একজন বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী হিসেবে আরবে লুকমান বহুল পরিচিত ব্যক্তিত্ব। জাহিলী যুগের কবিরা যেমন ইমরাউল কায়েস, লবীদ, আ’শা, তারাফাহ প্রমুখ তাদের কবিতায় তার কথা বলা হয়েছে। আরবের কোন কোন লেখাপড়া জানা লোকের কাছে “সহীফা লুকমান” নামে তার জ্ঞানগর্ভ উক্তির একটি সংকলন পাওয়া যেতো। হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে, হিজরাতের তিন বছর পূর্বে মদীনার সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি নবী (সা.) এর দাওয়াতের প্রভাবিত হন তিনি ছিলেন সুওয়াইদ ইবনে সামেত। তিনি হজ্ব সম্পাদন করার জন্য মক্কায় যান। সেখানে নবী করীম ﷺ নিজের নিয়ম মতো বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত হাজীদের আবাসস্থলে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেককে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। এ প্রসঙ্গে সুওয়াইদ যখন নবী (সা.) এর বক্তৃতা শুনেন, তাকে বলেন, আপনি যে ধরনের কথা বলেছেন তেমনি ধরনের একটি জিনিস আমার কাছেও আছে। তিনি জিজ্ঞেস করেন, সেটা কি? জবাব দেন সেটা লুকমানের পুস্তিকা। তারপর নবী করীমের ﷺ অনুরোধে তিনি তার কিছু অংশ পাঠ করে তাকে শুনান। তিনি বলেন, এটা বড়ই চমৎকার কথা। তবে আমার কাছে এর চেয়েও বেশি চমৎকার কথা আছে। এরপর কুরআন শুনান। কুরআন শুনে সুওয়াইদ অবশ্যই স্বীকার করেন, নিঃসন্দেহে এটা লুকমানের পুস্তিকার চেয়ে ভালো। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২ খণ্ড, ৬৭-৬৯ পৃ; উসুদুল গাবাহ, ২ খণ্ড, ৩৭৮ পৃষ্ঠা) ঐতিহাসিকগণ বলেন, এই সুওয়াইদ ইবনে সামেত তার যোগ্যতা, বীরত্ব, সাহিত্য ও কাব্য মনীষা এবং বংশ মর্যাদার কারণে মদীনায় “কামেল” নামে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু নবী (সা.) এর সাথে সাক্ষাতের পর যখন তিনি মদীনায় ফিরে যান তার কিছুদিন পর বুয়াসের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং তাতে তিনি মারা যান। তার গোত্রের লোকদের সাধারণভাবে এ ধারণা ছিল যে, নবী (সা.) এর সাক্ষাতের পর তিনি মুসলমান হয়ে যান।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে লুকমানের ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে ব্যাপক মতবিরোধ দেখা যায়। জাহেলিয়াতের অন্ধকার যুগে কোন লিখিত ইতিহাসের অস্তিত্ব ছিল না। শত শত বছর থেকে মুখে মুখে শ্রুত যেসব তথ্য স্মৃতির ভাণ্ডারে লোককাহিনী-গল্প-গাঁথার আকারে সংগৃহীত হয়ে আসছিল সেগুলোর ওপর ছিল এর ভিত্তি। এসব বর্ণনার প্রেক্ষিতে কেউ কেউ হযরত লুকমানকে আদ জাতির অন্তর্ভুক্ত ইয়ামনের বাদশাহ মনে করতো। মাওলানা সাইয়েদ সুলাইমান নদবী এসব বর্ণনার ওপর নির্ভর করে তার “আরদুল কুরআন” গ্রন্থে এ মত প্রকাশ করেছেন যে, আদ জাতির ওপর আল্লাহর আযাব নাযিল হবার পর হযরত হূদের (আ) সাথে তাদের যে ঈমানদার অংশটি বেঁচে গিয়েছিল লুকমান ছিলেন তাদেরই বংশোদ্ভূত। ইয়ামনে এ জাতির যে শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তিনি ছিলেন তার অন্যতম শাসক ও বাদশাহ। কিন্তু কতিপয় প্রবীণ সাহাবী ও তাবেঈদের মাধ্যমে প্রাপ্ত অন্য বর্ণনাগুলো এর সম্পূর্ণ বিপরীত। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, লুকমান ছিলেন একজন হাবশী গোলাম। হযরত আবু হুরাইরা (রা.), মুজাহিদ, ইকরিমাহও খালেদুর রাব’ঈও একথাই বলেন। হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী (রা.) বলেন, তিনি ছিলেন নূবার অধিবাসী। সাঈদ ইবনে মুসাইয়েবের উক্তি হচ্ছে, তিনি মিসরের কালো লোকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এ তিনটি বক্তব্য প্রায় কাছাকাছি অবস্থান করছে। কারণ আরবের লোকেরা কালো বর্ণের মানুষদেরকে সেকালে প্রায়ই হাবশী বলতো। আর নূবা হচ্ছে মিসরের দক্ষিণে এবং সুদানের উত্তরে অবস্থিত একটি এলাকা। তাই তিনটি উক্তিতে একই ব্যক্তিকে নূবী, মিসরীয় ও হাবশী বলা কেবলমাত্র শাব্দিক বিরোধ ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থের দিক দিয়ে এখানে কোন বিরোধ নেই। তারপর রওদাতুল আনাফে সুহাইলির ও মরূজুয যাহাবে মাস’উদীর বর্ণনা থেকে এ সূদানী গোলামের কথা আরবে কেমন করে ছড়িয়ে পড়লো এ প্রশ্নের ওপরও আলোকপাত হয়। এ উভয় বর্ণনায় বলা হয়েছে, এ ব্যক্তি আসলে ছিলেন নূবী। কিন্তু তিনি বাসিন্দা ছিলেন মাদযান ও আইল (বর্তমান আকাবাহ) এলাকার। এ কারণে তার ভাষা ছিল আরবী এবং তার জ্ঞানের কথা আরবে ছড়িয়ে পড়ে। তা ছাড়া সুহাইলী আরো বিস্তারিত ভাবে বলেছেন যে, লুকমান হাকীম ও লুকমান ইবনে আদ দু’জন আলাদা ব্যক্তি। তাদেরকে এক ব্যক্তি মনে করা ঠিক নয়। (রওদুল আনাফ, ১ম খণ্ড, ২৬৬ পৃষ্ঠা এবং মাসউদী, ১ম খণ্ড, ৫৭ পৃষ্ঠা।)
এখানে একথাটিও সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে দেয়া প্রয়োজন যে, প্রাচ্যবিদ ডিরেনবুর্গ (Derenbourg) প্যারিস লাইব্রেরীর যে আরবী পাণ্ডুলিপিটি “লুকমান হাকীমের গাঁথা” (Fables De Loqman Lo Sage) নামে প্রকাশ করেছেন সেটি আসলে বানোয়াট। “লুকমানের সহীফা”র সাথে তার দূরতম কোন সম্পর্কও নেই। ত্রয়োদশ ঈসায়ী শতকে এ গাঁথাগুলো কেউ সংকলন করেছিলেন। তার আরবী সংস্করণ বড়ই ত্রুটিপূর্ণ। সেগুলো পড়লে পরিষ্কার অনুভব করা যাবে যে, আসলে অন্য কোন ভাষা থেকে অনুবাদ করে গ্রন্থকার নিজের পক্ষ থেকে সেগুলোর সম্পর্ক লুকমান হাকীমের সাথে জুড়ে দিয়েছেন। প্রাচ্যবিদরা এ ধরনের জাল ও বানোয়াট জিনিসগুলো বের করে যে উদ্দেশ্যে সামনে আনেন তা এছাড়া আর কিছুই নয় যে, কুরআন বর্ণিত কাহিনীগুলোকে যে কোনভাবেই অনৈতিহাসিক কাহিনী প্রমাণ করে অনির্ভরযোগ্য গণ্য করা। যে ব্যক্তিই ইনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলামে “লুকমান” শিরোনামে (B.Heller) হেলারের নিবন্ধটি পড়বেন তার কাছেই তাদের মনোভাব অস্পষ্ট থাকবে না।