এখানে কারো এ ধরনের সন্দেহ করার অবকাশ নেই যে, ইসলামী রাষ্ট্রেও তো মুসলিম ও জিম্মীর মধ্যে ফারাক করা হয় এবং তাদের অধিকার ও ক্ষমতাও সকল দিক দিয়ে সমান রাখা হয়নি। এ সন্দেহ এজন্য সঠিক নয় যে, ফেরাউনী বিধানে যেমন বংশ, বর্ণ, ভাষা বা শ্রেণীগত বিভেদের উপর বৈষম্যের ভিত্ রাখা হয়েছে ইসলামী বিধানে ঠিক তেমনটি নয়। বরং ইসলামী বিধানে নীতি ও মতবাদের উপর এর ভিত রাখা হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জিম্মী ও মুসলমানের মধ্যে আইনগত অধিকারের ক্ষেত্রে মোটেই কোন ফারাক নেই। সকল পার্থক্য একমাত্র রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে। আর এ পার্থক্যের কারণ এছাড়া আর কিছুই নয় যে, একটি আদর্শিক রাষ্ট্রে শাসকদল একমাত্র তারাই হতে পারে যারা হবে রাষ্ট্রের মূলনীতির সমর্থক। এ দলে এমন প্রত্যেক ব্যক্তি শামিল হতে পারে যে এ মূলনীতি মেনে নেবে না। এ পার্থক্য ও ফেরাউনী ধরণের পার্থক্যের মধ্যে কোন মিল নেই। কারণ, ফেরাউনী পার্থক্যের ভিত্তিতে পরাধীন প্রজন্মের কোন ব্যক্তি কখনো শাসক দলে শামিল হতে পারে না। সেখানে পরাধীন প্রজন্মের লোকেরা রাজনৈতিক ও আইনগত অধিকার তো দূরের কথা মৌলিক মানবিক অধিকারও লাভ করে না। এমনকি জীবিত থাকার অধিকারও তাদের থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়। সেখানে কখনো পরাধীনদের জন্য কোন অধিকারের জামানত দেয়া হয় না। সব ধরনের স্বার্থ, মুনাফা, সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা একমাত্র শাসক সমাজের জন্য নির্দিষ্ট থাকে এবং এ বিশেষ অধিকার একমাত্র জাতির মধ্যে জন্মলাভকারী ব্যক্তিই লাভ করে।
এ থেকে জানা যায়, হযরত ইউসূফ (আ) এর যুগ অতিক্রান্ত হবার পর মিসরে একটি জাতীয়তাবাদী বিপ্লব সাধিত হয়েছিল এবং কিবতীদের হাতে যখন পূণর্বার শাসন ক্ষমতা এসেছিল তখন নতুন জাতীয়তাবাদী সরকার বনী ঈসরাইলের শক্তি নির্মূল করার পূর্ণ প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। এ ব্যাপারে শুধুমাত্র বনী ঈসরাঈলকে লাঞ্ছিত ও পদদলিত এবং তাদেরকে নিকৃষ্ট ধরণের সেবা কর্মের জন্য নির্দিষ্ট করেই ক্ষান্ত থাকা হয়নি বরং এ থেকে আরো অগ্রসর হয়ে তাদের ছেলেদের হত্যা করে কেবলমাত্র মেয়েদের জীবিত রাখার নীতি অবলম্বন করা হয়, যাতে করে তাদের মেয়েরা ধীরে ধীরে কিবতীদের কর্তৃত্বাধীনে এসে যেতে থাকে এবং তাদের থেকে ইসরাঈলের পরিবর্তে কিবতীদের বংশ বিস্তার লাভ করে। তালমূদ এর আরো বিস্তারিত বিবরণ এভাবে দিয়েছে যে, হযরত ইউসূফ (আ) এর ইন্তিকালের সময় থেকে একশতকের কিছু বেশি সময় অতিক্রান্ত হবার পর থেকে এ বিপ্লব আসে। সেখানে বলা হয়েছে, নতুন জাতীয়তাবাদী সরকার প্রথমে বনী ইসরাঈলকে তাদের উর্বর কৃষিক্ষেত্র, বাসগৃহ ও সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে। তারপর তাদেরকে বিভিন্ন সরকারী পদ থেকে বেদখল করে দেয়। এরপরও যখন কিবতী শাসকরা অনুভব করে যে, বনী ইসরাঈল ও তাদের সমধর্মাবলম্বী মিসরীয়রা যথেষ্ট প্রভাবশালী তখন তারা ইসরাঈলীদেরকে লাঞ্ছিত ও হীনবল করতে থাকে এবং তাদের থেকে কঠিন পরিশ্রমের বিনিময়ে সামান্য পারিশ্রমিক বা বিনা পারিশ্রমিকেই কাজ আদায় করতে থাকে। কুরআনে এক জায়গায় বলা হয়েছে যে, “তারা মিসরের অধিবাসীদের একটি গোষ্ঠিকে লাঞ্ছিত ও হীনবল করতো” এ বক্তব্য সেই উক্তির ব্যাখ্যা বিবেচিত হতে পারে। আর সূরা আল বাকারায় আল্লাহ যে বলেছেন, ফেরাউনের বংশধররা বনী ইসরাঈলকে কঠোর শাস্তি দিতো। يَسُومُونَكُمْ سُوءَ الْعَذَابِ এরও ব্যাখ্যা এটিই।
কিন্তু বাইবেল ও কুরআনে এ ধরণের কোন আলোচনা নেই যাতে বলা হয়েছে যে, কোন জোতিষী ফেরাউনকে বলেছিল, বনী ইসরাঈলে একটি শিশু জন্ম নেবে, তার হাতে ফেরাউনী কর্তৃত্বের মৃত্যু ঘটবে এবং এ বিপদের পথ রোধ করার জন্য ফেরাউন ইসরাঈলীদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিল। অথবা ফেরাউন কোন ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছিল এবং তার তা’বীর এভাবে দেয়া হয়েছিল যে, বনী ইসরাঈলের মধ্যে এ ধরণের বিশেষ গুণ বিশিষ্ট শিশু জন্ম নেবে। তালমূদ ও অন্যান্য ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে এ কাহিনী আমাদের মুফাসসিরগণ উদ্বৃত করেছেন। (দেখুন জুয়িশ ইনসাইক্লোপিডিয়া, নিবদ্ধ “মুসা” এবং The Talmud selections. P.123-24)