আশ শূরা

৫৩ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
আয়াত
-
৫১ ) কোন ৭৮ মানুষই এ মর্যাদার অধিকারী নয় যে, আল্লাহ‌ তার সাথে সরাসরি কথা বলবেন। তিনি কথা বলেন হয় অহীর (ইঙ্গিত) মাধ্যমে, ৭৯ অথবা পর্দার আড়াল থেকে, ৮০ কিংবা তিনি কোন বার্তাবাহক (ফেরেশতা) পাঠান এবং সে তাঁর হুকুমে তিনি যা চান অহী হিসেবে দেয়। ৮১ তিনি সুমহান ও সুবিজ্ঞ। ৮২
وَمَا كَانَ لِبَشَرٍ أَن يُكَلِّمَهُ ٱللَّهُ إِلَّا وَحْيًا أَوْ مِن وَرَآئِ حِجَابٍ أَوْ يُرْسِلَ رَسُولًا فَيُوحِىَ بِإِذْنِهِۦ مَا يَشَآءُ إِنَّهُۥ عَلِىٌّ حَكِيمٌ ٥١
৫২ ) এভাবেই (হে মুহাম্মাদ) , আমি আমার নির্দেশে তোমার কাছে এক রূহকে অহী করেছি। ৮৩ তুমি আদৌ জানতে না কিতাব কি এবং ঈমানই বা কি। ৮৪ কিন্তু সেই রূহকে আমি একটি আলো বানিয়ে দিয়েছি যা দিয়ে আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথ দেখিয়ে থাকি। নিশ্চিতভাবেই আমি তোমাকে সোজা পথের দিক নির্দেশনা দান করছি।
وَكَذَٰلِكَ أَوْحَيْنَآ إِلَيْكَ رُوحًا مِّنْ أَمْرِنَا مَا كُنتَ تَدْرِى مَا ٱلْكِتَٰبُ وَلَا ٱلْإِيمَٰنُ وَلَٰكِن جَعَلْنَٰهُ نُورًا نَّهْدِى بِهِۦ مَن نَّشَآءُ مِنْ عِبَادِنَا وَإِنَّكَ لَتَهْدِىٓ إِلَىٰ صِرَٰطٍ مُّسْتَقِيمٍ ٥٢
৫৩ ) সেই আল্লাহর পথের দিকে যিনি যমীন ও আসমানের সব জিনিসের মালিক। সাবধান, সব কিছু আল্লাহর দিকেই ফিরে যায়। ৮৫
صِرَٰطِ ٱللَّهِ ٱلَّذِى لَهُۥ مَا فِى ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِى ٱلْأَرْضِ أَلَآ إِلَى ٱللَّهِ تَصِيرُ ٱلْأُمُورُ ٥٣
৭৮.
বক্তব্যের সূচনা পর্বে যা বলা হয়েছিলো সমাপ্তি পর্যায়েও সেই বিষয়টিই বলা হচ্ছে। কথাটা পুরোপুরি বুঝতে হলে এই সূরার প্রথম আয়াত এবং তার টীকা পুনরায় দেখে নিন।
৭৯.
এখানে অহী অর্থ ‘ইলকা’, ইলহাম, মনের মধ্যে কোন কথা সৃষ্টি করে দেয়া কিংবা স্বপ্নে কিছু দেখিয়ে দেয়া, যেমন হযরত ইবরাহীম ও ইউসুফকে দেখানো হয়েছিলো (ইউসুফ, আয়াত ৪ ও ১০০ এবং আস সাফফাত, ১০২)
৮০.
এর সারমর্ম হচ্ছে, বান্দা শব্দ শুনতে পায় কিন্তু শব্দদাতাকে দেখতে পায় না, যেমন হযরত মূসার ক্ষেত্রে ঘটেছিলো। তূর পাহাড়ের পাদদেশে একটি বৃক্ষ থেকে হঠাৎ আওয়াজ আসতে শুরু হলো। কিন্তু যিনি কথা বললেন তিনি তাঁর দৃষ্টির আড়ালেই থাকলেন (ত্বাহা আয়াত ১১ থেকে ৪৮; আন নামল, আয়াত ৮ থেকে ১২; আল কাসাস, আয়াত ৩০ থেকে ৩৫)
৮১.
যে পদ্ধতিতে নবী-রসূলদের কাছে সমস্ত আসমানী কিতাব এসেছে এটা অহী আসার সেই পদ্ধতি। কেউ কেউ এ আয়াতাংশের ভুল ব্যাখ্যা করে এর অর্থ করেছেনঃ আল্লাহ‌ রসূল প্রেরণ করেন যিনি তাঁর নির্দেশে সাধারণ লোকদের কাছে তাঁর বাণী পৌঁছিয়ে দেন।” কিন্তু কুরআনের ভাষাفَيُوحِيَ بِإِذْنِهِ مَا يَشَاءُ (তারপর সে তাঁর নির্দেশে তিনি যা চান তাই অহী হিসেবে দেয়) তাদের এই ব্যাখ্যার ভ্রান্তি সম্পূর্ণ স্পষ্ট করে দেয়। সাধারণ মানুষের সামনে নবীদের তাবলীগী কাজকর্মকে “অহী প্রদান” অর্থে না কুরআনের কোথাও আখ্যায়িত করা হয়েছে, না আরবী ভাষায় মানুষের সাথে মানুষের কথাবার্তাকে ‘অহী’ শব্দ দ্বারা ব্যাখ্যা করার কোন অবকাশ আছে। অহীর আভিধানিক অর্থই হচ্ছে গোপন এবং ত্বরিত ইঙ্গিত। নবী-রসূলদের তাবলীগী কাজকর্ম বুঝাতে এই শব্দটির ব্যবহার শুধু এমন ব্যক্তিই করতে পারে যে আরবী ভাষায় একেবারেই অজ্ঞ।
৮২.
অর্থাৎ তিনি কোন মানুষের সাথে সামনা-সামনি কথাবার্তা বলার বহু ঊর্ধ্বে। নিজের কোন বান্দার কাছে নির্দেশনা পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য সামনা-সামনি বাক্যালাপ করা ছাড়া আর কোন কৌশল উদ্ভাবন করতে তাঁর জ্ঞান অক্ষম নয়।
৮৩.
“এভাবেই” অর্থ শুধু শেষ পদ্ধতি নয়, বরং ওপরের আয়াতে যে তিনটি পদ্ধতি উল্লেখিত হয়েছে তার সব ক’টি। আর ‘রূহ’ অর্থ অহী অথবা অহীর মাধ্যমে নবীকে ﷺ যে শিক্ষা দান করা হয়েছে সেই শিক্ষা। কুরআন ও হাদীস থেকেই একথা প্রমাণিত যে, এই তিনটি পদ্ধতিতেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হিদায়াত দান করা হয়েছেঃ

একঃ হাদীস শরীফে হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে অহী আসার সূচনা হয়েছিল সত্য স্বপ্নের আকারে (বুখারী ও মুসলিম)। এই ধারা পরবর্তী সময় পর্যন্ত জারি ছিল। তাই হাদীসে তাঁর বহু সংখ্যক স্বপ্নের উল্লেখ দেখা যায়। যার মাধ্যমে হয় তাঁকে কোন শিক্ষা দেয়া হয়েছে কিংবা কোন বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। তাছাড়া কুরআন মজীদে নবীর ﷺ একটি স্বপ্নের সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে (আল ফাতহু, আয়াত ২৭)। তাছাড়া কতিপয় হাদীসে একথারও উল্লেখ আছে যে, নবী (সা.) বলেছেন, আমার মনে অমুক বিষয়টি সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে, কিংবা আমাকে একথাটি বলা হয়েছে বা আমাকে এই নির্দেশ দান করা হয়েছে অথবা আমাকে এ কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছে। এ ধরনের সব কিছু অহীর প্রথমোক্ত শ্রেণীর সাথে সম্পর্কিত। বেশীর ভাগ হাদীসে কুদসী এই শ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত।

দুইঃ মে’রাজে নবীকে ﷺ দ্বিতীয় প্রকার অহী দ্বারা সম্মানতি করা হয়েছে। কতিপয় হাদীসে নবীকে ﷺ পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের নির্দেশ দেয়া এবং তা নিয়ে তাঁর বার বার দরখাস্ত পেশ করার কথা যেভাবে উল্লেখিত হয়েছে তা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, সে সময় আল্লাহ‌ এবং তাঁর বান্দা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে ঠিক তেমনি কথাবার্তা হয়েছিলো যেমনটি তূর পাহাড়ের পাদদেশে মূসা (আ) ও আল্লাহর মধ্যে হয়েছিলো।

তিনঃ এরপর থাকে অহীর তৃতীয় শ্রেণী। এ ব্যাপারে কুরআন নিজেই সাক্ষ্য দান করে যে, কুরআনকে জিবরাঈল আমীনের মাধ্যমে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌঁছানো হয়েছে (আল বাকারা ৯৭, আশ শু’আরা ১৯২ থেকে ১৯৫ আয়াত)।

৮৪.
অর্থাৎ নবুওয়াতের মর্যাদায় ভূষিত হওয়ার আগে নবীর ﷺ মগজে এ ধারণা পর্যন্তও কোন দিন আসেনি যে, তিনি কোন কিতাব লাভ করতে যাচ্ছেন বা তাঁর লাভ করা উচিত। বরং তিনি আসমানী কিতাব এবং তার বিষয়বস্তু সম্পর্কে আদৌ কিছু জানতেন না। অনুরূপ আল্লাহর প্রতি তাঁর ঈমান অবশ্যই ছিল। কিন্তু মানুষকে আল্লাহ‌ সম্পর্কে কি কি বিষয় মানতে হবে সচেতনভাবে তিনি তার বিস্তারিত কিছুই জানতেন না। একথাও তাঁর জানা ছিল না যে, এর সাথে ফেরেশতা, নবুওয়াত, আল্লাহর কিতাবসমূহ এবং আখেরাত সম্পর্কে অনেক কিছুই মানা আবশ্যক। এ দু’টি ছিল এমনই বিষয় যা মক্কার কাফেরদের কাছেও গোপন ছিল না। মক্কার কোন মানুষই এ প্রমাণ দিতে সক্ষম ছিল না যে, হঠাৎ নবুওয়াত ঘোষণার পূর্বে সে কখনো নবীর ﷺ মুখে আল্লাহর কিতাবের কথা শুনেছে কিংবা মানুষদের অমুক অমুক বিষয়ের প্রতি ঈমান আনতে হবে এমন কোন কথা শুনেছে। একথা সুস্পষ্ট যদি কোন ব্যক্তি পূর্ব থেকেই নবী হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকে তাহলে চল্লিশ বছর পর্যন্ত রাত দিন তাঁর সাথে উঠাবসা করেও কেউ তাঁর মুখ থেকে কিতাব ও ঈমান শব্দ পর্যন্ত শুনবে না। অথচ চল্লিশ বছর পর সে ঐ সব বিষয়েই হঠাৎ জোরালো বক্তব্য পেশ করতে শুরু করবে তা কখনো হতে পারে না।
৮৫.
এটা কাফেরদের বিরুদ্ধে উচ্চারিত শেষ সতর্কবাণী। এর তাৎপর্য হলো, নবী (সা.) বললেন আর তোমরা তা শুনে প্রত্যাখ্যান করলে কথা এখানেই শেষ হয়ে যাবে না। পৃথিবীতে যা কিছু ঘটছে তার সবই আল্লাহর সামনে পেশ করা হবে এবং সবশেষে কার কি পরিণাম হবে সে চূড়ান্ত ফায়সালা তাঁর দরবার থেকেই হবে।
অনুবাদ: