هُوَ ٱلَّذِىٓ أَنزَلَ ٱلسَّكِينَةَ فِى قُلُوبِ ٱلْمُؤْمِنِينَ لِيَزْدَادُوٓا۟ إِيمَـٰنًۭا مَّعَ إِيمَـٰنِهِمْ ۗ وَلِلَّهِ جُنُودُ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ ۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًۭا
তিনিই তো সে সত্তা যিনি মু’মিনদের মনে প্রশান্তি নাযিল করেছেন ৬ যাতে তারা নিজেদের ঈমান আরো বাড়িয়ে নেয়। ৭ আসমান ও যমীনের সমস্ত বাহিনী আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন। তিনি মহাজ্ঞানী ও কৌশলী। ৮
৬
سكِينَةَ আরবী ভাষায় স্থিরতা, প্রশান্তি ও দৃঢ় চিত্ততাকে বুঝায়। এখানে আল্লাহ তা’আলা মু’মিনদের অন্তরে তা নাযিল করাকে হুদাইবিয়ায় ইসলাম ও মুসলমানগণ যে বিজয় লাভ করেছিলো তার গুরুত্ব পূর্ণ কারণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সে সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে সামান্য চিন্তা-ভাবনা করলেই বুঝা যায় তা কি ধরনের প্রশান্তি ছিল যা ঐ পুরো সময়টা ধরেই মুসলমানদের হৃদয় মনে অবতীর্ণ করা হয়েছিল আর কিভাবে তা এ বিজয়ের কারণ হয়েছিল। যে সময় রসূলুল্লাহ ﷺ উমরা আদায়ের জন্য মক্কা শরীফ যাওয়ার সংকল্প প্রকাশ করেছিলেন মুসলমানগণ যদি সে সময় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তেন এবং মুনাফিকদের মত মনে করতেন যে এতো স্পষ্টত মৃত্যুর মুখের মধ্যে চলে যাওয়া কিংবা পথে যখন খবর পাওয়া গেল কাফের কুরাইশরা যুদ্ধ করতে সংকল্প করেছে তখন যদি মুসলমানরা হতবুদ্ধি ও অস্থির হয়ে পড়তেন যে, যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম ছাড়াই কিভাবে আমরা শত্রুর মোকাবিলা করবো আর এ কারণে তাদের মধ্যে বিশৃংখলার সৃষ্টি হতো তাহলে হুদাবিয়াতে যে ফলাফল অর্জিত হয়েছিল তা কখনো অর্জিত হতো না। তাছাড়া কাফেররা হুদায়িবিয়ায় যখন মুসলমানদের আক্রমণ হতে বাধা দিয়েছিল, যখন আকস্মিক হামলা চালিয়ে এবং রাতের অন্ধাকারে আক্রমণ করে করে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেছিল, যখন হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাত লাভের খবর পাওয়া গিয়েছিল, যখন আবু জানদাল অত্যাচারিতের মূর্ত ছবি হয়ে মুসলমানদের জনসমাবেশের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তখন যদি মুসলমানগণ উত্তেজিত হয়ে রসূল্লাল্লাহ ﷺ যে শৃংখলা ও সংযম প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তা নষ্ট করতেন তাহলে সবকিছুই ভুন্ডল হয়ে যেতো। সবচেয়ে বড় কথা হলো, মুসলমানদের গোটা সংগঠনের কাছে সন্ধিচুক্তির যেসব শর্ত অত্যন্ত অপছন্দনীয় ছিল রসূলুল্লাহ ﷺ যখন তা মেনে নিয়েই চুক্তি সম্পাদন করতে যাচ্ছিলেন তখন যদি সাহাবীগণ নবীর ﷺ নির্দেশ অমান্য করে বসতেন তাহলে হুদাইবিয়ার এ বিরাট বিজয় বিরাট পরাজয়ে রূপান্তরিত হতো। এসব নাজুক মুহূর্তে রসূলের নেতৃত্ব ও পথপ্রদর্শন সম্পর্কে, ইসলামের সত্যতা সম্পর্কে এবং নিজেদের আদর্শিক কর্ম-তৎপরতার ন্যায় ও সত্য হওয়া সম্পর্কে মুসলমানদের মনে যে পূর্ণ আস্থা ও প্রশান্তি ছিল তা সরাসরি আল্লাহর মেহেরবানী। এ কারণে তারা ধীরে স্থীর মনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল যে, আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে যাই ঘটুক না কেন তা সবই শিরধার্য। এ করণে তারা ভয়-ভীতি, অস্থিরতা, উস্কানী এবং নৈরাশ্য সবকিছু থেকে মুক্ত ছিলেন। এর কল্যাণেই তাঁদের শিবিরে পূর্ণ শৃংখলা ও সংযম বজায় ছিল এবং সন্ধির শর্তসমূহ সম্পর্কে অত্যন্ত অবনত মস্তকে মেনে নিয়েছিলেন। এটাই সেই প্রশান্তি যা আল্লাহ তা’আলা মু’মিনদের মনে নাযিল করেছিলেন। এর কারণেই উমরা আদায়ের সেই বিপদসংকুল উদ্যোগটি সর্বোত্তম সাফল্যের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল।
৭
অর্থাৎ তাদের যে ঈমান এ অভিযানের পূর্বে ছিল, তার সাথে আরো ঈমান তারা অর্জন করলো এ কারণে যে, এ অভিযান চলাকালে একের পর এক যত পরীক্ষা এসেছে তার প্রত্যেকটিতে তারা নিষ্ঠা, তাকওয়া ও আনুগত্যের নীতির ওপর দৃঢ়পদ থেকেছে। যেসব আয়াত থেকে বুঝা যায় ঈমান কোন স্থির, জড় ও অপরিবর্তনীয় অবস্থার নাম নয়। বরং ঈমান হ্রাস বৃদ্ধি ও ওঠানামা আছে, এ আয়াতটি তার একটি। ইসলাম গ্রহণের পর থেকে মু’মিনদের জীবনের পদে পদে এমন সব পরীক্ষা আসে যখন তাকে এ সিদ্ধান্তকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় যে, আল্লাহর দ্বীনের জন্য সে তার জান-মাল আবেগ-অনুভূতি, আশা-আকাংখা, সময়, আরাম আয়েশ এবং স্বার্থ কুরবানী করতে প্রস্তুত আছে কিনা। এরূপ প্রতিটি পরিক্ষার সময় যদি সে কুরবানী ও ত্যাগের পথ অনুসরণ করে তাহলে তার ঈমান উন্নতিও সমৃদ্ধিলাভ করে। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে তার ঈমান থমকে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত এমন এক সময়ও আসে যখন তার ঈমানের প্রাথমিক ও পুঁজিও সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে, যা নিয়ে সে ইসলামের গণ্ডিতে প্রবেশ করেছিল। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আনফাল, টীকা ২; আল আহযাব, টীকা ৩৮)।
৮
অর্থাৎ আল্লাহর কাছে এমন বাহিনী আছে, যার সাহায্যে তিনি যখন ইচ্ছা কাফেরদের ধ্বংস করে দিতে পারেন। কিন্তু বিশেষ উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে ইচ্ছা করেই তিনি ঈমানদারদের ওপর এ দায়িত্ব অর্পণ করেছেন যাতে তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে চেষ্টা-সাধনা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হয়ে আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত করেন। এ কাজের দ্বারাই তাদের মর্যাদা উন্নত এবং আখোতের সাফল্যের দ্বার উন্মুক্ত হয়। পরের আয়াত এ কথারই প্রতিধ্বনি করছে।