وَقَالَ الْمَلَأُ مِنْ قَوْمِ فِرْعَوْنَ أَتَذَرُ مُوسَى وَقَوْمَهُ لِيُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَيَذَرَكَ وَآلِهَتَكَ
“আর ফেরাউনের জাতির সরদাররা বললো, তুমি কি মুসা ও তার জাতিকে অবাধ ছাড়পত্র দিয়ে দেবে যে, তারা দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করুক এবং তোমাকে ও তোমার উপাস্যদেরকে ত্যাগ করুক?” (আল আ’রাফঃ ১২৭)
তাই ফেরাউন অবশ্যই এখানে “ইলাহ” শব্দটি নিজের জন্য স্রষ্টা ও উপাস্য অর্থে নয় বরং সার্বভৌম ও স্বয়ং সম্পূর্ণ শাসক এবং তাকে আনুগত্য করতে হবে, এ অর্থে ব্যবহার করেছিল। তার বলার উদ্দেশ্য ছিল, আমি মিসরের এ সরযমীনের মালিক। এখানে আমারই হুকুম চলবে। আমারই আইনকে এখানে আইন বলে মেনে নিতে হবে। আমারই সত্তাকে এখানে আদেশ ও নিষেধের উৎস বলে স্বীকার করতে হবে। এখানে অন্য কেউ তার হুকুম চালাবার অধিকার রাখে না। এ মূসা কে? সে রব্বুল আলামীনের প্রতিনিধি সেজে দাঁড়িয়েছে এবং আমাকে এমনভাবে হুকুম শুনাচ্ছে যেন সে আসল শাসনকর্তা এবং আমি তার হুকুমের অধীন? এ কারণে সে তার দরবারের লোকদের সম্বোধন করে বলেছিলঃ
يَا قَوْمِ أَلَيْسَ لِي مُلْكُ مِصْرَ وَهَذِهِ الْأَنْهَارُ تَجْرِي مِنْ تَحْتِي
“হে আমার জাতি! মিসরের বাদশাহী কি আমারই নয় এবং এ নদীগুলো কী আমার অধীনে প্রবাহিত নয়?” (আয যুখরুফঃ৫১)
আর এ কারণেই সে বারবার হযরত মূসাকে বলছিলঃ
أَجِئْتَنَا لِتَلْفِتَنَا عَمَّا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا وَتَكُونَ لَكُمَا الْكِبْرِيَاءُ فِي الْأَرْضِ
“তুমি কি এসেছ আমাদের বাপ-দাদাদের আমল থেকে যে পদ্ধতি চলে আসছে তা থেকে আমাদের সরিয়ে দিতে এবং যাতে এদেশে তোমাদের দু’ভাইয়ের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়?” (ইউনূসঃ ৭৮)
أَجِئْتَنَا لِتُخْرِجَنَا مِنْ أَرْضِنَا بِسِحْرِكَ يَا مُوسَى
“হে মুসা! তুমি কি নিজের যাদুবলে আমাদের ভূখণ্ড থেকে আমাদের উৎখাত করতে এসেছো? (ত্বা-হাঃ ৫৭)
إِنِّي أَخَافُ أَنْ يُبَدِّلَ دِينَكُمْ أَوْ أَنْ يُظْهِرَ فِي الْأَرْضِ الْفَسَادَ
“আমি ভয় করছি এ ব্যক্তি তোমাদের দ্বীন পরিবর্তিত করে দেবে অথবা দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।” (আল মু’মিনঃ২৬)
এদিক দিয়ে চিন্তা করলে যেসব রাষ্ট্র আল্লাহর নবী প্রদত্ত শরীয়াতের অধীনতা প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের তথাকথিত রাজনৈতিক ও আইনগত সার্বভৌমত্বের দাবীদার, ফেরাউনের অবস্থা তাদের থেকে ভিন্নতর ছিল না। তারা আইনের উৎস এবং আদেশ নিষেধের কর্তা হিসেবে অন্য কোন বাদশাকে মানুক অথবা জাতির ইচ্ছার আনুগত্য করুক যতক্ষণ তারা এরূপ নীতি অবলম্বন করে চলবে যে, দেশে আল্লাহ ও তার রসুলের নয় বরং আমাদের হুকুম চলবে, ততক্ষণ তাদের ও ফেরাউনের নীতি ও ভূমিকার মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য থাকবে না। এটা ভিন্ন কথা যে, অবুঝ লোকেরা একদিকে ফেরাউনকে অভিসম্পাত করতে থাকে, অন্যদিকে ফেরাউনী রীতিনীতির অনুসারী এসব শাসককে বৈধতার ছাড়পত্র দিয়ে দেয়। যে ব্যক্তি প্রকৃত সত্যের জ্ঞান রাখে, সে শব্দ ও পরিভাষা নয়, অর্থ ও প্রাণশক্তি দেখবে। ফেরাউন নিজের জন্য “ইলাহ” শব্দ ব্যবহার করেছিল এবং এরা সেই একই অর্থে সার্বভৌমত্বের পরিভাষা ব্যবহার করছে, এতে এমন কী পার্থক্য সৃষ্টি হয়! (আরো বেশি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা ত্বা-হা ২১ টীকা)
কুরআন এখানে এ কথা বলছে না যে, ফেরাউন সত্যি সত্যিই একটি ইমারত এ উদ্দেশ্যে বানিয়েছিল এবং তাতে উঠে আল্লাহকে দেখার চেষ্টা করেছিল। বরং কুরআন শুধুমাত্র তার এ উক্তি উদ্ধৃত করছে। এ থেকে আপাতদৃষ্টি মনে হয় সে কার্যত এ বোকামি করেনি। এ কথাগুলোর মাধ্যমে কেবলমাত্র মানুষকে বোকা বানানোই ছিল তার উদ্দেশ্য।
ফেরাউন সত্যিই বিশ্ব-জাহানের মালিক ও প্রভু আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করতো, না নিছক জিদ ও হঠকারিতার বশবর্তী হয়ে নাস্তিক্যবাদী কথাবার্তা বলতো, তা সুস্পষ্টভাবে জানা যায় না। তার উক্তিগুলো থেকে ঠিক একই ধরণের মানসিক অস্থিরতার সন্ধান পাওয়া যায় যেমন রুশ কম্যুনিষ্টদের কথাবার্তায় পাওয়া যায়। কখনো সে আকাশে উঠে দুনিয়াবাসীকে জানাতে চাইতো, আমি উপরে সব দেখে এসেছি, মূসার আল্লাহ কোথাও নেই। আবার কখনো বলতো-
فَلَوْلَا أُلْقِيَ عَلَيْهِ أَسْوِرَةٌ مِنْ ذَهَبٍ أَوْ جَاءَ مَعَهُ الْمَلَائِكَةُ مُقْتَرِنِينَ
“যদি সত্যিই মূসা আল্লাহর প্রেরিত হয়ে থাকে, তাহলে কেন তার জন্য সোনার কাঁকন অবতীর্ণ হয়নি অথবা ফেরেশতারা তাঁর আরদালী হয়ে আসেনি কেন?”
* অবশ্য ১৯৯১ তে এসে রুশী কম্যুনিষ্টদের আর আল্লাহর সন্ধানে স্পুটনিকে ও লুনিকে চড়তে হচ্ছে না। এখন বাস্তবতার প্রচণ্ড আঘাতে তারা কম্যুনিজম ত্যাগ করে আল্লাহকে স্বীকৃতি দেবার দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। -অনুবাদক
এ কথাগুলো রাশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিঃ ক্রুশ্চেভের কথা থেকে মোটেই ভিন্নতর নয়। তিনি কখনো আল্লাহকে অস্বীকার করতেন আবার কখনো বারবার আল্লাহর নাম নিতেন এবং তাঁর নামে কসম খেতেন। আমাদের অনুমান, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম ও তাঁর খলিফাদের যুগ শেষ হবার পর মিসরে কিব্তী জাতীয়তাবাদের শক্তি বৃদ্ধি হয় এবং স্বদেশপ্রীতির ভিত্তিতে দেশে রাজনৈতিক বিপ্লব সাধিত হয়। এ সময় নতুন নেতৃত্ব জাত্যাভিমানের আবেগে আল্লাহর বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ ঘোষণা করে। হযরত ইউসূফ ও তাঁর অনুসারী ইসরাঈলী এবং মিসরীয় মুসলমানরা তাদেরকে আল্লাহকে মেনে চলার দাওয়াত দিয়ে আসছিলেন। তারা মনে করলো, আল্লাহকে মেনে নিয়ে আমরা ইউসূফীয় সংস্কৃতির প্রভাব মুক্ত হতে পারবো না এবং এ সংস্কৃতি জীবিত থাকলে আমাদের রাজনৈতিক প্রভাবও শক্তিশালী হতে পারবে না। তারা আল্লাহকে স্বীকৃতি দেবার সাথে মুসলিম কর্তৃত্বকে অংগাংগীভাবে জড়িত মনে করছিল। তাই একটির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য অন্যটিকে অস্বীকার করা তাদের জন্য জরুরী ছিল, যদিও তার অস্বীকৃতি তাদের অন্তরের ভেতর থেকে বের হয়েও বের হচ্ছিল না।”