আয়াত
৭১ ) এরা কি দেখে না, আমি নিজের হাতে তৈরী জিনিসের ৬০ মধ্য থেকে এদের জন্য সৃষ্টি করেছি গবাদি পশু এবং এখন এরা তার মালিক।
أَوَلَمْ يَرَوْا۟ أَنَّا خَلَقْنَا لَهُم مِّمَّا عَمِلَتْ أَيْدِينَآ أَنْعَٰمًا فَهُمْ لَهَا مَٰلِكُونَ ٧١
৭২ ) আমি এভাবে তাদেরকে এদের নিয়ন্ত্রণে দিয়ে দিয়েছি যে, তাদের মধ্য থেকে কারো ওপর এরা সওয়ার হয়, কারো গোশত খায়
وَذَلَّلْنَٰهَا لَهُمْ فَمِنْهَا رَكُوبُهُمْ وَمِنْهَا يَأْكُلُونَ ٧٢
৭৩ ) এবং তাদের মধ্যে এদের জন্য রয়েছে নানা ধরনের উপকারিতা ও পানীয়। এরপর কি এরা কৃতজ্ঞ হয় না? ৬১
وَلَهُمْ فِيهَا مَنَٰفِعُ وَمَشَارِبُ أَفَلَا يَشْكُرُونَ ٧٣
৭৪ ) এ সবকিছু সত্ত্বেও এরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে এবং এদেরকে সাহায্য করা হবে এ আশা করছে।
وَٱتَّخَذُوا۟ مِن دُونِ ٱللَّهِ ءَالِهَةً لَّعَلَّهُمْ يُنصَرُونَ ٧٤
৭৫ ) তারা এদের কোন সাহায্য করতে পারে না বরং উল্টো এরা তাদের জন্য সদা প্রস্তুত সৈন্য হয়ে বিরাজ করছে। ৬২
لَا يَسْتَطِيعُونَ نَصْرَهُمْ وَهُمْ لَهُمْ جُندٌ مُّحْضَرُونَ ٧٥
৭৬ ) হ্যাঁ, এদের তৈরী কথা যেন তোমাকে মর্মাহত না করে এদের গোপন ও প্রকাশ্য সব কথাই আমি জানি। ৬৩
فَلَا يَحْزُنكَ قَوْلُهُمْ إِنَّا نَعْلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعْلِنُونَ ٧٦
৭৭ ) মানুষ ৬৪ কি দেখে না, তাকে আমি সৃষ্টি করেছি শুক্রবিন্দু থেকে এবং তারপর সে দাঁড়িয়ে গেছে স্পষ্ট ঝগড়াটে হয়ে? ৬৫
أَوَلَمْ يَرَ ٱلْإِنسَٰنُ أَنَّا خَلَقْنَٰهُ مِن نُّطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيمٌ مُّبِينٌ ٧٧
৭৮ ) এখন সে আমার ওপর উপমা প্রয়োগ করে ৬৬ এবং নিজের সৃষ্টির কথা ভুলে যায় ৬৭ বলে, "এ হাড়গুলো যখন পচে গলে গেছে এতে আবার প্রাণ সঞ্চার করবে কে?"
وَضَرَبَ لَنَا مَثَلًا وَنَسِىَ خَلْقَهُۥ قَالَ مَن يُحْىِ ٱلْعِظَٰمَ وَهِىَ رَمِيمٌ ٧٨
৭৯ ) তাকে বলো, এদেরকে তিনি জীবিত করবেন যিনি প্রথমে এদেরকে সৃষ্টি করেছিলেন এবং তিনি সৃষ্টির প্রত্যেকটি কাজ জানেন।
قُلْ يُحْيِيهَا ٱلَّذِىٓ أَنشَأَهَآ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيمٌ ٧٩
৮০ ) তিনিই তোমাদের জন্য সবুজ বৃক্ষ থেকে আগুন সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা তা থেকে নিজেদের চুলা জ্বালিয়ে থাকো। ৬৮
ٱلَّذِى جَعَلَ لَكُم مِّنَ ٱلشَّجَرِ ٱلْأَخْضَرِ نَارًا فَإِذَآ أَنتُم مِّنْهُ تُوقِدُونَ ٨٠
৬০.
হাত শব্দটি আল্লাহর জন্য রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, এর অর্থ এ নয় যে, নাউযুবিল্লাহ পবিত্র ও মহান আল্লাহ শরীর ও দেহাবয়বের অধিকারী এবং মানুষের মতো হাত দিয়ে কাজ করেন। বরং এর মাধ্যমে একথাই বুঝানো হয়েছে যে, এ জিনিসগুলো আল্লাহ নিজেই তৈরী করেছেন এবং এগুলোর সৃষ্টিকর্মের অন্য কারো সামান্যতমও অংশ নেই।
৬১.
নিয়ামতকে নিয়ামতদাতা ছাড়া অন্য কারো দান মনে করা, এজন্য অন্য কারো অনুগ্রহভাজন হওয়া এবং নিয়ামতদাতা ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে নিয়ামতলাভের আশা করা অথবা নিয়ামত চাওয়া, এ সবকিছুই নিয়ামত অস্বীকারেরই নামান্তর। অনুরূপভাবে নিয়ামতদাতার প্রদত্ত নিয়ামতকে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্যবহার করলেও নিয়ামত অস্বীকার করাই হয়। কাজেই একজন মুশরিক ও কাফের এবং মুনাফিক ও ফাসেক নিছক মুখে ধন্যবাদ শব্দ ব্যবহার করে আল্লাহর শোকরগুজার বান্দা গণ্য হতে পারে না। এ জন্তু-জানোয়ারগুলোকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, একথা মেনে নিতে মক্কার কাফেররা অস্বীকার করতো না। তাদের একজনও এগুলোর সৃষ্টির ব্যাপারে অন্য উপাস্যদের হাত আছে বলে দাবী করতো না। কিন্তু এ সবকিছু মেনে নেবার পরও যখন তারা আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতের জন্য নিজেদের উপাস্য দেবতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতো, তাদের সামনে নজরানা পেশ করতো এবং আরো নিয়ামত দান করার জন্য তাদের কাছে প্রার্থনা করতো, এ সঙ্গে তাদের জন্য বলিদান করতে থাকতো, তখন আল্লাহর কাছে তাদের মৌখিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে পড়তো। এজন্যই আল্লাহ তাদেরকে নিয়ামত অস্বীকারকারী ও অকৃতজ্ঞ বলে অভিহিত করেছেন।
৬২.
অর্থাৎ ঐ মিথ্যা উপাস্য দেবতারা নিজেরাই তাদের অস্তিত্ব, টিকে থাকা, সংরক্ষণ ও প্রয়োজন পূরণের জন্য এসব পূজা উপাসনাকারীর মুখাপেক্ষী। এ সেনাবাহিনী ছাড়া তাদের খোদায়ী এক দিনও চলে না। এরা তাদের সার্বক্ষনিক উপস্থিত দাস। এরা তাদের দরবার বানিয়ে ও সাজিয়ে রাখছে। এরা তাদের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে বেড়াচ্ছে। এরা আল্লাহর বান্দদেরকে তাদের ভক্তে-অনুরক্তে পরিণত করছে। তাদের সমর্থনে এরা ঝগড়া-বিবাদ ও যুদ্ধ-বিগ্রহ করছে। তারপরই তাদের খোদায়ী প্রতিষ্ঠিত হয়। নয়তো কেউ তাদের কথা জিজ্ঞেসও করতো না। তারা আসল খোদা নয়। কেউ তাদেরকে মেনে নিক বা না নিক তারা নিজ শক্তিতে বলীয়ান হয়ে সমগ্র বিশ্ব-জাহানে কর্তৃত্ব চালিয়ে যাবে, এমন ক্ষমতা তাদের নেই।
৬৩.
সম্বোধন করা হয়েছে নবী ﷺ কে। গোপন ও প্রকাশ্য কথা বলে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, মক্কার কাফেরদের বড় বড় সরদাররা তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যার ঝড় সৃষ্টি করছিল। তারা ভালোভাবেই জানতো এবং নিজেদের ব্যক্তিগত মজলিসে একথা স্বীকার করতো যে, নবী ﷺ এর বিরুদ্ধে তারা যেসব অপবাদ দিচ্ছে সেগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন। তারা লোকদের মনে তাঁর বিরুদ্ধে খারাপ ধারণা সৃষ্টি করার জন্য তাঁকে কবি, গণক, যাদুকর, পাগল এবং আরো না জানি কত কি বলতো। কিন্তু তাদের নিজেদের বিবেক একথা মানতো এবং তারা পরস্পরের সামনে স্বীকারও করতো যে, এসব ডাহা মিথ্যা কথা এবং নিছক তাঁর দাওয়াতকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য তারা এগুলো তৈরী করছে। তাই আল্লাহ তাঁর নবীকে বলছেন, এদের বাজে কথায় মন খারাপ করো না। যারা মিথ্যা দিয়ে সত্যের মোকাবিলা করে তারা শেষ পর্যন্ত এ দুনিয়ায়ও ব্যর্থ হবে এবং আখেরাতেও নিজেদের অশুভ পরিণতি দেখে নেবে।
৬৪.
এবার কাফেরদের প্রশ্নের যুক্তিভিত্তিক জবাব দেয়া হচ্ছে। ৪৮ আয়াতে এ প্রশ্নটি উদ্ধৃত হয়েছে। “কিয়ামতের হুমকি কবে পূর্ণ হবে” তাদের এ প্রশ্ন এ জন্য ছিল না যে, তারা কিয়ামত আসার তারিখ জানতে চাচ্ছিল বরং এজন্য ছিল যে, মৃত্যুর পর তারা মানুষদের পুনর্বার উঠানোকে অসম্ভব বরং বুদ্ধি বিরোধী মনে করতো। তাই তাদের প্রশ্নের জবাবে আখেরাতের সম্ভাবনার পক্ষে যুক্তি পেশ করা হচ্ছে।
ইবনে আব্বাস (রাঃ), কাতাদাহ ও সাঈদ ইবনে জুবাইর বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায়, এ সময় মক্কার কাফের সরদারদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি কবরস্থান থেকে কোন লাশের একটি গলিত হাড় নিয়ে আসে এবং নবী ﷺ এর সামনে সেটি ভেঙ্গে ফেলে এবং তার বিচূর্ণিত অংশগুলো বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে বলে, “হে মুহাম্মাদ, তুমি বলছো মৃতদেরকে আবার জীবিত করে উঠানো হবে। বলো, এ পঁচা-গলা হাড়গুলোকে আবার কে জীবিত করবে?” সঙ্গে সঙ্গেই এ আয়াতগুলোতে এর জবাব দেয়া হয়।
৬৫.
অর্থাৎ এমন শুক্রবিন্দু যার মধ্যে নিছক একটি প্রাথমিক জীবন-কীট ছাড়া আর কিছুই ছিল না, তাকে উন্নতি দান করে আমি এমন পর্যায়ে পৌঁছিয়ে দিয়েছি যার ফলে সে কেবল প্রাণীদের মতো চলাফেরা ও পানাহার করতে থাকেনি বরং এর থেকে অগ্রসর হয়ে তার মধ্যে চেতনা, বুদ্ধি-জ্ঞান এবং তর্ক-বিতর্ক, আলাপ-আলোচনা, যুক্তি প্রদর্শন করা ও বাগ্মীতার এমন সব যোগ্যতা সৃষ্টি হয়ে গেছে যা অন্য কোন প্রাণীর মধ্যে নেই। এমন কি এখন সে নিজের স্রষ্টাকেও বিদ্রূপ করতে এগিয়ে আসছে।
৬৬.
অর্থাৎ আমাকে সৃষ্টিকুলের মতো অক্ষম মনে করে এবং এ ধারণা পোষণ করে যে, মানুষ যেমন কোন মৃতকে জীবিত করতে পারে না, ঠিক তেমনি আমিও পারি না।
৬৭.
অর্থাৎ একথা ভুলে যায় যে, আমি নিষ্প্রাণ বস্তু থেকে এমন প্রাথমিক জীবন-কীট সৃষ্টি করেছি, যা তার সৃষ্টির উৎসে পরিণত হয়েছে এবং তারপর এ কীটকে লালন করে তাকে এত বড় করে দিয়েছি, যার ফলে সে আজ আমার সামনে কথা বলার যোগ্যতা অর্জন করেছে।
৬৮.
এর অর্থ হচ্ছে, তিনি সবুজ বৃক্ষসমূহে এমন দাহ্যবস্তু রেখে দিয়েছেন যা ব্যবহার করে তোমরা কাঠের সাহায্যে আগুন জ্বালিয়ে থাকো। অথবা এর মাধ্যমে ‘মারখ’ ও ‘আফার’ নামক দু’টি গাছের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ গাছ দু’টির কাঁচা ডাল নিয়ে আরবের লোকেরা একটার ওপর আর একটাকে মারতো, ফলে তা থেকে আগুন ঝরে পড়তো। প্রাচীন যুগে গ্রামীণ আরবরা আগুন জ্বালাবার জন্য চকমকি হিসেবে এ ডাল ব্যবহার করতো এবং সম্ভবত আজও করে থাকে।