لَقَدْ رَأَى مِنْ آيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَى
এসব কারণে বাহ্যত এ বিতর্কের কোন প্রয়োজনই ছিল না যে, এ দু’টি ক্ষেত্রে রসূলুল্লাহ্ ﷺ আল্লাহ তা’আলাকে দেখেছিলেন, না জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে দেখেছিলেন? কিন্তু যে কারণে এ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে তা হচ্ছে, এ বিষয়ে বর্ণিত হাদীসসমূহে মতানৈক্য দেখা যায়। এ বিষয়ে বিভিন্ন সাহাবা কিরাম কর্তৃক বর্ণিত হাদীসসমূহ আমরা নীচে এক এক করে বর্ণনা করলাম।
একঃ হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসসমূহঃ
হাদীস গ্রন্থ বুখারীর কিতাবুত তাফসীরে হযরত মাসরূক থেকে বর্ণিত হয়েছে, আমি হযরত আয়েশা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম; “আম্মাজান, হযরত মুহাম্মাদ ﷺ কি আল্লাহকে দেখেছিলেন? ” তিনি জবাব দিলেন।”তোমার একথা শুনে আমার গায়ের পশম শিউরে উঠেছে। তুমি কি করে ভুলে গেলে যে, তিনটি বিষয় এমন যা কেউ দাবী করলে মিথ্যা দাবী করা হবে।” (তার মধ্যে প্রথম কথাটি হয়রত আয়েশা (রাঃ) যা বললেন, তা হচ্ছে) “কেউ যদি তোমাকে বলে যে, হযরত মুহাম্মাদ ﷺ আল্লাহকে দেখেছিলেন, তাহলে সে মিথ্যা বলে।” তারপর হযরত আয়েশা (রাঃ) এ আয়াতগুলো পাঠ করলেন। لَا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ (দৃষ্টিসমূহ তাঁকে দেখতে সক্ষম নয়।)
وَمَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُكَلِّمَهُ اللَّهُ إِلَّا وَحْيًا أَوْ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ أَوْ يُرْسِلَ رَسُولًا فَيُوحِيَ بِإِذْنِهِ مَا يَشَاءُ
“কোন মানুষেরই এমন মর্যাদা নেই যে, আল্লাহ তার সাথে সরাসরি কথা বলবেন। তবে হয় অহী হিসেবে বা পর্দার আড়াল থেকে কিংবা তিনি কোন ফেরেশতা পাঠাবেন এবং সে তাঁর ইচ্ছা মাফিক তার প্রতি অহী নাযিল করবে।” এরপর তিনি বললেনঃ “তবে রসূলুল্লাহ্ ﷺ জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে দু’বার তাঁর আসল আকৃতিতে দেখেছেন।”
এ হাদীসের একটি অংশ বুখারীর কিতাবুত তাওহীদের ৪র্থ অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া বাদউল খালক অধ্যায়ে ইমাম বুখারীর মাসরূক বর্ণিত যে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন তাতে মাসরূপ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। হযরত আয়েশার একথা শুনে আমি বললাম তাহলে আল্লাহ তা’আলার একথার কি অর্থ হবে? ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى - فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى তিনি বললেন এর দ্বারা জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে বুঝানো হয়েছে। তিনি সব সময় মানুষের রূপ ধরে রসূলুল্লাহ্ ﷺ এর কাছে আসতেন। কিন্তু ঐ সময় তিনি তাঁর আসল আকৃতিতে তাঁর কাছে এসেছিলেন এবং তাঁর শরীরে গোটা দিগন্ত আড়াল হয়ে গিয়েছিল।
মুসলিম কিতাবুল ঈমানের باب فى ذكر كدرة المنتهى এ হযরত আয়েশার (রাঃ) সাথে মাসরূকের এ কথোপকথন অধিক বিস্তারিত রূপে উদ্ধৃত হয়েছে। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছেঃ হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেনঃ যে ব্যক্তি দাবী করে যে, মুহাম্মাদ ﷺ তাঁর রবকে দেখেছেন সে আল্লাহ তা’আলার প্রতি অতি বড় অপবাদ আরোপ করে।” মাসরূক বলেনঃ আমি হেলান দিয়ে বসেছিলাম। একথা শুনে আমি উঠে বসলাম এবং বললাম উম্মুল মু’মিনীন তাড়াহুড়ো করবেন না। আল্লাহ তা’আলা কি বলেন নি وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَى এবং وَلَقَدْ رَآهُ بِالْأُفُقِ الْمُبِينِ জবাবে হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেনঃ এ উম্মতের মধ্যে আমিই সর্ব প্রথম এ ব্যাপারে রসূলুল্লাহ্ ﷺ কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেনঃ
إِنَّمَا هُوَ جِبْرِيلُ عليه السلام, لَمْ أَرَهُ عَلَى صُورَتِهِ الَّتِى خُلِقَ عَلَيْهَا غَيْرَ هَاتَيْنِ الْمَرَّتَيْنِ- رَأَيْتُهُ مُنْهَبِطًا مِنَ السَّمَاءِ سَادًّا عِظَمُ خَلْقِهِ مَا بَيْنَ السَّمَاءِ والأَرْضِ-
তিনি তো ছিলেন জিবরাঈল আলাইহিস সালাম। আল্লাহ তা’আলা তাঁকে যে আকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন সে আসল আকৃতিতে আমি তাঁকে এ দু’বার ছাড়া আর কখনো দেখিনি। দু’বারই আমি তাঁকে আসমান থেকে নেমে আসতে দেখেছি। সে সময় তাঁর বিশাল সত্তা পৃথিবী ও আসমানের মধ্যবর্তী সমগ্র শূন্যলোক ছেয়ে ফেলেছিলো।”
মাসরূক বর্ণিত এ হাদীস ইবনে মারদুইয়া যে ভাষায় বর্ণনা করেছেন তা হচ্ছেঃ হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেনঃ আমিই সর্ব প্রথম রসূলুল্লাহ্ ﷺ কে জিজ্ঞেস করেছিলামঃ আপনি কি আপনার রবকে দেখেছিলেন? জবাবে নবী ﷺ বললেন, না। “আমি তো জিবরাঈলকে আসমান থেকে নেমে আসতে দেখেছিলাম।”
দুইঃ হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বর্ণিত হাদীসসমূহঃ বুখারী কিতাবুত তাফসীর, মুসলিম কিতাবুল ঈমান এবং তিরমিযী আবওয়াবুত তাফসীরে যির ইবনে হুবাইশ থেকে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى আয়াতটির তাফসীর প্রসঙ্গে বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ্ ﷺ জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে এমন আকৃতিতে দেখেছেন যে, তাঁর ছয়শত ডানা ছিল।
মুসলিমে অন্যান্য রেওয়ায়াতে مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَى এবং لَقَدْ رَأَى مِنْ آيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَى আয়াতেরও এ একই তাফসীর আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে যির ইবনে হুবাইশ বর্ণনা করেছেনঃ
মুসনাদে আহমাদে আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদের এ তাফসীর যির ইবনে হুবাইশ ছাড়া আবদুর রহমান ইবনে ইয়াযীদ এবং আবু ওয়ায়েলের মাধ্যমেও বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়াও মুসনাদে আহমাদে যির ইবনে হুবাইশের আরো দু’টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে যাতে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَى - عِنْدَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى আয়াতের তাফসীর বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেনঃ
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم رَأَيْتُ جِبْرِيلَ عند سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى عليه سِتُّمِائَةِ جَنَاحٍ-
“রসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেছেনঃ “আমি জিবরাঈলকে সিদরাতুল মুনতহার কাছে দেখেছি। সে সময় তাঁর ছয়শত ডানা ছিল।”
এ একই বিষয়বস্তু সম্বলিত হাদীস শাকীক ইবনে সালামা থেকে ইমাম আহমদও বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসে বলেছেন, আমি আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদের (রাঃ) মুখ থেকে শুনেছি যে, রসূলুল্লাহ্ ﷺ নিজে বলেছিলেনঃ আমি জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে এ আকৃতিতে “সিদরাতুল মুনহাতায়” দেখেছিলাম।
তিনঃ আতা ইবনে আবী রাবাহ হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) কে وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَى অর্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেনঃ رَأَى جِبْرِيلَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ নবী ﷺ জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে দেখেছিলেন (মুসলিম, কিতাবুল ঈমান)।
চারঃ ইমাম মুসলিম কিতাবুল ঈমানে হযরত আবু যার গিফারীর মাধ্যমে আবদুল্লাহ্ ইবনে শাকীক বর্ণিত দু’টি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। এক রেওয়াতে তিনি বলেছেনঃ আমি রসূলুল্লাহ্ ﷺ কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি আপনার রবকে দেখেছিলেন? জবাবে নবী ﷺ বললেনঃ نُورٌ أَنَّى أَرَاهُ । অপর রেওয়ায়াতে বলেছেনঃ তিনি আমার এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেনঃ رَأَيْتُ نُورًا । ইবনুল কাইয়েম زاد المعاد গ্রন্থে নবী ﷺ এর প্রথম উক্তির অর্থ বর্ণনা করে বলেছেন আমার ও আল্লাহকে দেখার মধ্যে প্রতিবন্ধক ছিল নূর। তিনি দ্বিতীয় উক্তির অর্থ বর্ণনা করেছেন এই যে, আমি আমার রবকে দেখিনি, বরং নূর দেখেছি।”
নাসায়ী ও ইবনে আবী হাতেম নিম্নোক্ত ভাষায় হযরত আবু যারের (রাঃ) বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। রসূলুল্লাহ্ ﷺ অন্তর দিয়ে তাঁর রবকে দেখেছেন, চোখ দিয়ে দেখেন নি।”
পাঁচঃ ইমাম মুসলিম কিতাবুল ঈমানে হযরত আবু মুসা আশ’আরী (রাঃ) থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদীসে নবী ﷺ বলেছেনঃ مَا انْتَهَى إِلَيْهِ بَصَرُهُ مِنْ خَلْقِهِ “আল্লাহ্ তা’আলার সৃষ্টির মধ্য থেকে কারো চোখই আল্লাহ তা’আলা পর্যন্ত পৌঁছেনি।”
ছয়ঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীসসমূহঃ
মুসলিমের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাসকে - مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَى- وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَى আয়াত দু’টির অর্থ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেনঃ রসূলুল্লাহ্ ﷺ তাঁর রবকে দু’বার অন্তর দিয়ে দেখেছেন। মুসনাদে আহমাদেও এ হাদীসটি আছে।
আতা ইবনে আবী রাবাহর বরাত দিয়ে ইবনে মারদুইয়াহ ইবনে আব্বাসের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, রসূলুল্লাহ্ ﷺ আল্লাহ তা’আলাকে চোখ দিয়ে নয়, অন্তর দিয়ে দেখেছিলেন।
নাসায়ীতে ইকরিমা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ইবনে আব্বাস বলেছেনঃ
اتعجبون ان تكون الخلة لابراهيم والكلام لموسى والروية لمحمد؟
“আল্লাহ্ তা’আলা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন, মূসা আলাইহিস সালামের সাথে কথা বলে তাঁকে সম্মানিত করেছেন এবং মুহাম্মাদ ﷺ কে তাঁর দর্শনলাভের মর্যাদা দিয়েছেন” এতে কি তোমরা বিস্ময়বোধ করছো? হাকেমও এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং একে সহীহ বলে উল্লেখ করেছেন।
তিরমিযীতে শা’বী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ইবনে আব্বাস এক মজলিসে বললেনঃ আল্লাহ তা’আলা তাঁর সাক্ষাত লাভ ও কথোপকথনকে মুহাম্মাদ ﷺ ও মূসা আলাইহিস সালামের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন। তিনি মুসা আলাইহিস সালামের সাথে দু’বার কথা বলেছেন এবং মুহাম্মাদ ﷺ তাঁকে দু’বার দেখেছেন।” ইবনে আব্বাসের এ কথা শুনে মাসরূক হযরত আয়েশার (রাঃ) কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ মুহম্মাদ ﷺ কি তাঁর রবকে দেখেছিলেন? তিনি বললেনঃ “তুমি এমন কথা বলেছো যা শুনে আমার পশম শিউরে উঠেছে।” এরপর হযরত আয়েশা (রাঃ) ও মাসরূকের মধ্যে যে কথাবার্তা হয়েছে আমরা উপরে হযরত আয়েশার (রাঃ) বর্ণিত হাদীসসমূহের মধ্যে উদ্ধৃত করেছি।
তিরমিযীতেই অন্য যেসব হাদীস ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হয়েছে তার একটিতে তিনি বলেছেন, নবী ﷺ আল্লাহ তা’আলাকে দেখেছিলেন। দ্বিতীয় একটি হাদীসে বলেছেন; দু’বার দেখেছিলেন এবং তৃতীয় আরেকটি হাদীসে বলেছেন, তিনি অন্তর দিয়ে আল্লাহ তা’আলাকে দেখেছিলেন।”
মুসনাদে আহমাদে ইবনে আব্বাস বর্ণিত একটি হাদীসে আছেঃ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم رَأَيْتُ رَبِّى تَبَارَكَ وَتَعَالَى “আমি আমার মহাকল্যাণময় ও মর্যাদাবান রবকে দেখেছি।” আরেকটি হাদীসে তিনি বলেনঃ
أَنَّ رسول الله صلى الله عليه وسلم قَالَ أَتَانِى رَبِّى اللَّيْلَةَ فِى أَحْسَنِ صُورَةٍ - أَحْسِبُهُ يَعْنِى فِى النَّوْمِ-
রসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেছেনঃ “আমার রব আজ রাতে অতীব সুন্দর আকৃতিতে আমার কাছে এসেছিলেন। আমার মনে হয় নবীর ﷺ এ কথার অর্থ তিনি স্বপ্নে আল্লাহ তা’আলাকে দেখেছিলেন।”
তাবারানী ও ইবনে মারদুইয়াহ ইবনে আব্বাস বর্ণিত একটি হাদীসে এও উদ্ধৃত করেছেন যে, রসূলুল্লাহ্ ﷺ দু’বার তাঁর রবকে দেখেছেন। একবার দেখেছেন চোখে আরেকবার দেখেছেন অন্তর দিয়ে।
সাতঃ মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব আল-কুরাযী বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ্ ﷺ এর সাহাবীদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ আপনি কি আপনার রবকে দেখেছেন? নবী ﷺ জবাব দিলেনঃ আমি তাঁকে দু’বার অন্তর দিয়ে দেখেছি। (ইবনে আবী হাতেম)। এ বর্ণনাটিকে ইবনে জারীর যেরূপ ভাষায় উদ্ধৃত করেছেন তা হচ্ছে, নবী ﷺ বললেনঃ “আমি তাঁকে চোখ দিয়ে অন্তর দিয়ে দু’বার দেখেছি।”
আটঃ মি’রাজের ঘটনা প্রসঙ্গে শারীক ইবনে আব্দুল্লাহ্র বরাত দিয়ে ইমাম বুখারী কিতাবুল তাওহীদে হযরত আনাস ইবনে মালেক বর্ণিত যে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন তাতে এ কথাগুলো আছেঃ
حَتَّى جَاءَ سِدْرَةَ الْمُنْتَهَى وَدَنَا الْجَبَّارُ رَبُّ الْعِزَّةِ فَتَدَلَّى حَتَّى كَانَ مِنْهُ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى فَأَوْحَى اللَّهُ فِيمَا أَوْحَى إِلَيْهِ خَمْسِينَ صَلاَةً-
“তিনি যখন সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছলেন তখন মহাপরাক্রান্ত ও মহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর নিকটবর্তী হলেন এবং তার উপর দিকে শূন্যে অবস্থান করলেন। এমন কি নবী ﷺ ও তাঁর মধ্যে মুখোমুখি দু’টি ধনুকের মধ্যকার সমান বা তার চেয়েও কম ব্যবধান রইলো। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা তাঁর কাছে যেসব বিষয়ে অহী করলেন তার মধ্যে পঞ্চম ওয়াক্ত নামাযের নির্দেশও ছিল।”
কিন্তু এ হাদীসের সনদ ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে ইমাম খাত্তাবী, হাফেজ ইবনে হাজার, ইবনে হাযম এবং الجمع بين الصحيحين প্রণেতা হাফেয আবদুল হক যেসব আপত্তি উত্থাপন করেছেন তা ছাড়াও সবচেয়ে বড় আপত্তি হচ্ছে এটি স্পষ্টরূপে কুরআনের পরিপন্থী। কারণ, কুরআন মজীদে দু’টি ভিন্ন ভিন্ন সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করে। তার মধ্যে প্রথমটি নবুওয়াতের প্রাথমিক যুগে একটি উঁচু দিগন্তে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেখানে دَنَا فَتَدَلَّى - فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى বিষয়ক ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল। আর দ্বিতীয়টি সিদরাতুল মুনতাহার সন্নিকটে সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু ওপরে বর্ণিত এ রেওয়ায়াতটি দু’টি সাক্ষাতের ঘটনাকে একসাথে মিলিয়ে জগাখিচুড়ি করে একই সাক্ষাত বানিয়ে ফেলেছে। অতএব কুরআন মজীদের পরিপন্থী হওয়ার কারণে কোন ক্রমেই তা গ্রহণ করা যেতে পারে না।
এরপর ওপরে বর্ণিত হাদীসগুলোর প্রসঙ্গে আসা যাক। ও গুলোর মধ্যে আবার হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এবং হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসগুলোই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তাঁরা উভয়েই ঐকমত্য সহকারে খোদ রসূলুল্লাহ্ ﷺ থেকে একথা বর্ণনা করেছেন যে, উভয় ক্ষেত্রেই তিনি আল্লাহ তা’আলাকে নয়, জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে দেখেছিলেন। তাছাড়া এসব হাদীস কুরআন মজিদের বক্তব্য ও ইঙ্গিতের সাথেও সম্পূর্ণরূপে সঙ্গতিপূর্ণ। এছাড়া হযরত আবু যার (রাঃ) এবং হযরত আবু মূসা আশ’আরী (রাঃ) নবীর ﷺ যেসব উক্তি উদ্ধৃত করেছেন তা থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে হাদীস গ্রন্থসমূহে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস থেকে যেসব হাদীস বর্ণিত হয়েছে তাতে গুরুতর অনৈক্য পরিলক্ষিত হয়। কোন হাদীসে উভয় সাক্ষাতকেই চাক্ষুষ সাক্ষাত বলা হয়েছে, কোনটিতে উভয় সাক্ষাতকেই অন্তরের সাক্ষাত বলা হয়েছে, কোনটাতে একটি সাক্ষাতকে চাক্ষুষ অপরটিকে অন্তরের বলা হয়েছে, আবার কোনটিতে চাক্ষুষ দর্শনকে পরিষ্কার ভাষায় অস্বীকার করা হয়েছে। এসব বর্ণনার একটিও এমন নয় যাতে রসূলুল্লাহ্ ﷺ এর নিজের উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে। আর যেখানে তারা রসূলুল্লাহ্ ﷺ এর নিজের কোন কথা বা উক্তি উদ্ধৃত করেছেন সেখানে প্রথমত কুরআন মজীদে বর্ণিত এ দু’টি সাক্ষাত লাভের কোনটিরও নামের উল্লেখ নেই। তাছাড়া তাদের একটি রেওয়ায়াতের ব্যাখ্যা অন্য রেওয়ায়াতের থেকে যা জানা যায় তা হচ্ছে নবী ﷺ কোন সময়ই জাগ্রত অবস্থায় আল্লাহ তা’আলাকে দেখেননি, স্বপ্নে আল্লাহ তা’আলাকে দেখেছিলেন। তাই প্রকৃতপক্ষে এসব আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাসের সাথে সম্পর্কিত রেওয়ায়াতসমূহের ওপর নির্ভর করা যেতে পারে না। অনুরূপভাবে মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব আল-কুরাযীর বর্ণনাসমূহে যদিও রসূলুল্লাহ্ ﷺ এর উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে কিন্তু যেসব সাহাবায়ে কিরাম নবী ﷺ থেকে একথা থেকে একথা শুনেছেন তাতে তাদের নাম বলা হয়নি। তার একটিতে আবার বলা হয়েছে যে, নবী ﷺ চাক্ষুষ দেখার বিষয় সরাসরি অস্বীকার করেছেন।