يَـٰٓأَهْلَ ٱلْكِتَـٰبِ لَا تَغْلُوا۟ فِى دِينِكُمْ وَلَا تَقُولُوا۟ عَلَى ٱللَّهِ إِلَّا ٱلْحَقَّ ۚ إِنَّمَا ٱلْمَسِيحُ عِيسَى ٱبْنُ مَرْيَمَ رَسُولُ ٱللَّهِ وَكَلِمَتُهُۥٓ أَلْقَىٰهَآ إِلَىٰ مَرْيَمَ وَرُوحٌۭ مِّنْهُ ۖ فَـَٔامِنُوا۟ بِٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦ ۖ وَلَا تَقُولُوا۟ ثَلَـٰثَةٌ ۚ ٱنتَهُوا۟ خَيْرًۭا لَّكُمْ ۚ إِنَّمَا ٱللَّهُ إِلَـٰهٌۭ وَٰحِدٌۭ ۖ سُبْحَـٰنَهُۥٓ أَن يَكُونَ لَهُۥ وَلَدٌۭ ۘ لَّهُۥ مَا فِى ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَمَا فِى ٱلْأَرْضِ ۗ وَكَفَىٰ بِٱللَّهِ وَكِيلًۭا
হে আহলী কিতাব! নিজেদের দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না ২১১ আর সত্য ছাড়া কোন কথা আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করো না। মারয়াম পুত্র ঈসা মসীহ আল্লাহর একজন রসূল ও একটি ফরমান ২১২ ছাড়া আর কিছুই ছিল না, যা আল্লাহ মারয়ামের দিকে পাঠিয়েছিলেন। আর সে একটি রূহ ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে ২১৩ (যে মারয়ামের গর্ভে শিশুর রূপ ধারণ করেছিল) । কাজেই তোমরা আল্লাহ ও তার রসূলদের প্রতি ঈমান আনো ২১৪ এবং “তিন” বলো না। ২১৫ নিবৃত্ত হও, এটা তোমাদের জন্যই ভালো। আল্লাহই তো একমাত্র ইলাহ। কেউ তার পুত্র হবে, তিনি এর অনেক উর্ধ্বে। ২১৬ পৃথিবী ও আকাশের সবকিছুই তার মালিকানাধীন ২১৭ এবং সে সবের প্রতিপালক ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তিনি নিজেই যথেষ্ট। ২১৮
২১১
এখানে আহলে কিতাব খৃস্টানদের বুঝানো হয়েছে এবং ‘বাড়াবাড়ি’ করা অর্থ হচ্ছে, কোন বিষয়ের সমর্থনে ও সহযোগিতায় সীমা অতিক্রম করে যাওয়া ইহুদীদের অপরাধ ছিল, তারা ঈসা আলাইহিস সালামকে অস্বীকার ও তাঁর বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আর খৃস্টানদের অপরাধ ছিল, তারা ঈসা আলাইহিস সালামের প্রতি ভক্তি, প্রীতি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
২১২
মূলে ‘কালেমা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। মারয়ামের প্রতি কালেমা (ফরমান) পাঠাবার অর্থ হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তা’আলা মারয়াম আলাইহাস সালামের গর্ভাধারকে কোন পুরুষের শুক্রকীটের সহায়তা ছাড়াই গর্ভধারণ করার হুকুম দিলেন। ঈসা আলাইহিস সালামের বিনা বাপে জন্মগ্রহণ করার রহস্য সম্পর্কে খৃস্টানদের প্রথমে একথাই বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা গ্রীক দর্শনের প্রভাবে ভুল পথ অবলম্বন করে। ফলে প্রথমে তারা কালেমা শব্দটিকে ‘কালাম’ বা ‘কথা’ (Logos)-এর সমার্থক মনে করে। তারপর এ কালাম ও কথা থেকে আল্লাহ তা’আলার নিজ সত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট কালাম-গুণ অর্থাৎ আল্লাহর কথা বলা বুঝানো হয়েছে। অতঃপর ধারণা করা হয়েছে যে, আল্লাহর সত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট এ গুণটি মারয়াম আলাইহাস সালামের উদরে প্রবেশ করে একটি দেহাবয়ব ধারণ করে এবং তাই ঈসা মসীহের রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এভাবে খৃস্টানদের মধ্যে ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ মনে করার ভ্রান্ত আকীদার উদ্ভব হয়েছে। তাদের মধ্যে ভ্রান্ত বিশ্বাস শিকড় গেড়ে বসেছে যে সব, আল্লাহ নিজেই নিজেকে অথবা নিজের চিরন্তন গুণাবলী থেকে ‘কালাম’ ও ‘বাক’ গুণকে ঈসার রূপে প্রকাশ করেছেন।
২১৩
এখানে ঈসা আলাইহিস সালামকে روح منه(আল্লাহর কাছ থেকে আসা রূহ) বলা হয়েছে। সূরা আল বাকারায় একথাটিকে নিম্নোক্তভাবে বলা হয়েছেঃايدنه بروح القدس(আমি পাক রূহের সাহায্যে ঈসাকে সাহায্য করেছি)। এই উভয় বাক্যের অর্থ হচ্ছেঃ আল্লাহ ঈসা আলাইহিস সালামকে পাক রূহ দান করেছিলেন। অন্যায় ও পাপাচারের সাথে এই পাক রূহের কোনদিন কোন পরিচয়ই হয়নি। আপাদমস্তক সত্য ও সততা এবং উন্নত নৈতিক চরিত্র ছিল এর বৈশিষ্ট। খৃস্টানদের কাছেও হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের এই একই পরিচিতি দান করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এর মধ্যেও বাড়াবাড়ি করেছে।روح من اللهঅর্থাৎ আল্লাহর কাছ থেকে একটি রূহকে তারা বিকৃত করে সরাসরি আল্লাহ বানিয়ে নিয়েছে। আর “রূহুল কুদুস” (Holy Ghost) –কে ধরে নিয়েছে “আল্লাহর মুকাদ্দাস বা মহাপবিত্র রূহ”, যা ঈসার মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছিল। এভাবে আল্লাহ ও ঈসার সাথে রূহুল কুদুসকে তৃতীয় একজন মাবুদ বানিয়ে নেয়া হয়েছিল। এটা ছিল খৃস্টানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাড়াবাড়ি এবং এর ফলে তারা গোমরাহীতে লিপ্ত হয়ে গিয়েছিল। মজার ব্যাপার এই যে, মথি লিখিত ইঞ্জীলে আজও এ বাক্যটি লেখা রয়েছেঃ ফেরেশতারা তাকে (অর্থাৎ ইউসুফ নাজ্জারকে) স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললো, “‘হে ইউসুফ ইবনে দাউদ! তোমার স্ত্রী মারয়ামকে তোমার কাছে নিয়ে আসতে ভয় পেয়ো না। কারণ তার পেটে যে রয়েছে সে রূহুল কুদুসের কুদরাতের সৃষ্টি হয়েছে।” (অধ্যায় ১: শ্লোক ২০)
২১৪
অর্থাৎ আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ বলে মেনে নাও এবং সমস্ত রসূলদের রিসালাতের স্বীকৃতি দাও। ঈসা মসীও (আ) তাঁদেরই মধ্যকার একজন রসূল। এটিই ছিল হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের আসল শিক্ষা। ঈসায়ী সম্প্রদায়ের প্রত্যেক ব্যক্তিকে এই যথার্থ সত্য শিক্ষাটি মেনে নেয়া উচিত।
২১৫
অর্থাৎ তিন ইলাহের আকীদা তোমাদের মধ্যে তেমন যে কোন আকৃতিতে বিদ্যমান থাক না কেন তা পরিহার করো। আসলে খৃস্টানরা একই সঙ্গে একত্ববাদ ও ত্রিত্ববাদ উভয়টিই মানে। ইঞ্জীলগুলোতে মসহী আলাইহিস সালামের যে সমস্ত সুস্পষ্ট বাণী পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে কোন একজন খৃস্টানও একথা অস্বীকার করতে পারবে না যে, আল্লাহ এক এবং তিনি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন ইলাহ নেই। তাওহীদ যে দ্বীনের মূলকথা এটা স্বীকার না করে তাদের উপায় নেই। কিন্তু শুরুতেই তাদের মনে এই ভুল ধারণার জন্ম হয়েছিল যে, আল্লাহর কালাম ঈসার রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং আল্লাহর রূহ তাঁর মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে। এই ভুল ধারণার কারণে তারা সমগ্র বিশ্ব-জাহানের মালিক আল্লাহর সাথে ঈসা মসীহ ও রূহুল কুদুসের (জিব্রীল) খোদায়ীকেও মেনে নেয়াকে অযথা নিজেদের জন্য অপরিহার্য গণ্য করেছেন। এভাবে জোরপূর্বক একটি আকীদা নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে নেবার কারণে একত্ববাদে বিশ্বাস আবার ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসের সাথে সাথে ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসের সাথে সাথে একত্ববাদে বিশ্বাসকে কিভাবে একই সঙ্গে মেনে চলা যায়, এটা যথার্থই তাদের জন্য রহস্যময় ও জটিল হয়ে উঠেছে। প্রায় আঠার শো বছর থেকে খৃস্টান পণ্ডিতগণ নিজেদের সৃষ্টি এই জটিলতার গ্রন্থী উন্মোচন করার জন্য মাথা ঘামিয়ে চলেছেন। এরই বিভিন্ন ব্যাখ্যার ভিত্তিতে বহু দল উপদল গঠিত হয়েছে। এরই ভিত্তিতে অন্য দলকে কাফের বলে প্রচার করেছে। এই বিবাদের ফলে গীর্জার সংহতি বিনষ্ট হয়েছে এবং বিভিন্ন গীর্জা নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ঘোষণা করেছে। তাদের আকায়েদ ও যুক্তি শাস্ত্রের সমস্ত শক্তি এরই পেছনে ব্যয়িত হয়েছে। অথচ এ জটিল সমস্যাটি আল্লাহ সৃষ্টি করেননি। তাঁর প্রেরিত ঈসা মসীহও এ সমস্যাটি সৃষ্টি করেননি। আবার আল্লাহকে তিন মেনে নিয়ে তাঁর একত্ববাদের গায়ে কোন আচঁড় না লাগানো কোনক্রমে সম্ভব নয়। শুধুমাত্র তাদের বাড়াবাড়ির কারণেই এই জটিল সমস্যাটির উদ্ভব হয়েছে। কাজেই বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকাই এর একমাত্র সমাধান। এ জন্য তাদের পরিহার করতে হবে ঈসা মসীহ ও রূহুল কুদুসের ইলাহ ও মাবুদ হবার ধারণা। একমাত্র আল্লাহকেই একক ইলাহ হিসেবে মেনে নিতে হবে এবং মসীহকে কেবলমাত্র তার পয়গাম্বর গণ্য করতে হবে, তার খোদায়ীতে তাকে কোনো প্রকার শরীক করা যাবে না।
২১৬
এটি হচ্ছে খৃস্টানদের চতুর্থ বাড়াবাড়ির প্রতিবাদ। বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টের বর্ণনা যদি সঠিক হয়েও থাকে তাহলে তা থেকে (বিশেষ করে প্রথম তিনটি ইঞ্জীল থেকে) বড়জোড় এতটুকুই প্রমাণিত হয় যে, মসীহ আলাইহিস সালাম আল্লাহ ও বান্দার সম্পর্ককে বাপ ও বেটার সম্পর্কের সাথে তুলনা করেছিলেন। আর ‘বাপ’ শব্দটি তিনি আল্লাহর জন্য নিছক উপমা ও রূপক হিসেবে ব্যবহার করেছেন, যাতে এই সম্পর্ক বুঝা যায়। আসল অর্থে এটিকে ব্যবহার করেননি। এটা কেবলমাত্র ঈসা আলাইহিস সালামের একার বৈশিষ্ট্য নয়। প্রাচীন যুগ থেকে বনী ইসরাঈলরা আল্লাহর জন্য বাপ প্রতিশব্দটি ব্যবহার করে আসছে। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। ঈসা আলাইহিস সালাম নিজের কওমের মধ্যে প্রচলিত বাকধারা অনুযায়ী এ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। তিনি আল্লাহকে কেবলমাত্র নিজের নয় বরং সমস্ত মানুষের বাপ বলতেন। কিন্তু খৃস্টানরা এখানে এসে আবার বাড়াবাড়ি করেছেন। তারা মসীহকে আল্লাহর একমাত্র পুত্র গণ্য করেছে। এক্ষেত্রে তারা যে অদ্ভূত মতবাদ পোষণ করে তার সারনির্যাস হচ্ছেঃ যেহেতু মসীহ আল্লাহর বহিঃপ্রকাশ এবং তার কালেমা ও তাঁর রূহের শারীরিক উদ্দেশ্য দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন যে, তিনি মানুষের গোনাহ নিজের মাথায় নিয়ে শূলে চড়ে প্রাণ দেবেন এবং নিজের রক্তের বিনিময়ে মানুষের গোনাহের কাফ্ফারা আদায় করবেন। অথচ মসীহ আলাইহিস সালামের কোন বাণী থেকে তারা এর কোন প্রমাণ পেশ করতে পারবে না। এ আকীদাটি তাদের নিজেদের তৈরী করা। তারা নিজেদের পয়গাম্বরের মহান ব্যক্তিত্বে প্রভাবিত হয়ে যে বাড়াবাড়ি করেছে এটি তারই ফলশ্রুতি।
আল্লাহ এখানে কাফ্ফারা সম্পকির্ত বিশ্বাসের প্রতিবাদ করেননি। কারণ এটা খৃস্টানদের কোন স্বতন্ত্র ও স্থায়ী বিশ্বাস নয়। বরং এটা হচ্ছে মসীহকে (আ) আল্লাহর পুত্র গণ্য করার পরিণতি এবং ‘যদি মসীহ আল্লাহর একমাত্র পুত্রই হন তাহলে তিনি শূলবিদ্ধ হয়ে লাঞ্ছিতের মৃত্যুবরণ করলেন কেন’ এ প্রশ্নের একটি দার্শনিক ও মরমীয় ব্যাখ্যা। কাজেই যদি মসীহ আলাইহিস সালামের আল্লাহর পুত্র হবার ধারণার প্রতিবাদ করা হয় এবং তাঁর শূলবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করা সম্পকির্ত ভুল ধারণা দূর করা যায় তাহলে আপনা আপনিই এ বিশ্বাসের প্রতিবাদ হয়ে যায়।
২১৭
অর্থাৎ পৃথিবী ও আকাশের অস্তিত্ব সম্পন্ন কোন জিনিসের সাথেও আল্লাহর পিতা-পুত্রের সম্পর্ক নেই। বরং এ সম্পর্ক হচ্ছে মালিক ও তার মালিকানাধীন বস্তুর।
২১৮
অর্থাৎ নিজের খোদায়ীর ব্যবস্থাপনা করার জন্য আল্লাহ নিজেই যথেষ্ট। তার কারো কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করার কোন প্রয়োজন নেই। কাজেই এ জন্য কাউকে পুত্র বানাবারও তার কোন দরকার নেই।