আয যুমার

৭৫ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
২১ ) তোমরা কি দেখো না, আল্লাহ‌ আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেছেন। তারপর তাকে পৃথিবীর ওপর স্রোত, ঝর্ণাধারা এবং নদীর আকারে ৩৮ প্রবাহিত করেছেন। অতঃপর সেই পানি দ্বারা তিনি নানা রং-এর শস্য উৎপাদন করেন। পরে সে শস্য পেকে শুকিয়ে যায়। তারপর তোমরা দেখতে পাও যে, তা হলুদ বর্ণ ধারণ করছে। অবশেষে আল্লাহ‌ তা ভূষিতে পরিণত করেন। নিশ্চয়ই জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেক সম্পন্নদের জন্য এর মধ্যে শিক্ষা রয়েছে। ৩৯
أَلَمْ تَرَ أَنَّ ٱللَّهَ أَنزَلَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءً فَسَلَكَهُۥ يَنَٰبِيعَ فِى ٱلْأَرْضِ ثُمَّ يُخْرِجُ بِهِۦ زَرْعًا مُّخْتَلِفًا أَلْوَٰنُهُۥ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَىٰهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَجْعَلُهُۥ حُطَٰمًا إِنَّ فِى ذَٰلِكَ لَذِكْرَىٰ لِأُو۟لِى ٱلْأَلْبَٰبِ ٢١
২২ ) আল্লাহ তা’আলা যে ব্যক্তির বক্ষ ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন ৪০ এবং যে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত আলোতে চলছে ৪১ সেকি (সে ব্যক্তির মতো হতে পারে যে এসব কথা থেকে কোন শিক্ষাই গ্রহণ করেনি?) ধ্বংস সে লোকদের জন্য যাদের অন্তর আল্লাহর উপদেশ বাণীতে আরো বেশী কঠোর হয়ে গিয়েছে। ৪২ সে সুস্পষ্ট গোমরাহীর মধ্যে ডুবে আছে।
أَفَمَن شَرَحَ ٱللَّهُ صَدْرَهُۥ لِلْإِسْلَٰمِ فَهُوَ عَلَىٰ نُورٍ مِّن رَّبِّهِۦ فَوَيْلٌ لِّلْقَٰسِيَةِ قُلُوبُهُم مِّن ذِكْرِ ٱللَّهِ أُو۟لَٰٓئِكَ فِى ضَلَٰلٍ مُّبِينٍ ٢٢
২৩ ) আল্লাহ‌ সর্বোত্তম বাণী নাযিল করেছেন, এমন একটি গ্রন্থ যার সমস্ত অংশ সামঞ্জস্যপূর্ণ ৪৩ যার মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ের পূনরাবৃত্তি করা হয়েছে। এসব শুনে সে লোকদের লোম শিউরে ওঠে যারা তাদের রবকে ভয় করে। তারপর তাদের দেহমন বিগলিত হয়ে আল্লাহর স্মরণের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এটা হচ্ছে আল্লাহর হিদায়াত। এর দ্বারা তিনি যাকে ইচ্ছা সঠিক পথে নিয়ে আসেন। আর যাকে আল্লাহ‌ নিজেই হিদায়াত দান করেন না তার জন্য কোন হিদায়াতকারী নেই।
ٱللَّهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ ٱلْحَدِيثِ كِتَٰبًا مُّتَشَٰبِهًا مَّثَانِىَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ ٱلَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَىٰ ذِكْرِ ٱللَّهِ ذَٰلِكَ هُدَى ٱللَّهِ يَهْدِى بِهِۦ مَن يَشَآءُ وَمَن يُضْلِلِ ٱللَّهُ فَمَا لَهُۥ مِنْ هَادٍ ٢٣
২৪ ) তুমি সে ব্যক্তির দুর্দশা কি করে উপলব্ধি করবে যে কিয়ামতের দিন আল্লাহর আযাবের কঠোর আঘাত তার মুখমণ্ডলের ওপর নেবে? ৪৪ এসব জালেমদের বলে দেয়া হবেঃ এখন সেসব উপার্জনের ফল ভোগ করো যা তোমরা উপার্জন করেছিলে। ৪৫
أَفَمَن يَتَّقِى بِوَجْهِهِۦ سُوٓءَ ٱلْعَذَابِ يَوْمَ ٱلْقِيَٰمَةِ وَقِيلَ لِلظَّٰلِمِينَ ذُوقُوا۟ مَا كُنتُمْ تَكْسِبُونَ ٢٤
২৫ ) এদের পূর্বেও বহু লোক এভাবেই অস্বীকার করেছে। শেষ পর্যন্ত এমন এক দিক থেকে তাদের ওপর আযাব আপতিত হয়েছে যা তারা কল্পনাও করতে পারতো না।
كَذَّبَ ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ فَأَتَىٰهُمُ ٱلْعَذَابُ مِنْ حَيْثُ لَا يَشْعُرُونَ ٢٥
২৬ ) আল্লাহ দুনিয়ার জীবনেই তাদেরকে লাঞ্ছনার শিকার করেছেন। আখেরাতের আযাব তো তার চেয়েও অধিক কঠোর। হায়! তারা যদি তা জানতো।
فَأَذَاقَهُمُ ٱللَّهُ ٱلْخِزْىَ فِى ٱلْحَيَوٰةِ ٱلدُّنْيَا وَلَعَذَابُ ٱلْءَاخِرَةِ أَكْبَرُ لَوْ كَانُوا۟ يَعْلَمُونَ ٢٦
২৭ ) এ কুরআনের মধ্যে আমি মানুষের জন্য নানা রকমের উপমা পেশ করেছি যাতে তারা সাবধান হয়ে যায়,
وَلَقَدْ ضَرَبْنَا لِلنَّاسِ فِى هَٰذَا ٱلْقُرْءَانِ مِن كُلِّ مَثَلٍ لَّعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ ٢٧
২৮ ) আরবী ভাষার কুরআন ৪৬ --- যাতে কোন বক্রতা নেই। ৪৭ যাতে তারা মন্দ পরিণাম থেকে রক্ষা পায়।
قُرْءَانًا عَرَبِيًّا غَيْرَ ذِى عِوَجٍ لَّعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ ٢٨
২৯ ) আল্লাহ‌ একটি উপমা পেশ করছেন। একজন ক্রীতদাসের-- যে কতিপয় রূঢ় চরিত্র প্রভুর মালিকানাভুক্ত, যারা সবাই তাকে নিজের দিকে টানে এবং আরেক ব্যক্তির যে পুরোপুরী একই প্রভুর ক্রীতদাস। এদের দু’জনের অবস্থা কি সমান হতে পারে? ৪৮ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। ৪৯ কিন্তু অধিকাংশ মানুষ অজ্ঞতার মধ্যে ডুবে আছে। ৫০
ضَرَبَ ٱللَّهُ مَثَلًا رَّجُلًا فِيهِ شُرَكَآءُ مُتَشَٰكِسُونَ وَرَجُلًا سَلَمًا لِّرَجُلٍ هَلْ يَسْتَوِيَانِ مَثَلًا ٱلْحَمْدُ لِلَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ ٢٩
৩০ ) [হে নবী (সা)] তোমাকেও মরতে হবে এবং এসব লোককেও মরতে হবে। ৫১
إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُم مَّيِّتُونَ ٣٠
৩৮.
মূল আয়াতে يَنَابِيعَ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যা এ তিনটি জিনিস বুঝাতেই ব্যবহার করা হয়।
৩৯.
অর্থাৎ এ থেকে একজন বুদ্ধিমান মানুষ এ শিক্ষা গ্রহণ করে যে, দুনিয়ার এ জীবন ও এর সব সৌন্দর্য ও চাকচিক্য অস্থায়ী। প্রতিটি বসন্তের পরিণামই শরতের মলিনতা এবং যৌবনের পরিণাম বার্ধক্য ও মৃত্যু। প্রতিটি উত্থানই অবশেষে পতনে পরিণতি লাভ করে। সুতরাং এ পৃথিবী এমন জিনিস নয় যার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মানুষ আল্লাহ‌ ও আখেরাতকে ভুলে যেতে পারে এবং এখানকার ক্ষণস্থায়ী বসন্তের মজা উপভোগ করার জন্য এমন আচরণ করবে যা তার পরিণামকে ধ্বংস করবে। তাছাড়া একজন বুদ্ধিমান লোক এসব দৃশ্য দেখে শিক্ষা গ্রহণ করে যে, এ দুনিয়ার বসন্ত ও শরত আল্লাহর ইখতিয়ারে। তিনি যাকে ইচ্ছা উত্থান ঘটান এবং যাকে ইচ্ছা দুর্দশাগ্রস্ত করেন। আল্লাহ‌ যাকে সমৃদ্ধ ও উন্নত করছেন তার বেড়ে ওঠা যেমন কেউ রোধ করতে পারে না। তেমনি আল্লাহ‌ যাকে ধ্বংস করতে চান তাকে মাটিতে মিশে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে এমন শক্তিও কারো নেই।
৪০.
অর্থাৎ এ সমস্ত বাস্তব ব্যাপার দ্বারা শিক্ষা গ্রহণ এবং ইসলামকে অকাট্য ও নির্ভুল সত্য বলে মেনে নেয়ার যোগ্যতা ও সুযোগ আল্লাহ‌ যাকে দিয়েছেন। কোন ব্যাপারে মানুষের বক্ষ উন্মুক্ত হয়ে যাওয়া মূলত এমন একটি মানসিক অবস্থার নাম, যখন তার মনে উক্ত বিষয় সম্পর্কে কোন দুশ্চিন্তা বা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কিংবা সন্দেহ-সংশয় থাকে না এবং কোন বিপদের আভাস বা কোন ক্ষতির আশঙ্কাও তাকে ঐ বিষয় গ্রহণ করতে বাঁধা দিতে পারে না। বরং সে পূর্ণ মানসিক তৃপ্তির সাথে এ সিদ্ধান্ত করে যে, এ জিনিসটি ন্যায় ও সত্য। তাই যাই ঘটুক না কেন আমাকে এর ওপরই চলতে হবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোন ব্যক্তি যখন ইসলামের পথ অবলম্বন করে তখন আল্লাহ‌ ও রসূলের পক্ষ থেকে যে নির্দেশই আসে তা সে অনিচ্ছায় নয় খুশী ও আগ্রহের সাথে মেনে নেয়। কিতাব ও সুন্নাহ থেকে যে আকাইদ ও ধ্যান-ধারণা এবং যে নীতিমালা ও নিয়ম-কানুন তার সামনে আসে তা সে এমনভাবে গ্রহণ করে যেন সেটাই হৃদয়ের প্রতিধ্বনি। কোন অবৈধ সুবিধা পরিত্যাগ করতে তার কোন অনুশোচনা হয় না। সে মনে করে ঐগুলো তার জন্য কল্যাণকর কিছু ছিল না। বরং তা ছিল একটি ক্ষতি যা থেকে আল্লাহর অনুগ্রহ রক্ষা পেয়েছে। অনুরূপ ন্যায় ও সত্যের ওপর কায়েম থাকার কারণে তার যদি কোন ক্ষতি হয় তাহলে সে সেই জন্য আফসোস করে না, ঠাণ্ডা মাথায় বরদাশত করে এবং আল্লাহর পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার পরিবর্তে তার কাছে ঐ ক্ষতি হালকা মনে হয়। বিপদাপদ আসলে তার এ একই অবস্থা হয়। সে মনে করে, আমার দ্বিতীয় কোন পথই নেই---এ বিপদ থেকে বাঁচার জন্য, যে পথ দিয়ে আমি বের হয়ে যেতে পারি। আল্লাহর সরল-সোজা পথ একটিই। আমাকে সর্বাবস্থায় ঐ পথেই চলতে হবে। বিপদ আসলে আসুক।
৪১.
অর্থাৎ জ্ঞানের আলো হিসেবে সে আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাত লাভ করেছে যার উজ্জ্বল আলোতে সে জীবনে চলার অসংখ্য ছোট ছোট পথের মধ্যে কোনটি ন্যায় ও সত্যের সোজা রাস্তা তা প্রতি পদক্ষেপে স্পষ্ট দেখতে পায়।
৪২.
“শরহে সদর” (উন্মুক্ত বক্ষ বা খোলা মন) এর বিপরীতে মানুষের মনের দু’টি অবস্থা হতে পারে। একটি হচ্ছে ‘দ্বীকে সদর’ (বক্ষ সংকীর্ণ হয়ে যাওয়া, মন সংকীর্ণ হয়ে যাওয়া) এর অবস্থা। এ অবস্থায় মনের মধ্যে ন্যায় ও সত্য প্রবেশের কিছু না কিছু অবকাশ থাকে। দ্বিতীয়টি ‘কাসাওয়াতে ক্বালব’ (মন কঠিন হয়ে যাওয়া) এর অবস্থা। এ অবস্থায় মনের মধ্যে ন্যায় ও সত্য প্রবেশের কোন সুযোগই থাকে না। দ্বিতীয় অবস্থাটি সম্পর্কে আল্লাহ‌ তা’আলা বলছেনঃ যে ব্যক্তি এ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে তার জন্য সর্বাত্মক ধ্বংস ছাড়া আর কিছু নেই। এর অর্থ হচ্ছে, মনের সংকীর্ণতার সাথে হলেও কেউ যদি একবার ন্যায় ও সত্যকে কোনভাবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়ে যায় তাহলেও তার জন্য রক্ষা পাওয়ার কিছু না কিছু সম্ভাবনা থাকে। আয়াতের বর্ণনাভঙ্গি হতে এ দ্বিতীয় বিষয়টি আপনা থেকেই প্রকাশ পায়। কিন্তু আল্লাহ‌ তা’আলা তা সুস্পষ্ট করে বলেননি। কারণ, যারা রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতায় জেদ ও হঠকারিতা করতে একপায়ে দাঁড়িয়ে ছিল এবং এ সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেছিলো যে, কোনমতেই তাঁর কোন কথা মানবে না, আয়াতের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে সাবধান করা। তাদেরকে এ মর্মে সাবধান করা হয়েছে যে, তোমরা তোমাদের এ জিদ ও হঠকারিতাকে অত্যন্ত গর্বের বিষয় বলে মনে করে থাকো। কিন্তু আল্লাহর যিকির এবং তাঁর পক্ষ থেকে আসা উপদেশ বাণী শুনে বিনম্র হওয়ার পরিবর্তে কেউ যদি আরো বেশী কঠোর হয়ে যায় তাহলে একজন মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় অযোগ্যতা ও দুর্ভাগ্য আর কিছুই নেই।
৪৩.
ঐ সব বাণীর মধ্যে কোন বৈপরীত্য ও বিরোধ নেই। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত গোটা কিতাব একই দাবী, একই আকীদা-বিশ্বাস এবং চিন্তা ও কর্মের একই আদর্শ পেশ করে। এর প্রতিটি অংশ অন্য সব অংশের এবং প্রতিটি বিষয় অন্য সব বিষয়ের সত্যায়ন, সমর্থন এবং ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষেণ করে। অর্থ ও বর্ণনা উভয় দিক দিয়েই এ গ্রন্থের পূর্ণ মিল ও সামঞ্জস্য (Consistency) বিদ্যমান।
৪৪.
মানুষ মুখমণ্ডলের ওপর কোন আঘাত তখনই করে যখন সে পুরোপুরি অক্ষম ও নিরূপায় হয়ে পড়ে। অন্যথায় যতক্ষণ পর্যন্ত তার মধ্যে প্রতিরোধের সামান্যতম শক্তিও থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত সে শরীরের প্রত্যেকটি অংশে আঘাত সহ্য করতে থাকে কিন্তু মুখের ওপর আঘাত লাগতে দেয় না। তাই এখানে ঐ ব্যক্তির চরম অসহায়ত্বের চিত্র অংকন করা হয়েছে এই বলে যে, সে নিজের মুখের ওপর চরম আঘাত সহ্য করবে।
৪৫.
মূল আয়াতে كسب শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআন মজীদে পরিভাষায় كسب শব্দের অর্থ হচ্ছে ব্যক্তি তার কর্মের ফলশ্রুতি হিসেবে শাস্তি ও পুরস্কার লাভের যে উপযুক্ততা অর্জন করে তাই। সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের আসল উপার্জন হচ্ছে এই যে, সে তার কাজের ফলশ্রুতিতে আল্লাহর কাছে পুরস্কারের যোগ্য হয়ে যায়। আর গোমরাহী ও বিপথগামীতা অবলম্বনকারী ব্যক্তিদের প্রকৃত উপার্জন হচ্ছে, সে শাস্তি যা সে আখেরাতে লাভ করবে।
৪৬.
অর্থাৎ এ কিতাব অন্য কোন ভাষায় নাযিল হয়নি যে, তা বুঝার জন্য মক্কা ও আরবের লোকদের কোন অনুবাদক বা ব্যাখ্যাকারের দরকার হয়। এ কিতাব তাদের নিজের ভাষায় নাযিল হয়েছে। যা তারা নিজেরাই সরাসরি বুঝতে সক্ষম।
৪৭.
অর্থাৎ তার মধ্যে কোন বক্রতা বা জাটিলতাপূর্ণ কোন কথা নেই যে, তা বুঝা সাধারণ মানুষের জন্য কঠিন হবে। বরং এর মধ্যে পরিষ্কারভাবে সহজ-সরল কথা বলা হয়েছে। প্রত্যেক ব্যক্তি এখান থেকে জেনে নিতে পারে এ গ্রন্থ কোন্ জিনিসকে ভ্রান্ত বলে এবং কেন বলে? কোন্ জিনিসকে সঠিক বলে এবং কিসের ভিত্তিতে? কি স্বীকার করাতে চায় এবং কোন্ জিনিস অস্বীকার করাতে চায়। কোন্ কোন্ কাজের নির্দেশ দেয় এবং কোন্ কোন্ কাজে বাঁধা দেয়।
৪৮.
এ উপমাতে আল্লাহ‌ তা’আলা শিরক ও তাওহীদের পার্থক্য এবং মানব জীবনের ওপর এ দু’টির প্রভাব এমন পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেছেন যে, এতো বড় বিষয়কে এর চেয়ে সংক্ষিপ্ত কথায় এবং এতটা কার্যকর পন্থায় বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। একথা সবাই স্বীকার করবে যে, যে ব্যক্তি অনেক মালিক বা মনিবের অধীন এবং তারা প্রত্যেকেই তাকে নিজের দিকে টানে। তারা এমন বদমেজাজী যে, প্রত্যেকে তার সেবা গ্রহণ করতে চায় কিন্তু অন্য মালিকের নির্দেশ পালনের সুযোগ তাকে দেয় না, তাছাড়া তাদের পরস্পর বিরোধী নির্দেশ শুনতে গিয়ে যার নির্দেশই সে পালন করতে অপরাগ হয় সে তাকে শুধু ধমক ও বকাঝকা দিয়েই ক্ষান্ত হয় না, বরং শাস্তি দিতেও বদ্ধপরিকর হয়, এমন ব্যক্তির জীবন অনিবার্যরূপেই অত্যন্ত সংকীর্ণতার মধ্যে পতিত হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি একই মনিবের চাকর সে ব্যক্তি অতীব আরাম ও শান্তিতে জীবন যাপন করবে। তাকে অন্য কারো খেদমত এবং সন্তোষ বিধান করতে হয় না। এটা এমন সহজ-সরল কথা যা বুঝার জন্য বড় বেশী চিন্তা-ভাবনা করার প্রয়োজন হয় না। এ উপমা পেশ করার পর কারো জন্য একথা বুঝাও কঠিন নয় যে এক আল্লাহর দাসত্বে মানুষের জন্য যে শান্তি ও নিরাপত্তা আছে বহু সংখ্যক ইলাহর দাসত্ব করে কখনো তা লাভ করা যেতে পারে না।

এখানে একথাও ভালভাবে বুঝে নেয়া দরকার যে, পাথরের মূর্তির সাথে বহু সংখ্যক বক্র স্বভাবের এবং পরস্পর কলহপ্রিয় মনিবদের উপমা খাটে না। এ উপমা সেসব জীবন্ত মনিবদের ক্ষেত্রেই খাটে যারা কার্যতই পরস্পর বিরোধী নির্দেশ দান করে এবং বাস্তবেও তাকে নিজের দিকে টানতে থাকে। পাথরের মূর্তি কাকে কবে আদেশ দেয় এবং কাকে কখন নিজের খেদমতের জন্য ডাকে? এ তো জীবন্ত মনিবদের কাজ। মানুষের নিজের প্রবৃত্তির মধ্যে, বংশের মধ্যে, জ্ঞাতি-গোষ্ঠির মধ্যে, জাতি ও দেশের সমাজের মধ্যে, ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে, শাসক ও আইন প্রণেতাদের মধ্যে, কায়কারবার ও জীবিকার গণ্ডির মধ্যে এবং পৃথিবীর সভ্যতার ওপর প্রভাব বিস্তারকারী শক্তিসমূহের মধ্যে সর্বত্র বিদ্যমান। তাদের পরস্পর বিরোধী আকাঙ্ক্ষা ও বিভিন্ন দাবী মানুষকে সবসময় নিজের দিকে টানতে থাকে। সে তাদের যার আকাঙ্ক্ষা ও দাবী পূরণ করতে ব্যর্থ হয় সে তাকে নিজের কর্মের গণ্ডির মধ্যে শাস্তি না দিয়ে ছাড়ে না। তবে প্রত্যেকেরে শাস্তির উপকরণ ভিন্ন ভিন্ন। কেউ মনে আঘাত দেয়, কেউ অসন্তুষ্ট হয়, কেউ উপহাস করে, কেউ সম্পর্ক ছিন্ন করে। কেউ নির্বোধ বলে আখ্যায়িত করে, কেউ ধর্মের ওপর আক্রমণ করে এবং কেউ আইনের আশ্রয় নিয়ে শাস্তি দেয়। মানুষের জন্য এ সংকীর্ণতা থেকে বাঁচার একটিই মাত্র উপায় আছে। আর তা হচ্ছে তাওহীদের পথ গ্রহণ করে শুধু এক আল্লাহর বান্দা হয়ে যাওয়া এবং গলদেশ থেকে অন্যদের দাসত্বের শৃঙ্খল ছিঁড়ে দূরে নিক্ষেপ করা।

তাওহীদের পথ অবলম্বন করারও দু’টি পন্থা আছে এবং এর ফলাফলও ভিন্ন ভিন্ন।

একটি পন্থা এই যে, কেউ ব্যক্তিগত পর্যায়ে এক আল্লাহর বান্দা হয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেবে কিন্তু আশে-পাশের পরিবেশ তার সহযোগী হবে না। এক্ষেত্রে তার জন্য বাইরের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও সংকীর্ণতা আগের চেয়েও বেড়ে যেতে পারে। তবে সে যদি সরল মনে এ পথ অবলম্বন করে থাকে তাহলে মনের দিক দিয়ে শান্তি ও তৃপ্তি লাভ করবে। সে প্রবৃত্তির এমন প্রতিটি আকাঙ্ক্ষা প্রত্যাখ্যান করবে যা আল্লাহর নির্দেশের পরিপন্থী বা যা পূরণ করার পাশাপাশি আল্লাহভীরুতার দাবী পূরণ করা যেতে পারে না। সে পরিবার, গোত্র, গোষ্ঠী, জাতি, সরকার, ধর্মীয় নেতৃত্ব এবং আর্থিক কর্তৃত্বেরও এমন কোন দাবী গ্রহণ করবে না যা আল্লাহর আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। এর ফলে সে সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন হতে পারে তথা অনিবার্যরূপেই হবে কিন্তু তার মন এ ব্যাপারে পুরোপুরি পরিতৃপ্ত থাকবে যে, আমি যে আল্লাহর বান্দা তার দাসত্বের দাবী আমি সম্পূর্ণরূপে পূরণ করছি। আর আমি যাদের বান্দা নই আমার কাছে তাদের এমন কোন অধিকার নেই, যে কারনে আমি আমার রবের নির্দেশের বিরুদ্ধে তাদের দাসত্ব করবো। দুনিয়ার কোন শক্তিই তার থেকে মনের এ প্রশান্তি এবং আত্মার এ শান্তি ও তৃপ্তি ছিনিয়ে নিতে পারে না। এমনকি তাকে যদি ফাঁসি কাষ্ঠেও চড়তে হয় তাহলে সে প্রশান্ত মনে ফাঁসির কাষ্ঠেও ঝুলে যাবে। সে একথা ভেবে সামান্য অনুশোচনাও করবে না যে, আমি কেন মিথ্যা প্রভুদের সামনে মাথা নত করে আমার জীবন রক্ষা করলাম না।

আরেকটি পন্থা এই যে, গোটা সমাজ তাওহীদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাক এবং সেখানে নৈতিক চরিত্র, সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ধর্ম, আইন-কানুন, রীতি-নীতি ও দেশাচার, রাজনীতি, অর্থনীতি মোট কথা জীবনের প্রতিটি বিভাগের জন্য আকীদা-বিশ্বাস হিসেবে সেসব মূলনীতি মেনে নেয়া হোক এবং কার্যত চালু করা হোক যা মহান আল্লাহ‌ তাঁর কিতাব ও রসূলের মাধ্যমে দিয়েছেন। আল্লাহর দ্বীন যেটিকে গোনাহ বলবে আইন সেটিকেই অপরাধ হিসেবে গণ্য করবে, সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা সেগুলোকে উৎখাত করার চেষ্টা করবে, শিক্ষা-দীক্ষা সেটি থেকে বাঁচার জন্য মন-মানসিকতা তৈরী করবে। মিম্বার ও মিহরাব থেকে এর বিরুদ্ধেই আওয়াজ উঠবে সমাজ এটিকে দোষণীয় মনে করবে এবং জীবিকা অর্জনের প্রতিটি কায়-কারবারে তা নিষিদ্ধ হবে। অনুরূপভাবে আল্লাহর দ্বীন যে জিনিসকে কল্যাণ ও সুকৃতি হিসেবে আখ্যায়িত করবে আইন তাকেই সমর্থন করবে। ব্যবস্থাপনার শক্তি তার লালন-পালন করবে। গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা মন-মগজে সেটিকে বদ্ধমূল করতে এবং চরিত্র ও কর্মে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করবে। মিম্বর ও মিহরাব তারই শিক্ষা দেবে, সমাজও তারই প্রশংসা করবে। তার ওপরেই প্রচলিত রীতি-নীতি কার্যত প্রতিষ্ঠিত করবে এবং কায়-কারবার ও জীবন জীবিকার প্রক্রিয়াও সে অনুসারেই চলবে। এভাবেই মানুষ পূর্ণ আভ্যন্তীণ ও বাহ্যিক শান্তি লাভ করে এবং বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক উন্নতির সমস্ত দরজা তার জন্য খুলে যায়। কারণ, আল্লাহ‌ ও গায়রুল্লাহর দাসত্বের দাবীর যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তা তখন প্রায় শেষ হয়ে যায়।

ইসলাম যদিও প্রত্যেক ব্যক্তিকে এই বলে আহবান জানায় যে, দ্বিতীয় অবস্থাটা সৃষ্টি হোক বা না হোক সর্বাবস্থায় সে তাওহীদকেই তার আদর্শ হিসেবে মেনে চলবে এবং সব রকম বিপদ-আপদ ও দুঃখ-কষ্টের মোকাবিলা করে আল্লাহর দাসত্ব করবে। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, ইসলামের চূড়ান্ত লক্ষ্য এ দ্বিতীয় অবস্থা সৃষ্টি করা। সমস্ত নবী ও রসূল আলাইহিমুস সালামের প্রচেষ্টা ও দাবীও এই যে, একটি মুসলিম উম্মাহর উত্থান ঘটুক যারা কুফর ও কাফেরদের আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে জামায়াত বদ্ধভাবে আল্লাহর দ্বীন অনুসরণ করবে। কুরআন ও সুন্নাত সম্পর্কে অজ্ঞ এবং বিবেক-বুদ্ধিহীন না হয়ে কেউই একথা বলতে পারে না যে, নবী রসূল আলাইহিমুস সালামের চেষ্টা সাধানার লক্ষ্য ছিল শুধু ব্যক্তিগত ঈমান ও আনুগত্য। সামাজিক জীবনে ‘দ্বীন হক’ বা ন্যায় ও সত্যের আদর্শ কায়েম করার উদ্দেশ্য আদৌ তাঁদের ছিল না।

৪৯.
এখানে “আলহামদুলিল্লাহ” এর অর্থ বুঝার জন্য মনের মধ্যে এ চিত্রটি অংকন করুন যে, শ্রোতাদের সামনে উপরোক্ত প্রশ্ন পেশ করার পর বক্তা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন যাতে তাওহীদের বিরোধীতাকারীদের কাছে তার কোন জবাব থাকলে যেন দিতে পারে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে যখন কোন জবাব আসলো না এবং কোন দিক থেকে এ জবাবও আসলো না যে, দু’টি সমান, তখন বক্তা বললেন ‘আলহামদুলিল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর শুকরিয়া যে তোমরা নিজেরাও মনে মনে এ দু’টি অবস্থার পার্থক্য অনুভব করে থাকো। একজন মনিবের দাসত্বের চেয়ে অনেক মনিবের দাসত্ব উত্তম বা দু’টি সমান পর্যায়ের একথা বলার ধৃষ্ঠতা তোমাদের কারোই নেই।
৫০.
অর্থাৎ একজন মনিবের দাসত্ব ও বহু সংখ্যক মনিবের দাসত্বের মধ্যকার পার্থক্য তো বেশ বুঝতে পার কিন্তু এক প্রভুর দাসত্ব ও বহু সংখ্যক প্রভুর দাসত্বের মধ্যকার পার্থক্য যখন বুঝানোর চেষ্টা করা হয় তখন অজ্ঞ সেজে বসো।
৫১.
এ বাক্যাংশ ও পূর্ববর্তী বাক্যাংশের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম শূন্যতা আছে যা স্থান কাল ও পূর্বাপর বিষয়ে চিন্তা করে যে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি নিজেই পূর্ণ করতে পারেন। এখানে এ বিষয়টি প্রচ্ছন্ন আছে যে, তোমরা এভাবে একটি পরিষ্কার সহজ-সরল কথা সহজ-সরল উপায়ে এসব লোককে বুঝাচ্ছো আর এরা হঠকারিতা করে তোমাদের কথা শুধু প্রত্যাখ্যানই করছে না বরং এ সুস্পষ্ট সত্যকে পরাভূত করার জন্য তোমাদের চরম শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠিক আছে! চিরদিন তোমরাও থাকবে না, এরাও থাকবে না। একদিন উভয়কেই মরতে হবে। তখন সবাই যার যার পরিণাম জানতে পারবে।
অনুবাদ: