বিখ্যাত মুফাসসির কাতাদা সূরা ইউনুসের ৯৮ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ “এমন কোন জনপদ দেখা যায়নি যার অধিবাসীরা কুফরী করেছে এবং আযাব এসে যাবার পরে ঈমান এনেছে আর তারপর তাদেরকে রেহাই দেয়া হয়েছে। একমাত্র ইউনুসের সম্প্রদায় এর ব্যতিক্রম।। তারা যখন তাদের নবীর সন্ধান করে তাঁকে না পেয়ে অনুভব করলো আযাব নিকটে এসে গেছে তখন আল্লাহ তাদের মনে তাওবার প্রেরণা সৃষ্টি করলেন।” (ইবনে কাসীর, ২ খণ্ড, ৪৩৩ পৃষ্ঠা)
একই আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা আলূসী লিখছেন, এ জাতির কাহিনী হচ্ছেঃ “হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম মসুল এলাকায় নিনেভাবাসীদের কাছে আগমন করেছিলেন। তারা ছিল কাফের ও মুশরিক। হযরত ইউনুস তাদেরকে এক ও লা-শরীক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার ও মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করার আহবান জানান। তারা তাঁর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে এবং তাঁর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে। হযরত ইউনুস তাদেরকে জানিয়ে দেন, তৃতীয় দিন আযাব আসবে এবং তৃতীয় দিন আসার আগেই অর্ধ রাতে তিনি জনপদ থেকে বের হয়ে পড়েন। তারপর দিনের বেলা যখন এ জাতির মাথার ওপর আযাব পৌঁছে যায় ...................... এবং তাদের বিশ্বাস জন্মে যে, তারা সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে তখন তারা নিজেদের নবীকে খুঁজতে থাকে কিন্তু তাঁকে খুঁজে পায় না। শেষ পর্যন্ত তারা সবাই নিজেদের ছেলে-মেয়ে, পরিবার-পরিজন ও গবাদি পশু নিয়ে খোলা প্রান্তরে বের হয়ে আসে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে ও তাওবা করে। ................................ আল্লাহ তাদের প্রতি করুণা করেন এবং তাদের দোয়া কবুল করেন।” (রূহুল মা’আনী, ১১ খণ্ড, ১৭০ পৃষ্ঠা)
সূরা আম্বিয়ার ৮৭ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা আলূসী লিখেছেনঃ “হযরত ইউনুসের নিজের জাতির প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে বের হয়ে যাওয়া ছিল হিজরাতের কাজ। কিন্তু তাঁকে এর হুকুম দেয়া হয়নি।” (রুহুল মা’আনী, ১৭ খণ্ড, ৭৭ পৃষ্ঠা) তারপর তিনি হযরত ইউনুসের দোয়ার বাক্যাংশ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ এর অর্থ বর্ণনা করেছেন এভাবেঃ “অর্থাৎ আমি অপরাধী ছিলাম। নবীদের নিয়মের বাইরে গিয়ে হুকুম আসার আগেই হিজরাত করার ব্যাপারে আমি তাড়াহুড়া করেছিলাম। হযরত ইউনুস আলাইহিস সালামের পক্ষ থেকে এটি ছিল তাঁর নিজের গোনাহের স্বীকৃতি এবং তাওবার প্রকাশ, যাতে আল্লাহ তাঁকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন।” (রূহুল মা’আনী ১৭ খণ্ড, ৭৮ পৃষ্ঠা)
এ আয়াতটির টীকায় মওলানা আশরাফ আলী থানবী লিখেছেনঃ “তাঁর নিজের জাতি তাঁর প্রতি ঈমান না আনায় তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে চলে যান এবং জাতির ওপর থেকে আযাব হটে যাবার পরও নিজে তাদের কাছে ফিরে আসেননি। আর এ সফরের জন্য আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষাও করেননি।” (বায়ানুল কুরআন)
এ আয়াতের টীকার মওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী লিখেছেনঃ “জাতির কার্যকলাপে ক্ষিপ্ত হয়ে ক্রুদ্ধচিত্তে শহর থেকে বের হয়ে যান। আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা করেননি এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান যে, তিনি দিনের মধ্যে তোমাদের ওপর আযাব নেমে আসবে। إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ................ বলে নিজের অপরাধ স্বীকার করেন এ মর্মে যে, অবশ্যই আমি তাড়াহুড়া করেছি, তোমার হুকুমের অপেক্ষা না করেই জনপদের অধিবাসীদের ত্যাগ করে বের হয়ে পড়ি।”
সূরা সা-ফফা-তের ওপরে উল্লেখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম রাযী লিখেছেনঃ হযরত ইউনুসের অপরাধ ছিল, তাঁর যে জাতি তাঁর প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছিল আল্লাহ তাকে ধ্বংস করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, এ আযাব নির্ঘাত এসে যাবে। তাই তিনি সবর করেননি। জাতিকে দাওয়াত দেবার কাজ বাদ দিয়ে বাইরে বের হয়ে গিয়েছিলেন। অথচ দাওয়াতের কাজ সবসময় জারী রাখাই ছিল তাঁর দায়িত্ব। কারণ আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস না করার সম্ভাবনা তখনো ছিল।” (তাফসীরে কবীর, ৭ খণ্ড, ১৬৮ পৃষ্ঠা)
আল্লামা আলুসী إِذْ أَبَقَ إِلَى الْفُلْكِ الْمَشْحُونِ সম্পর্কে লিখেছেনঃ “আবাকা এর আসল মানে হচ্ছে, প্রভুর কাছ থেকে দাসের পালিয়ে যাওয়া। যেহেতু হযরত ইউনুস তাঁর রবের অনুমতি ছাড়াই নিজের জাতির কাছ থেকে পলায়ন করেছিলেন তাই তাঁর জন্য এ শব্দটির ব্যবহার সঠিক হয়েছে। “তারপর সামনের দিকে তিনি আরো লিখেছেনঃ “তৃতীয় দিনে হযরত ইউনুস আল্লাহর অনুমতি ছাড়াই বের হয়ে গেলেন। এখন তাঁর জাতি তাঁকে না পেয়ে তাদের বড়দের ছোটদের ও গবাদি পশুগুলো নিয়ে বের হয়ে পড়লো। আযাব অবতীর্ণ হবার বিষয়টি তাদের কাছে এসে পৌঁছেছিল। তারা আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করলো এবং ক্ষমা প্রার্থনা করলো। আল্লাহ তাদেরকে মাফ করে দিলেন।” (রূহুল মা’আনী, ২৩ খণ্ড, ১০৩ পৃষ্ঠা)
মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী وَهُوَ مُلِيمٌ এ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ “অভিযোগ এটিই ছিল যে, ইজতিহাদী ভুলের দরুন আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা না করে জনপদ থেকে বের হয়ে পড়েন এবং আযাবের দিন নির্ধারণ করে দেন্”
আবার সূরা আল কলম----এর
فَاصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ وَلَا تَكُنْ كَصَاحِبِ الْحُوتِ
আয়াতের টীকার মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী লিখেছেনঃ “অর্থাৎ মাছের পেটে প্রবেশকারী পয়গম্বরের (হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম) মতো মিথ্যা আরোপকারীদের ব্যাপারে সংকীর্ণমনতা ও ভাতি-আশংকার প্রকাশ ঘটাবে না।” তারপর একই আয়াতের وَهُوَ مَكْظُومٌ বাক্যাংশের টীকায় তিনি লিখেছেনঃ “অর্থাৎ জাতির বিরুদ্ধে ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। বিরক্ত হয়ে দ্রুত আযাবের জন্য দোয়া এবং ভবিষ্যদ্বাণী করে বসলেন।”
মুফাসসিরগণের এসব বর্ণনা থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, তিনটি ভুলের কারণে হযরত ইউনুসের (আ) ওপর অসন্তোষ ও ক্রোধ নেমে আসে। এক, তিনি নিজেই আযাবের দিন নির্দিষ্ট করে দেন। অথচ আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ধরনের কোন ঘোষণা হয়নি। দুই, সেদিন আসার আগেই হিজরাত করে দেশ থেকে বের হয়ে যান। অথচ আল্লাহর হুকুম না আসা পর্যন্ত নবীর নিজ স্থান ত্যাগ করা উচিত নয়। তিন, সে জাতির ওপর থেকে আযাব হটে যাওয়ার পর তিনি নিজে তাদের মধ্যে ফিরে যাননি।