“সেই ব্যক্তি বললো, আমি চোখের পলক ফেলতেই তা নিয়ে আসছি। তখনই সুলাইমান তা তাঁর নিজের কাছে রক্ষিত দেখতে পেলো।”
ঘটনাটি কেমন অদ্ভূত ও বিস্ময়কর সে কথা মন থেকে বের করে দিয়ে যে ব্যক্তি এ বাক্যাংশটি পড়বে, সে এ থেকে এ অর্থই গ্রহণ করবে যে, ঐ ব্যক্তির একথা বলার সাথে সাথেই সে যা দাবী করেছিলো তা ঘটে গেলো। এ সোজা সরল কথাটিকে অনর্থক টানা হেঁচড়া করে এ অর্থ করার কি দরকার ছিল? তারপর সিংহাসন দেখতেই হযরত সুলাইমানের একথা বলাঃ “এ আমার রবের অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করেন, আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি অথবা অনুগ্রহ অস্বীকারকারী হয়ে যাই”-এমন এক অবস্থায় এটা কোন অস্বাভাবিক ঘটনা হলে তবেই যথাযথ হতে পারে। অন্যথায় যদি ঘটনা এমনটিই হতো, তাঁর একজন চালাক-চতুর ও করিতকর্মা কর্মচারী রাণীর জন্য অতিদ্রুত একটি সিংহাসন তৈরি করে বা তৈরি করিয়ে নিয়ে আসতো, তাহলে বলা নিষ্প্রয়োজন যে তা এমন কোন অভিনব ব্যাপার হতো না যে, এজন্য হযরত সুলাইমান বে এখতিয়ার هَذَا مِنْ فَضْلِ رَبِّي (এটা আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ) বলে চিৎকার করে উঠতেন এবং তাঁর মনে আশঙ্কা জাগতো যে, এতো দ্রুত সম্মানীয় অতিথীর জন্য সিংহাসন তৈরি হবার কারণে আমি আবার অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পরিবর্তে তার নিয়ামত অস্বীকারকারী হয়ে যাই। সামান্য এতোটুকু ঘটনায় একজন মু’মিন শাসনকর্তার এত বেশী অহংকার ও আত্মম্ভরিতায় লিপ্ত হয়ে যাবার কী এমন আশঙ্কা থাকতে পারে, বিশেষ করে যখন তিনি একজন সাধারণ ও মামুলি পর্যায়ের মু’মিন নন বরং আল্লাহর নবী?
এরপর যে প্রশ্নটির নিস্পত্তি বাকী থাকে তা এই যে, চোখের পলক ফেলতেই দেড় হাজার মাইল দূর থেকে একটি সিংহাসন কেমন করে উঠে এলো? এর সংক্ষিপ্ত জবাব হচ্ছে, স্থান-কাল এবং বস্তু ও গতি সম্পর্কে যে ধারণা আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তৈরী করে রেখেছি সেসবের যাবতীয় সীমারেখা কেবল মাত্র আমাদের নিজেদের জন্যই সঙ্গত। আল্লাহর জন্য এসব ধারণা সঠিক নয় এবং তিনি এসব সীমানার মধ্যে আবদ্ধও নন। তিনি নিজের অসীম ক্ষমতাবলে একটি নিতান্ত মামুলি সিংহাসন তো দূরের কথা সূর্য এবং তার চাইতেও বড় বড় গ্রহ-নক্ষত্রকেও মুহূর্তের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করাতে পারেন। যে আল্লাহর একটি মাত্র হুকুমে এ বিশাল বিশ্ব-জগতের জন্ম হয়েছে। তাঁর সামান্য একটি ইশারায়ই সাবার রাণীর সিংহাসনকে আলোকের গতিতে চালিত করার জন্য যথেষ্ট ছিল। আল্লাহ তাঁর এক বান্দা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এক রাতে মক্কা থেকে বাইতুল মাকদিসে নিয়ে গিয়ে আবার ফিরিয়েও এনেছিলেন, একথা তো কুরআনেই উল্লেখ করা হয়েছে।
إِنْ تَكْفُرُوا أَنْتُمْ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا فَإِنَّ اللَّهَ لَغَنِيٌّ حَمِيدٌ
“যদি তোমরা এবং সারা দুনিয়াবাসীরা মিলে কুফরী করো তাহলেও তাতে আল্লাহর কিছু এসে যায় না এবং আপন সত্তায় আপনি প্রশংসিত।” (ইবরাহীম, ৮)
সহীহ মুসলিমের নিম্নোক্ত হাদীসে কুদসীতেও এ একই বিষয়বস্তুর অবতারণা করা হয়েছেঃ
يَا عِبَادِى لَوْ أَنَّ أَوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ وَإِنْسَكُمْ وَجِنَّكُمْ كَانُوا عَلَى أَتْقَى قَلْبِ رَجُلٍ مِنْكُمْ مَا زَادَ ذَلِكَ فِى مُلْكِى شَيْئًا- يَا عِبَادِى لَوْ أَنَّ أَوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ وَإِنْسَكُمْ وَجِنَّكُمْ كَانُوا عَلَى أَفْجَرِ قَلْبِ رَجُلٍ مِنْكُمْ مَا نَقَصَ ذَلِكَ فى مُلْكِى شَيْئًا- يَا عِبَادِى إِنَّمَا هِىَ أَعْمَالُكُمْ أُحْصِيهَا لَكُمْ ثُمَّ أُوَفِّيكُمْ إِيَّاهَا- فَمَنْ وَجَدَ خَيْرًا فَلْيَحْمَدِ اللَّهَ وَمَنْ وَجَدَ غَيْرَ ذَلِكَ فَلاَ يَلُومَنَّ إِلاَّ نَفْسَهُ-
“মহান আল্লাহ বলেন, হে আমার বান্দারা যদি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তোমরা সকল মানুষ ও জিন তোমাদের মধ্যকার সবচেয়ে বেশী মুত্তাকী ব্যক্তির হৃদয়ের মতো হয়ে যাও, তাহলে তার ফলে আমার বাদশাহী ও শাসন কর্তৃত্বে কিছুমাত্র বৃদ্ধি ঘটে না। হে আমার বান্দারা! যদি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তোমরা সকল মানুষ ও জিন তোমাদের মধ্যকার সবচেয়ে বেশী বদকার ব্যক্তিটির হৃদয়ের মতো হয়ে যাও, তাহলে এর ফলে আমার বাদশাহীতে কোন কমতি দেখা যাবে না। হে আমার বান্দারা! এগুলো তোমাদের নিজেদেরই কর্ম, তোমাদের হিসেবের খাতায় আমি এগুলো গণনা করি, তারপর এগুলোর পুরোপুরি প্রতিদান আমি তোমাদের দিয়ে থাকি। কাজেই যার ভাগ্যে কিছু কল্যাণ এসেছে তার আল্লাহর শোকরগুজারী করা উচিত এবং যে অন্যকিছু লাভ করেছে তার নিজেকে ভর্ৎসনা করা উচিত।”