নির্ভরযোগ্য হাদীসে বলা হয়েছে, এ আয়াত নাযিল হবার পর নবী ﷺ সবার আগে নিজের দাদার সন্তানদের ডাকলেন এবং তাদের একেক জনকে সম্বোধন করে বললেনঃ
يَا بَنِي عَبْدِ الْمُطَّلِبِ, يَا عَبَّاس,يَا صَفِيَّةُ عَمَّة رَسُول الله, يَا فَاطِمَةَ بنَت مُحَمَّدٍ أَنْقِذُوا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ , فَإِنِّي لَا أَمْلِكُ مِنَ اللهِ شَيْئًا سَلُونِى مِنْ مَالِى مَا شِئْتُمْ-
“হে বনী আবদুল মুত্তালিব, হে আব্বাস, হে আল্লাহর রসূলের ফুফী সফীয়াহ, হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমা, তোমরা আগুনের আযাব থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার চিন্তা করো। আমি আল্লাহর আযাব থেকে তোমাদের বাঁচাতে পারবো না। তবে হ্যাঁ আমার ধন-সম্পত্তি থেকে তোমরা যা চাও চাইতে পারো।”
তারপর তিনি অতি প্রত্যুষে সাফা পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় উঠে দাঁড়িয়ে ডাক দিলেনঃ يا صباحاه (হায়, সকালের বিপদ!) হে কুরাইশের লোকেরা! হে বনী কা’ব ইবনে লুআই! হে বনী মুররা! হে কুসাইর সন্তান-সন্ততিরা! হে বনী আবদে মান্নাফ! হে বনী আবদে শামস! হে বনী হাশেম, হে বনী আবদুল মুত্তালিব! এভাবে কুরাইশদের প্রত্যেকটি গোত্র ও পরিবারের নাম ধরে তিনি আওয়াজ দেন। আরবে একটি প্রচলিত নিয়ম ছিল, অতি প্রত্যুষে যখন কোন বহিশত্রুর হামলার আশঙ্কা দেখা দিতো ওয়াকিফহাল ব্যক্তি এভাবেই সবাইকে ডাকতো এবং লোকেরা তার আওয়াজ শুনতেই চারদিকে থেকে দৌড়ে যেতো। কাজেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ আওয়াজ শুনে লোকেরা যার যার ঘর থেকে বের হয়ে এলো। তখন তিনি বললেনঃ “হে লোকেরা! যদি আমি বলি, এ পাহাড়ের পেছনে একটি বিশাল সেনাবাহিনী তোমাদের উপর আক্রমণ করার জন্য ওঁৎ পেতে আছে। তাহলে কি তোমরা আমার কথা সত্য বলে মেনে নেবে? ” সবাই বললো, হ্যাঁ আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, তুমি কখনো মিথ্যা বলনি। তিনি বললেন, “বেশ, তাহলে আমি আল্লাহর কঠিন আযাব আসার আগে তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। তাঁর পাকড়াও থেকে নিজেদের বাঁচাবার চিন্তা করো। আল্লাহর মোকাবিলায় আমি তোমাদের কোন কাজে লাগতে পারবোনা। কিয়ামতের দিন কেবলমাত্র মুত্তাকীরাই হবে আমার আত্মীয়। এমন যেন না হয়, অন্য লোকেরা সৎকাজ নিয়ে আসবে এবং তোমরা দুনিয়ার জঞ্জাল মাথায় করে নিয়ে উপস্থিত হবে। সে সময় তোমরা ডাকবে, হে মুহাম্মাদ! কিন্তু আমি তোমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবো। তবে দুনিয়ায় আমার সাথে তোমাদের রক্তের সম্পর্ক এবং এখানে আমি তোমাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখবো।” এ বিষয়বস্তু সম্বলিত অনেকগুলো হাদীস বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী, নাসাঈ, তাফসীরে ইবনে জারীরে হযরত আয়েশা, আবু হুরাইরা, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, যুহাইর ইবনে আমর ও কুবাইসাহ ইবনে মাহারিক থেকে বর্ণিত হয়েছে।
কুরআনে وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ ---এর হুকুম হলো এবং নবী (সা.) তাঁর আত্মীয়দেরকে একত্র করে একথা জানিয়ে দিয়ে সে হুকুম তামিল করলেন, ব্যাপারটির এখানেই শেষ নয়। আসলে এর মধ্যে যে মূলনীতি সুস্পষ্ট করা হয়েছিল তা ছিল এই যে, দ্বীনের মধ্যে নবী ও তাঁর বংশের জন্য এমন কোন বিশেষ সুবিধা নেই যা থেকে অন্যরা বঞ্চিত। যে জিনিসটি প্রাণ সংহারক বিষ সেটি সবারই জন্য প্রাণ সংহারক। নবীর কাজ হচ্ছে সবার আগে নিজে তা থেকে বাঁচবেন এবং নিজের নিকটবর্তী লোকদেরকে তার ভয় দেখাবেন। তারপর সাধারণ অসাধারণ নির্বিশেষে সবাইকে এ মর্মে সতর্ক করে দেবেন যে, এটি যে-ই খাবে, সে-ই মারা পড়বে। আর যে জিনিসটি লাভজনক তা সবার জন্য লাভজনক। নবীর দায়িত্ব হচ্ছে, সবার আগে তিনি নিজে সেটি অবলম্বন করবেন এবং নিজের আত্মীয়দেরকে সেটি অবলম্বন করার উপদেশ দেবেন। এর ফলে প্রত্যেক ব্যক্তি দেখে নেবে এ ওয়াজ-নসিহত শুধুমাত্র অন্যের জন্য নয় বরং নিজের দাওয়াতের ব্যাপারে নবী আন্তরিক। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সারা জীবন এ পদ্ধতি অবলম্বন করে গেছেন। মক্কা বিজয়ের দিন যখন তিনি শহরে প্রবেশ করলেন তখন ঘোষণা করে দিলেনঃ
كُلَّ رِبًا فِى الْجَاهِلِيَّةِ مَوْضُوعٌ تحت قدمى ها تين وأَوَّلَ رِباً يُوضَعُ رِبَا عَبَّاسِ
“লোকদের কাছে অনাদায়কৃত জাহেলী যুগের প্রত্যেকটি সুদ আমার এ দু’পায়ের তলে পিষ্ট করা হয়েছে। আর সবার আগে যে সুদকে আমি রহিত করে দিচ্ছি তা হচ্ছে আমার চাচা আব্বাসের সুদ।”
(উল্লেখ্য, সুদ হারাম হবার আগে আব্বাস (রা.) সুদে টাকা খাটাতেন এবং সে সময় পর্যন্ত লোকদের কাছে তাঁর বহু টাকার সুদ পাওনা ছিল) একবার চুরির অভিযোগে তিনি কুরাইশদের ফাতিমা নামের একটি মেয়ের হাত কাটার হুকুম দিলেন। হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রা.) তার পক্ষে সুপারিশ করলেন। এতে তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, যদি মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতিমাও চুরি করতো তাহলে আমি তার হাত কেটে দিতাম।