أَفَرَءَيْتَ مَنِ ٱتَّخَذَ إِلَـٰهَهُۥ هَوَىٰهُ وَأَضَلَّهُ ٱللَّهُ عَلَىٰ عِلْمٍۢ وَخَتَمَ عَلَىٰ سَمْعِهِۦ وَقَلْبِهِۦ وَجَعَلَ عَلَىٰ بَصَرِهِۦ غِشَـٰوَةًۭ فَمَن يَهْدِيهِ مِنۢ بَعْدِ ٱللَّهِ ۚ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ
তুমি কি কখনো সেই ব্যক্তির অবস্থা ভেবে দেখেছো যে তার প্রবৃত্তির কামনা বাসনাকে খোদা বানিয়ে নিয়েছে ৩০ আর জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও ৩১ আল্লাহ তাকে গোমরাহীর মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন, তার দিলে ও কানে মোহর মেরে দিয়েছেন এবং চোখে আবরণ সৃষ্টি করেছেন। ৩২ আল্লাহ ছাড়া আর কে আছে যে তাকে হিদায়াত দান করতে পারে? তোমরা কি কোন শিক্ষা গ্রহণ করো না? ৩৩
৩০
প্রবৃত্তির কামনা-বাসনাকে খোদা বানিয়ে নেয়ার অর্থ ব্যক্তির নিজের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষার দাস হয়ে যাওয়া। তার মন যা চায় তাই সে করে বসে যদিও আল্লাহ তা হারাম করেছেন এবং তার মন যা চায় না তা সে করে না যদিও আল্লাহ তা ফরয করে দিয়েছেন। ব্যক্তি যখন এভাবে কারো আনুগত্য করতে থাকে তখন তার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, তার উপাস্য আল্লাহ নয়, বরং সে এভাবে যার আনুগত্য করছে সে-ই তার উপাস্য। সে মুখে তাকে ‘ইলাহা’ এবং উপাস্য বলুক বা না বলুক কিংবা মূর্তি তৈরী করে তার পূজা করুক বা না করুক তাতে কিছু এসে যায় না। কারণ, দ্বিধাহীন আনুগত্যই তার উপাস্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এভাবে কার্যত শিরক করার পর কোন ব্যক্তি শুধু এই কারণে শিরকের অপরাধ থেকে মুক্ত হতে পারে না যে, সে যার আনুগত্য করছে মুখে তাকে উপাস্য বলেনি এবং সিজদাও করেনি। অন্যান্য বড় বড় মুফাসসিরও আয়াতটির এ ব্যাখ্যাই করেছেন। ইবনে জারীর এর অর্থ বর্ণনা করেছেন এইভাবে যে, সে তার প্রবৃত্তির কামনা-বাসনাকে উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে। প্রবৃত্তি যা কামনা করেছে সে তাই করে বসেছে। না সে আল্লাহর হারামকৃত বস্তুকে হারাম বলে মনে করেছে, না তার হালালকৃত বস্তুকে হালাল বলে গণ্য করেছে। আবু বকর জাসসাস এর অর্থ বর্ণনা করেছেন, “কেউ যেমনভাবে আল্লাহর আনুগত্য করে সে ঠিক তেমনিভাবে প্রবৃত্তি আকাঙ্ক্ষার আনুগত্য করে।” যামাখশারী এর ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, “সে প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার প্রতি অত্যন্ত অনুগত। তার প্রবৃত্তি তাকে যেদিকে আহবান জানায় সে সেদিকেই চলে যায়। সে এমনভাবে তার দাসত্ব করে যেমন কেউ আল্লাহর দাসত্ব করে” (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল ফুরকান, টীকা ৫৬; সূরা সাবার ব্যাখ্যা, টীকা ৬৩; ইয়াসীন, টীকা ৫৩; আশ শূরা, টীকা ৩৮)।
৩১
মূল বাক্যাংশ হচ্ছে أَضَلَّهُ اللَّهُ عَلَى عِلْمٍ । এই বাক্যাংশের একটি অর্থ হতে পারে এই যে, জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর পক্ষ থেকে সে ব্যক্তিকে গোমরাহীর মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়েছে। কেননা সে প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার দাস হয়ে গিয়েছিলো। আরেকটি অর্থ হতে পারে এই যে, সে তার প্রবৃত্তির ইচ্ছা ও কামনা-বাসনাকে খোদা বানিয়ে বসেছে এ বিষয়টি জেনে আল্লাহ তাকে গোমরাহীর মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন।
৩২
আল্লাহ কর্তৃক কাউকে গোমরাহীর মধ্যে নিক্ষেপ, তার মন ও কানের ওপর মোহর লাগিয়ে দেয়া এবং চোখের ওপর আবরণ সৃষ্টি করে দেয়ার ব্যাখ্যা ইতিপূর্বে এ গ্রন্থের কয়েকটি স্থানে করেছি। দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল বাকারা, টীকা ১০ ও ১৬; আল আনয়াম, টীকা ১৭ ও ২৭; আল আরাফ, টীকা ৮০; আত তাওবা, টীকা ৮৯ ও ৯৩; ইউনুস, টীকা ৭১; আর রা’দ, টীকা ৪৪; ইবরাহীম, টীকা ৬, ৭ ও ৪০; আন নাহল, টীকা ১১০; বনী ইসরাঈল, টীকা ৫১; আর রূম, টীকা ৮৪; ফাতের, আয়াত ৮, টীকা ১৬ ও ১৭ এবং আল মু’মিন, টীকা ৫৪।
৩৩
যে প্রসঙ্গে এ আয়াতটি এসেছে তাতে আপনা থেকেই একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, যারা প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার দাসত্ব করতে চায় প্রকৃতপক্ষে সেই সব লোকই আখেরাতকে অস্বীকার করে এবং আখেরাতে বিশ্বাসকে নিজের স্বাধীনতার পথের অন্তরায় মনে করে। তা সত্ত্বেও তারা যখন আখেরাতকে অস্বীকার করে বসে তখন তাদের প্রবৃত্তির দাসত্ব আরো বৃদ্ধি পেয়ে থাকে এবং প্রতিনিয়তই তারা আরো বেশী করে গোমরাহীর মধ্যে হারিয়ে যেতে থাকে। এমন কোন অপকর্ম থাকে না যাতে জড়িত হওয়া থেকে তারা বিরত থাকে। কারো হক মারতে তারা দ্বিধান্বিত হয় না। ন্যায় ও ইনসাফের প্রতি তাদের মনে কোন শ্রদ্ধা থাকে না। তাই কোনো প্রকার জুলুম ও বাড়াবাড়ির সুযোগ লাভের পর তা থেকে তারা বিরত থাকবে এ আশা করা যায় না। যেসব ঘটনা দেখে মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, সেই সব ঘটনা তাদের চোখের সামনে আসে কিন্তু তারা তা থেকে যে শিক্ষা গ্রহণ করে তা হচ্ছে, আমরা যা কিছু করছি ঠিকই করছি এবং এসবই আমাদের করা উচিত। কোন উপদেশ বাণীই তাদের প্রভাবিত করে না। কোন মানুষকে দুষ্কর্ম থেকে বিরত রাখার জন্য যে যুক্তি প্রমাণ ফলপ্রসূ হতে পারে তা তাদের আবেদন সৃষ্টি করে না। বরং তারা তাদের এই লাগামহীন স্বাধীনতার পক্ষে যুক্তি প্রমাণ খুঁজে খুঁজে বের করে। ভাল চিন্তার পরিবর্তে তাদের মন ও মস্তিষ্ক রাত-দিন সম্ভাব্য সকল পন্থায় তাদের নিজেদের স্বার্থ ও কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার চেষ্টায় লেগে থাকে। আখেরাত বিশ্বাসের অস্বীকৃতি যে মানুষের নৈতিক চরিত্রের জন্য ধ্বংসাত্মক এটা তারই সুস্পষ্ট প্রমাণ। মানুষকে যদি মনুষ্যত্বের গণ্ডির মধ্যে কোন জিনিস ধরে রাখতে সক্ষম হয় তাহলে তা পারে কেবল এই অনুভূতি যে, আমরা দায়িত্ব মুক্ত নই, বরং আল্লাহর সামনে আমাদের সকল কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। এই অনুভূতিহীন হওয়ার পর কেউ যদি অতি বড় জ্ঞানীও হয় তাহলেও সে পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট আচরণ না করে পারে না।