসলমানের সন্তানের শৈশবে যখন বুদ্ধির প্রাথমিক উন্মেষ ঘটে তখনই তার মন-মগজে শুরুতেই এ নকশাটি বসিয়ে দেয়া উচিত।