ثُمَّ سَوَّىٰهُ وَنَفَخَ فِيهِ مِن رُّوحِهِۦ ۖ وَجَعَلَ لَكُمُ ٱلسَّمْعَ وَٱلْأَبْصَـٰرَ وَٱلْأَفْـِٔدَةَ ۚ قَلِيلًۭا مَّا تَشْكُرُونَ
তারপর তাকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করেছেন ১৫ এবং তার মধ্যে নিজের রূহ ফুঁকে দিয়েছেন, ১৬ আর তোমাদের কান, চোখ ও হৃদয় দিয়েছেন, ১৭ তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। ১৮
১৫
অর্থাৎ একটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অস্তিত্ব থেকে বাড়িয়ে তাকে পূর্ণ মানবিক আকৃতিতে পৌঁছান এবং সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও পঞ্চন্দ্রিয় সহকারে তাকে পুরোপুরি শারীরিক আকৃতি দান করেন।
১৬
রূহ বলতে নিছক যে জীবন প্রবাহের বদৌলতে একটি জীবের দেহ যন্ত্র সচল ও সক্রিয় হয় তাকে বুঝানো হয়নি। বরং এমন বিশেষ সার সত্তা ও সার উপাদান বুঝানো হয়েছে যা চিন্তা, চেতনা, বুদ্ধি, বিবেক, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী হয় এবং যার বদৌলতে মানুষ পৃথিবীর অন্য সমস্ত সৃষ্টি থেকে পৃথক একটি ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, অহংবোধের অধিকারী এবং প্রতিনিধিত্ব ক্ষমতা সম্পন্ন সত্তার পরিণত হয়। এ রূহ কে মহান আল্লাহ নিজের রূহ এ অর্থে বলেছেন যে, তা তারই মালিকানাধীন এবং তার পবিত্র সত্তার সাথে তাকে সম্পর্কিত করণ ঠিক তেমনি ধরনের যেমন একটি জিনিস তার মালিকের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে তার জিনিস হিসেবে আখ্যায়িত হয়। অথবা এর অর্থ হচ্ছে, মানুষের মধ্যে জ্ঞান, চিন্তা চেতনা, ইচ্ছা, সংকল্প, সিদ্ধান্ত ইখতিয়ার এবং এ ধরনের আরো যেসব গুণাবলীর উদ্ভব হয়েছে এসবই মহান আল্লাহর গুণাবলীর প্রতিচ্ছায়া। বস্তুর কোন যৌগিক উপাদান এদের উৎস নয় বরং এদের উৎস হচ্ছে আল্লাহর সত্তা। আল্লাহর তত্ত্বজ্ঞান থেকে সে জ্ঞান লাভ করেছে। আল্লাহর প্রজ্ঞা থেকে সে লাভ করেছে জ্ঞানবত্তা ও বিচক্ষণতা। আল্লাহর ক্ষমতা থেকে সে লাভ করেছে স্বাধীন ক্ষমতা। এসব গুণাবলী মানুষের মধ্যে কোন অজ্ঞান, নির্বোধ ও অক্ষম উৎস থেকে আসেনি। (আরো বেশি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল হিজর, ১৭ ও ১৯ টীকা।)
১৭
এটি একটি সূক্ষ্ম বর্ণনাভঙ্গি। রূহ সঞ্চার করার আগে মানুষের সমস্ত আলোচনা প্রথম পুরুষের করা হয়ঃ “তাকে সৃষ্টি করেছেন”, “তার বংশ উৎপাদন করেছেন”, “তাকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করেছেন”, “তার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করেছেন” এর কারণ হচ্ছে তখন পর্যন্ত সে সম্বোধন লাভের যোগ্যতা অর্জন করেনি। তারপর প্রাণ সঞ্চার করার পর এখন তাকে বলা হচ্ছে, “তোমাকে কান দিয়েছেন”, “চোখ দিয়েছেন”, “হৃদয় দিয়েছেন” কারণ প্রাণের অধিকারী হয়ে যাবার পরই সে এখন এমন যোগ্যতা অর্জন করেছে যার ফলে তাকে সম্বোধন করা যেতে পারে।
কানও চোখ অর্থ হচ্ছে এমন সব যার সাহায্যে মানুষ জ্ঞান আহরণ করে। যদিও জ্ঞান আহরণের মাধ্যমের মধ্যে জিহ্বা, নাসিকা ও ত্বকও অন্তর্ভুক্ত তবুও যেহেতু শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলোর তুলনায় অনেক বেশি বড় ও বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাই কুরআন বিভিন্ন স্থানে এ দু’টিকেই আল্লাহর উল্লেখযোগ্য দান আকারে পেশ করছে। এরপর “হৃদয়” মানে হচ্ছে এমন একটি “মন” (mind) যা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে সংগৃহীত ও তথ্যাদি বিন্যস্ত করে তা থেকে ফলাফল বের করে আনে এবং কর্মের বিভিন্ন সম্ভাব্য পথগুলোর মধ্য থেকে কোন একটি পথ নির্বাচন করে এবং সে পথে চলার সিদ্ধান্ত নেয়।
১৮
অর্থাৎ এ মহান মর্যাদাসম্পন্ন মানবিক রূহ এত উন্নত পর্যায়ের গুণাবলী সহকারে তোমাকে তো এ জন্য দেয়া হয়নি যে, তুমি দুনিয়ায় পশুদের মতো অবস্থান করবে এবং পশুরা নিজেদের জীবনের যে চিত্র তৈরি করতে পারে তুমি তোমার জীবনের জন্য তেমনি ধরনের একটি চিত্র তৈরি করে নেবে। এ চোখ দু’টি তোমাকে দেয়া হয়েছিল অন্তরদৃষ্টি দিয়ে দেখার জন্য, অন্ধ হয়ে থাকার জন্য দেয়া হয়নি। এ কান দু’টি তোমাকে দেয়া হয়েছিল পূর্ণ মনোযোগ সহকারে শোনার জন্য, বধির হয়ে বসে থাকার জন্য নয়। এ জন্য দেয়া হয়নি যে, তোমার সমস্ত যোগ্যতা কেবলমাত্র নিজের পাশবিক প্রবৃত্তি লালনের উপকরণ সংগ্রহে ব্যয় করবে এবং এর চাইতে যদি কিছুটা ওপরে ওঠো তাহলে নিজের স্রষ্টার বিরূদ্ধে বিদ্রোহের দর্শন ও কর্মসূচি তৈরি করতে লেগে যাবে। আল্লাহর কাছ থেকে এ মহামূল্যবান নিয়ামত লাভ করার পর যখন তুমি নাস্তিক্যবাদ বা শিরকের পথ অবলম্বন করো, যখন তুমি নিজেই খোদা বা অন্য খোদাদের বান্দা হয়ে বসো, যখন তুমি প্রবৃত্তির দাস হয়ে দেহ ও কামনার ভোগ-লালসায় ডুবে থাকো তখন যেন নিজের খোদাকে একথা বলো যে, আমি এসব নিয়ামতের যোগ্য ছিলাম না, আমাকে মানুষ সৃষ্টি না করে একটি বানর, নেকড়ে, কুমীর বা কাক হিসেবে সৃষ্টি করা উচিত ছিল।