এ আয়াতে মুসলমানদেরকে দু’টো জিনিসের হুকুম দেয়া হয়েছে। একটি হচ্ছে, “সাল্লু আলাইহে অর্থাৎ তাঁর প্রতি দরূদ পড়ো। অন্যটি হচ্ছে, “ওয়া সাল্লিমূ তাসলীমা” অর্থাৎ তাঁর প্রতি সালাম ও প্রশান্তি পাঠাও।
“সালাত” শব্দটি যখন “আলা” অব্যয় সহকারে বলা হয় তখন এর তিনটি অর্থ হয়ঃ এক, কারো অনুরক্ত হয়ে পড়া। দুই, কারো প্রশংসা করা। তিন, কারো পক্ষে দোয়া করা। এ শব্দটি যখন আল্লাহর জন্য বলা হবে তখন একথা সুস্পষ্ট যে, তৃতীয় অর্থটির জন্য এটি বলা হবে না। কারণ আল্লাহর অন্য কারো কাছে দোয়া করার ব্যাপারটি একেবারেই অকল্পনীয়। তাই সেখানে অবশ্যই তা হবে শুধুমাত্র প্রথম দু’টি অর্থের জন্য। কিন্তু যখন এ শব্দ বান্দাদের তথা মানুষ ও ফেরেশতাদের জন্য বলা হবে তখন তা তিনটি অর্থেই বলা হবে। তার মধ্যে ভালোবাসার অর্থও থাকবে, প্রশংসার অর্থও থাকবে এবং দোয়া ও রহমতের অর্থও থাকবে। কাজেই মু’মিনদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষে “সাল্লু আলাইহে”-এর হুকুম দেয়ার অর্থ হচ্ছে এই যে, তোমরা তাঁর ভক্ত-অনুরক্ত হয়ে যাও তাঁর প্রশংসা করো এবং তাঁর জন্য দোয়া করো।
“সালাত” শব্দেরও দু’টি অর্থ হয়। এক সবরকমের আপদ-বিপদ ও অভাব অনটন মুক্ত থাকা। এর প্রতিশব্দ হিসেবে আমাদের এখানে সালামতি বা নিরাপত্তা শব্দের ব্যবহার আছে, দুই, শান্তি, সন্ধি ও অবিরোধিতা। কাজেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষে “সাল্লিমূ তাসলিমা” বলার একটি অর্থ হচ্ছে, তোমরা তাঁর জন্য পূর্ণ নিরাপত্তার দোয়া করো। আর এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, তোমরা পুরোপুরি মনে প্রাণে তাঁর সাথে সহযোগিতা করো, তাঁর বিরোধিতা করা থেকে দূরে থাকো এবং তাঁর যথার্থ আদেশ পালনকারীতে পরিণত হও।
এ হুকুমটি নাযিল হবার পর বহু সাহাবী রসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন, হে আল্লাহর রসূল! সালামের পদ্ধতি তো আপনি আমাদের বলে দিয়েছেন। (অর্থাৎ নামাযে “আসসালামু আলাইকা আইয়ূহান নাবীয্যু ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ” এবং দেখা সাক্ষাত হলে “আসসালামু আলাইকা ইয়া রসূলুল্লাহ” বলা।) কিন্তু আপনার প্রতি সালাত পাঠাবার পদ্ধতিটা কি? এর জবাবে নবী করীম ﷺ বিভিন্ন লোককে বিভিন্ন সময় যেসব দরূদ শিখিয়েছেন তা আমি নিচে উদ্ধৃত করছিঃ
কা’ব ইবনে ‘উজরাহ (রা.) থেকেঃ
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ
এ দরূদটি সামান্য শাব্দিক বিভিন্নতা সহকারে হযরত কা’ব ইবনে উজ্ রাহ (রাঃ) থেকে বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে ইমাম আহমাদ, ইবনে আবী শাইবাহ, আবদুর রাজ্জাক, ইবনে আবী হাতেম ও ইবনে জারীরে উদ্ধৃত হয়েছে।
ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকেঃ তাঁর থেকেও হালকা পার্থক্য সহকারে ওপরে বর্ণিত একই দরূদ উদ্ধৃত হয়েছে। (ইবনে জারীর)
আবু হুমাইদ সায়েদী (রাঃ ) থেকেঃ
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ أَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ أَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ
(মুআত্তা ইমাম মালেক, মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ, আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ)
আবু মাসউদ বদরী (রাঃ) থেকেঃ
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ فَى الْعَالَمِينَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ
(মালেক, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, আহমদ, ইবনে জারীর, ইবনে হাব্বান ও হাকেম)
আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকেঃ
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ عَبْدِكَ وَرَسُولِكَ ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ ، وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ-
(আহমাদ, বুখারী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ)
বুরাইদাতাল খুযাঈ থেকেঃ
اللَّهُمَّ اجْعَلْ صَلَوَاتِكَ وَرَحْمَتَكَ وَبَرَكَاتِكَ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا جَعَلْتَهَا عَلَى إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ-
(আহমাদ, আবদ ইবনে হুমাইদ ও ইবনে মারদুইয়া)
হযরত আবু হুরাইরাহ (রাঃ ) থেকেঃ
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ وَبَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ آلِ إِبْرَاهِيمَ فِى الْعَالَمِينَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ- (নাসাঈ)
হযরত তালহা (রাঃ) থেকেঃ
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ (ইবনে জারীর)
এ দরূদগুলো শব্দের পার্থক্য সত্ত্বেও অর্থ সবগুলোর একই। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। এ বিষয়গুলো ভালোভাবে অনুধাবন করতে হবে।
প্রথমত, এসবগুলোতে নবী করীম ﷺ মুসলমানদেরকে বলেছেন, আমার ওপর দরূদ পাঠ করার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, তোমরা আল্লাহর কাছে এ মর্মে দোয়া করো, হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদের ﷺ ওপর দরূদ পাঠাও। অজ্ঞ লোকেরা, যাদের অর্থজ্ঞান নেই, তারা সঙ্গে সঙ্গেই আপত্তি করে বসে যে, এতো বড়ই অদ্ভূত ব্যাপার যে, আল্লাহ তো আমাদের বলছেন তোমরা আমার নবীর ওপর দরূদ পাঠ করো কিন্তু অপর দিকে আমরা আল্লাহকে বলছি তুমি দরূদ পাঠাও। অথচ এভাবে নবী ﷺ লোকদেরকে একথা বলেছেন যে, তোমরা আমার প্রতি “সালাতের” হক আদায় করতে চাইলেও করতে পারো না, তাই আল্লাহরই কাছে দোয়া চাও যেন তিনি আমার প্রতি দরূদ পাঠান। একথা বলা নিষ্প্রয়োজন, আমরা নবী করীমের ﷺ মর্যাদা বুলন্দ করতে পারি না। আল্লাহই বুলন্দ করতে পারেন। আমরা নবী করীমের ﷺ অনুগ্রহের প্রতিদান দিতে পারি না। আল্লাহই তার প্রতিদান দিতে পারেন। আমরা নবী করীমের ﷺ কথা আলোচনাকে উচ্চমাপে পৌঁছাবার এবং তাঁর দ্বীনকে সম্প্রসারিত করার জন্য যতই প্রচেষ্টা চালাই না কেন আল্লাহর মেহেরবানী এবং তাঁর সুযোগ ও সহায়তা দান ছাড়া তাতে কোন প্রকার সাফল্য অর্জন করতে পারি না। এমন কি নবী করীমের ﷺ প্রতি ভক্তি ভালোবাসাও আমাদের অন্তরে আল্লাহরই সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। অন্যথায় শয়তান নাজানি কত রকম প্ররোচনা দিয়ে আমাদের তাঁর প্রতি বিরূপ করে তুলতে পারে। اعاذنا الله من ذلك- ---আল্লাহ আমাদের তা থেকে বাঁচান। কাজেই নবী করীমের ﷺ ওপর দরূদের হক আদায় করার জন্য আল্লাহর কাছে তাঁর প্রতি সালাত বা দরূদের দোয়া করা ছাড়া আর কোন পথ নেই। যে ব্যক্তি “আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মাদিন” বলে সে যেন আল্লাহ সমীপে নিজের অক্ষমতা স্বীকার করতে গিয়ে বলে, হে আল্লাহ! তোমার নবীর ওপর সালাত বা দরূদ পাঠানোর যে কর্তব্য আমার ওপর চাপানো আছে তা যথাযথভাবে সম্পন্ন করার সামর্থ্য আমার নেই, আমার পক্ষ থেকে তুমিই তা সম্পন্ন করে দাও এবং তা করার জন্য আমাকে যেভাবে কাজে নিয়োগ করতে হয় তা তুমি নিয়োগ করো।
দ্বিতীয়ত, নবী করীমের ﷺ ভদ্রতা ও মহানুভবতার ফলে তিনি কেবল নিজেকেই এ দোয়ার জন্য নির্দিষ্ট করে নেননি। বরং নিজের সাথে তিনি নিজের পরিজন স্ত্রী ও পরিবারকেও শামিল করে নিয়েছেন। স্ত্রী ও পরিবার অর্থ সুস্পষ্ট আর পরিজন শব্দটি নিছক নবী করীমের ﷺ পরিবারের লোকদের জন্য নির্দিষ্ট নয়। বরং এর মধ্যে এমনসব লোকও এসে যায় যারা তাঁর অনুসারী এবং তাঁর পথে চলেন। পরিজন অর্থে মূলে “আল” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী ভাষার দৃষ্টিতে “আল” ও “আহল” --এর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এই যে, কোন ব্যক্তির “আল” হচ্ছে এমন সব লোক যারা হয় তার সাথী, সাহায্যকারী ও অনুসারী, তারা তার আত্মীয় বা অনাত্মীয় হোক বা না হোক অবশ্যই তার আত্মীয়। কুরআন মজীদের ১৪টি স্থানে “আলে ফেরাউন” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে কোন জায়গায়ও “আহল” মানে ফেরাউনের পরিবারের লোকেরা নয়। বরং এমন সমস্ত লোক যারা হযরত মূসার মোকাবিলায় ফেরাউনের সমর্থক ও সহযোগী ছিল। (দৃষ্টান্ত স্বরূপ দেখুন সূরা বাকারার ৪৯-৫০, আলে ইমরানের ১১, আল আ’রাফের ১৩০ ও আল মু’মিনূনের ৪৬ আয়াতসমুহ) কাজেই এমন সমস্ত লোকই “আলে” মুহাম্মাদ ﷺ এর বহির্ভূত হয়ে যায় যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শের অনুসারী নয়। চাই, তারা নবীর পরিবারের লোকই হোক না কেন। পক্ষান্তরে এমন সমস্ত লোক ও এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় যারা নবী করীমের ﷺ পদাংক অনুসরণ করে চলে, চাই তারা নবী করীমের ﷺ কোন দূরবর্তী রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয় নাই হোক। তবে নবী পরিবারের এমন প্রত্যেকটি লোক সর্বতোভাবেই “আলে” মুহাম্মাদের ﷺ অন্তর্ভুক্ত হবে যারা তাঁর সাথে রক্ত সম্পর্কও রাখে আবার তাঁর অনুসারীও।
তৃতীয়, তিনি যেসব দরূদ শিখিয়েছেন তার প্রত্যেকটিতেই অবশ্যই একথা রয়েছে যে, তাঁর প্রতি এমন অনুগ্রহ করা হোক যা ইবরাহীম ও ইবরাহীমের পরিজনদের ওপর করা হয়েছিল। এ বিষয়টি বুঝতে লোকদের বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আলেমগণ এর বিভিন্ন জটিল ব্যাখ্যা (তাবীল) করেছেন। কিন্তু কোন একটি ব্যাখ্যাও ঠিকমতো গ্রহণীয় নয়। আমার মতে এর সঠিক ব্যাখ্যা হচ্ছে এই যে, (অবশ্য আল্লাহই সঠিক জানেন) আল্লাহ হযরত ইবরাহীমের প্রতি একটি বিশেষ করুণা করেন। আজ পর্যন্ত কারো প্রতি এ ধরনের করুণা প্রদর্শন করেননি। আর তা হচ্ছে এই যে, যারা নবুওয়াত, অহী ও কিতাবকে হিদায়াতের উৎস বলে মেনে নেয় তারা সবাই হযরত ইবরাহীমের (আ) নেতৃত্বের প্রশ্নে একমত। এ ব্যাপারে মুসলমান, খৃস্টান ও ইহুদির মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। কাজেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে এই যে, যেভাবে হযরত ইবরাহীমকে মহান আল্লাহ সমস্ত নবীর অনুসারীদের নেতায় পরিণত করেছেন। অনুরূপভাবে আমাকেও পরিণত করুন। এমন কোন ব্যক্তি যে নবুওয়াত মেনে নিয়েছে সে যেন আমার নবুওয়াতের প্রতি ঈমান আনা থেকে বঞ্চিত না হয়।
নবী করীমের ﷺ প্রতি দরূদ পড়া ইসলামের সুন্নাত। তাঁর নাম উচ্চারিত হলে তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করা মুস্তাহাব। বিশেষ করে নামাযে দরূদ পড়া সুন্নাত। এ বিষয়ে সমগ্র আলেম সমাজ একমত। সমগ্র জীবনে নবী (সা.) এর প্রতি একবার দরূদ পড়া ফরয, এ ব্যাপারে ইজমা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কারণ আল্লাহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এর হুকুম দিয়েছেন। কিন্তু এরপর দরূদের ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের মধ্যে বিভিন্ন মত দেখা দিয়েছে।
ইমাম শায়েঈ (র.) বলেন, নামাযে একজন মুসল্লী যখন শেষ বার তাশাহ্হুদ পড়ে তখন সেখানে সালাতুন আলান নবী (صلوة على النبى) পড়া ফরয। কোন ব্যক্তি এভাবে না পড়লে তার নামায হবে না। সাহাবীগণের মধ্য থেকে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), হযরত আবু মাসউদ আনসারী (রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) ও হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.), তাবেঈদের মধ্য থেকে শা’বী, ইমাম মুহাম্মাদ বাকের, মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব কুরযী ও মুকাতিল ইবনে হাউয়ান এবং ফকীহগণের মধ্য থেকে ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহও এ মতের প্রবক্তা ছিলেন। শেষের দিকে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বালও মত অবলম্বন করেন।
ইমাম আবু হানীফা (র), ইমাম মালেক (র) ও অধিকাংশ উলামা এ মত পোষণ করেন যে, দরূদ সারা জীবনে শুধুমাত্র একবার পড়া ফরয। এটি কালেমায়ে শাহাদাতের মতো। যে ব্যক্তি একবার আল্লাহকে ইলাহ বলে মেনে নিয়েছে এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের স্বীকৃতি দিয়েছে সে ফরয আদায় করে দিয়েছে। অনুরূপভাবে যে একবার দরূদ পড়ে নিয়েছে সে নবীর ওপর সালাত পাঠ করার ফরয আদায়ের দায়িত্ব মুক্ত হয়ে গেছে। এরপর তার ওপর আর কালেমা পড়া ফরয নয় এবং দরূদ পড়াও ফরয নয়।
একটি দল নামাযে দরূদ পড়াকে সকল অবস্থায় ওয়াজিব গণ্য করেন। কিন্তু তারা তাশাহহুদের সাথে তাকে শৃংখলিত করেন না।
অন্য একটি দলের মতে প্রত্যেক দোয়ায় দরূদ পড়া ওয়াজিব। আরো কিছু লোক নবী করীমের ﷺ নাম এলে দরূদ পড়া ওয়াজিব বলে অভিমত পোষণ করেন। অন্য একটি দলের মতে এক মজলিসে নবী করীমের ﷺ নাম যতবারই আসুক না কেন দরূদ পড়া কেবলমাত্র একবারই ওয়াজিব।
কেবলমাত্র ওয়াজিব হবার ব্যাপারে এ মতবিরোধ। তবে দরূদের ফযীলত, তা পাঠ করলে প্রতিদান ও সওয়াব পাওয়া এবং তার একটি অনেক বড় সৎকাজ হবার ব্যাপারে তো সমস্ত মুসলিম উম্মাত একমত। যে ব্যক্তি ঈমানের সামান্যতম স্পর্শও লাভ করেছে তার এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন থাকতে পারে না। এমন প্রত্যেকটি মুসলমানের অন্তর থেকেই তো স্বাভাবিকভাবে দরূদ বের হবে যার মধ্যে এ অনুভূতি থাকবে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর পরে আমাদের প্রতি সবচেয়ে বড় অনুগ্রহকারী। মানুষের দিলে ঈমান ও ইসলামের মর্যাদা যত বেশী হবে তত বেশী মর্যাদা হবে তার দিলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুগ্রহেরও। আর মানুষ যত বেশী এ অনুগ্রহের কদর করতে শিখবে তত বেশীই সে নবী করীমের ﷺ ওপর দরূদ পাঠ করবে। কাজেই বেশী বেশী দরূদ পড়া হচ্ছে একটি মাপকাঠি। এটি পরিমাপ করে জানিয়ে দেয় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বীনের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কতটা গভীর এবং ঈমানের নিয়ামতের কতটা কদর তার অন্তরে আছে। এ কারণেই নবী ﷺ বলেছেনঃ
مَنْ صَلَّى عَلَىَّ صَلاَةً لَمْ تَزَلِ الْمَلاَئِكَةُ تُصَلِّى عَلَيْهِ مَا صَلَّى عَلَىَّ
“যে ব্যক্তি আমার প্রতি দরূদ পাঠ করে ফেরেশতারা তার প্রতি দরূদ পাঠ করে যতক্ষণ সে দরূদ পাঠ করতে থাকে।” (আহমাদ ও ইবনে মাজাহ)
مَنْ صَلَّى عَلَىَّ وَاحِدَةً صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ عَشْرًا
“যে আমার ওপর একবার দরূদ পড়ে আল্লাহ তার ওপর দশবার দরূদ পড়েন।” (মুসলিম)
أَوْلَى النَّاسِ بِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَكْثَرُهُمْ عَلَىَّ صَلاَةً(ترمذى)
“কিয়ামতের দিন আমার সাথে থাকার সবচেয়ে বেশী হকদার হবে সেই ব্যক্তি যে আমার ওপর সবচেয়ে বেশী দরূদ পড়বে।” (তিরযিমী)
الْبَخِيلُ الَّذِى مَنْ ذُكِرْتُ عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَىَّ(ترمذى)
“আমার কথা যে ব্যক্তির সামনে আলোচনা করা হয় এবং সে আমার ওপর দরূদ পাঠ করে না সে কৃপণ।” (তিরযিমী)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম ছাড়া অন্যের জন্য اللهم صل على فلان অথবা صلى الله عليه وسلم কিংবা এ ধরনের অন্য শব্দ সহকারে ‘সালাত’ পেশ করা জায়েয কিনা, এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। একটি দল, কাযী ঈয়াযের নাম এ দলের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, একে সাধারণভাবে জায়েয মনে করে। এদের যুক্তি হচ্ছে, কুরআনে আল্লাহ নিজেই অ-নবীদের ওপর একাধিক জায়গায় সালাতের কথা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন। যেমন
أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ (البقرة-157) خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ (التوبة-103) هُوَ الَّذِي يُصَلِّي عَلَيْكُمْ وَمَلَائِكَتُهُ (الاحزاب-43)
এভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামাও একাধিকবার অ-নবীদের জন্য সালাত শব্দ সহকারে দোয়া করেন। যেমন একজন সাহাবীর জন্য তিনি দোয়া করেন الهم صل على ال ابى اوفى (যে আল্লাহ! আবু আওফার পরিজনদের ওপর সালাত পাঠাও) হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহর (রা.) স্ত্রীর আবেদনের জবাবে বলেন, صلى الله عليك وعلى زوجك (আল্লাহ তোমার ও তোমার স্বামীর ওপর সালাত পাঠান)। যারা যাকাত নিয়ে আসতেন তাদের পক্ষে তিনি বলতেন, الهم صل عليهم (হে আল্লাহ! ওদের ওপর সালাত পাঠাও)। হযরত সা’দ ইবনে উবাদার পক্ষে তিনি বলেন, الهم اجعل صلوتك ورحمتك على ال سعدبن عباده (হে আল্লাহ! সা’দ ইবনে উবাদার (রা.) পরিজনদের ওপর তোমার সালাত ও রহমত পাঠাও)। আবার মু’মিনের রূহ সম্পর্কে নবী করীম ﷺ খবর দিয়েছেন যে, ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করেঃ صلى الله عليك وعلى جسدك কিন্তু মুসলিম উম্মাহর অধিকাংশের মতে এমনটি করা আল্লাহ ও তাঁর রসূলে জন্য তো সঠিক ছিল কিন্তু আমাদের জন্য সঠিক নয়। তারা বলেন, সালাত ও সালামকে মুসলমানরা আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এটি বর্তমানে তাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। তাই নবীদের ছাড়া অন্যদের জন্য এগুলো ব্যবহার না করা উচিত। এজন্যই হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয একবার নিজের একজন শাসন কর্তাকে লিখেছিলেন, “আমি শুনেছি কিছু বক্তা এ নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করতে শুরু করেছেন যে, ‘তারা সালাতু আলান নাবী’ --এর মতো নিজেদের পৃষ্ঠপোষক ও সাহায্য কারীদের জন্যও “সালাত” শব্দ ব্যবহার করছেন। আমার এ পত্র পৌঁছে যাবার পরপরই তাদেরকে এ কাজ থেকে নিরস্ত করো এবং সালাতকে একমাত্র নবীদের জন্য নির্দিষ্ট করে অন্য মুসলমানদের জন্য দোয়া করেই ক্ষান্ত হবার নিদের্শ দাও।” (রুহুল মা’আনী) অধিকাংশ আলেম এ মতও পোষণ করেন যে, নবী করীম ﷺ ছাড়া অন্য কোন নবীর জন্যও “সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম” ব্যবহার করা সঠিক নয়।