আন্ নিসা

১৭৬ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
১১১ ) কিন্তু যে ব্যক্তি পাপ কাজ করবে, তার এই পাপ কাজ তার নিজের জন্যই ক্ষতিকর হবে। আল্লাহ‌ সব কথাই জানেন, তিনি জ্ঞানী প্রজ্ঞাময়।
وَمَن يَكْسِبْ إِثْمًا فَإِنَّمَا يَكْسِبُهُۥ عَلَىٰ نَفْسِهِۦ وَكَانَ ٱللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا ١١١
১১২ ) আর যে ব্যক্তি কোন অন্যায় বা গোনাহর কাজ করে কোন নিরপরাধ ব্যক্তির ওপর তার দোষ চাপিয়ে দেয়, সে তো বড় মারাত্মক মিথ্যা অপবাদ ও সুস্পষ্ট গোনাহের বোঝা নিজের মাথায় তুলে নেয়।
وَمَن يَكْسِبْ خَطِيٓـَٔةً أَوْ إِثْمًا ثُمَّ يَرْمِ بِهِۦ بَرِيٓـًٔا فَقَدِ ٱحْتَمَلَ بُهْتَٰنًا وَإِثْمًا مُّبِينًا ١١٢
১১৩ ) হে নবী! তোমার প্রতি যদি আল্লাহর অনুগ্রহ না হতো এবং তার রহমত যদি তোমার সাথে সংযুক্ত না থাকতো, তাহলে তাদের মধ্য থেকে একটি দলতো তোমাকে বিভ্রান্ত করার ফায়সালা করেই ফেলেছিল। অথচ প্রকৃতপক্ষে তারা নিজেদের ছাড়া আর কাউকে বিভ্রান্ত করছিল না এবং তারা তোমার কোন ক্ষতি করতে পারতো না। ১৪২ আল্লাহ তোমার ওপর কিতাব ও হিকমত নাযিল করেছেন, এমন সব বিষয় তোমাকে শিখিয়েছেন যা তোমার জানা ছিল না এবং তোমার প্রতি তাঁর অনুগ্রহ অনেক বেশী।
وَلَوْلَا فَضْلُ ٱللَّهِ عَلَيْكَ وَرَحْمَتُهُۥ لَهَمَّت طَّآئِفَةٌ مِّنْهُمْ أَن يُضِلُّوكَ وَمَا يُضِلُّونَ إِلَّآ أَنفُسَهُمْ وَمَا يَضُرُّونَكَ مِن شَىْءٍ وَأَنزَلَ ٱللَّهُ عَلَيْكَ ٱلْكِتَٰبَ وَٱلْحِكْمَةَ وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُن تَعْلَمُ وَكَانَ فَضْلُ ٱللَّهِ عَلَيْكَ عَظِيمًا ١١٣
১১৪ ) লোকদের অধিকাংশ গোপন সলা-পরামর্শে কোন কল্যাণ থাকে না। তবে যদি কেউ গোপনে সাদ্‌কা ও দান –খয়রাতের উপদেশ দেয় অথবা কোন সৎকাজের জন্য বা জনগণের পারস্পরিক বিষয়ের সংশোধন ও সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যে কাউকে কিছু বলে, তাহলে অবশ্য এটি ভালো কথা। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যে কেউ এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে তাকে আমি বিরাট পুরস্কার দান করবো।
لَّا خَيْرَ فِى كَثِيرٍ مِّن نَّجْوَىٰهُمْ إِلَّا مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلَٰحٍۭ بَيْنَ ٱلنَّاسِ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ ٱبْتِغَآءَ مَرْضَاتِ ٱللَّهِ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا ١١٤
১১৫ ) কিন্তু যে ব্যক্তি রসূলের বিরোধীতায় কোমর বাঁধে এবং ঈমানদারদের পথ পরিহার করে অন্য পথে চলে, অথচ তার সামনে সত্য–সঠিক পথ সুস্পষ্ট হয়ে গেছে, তাকে আমি সেদিকেই চালাবো যেদিকে সে চলে গেছে ১৪৩ এবং তাকে জাহান্নামে ঠেলে দেবো, যা নিকৃষ্টতম আবাস।
وَمَن يُشَاقِقِ ٱلرَّسُولَ مِنۢ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ ٱلْهُدَىٰ وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ ٱلْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِۦ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصْلِهِۦ جَهَنَّمَ وَسَآءَتْ مَصِيرًا ١١٥
১১৬ ) আল্লাহ ১৪৪ কেবলমাত্র শিরকের গোনাহ মাফ করেন না। এছাড়া আর যাবতীয় গোনাহ তিনি যাকে ইচ্ছা মাফ করে দেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরীক করে, সে গোমরাহীর মধ্যে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِۦ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَآءُ وَمَن يُشْرِكْ بِٱللَّهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَٰلًۢا بَعِيدًا ١١٦
১১৭ ) এ ধরনের লোকেরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে দেবীর পূজা করে। তারা সেই বিদ্রোহী শয়তানের পূজা করে, ১৪৫
إِن يَدْعُونَ مِن دُونِهِۦٓ إِلَّآ إِنَٰثًا وَإِن يَدْعُونَ إِلَّا شَيْطَٰنًا مَّرِيدًا ١١٧
১১৮ ) যাকে আল্লাহ‌ অভিশপ্ত করেছেন। (তারা সেই শয়তানের আনুগত্য করছে) যে আল্লাহকে বলেছিল, “আমি তোমার বান্দাদের থেকে একটি নির্দিষ্ট অংশ নিয়েই ছাড়বো। ১৪৬
لَّعَنَهُ ٱللَّهُ وَقَالَ لَأَتَّخِذَنَّ مِنْ عِبَادِكَ نَصِيبًا مَّفْرُوضًا ١١٨
১১৯ ) আমি তাদেরকে পথভ্রষ্ট করবো। তাদেরকে আশার ছলনায় বিভ্রান্ত করবো। আমি তাদেরকে হুকুম করবো এবং আমার হুকুমে তারা পশুর কান ছিঁড়বেই। ১৪৭ আমি তাদেরকে হুকুম করবো এবং আমার হুকুমে তারা আল্লাহর সৃষ্টি আকৃতিতে রদবদল করে ছাড়বেই।” ১৪৮ যে ব্যক্তি আল্লাহকে বাদ দিয়ে এই শয়তানকে বন্ধু ও অভিভাবক বানিয়েছে সে সুস্পষ্ট ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
وَلَأُضِلَّنَّهُمْ وَلَأُمَنِّيَنَّهُمْ وَلَءَامُرَنَّهُمْ فَلَيُبَتِّكُنَّ ءَاذَانَ ٱلْأَنْعَٰمِ وَلَءَامُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ ٱللَّهِ وَمَن يَتَّخِذِ ٱلشَّيْطَٰنَ وَلِيًّا مِّن دُونِ ٱللَّهِ فَقَدْ خَسِرَ خُسْرَانًا مُّبِينًا ١١٩
১২০ ) সে তাদের কাছে ওয়াদা করে এবং তাদেরকে নানা প্রকার আশা দেয়, ১৪৯ কিন্তু শয়তানের সমস্ত ওয়াদা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
يَعِدُهُمْ وَيُمَنِّيهِمْ وَمَا يَعِدُهُمُ ٱلشَّيْطَٰنُ إِلَّا غُرُورًا ١٢٠
১৪২.
অর্থাৎ যদি তারা মিথ্যা বিবরণী পেশ করে তোমার মনে ভুল ধারণা সৃষ্টিতে সক্ষমও হতো এবং নিজেদের পক্ষে প্রকৃত সত্য ও ইনসাফ বিরোধী ফয়সালা করিয়ে নিতে পারতো তাহলে তাতে প্রকৃত ক্ষতি তাদেরই হতো। তোমার কোন ক্ষতি হতো না। কারণ আল্লাহর কাছে তুমি নও, তারাই হতো অপরাধী। যে ব্যক্তি বিচারককে ধোঁকা দিয়ে নিজের পক্ষে সত্যের বিপরীত ফয়সালা করিয়ে নেয় সে আসলে নিজেকে এই ভুল ধারণার শিকার করে যে, এই ধরনের কলা-কৌশল অবলম্বন করার ফলে সত্য তার পক্ষে এসে গেছে। অথচ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর দৃষ্টিতে সত্য যার দিকে মূলত তার দিকেই থেকে যায়। এক্ষেত্রে প্রতারিত বিচারপতির ফায়সালার কারণে আসল সত্যের ওপর কোন প্রভাবপড়ে না। (সূরা-বাকারার ১৯৭ নম্বর টীকা দেখুন)
১৪৩.
ওপরে উল্লেখিত মোকদ্দমায় আল্লাহর অহীর ভিত্তিতে নবী ﷺ যখন সেই বিশ্বাসঘাতক মুসলমানটির বিরুদ্ধে এবং নির্দোষ ইহুদীর পক্ষে ফয়সালা শুনিয়ে দিলেন তখন মুনাফিকটির ওপর জাহেলিয়াতের এমন প্রচণ্ড আক্রমণ হলো যার ফলে সে মদীনা ত্যাগ করে মক্কায় ইসলাম ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুশমনদের কাছে চলে গেলো এবং প্রকাশ্যে ইসলামের বিরোধীতা করতে লাগলো। এ আয়াতে তার এই আচরণের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
১৪৪.
এই রুকূ’তে ওপরের প্রসঙ্গের জের টেনে বলা হয়েছেঃ নিজের জাহেলিয়াতের স্রোতে ভেসে এ ব্যক্তি যে পথে পাড়ি জামিয়েছে সেটি কোন্‌ ধরনের পথ এবং সৎলোকদের দল থেকে আলাদা হয়ে যাদের সাথে সে জোট বেঁধেছে তারা কেমন লোক।
১৪৫.
শয়তানকে কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে পূজা অর্চনা করে না বা তাকে সরাসরি আল্লাহর মর্যাদায় অভিসিক্ত করে না। এ অর্থে কেউ শয়তানকে মাবুদ বানায় না, একথা ঠিক। তবে নিজের প্রবৃত্তি, ইচ্ছা আশা-আকাংখা ও চিন্তা–ভাবনার লাগাম শয়তানের হাতে তুলে দিয়ে যেদিকে সে চালায় সেদিকে চলা এবং এমনভাবে চলা যেন সে শয়তানের বান্দা এবং শয়তান তার প্রভু—এটাইতো শয়তানকে মাবুদ বানাবার একটি পদ্ধতি। এ থেকে জানা যায়, বিনা বাক্য ব্যয়ে, নির্দেশ মেনে চলা এবং অন্ধভাবে কারো হুকুম পালন করার নামই ‌‌‌‌‌‘ইবাদত।’ আর যে ব্যক্তি এভাবে কারও আনুগত্য করে সে আসলে তার ইবাদাত করে।
১৪৬.
অর্থাৎ তাদের সময়, পরিশ্রম, প্রচেষ্টা, শক্তি ও যোগ্যতা এবং তাদের সন্তান ও ধন-সম্পদ থেকে নিজের একটি অংশ নিয়ে নেবো। তাদের এমনভাবে প্ররোচিত করবো যার ফলে তারা এসবের একটি বিরাট অংশ আমার পথে ব্যয় করবে।
১৪৭.
আরববাসীদের বহুতর কুসংস্কারের মধ্যে একটির দিকে এখানে ইশারা করা হয়েছে। তাদের নিয়ম ছিল, উটনী পাঁচটি বা দশটি বাচ্চা প্রসব করার পর তার কান চিরে তাকে তারা নিজেদের দেবতার নামে ছেড়ে দিতো এবং তাকে কোন কাজে ব্যবহার করা হারাম মনে করতো। এভাবে যে উটের ঔরশে দশটি বাচ্চা জন্ম নিতো তাকেও দেবতার নামে উৎসর্গ করা হতো। পশুর কান চিরে দেয়া দেবতার নামে উৎসর্গ করার আলামত হিসেবে বিবেচিত হতো।
১৪৮.
আল্লাহর সৃষ্টি-আকৃতিতে রদবদল করার অর্থ বস্তুর সৃষ্টিকালীন কাঠামোও আকার-আকৃতির পরিবর্তন নয়। এ অর্থ গ্রহণ করলে তো সমগ্র মানব সভ্যতা-সংস্কৃতি শয়তানের অবৈধ হস্তক্ষেপের ফসল গণ্য হবে। কারণ আল্লাহর সৃষ্ট বস্তুতে মানুষের হস্তক্ষেপের নামই হচ্ছে সভ্যতা ও সংস্কৃতি। আসলে এখানে যে রদবদলকে শয়তানী কাজ বলা হয়েছে সেটি হচ্ছে, কোন বস্তুকে আল্লাহ‌ যে কাজের জন্য সৃষ্টি করেননি তাকে সেই কাজে লাগানো এবং যে কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন সে কাজে না লাগানো। অন্যকথায় বলা যায়, মানুষ নিজের ও বস্তুর প্রকৃতির বিরুদ্ধে যেসব কাজ করে এবং প্রকৃতির প্রকৃত উদ্দেশ্য উপেক্ষা করে যেসব পন্থা অবলম্বন করে তা সবই এই আয়াতের প্রেক্ষিতে শয়তানের বিভ্রান্তিকর আন্দোলনের ফসল। যেমন লূত জাতির কাজ, জন্ম শাসন, বৈরাগ্যবাদ, ব্রহ্মচর্য, নারী-পুরুষের বন্ধাকরণ, পুরুষদেরকে খোজা বানানো, মেয়েদের ওপর প্রকৃতি যে দায়িত্ব অর্পণ করেছে সে দায়িত্ব সম্পাদন করা থেকে তাদেরকে সরিয়ে রাখা এবং সমাজ-সংস্কৃতির এমনসব বিভাগে তাদের টেনে আনা যেগুলোর জন্য পুরুষদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এসব কাজ এবং শয়তানের শাগরিদরা দুনিয়ায় এ ধরনের আরো যেসব অসংখ্য কাজ করে বেড়াচ্ছে সেগুলো। আসলে এই অর্থ প্রকাশ করছে যে, তারা বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টার নির্ধারিত বিধি-বিধান ভুল মনে করে এবং তার মধ্যে সংস্কার সাধন করতে চায়।
১৪৯.
শয়তানের সমস্ত কারবারটাই চলে মৌখিক ওয়াদা ও আশা-ভরসা দেবার ভিত্তিতে। সে ব্যক্তিগত বা সমষ্টিক পর্যায়ে যখন মানুষকে কোন ভুল পথে পরিচালনা করতে চায়, তার সামনে এক আকাশ কুসুম রচনা করে। কাউকে ব্যক্তিগত আনন্দ উপভোগ এ সাফল্য লাভের আশায় উদ্বেল করে তোলে। কাউকে জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির আশ্বাস দেয়। কাউকে মানবজাতির কল্যাণ ও শ্রীবৃদ্ধির নিশ্চয়তা বিধান করে। কাউকে সত্যের কাছে পৌঁছে গেছে বলে মানসিক সান্ত্বনা দান করে। কারো মনে এই ধারণা বদ্ধমূল করে যে, আল্লাহ‌ বা আখেরাত বলে কিছুই নেই, মরে যাওয়ার পর সবাইকে মাটিতে মিশে যেতে হবে। কাউকে আশ্বাস দেয়, আখেরাত বলে যদি কিছু থেকেও থাকে তাহলে উমুক হুজুরের বদৌলতে, উমুকের দোয়ার তোফায়েলে সেখানকার ধর-পাকড় থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে। মোটকথা যাকে যে ধরনের আশার ছলনায় ভুলানো যায় তাকে সেভাবে নিজের প্রতারণা জালে ফাঁসাবার চেষ্টা করে।
অনুবাদ: