প্রথমত হযরত মূসাকে যেসব অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেসব অবস্থার মুখোমুখি ছিলেন তার তুলনায় ছিল অনেক বেশী কঠিন। হযরত মূসা ছিলেন একটি দাস জাতির সদস্য। ফেরাউন ও তার সম্প্রদায় এ জাতিকে মারাত্মকভাবে দাবিয়ে রেখেছিল। অন্যদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন কুরাইশ সম্প্রদায়ের সদস্য। তাঁর বংশ ও পরিবার কুরাইশদের অন্যান্য বংশ ও পরিবারের সাথে পুরোপুরি সমান মর্যাদায় অবস্থান করছিল। হযরত মূসা নিজেই সেই ফেরাউনের গৃহে প্রতিপালিত হয়েছিলেন এবং একটি হত্যা অভিযোগে দশ বছর আত্মগোপন করে থাকার পর তাঁকে আবার সেই বাদশাহর দরবারে গিয়ে দাঁড়াবার হুকুম দেয়া হয়েছিল যার কাছ থেকে পালিয়ে গিয়ে তিনি প্রাণ রক্ষা করেছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ধরণের কোন নাজুক অবস্থার মুখোমুখি হননি। তাছাড়া ফেরাউনের সাম্রাজ্য ছিল সে সময় দুনিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তিশালী সাম্রাজ্য। তার সাথে কুরাইশদের শক্তির কোন তুলনায় ছিল না। এ সত্ত্বেও ফেরাউন হযরত মূসার কোন ক্ষতিই করতে পারেনি এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর সাথে সংঘর্ষ বাধিয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এ থেকে আল্লাহ কুরাইশ বংশীয় কাফেরদের এ শিক্ষা দিতে চান যে, আল্লাহ যার পৃষ্ঠপোষক থাকেন তার সাথে মোকাবেলা করে কেউ জিততে পারে না। ফেরাউনই যখন মূসার মোকাবিলায় কিছুই করতে পারেনি তখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মোকাবিলায় তোমাদের জয়লাভের কথা কল্পনাই করা যায় না।
দ্বিতীয়ত হযরত মূসার মাধ্যমে ফেরাউনকে যেসব নিদর্শন দেখানো হয়েছে তার চেয়ে বেশী সুস্পষ্ট নিদর্শন আর কি হতে পারে? তারপর হাজার হাজার লোকের সমাবেশে ফেরাউনেরই চ্যালেঞ্জ অনুযায়ী প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে যাদুকরদের সাথে মোকাবিলা করে এ কথা প্রমাণও করে দেয়া হয়েছে যে, হযরত মূসা যা কিছু দেখাচ্ছেন তা যাদু নয়। যেসব যাদুশিল্প বিশেষজ্ঞগণ ফেরাউনের নিজের সম্প্রদায়ের সাথে সম্পৃক্ত ছিল এবং যাদেরকে ফেরাউন নিজেই ডেকেছিল, তারা নিজেরাই এ সত্য স্বীকার করে নিয়েছে যে, হযরত মূসার লাঠি যে অজগরে পরিণত হয়েছিল, সে ব্যাপারটি ছিল যথার্থ ও অকৃত্রিম এবং শুধুমাত্র আল্লাহর মু’জিযার মাধ্যমেই এমনটি হতে পারে, যাদুর সাহায্যে এমনটি হওয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয়। যাদুকররা ঈমান এনে এবং নিজেদের প্রাণকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশই রাখেননি যে, হযরত মূসার পেশকৃত নিদর্শন সত্যিই মু’জিযা, যাদু নয়। কিন্তু এ ব্যাপারেও যারা হঠকারিতায় লিপ্ত ছিল তারা নবীর সত্যতা স্বীকার করেনি। এখন তোমরা কেমন করে এমন কথা বলতে পারো যে, তোমাদের ঈমান আনা আসলে কোন ইন্দ্রিয়ানুভূত মু’জিযা ও বস্তুগত নিদর্শন দেখার ওপর নির্ভরশীল? জাতীয় ও বংশগত স্বার্থ, জাহেলী বিদ্বেষ ও স্বার্থপূজার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ খোলা মনে হক ও বাতিলের পার্থক্য অনুধাবন করে অসত্য কথা পরিহার করে সত্য ও সঠিক কথা গ্রহণ করতে প্রস্তুত হলে এ কিতাবে, এ কিতাব উপস্থাপনকারীর জীবনে এবং আল্লাহর বিশাল বিশ্ব-জগতে প্রত্যেক চাক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ যেসব নিদর্শন দেখতে পারে তার জন্য যথেষ্ট হয়। নয়তো এমন একজন হঠকারী ব্যক্তি যে সত্যের সন্ধান করে না এবং প্রবৃত্তির স্বার্থ পূজায় নিজেকে নিয়োজিত রাখে, যে তার স্বার্থে আঘাত লাগে এমন কোন সত্য গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়, সে যতই নিদর্শন দেখুক না কেন তার সামনে আকাশ ও পৃথিবী উল্টে দিলেও সে ঈমান আনবে না।
তৃতীয়ত এ হঠকারিতার যে পরিণাম ফেরাউন দেখেছে তা এমন কোন পরিণাম নয় যা দেখার জন্য অন্য লোকেরা পাগল হয়ে গেছে। নিজের চোখে আল্লাহর শক্তিমত্তার নিদর্শন দেখে নেবার পর যে তা মানে না সে এমনি ধরণের পরিণতিরই সম্মুখীন হয়। এখন তোমরা কি এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার পরিবর্তে এর স্বাদ আস্বাদন করা পছন্দ করছো? (তুলনামূলক অধ্যয়নের জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আ’রাফ ১০৩ থেকে ১৩৭, সূরা ইউনূস ৭৫ থেকে ৯২, সূরা বনী ইসরাঈল ১০১ থেকে ১০৪ এবং সূরা তা-হা ৯ থেকে ৭৯ আয়াত)।