এখানে আরো একটি সূক্ষ্ম বিষয় আছে যা ভালভাবে বুঝতে হবে। কুরআন মজীদের অতি অল্প সংখ্যক স্থানে আল্লাহ তা’আলার গুণবাচক নাম عَزِيزُ আযীয (মহাপরাক্রমশালী) এর সাথে قوى (নিরংকুশ শক্তির অধিকারী), مقتدر (ক্ষমতাধর), جبار (আপন নির্দেশাবলী বাস্তবায়নকারী) এবং ذوانتقام (প্রতিশোধ গ্রহণকারী) শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে যার সাহায্যে তাঁর নিরংকুশ ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে। যেখানে বাক্যের ধারাবাহিকতা জালেম ও অবাধ্যদের জন্য আল্লাহর আযাবের ভীতি প্রদর্শন দাবী করে কেবল সেখানেই এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ ধরনের হাতে গোনা কতিপয় স্থান বাদ দিলে আর যেখানেই عزيز আযীয শব্দ ব্যবহার হয়েছে সেখানেই তার সাথে সাথে حكيم হাকীম (অতিশয় বিজ্ঞ), عليم আলীম (সর্বজ্ঞতা), رحيم রহিম (দয়ালু, নিয়মতদানকারী), غفور গাফূর (ক্ষমাশীল), وهاب ওহ্হাব (সার্বক্ষণিক দানকারী) এবং حميد হামিদ (প্রশংসিত) শব্দগুলোর মধ্য থেকে কোন শব্দ অবশ্যই ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ, যে সত্তা অসীম ক্ষমতার অধিকারী সে যদি নির্বোধ হয়, মুর্খ হয়, দয়া মায়াহীন হয়, ক্ষমা ও মার্জনা আদৌ না জানে, কৃপণ হয় এবং দুশ্চরিত্র হয় তাহলে তার ক্ষমতার পরিণাম জুলুম নির্যাতন ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। পৃথিবীতে যেখানেই জুলুম নির্যাতন হচ্ছে তার মূল কারণ এই যে, যে ব্যক্তি অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে সে তার শক্তি ও ক্ষমতাকে হয় মূর্খতার সাথে ব্যবহার করছে, নয়তো সে দয়ামায়াহীন, কঠোর হৃদয় অথবা কৃপণ ও সংকীর্ণমনা কিংবা দুশ্চরিত্র ও দুষ্কর্মশীল। যে ক্ষেত্রেই শক্তির সাথে এসব দোষ একত্রিত হবে সেক্ষেত্রেই কোন কল্যাণের আশা করা যায় না। এ কারণে কুরআন মজীদে আল্লাহর গুণবাচক নাম عزيز আযীয এর সাথে তাঁর , حميد , غفور , رحيم , عليم , حكيم গাফুর, হামীদ ও وهاب ওয়াহ্হাব হওয়ার কথাও অবশ্যই উল্লেখ করা হয়েছে যাতে মানুষ জানতে পারে, যে আল্লাহ এ বিশ্ব-জাহান শাসন ও পরিচালনা করছেন একদিকে তিনি এমন ক্ষমতার অধিকারী যে যমীন থেকে নিয়ে আসমান পর্যন্ত কেউ তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাঁধা দিতে পারে না, অপরদিকে তিনি حكيم হাকীক বা মহাজ্ঞানীও বটে। তাঁর প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত সরাসরি জ্ঞান ও বিজ্ঞতার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। তিনি عليم আলীমও। যে ফায়সালাই তিনি করেন জ্ঞান অনুসারেই করেন। তিনি رحيم রহীমও। নিজের অসীম ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের নির্দয়ভাবে ব্যবহার করেন না। তিনি غفور গাফুরও। অধিনস্তদের সাথে ছিদ্রান্বেষণ বা খুঁত ধরা মানসিকতার নয়, বরং ক্ষমাশীলতার আচরণ করে থাকেন। তিনি وهاب ওয়াহ্হাবও। নিজের অধীনস্তদের সাথে কৃপণতার আচরণ করেন না। বরং চরমদানশীলতা ও বদান্যতার আচরণ করছেন এবং তিনি حميد হামীদও। তাঁর সত্তায় প্রশংসার যোগ্য সমস্ত গুণাবলীর ও পূর্ণতার সমাহার ঘটেছে।
যার সার্বভৌমত্বের (Sovereignty) ওপর রাষ্ট্র দর্শন ও আইন দর্শনের আলোচনা সম্পর্কে অবহিত, তারা কুরআনের এ বক্তব্যের প্রকৃত গুরুত্বকে ভালভাবে বুঝতে পারবেন। সাবভৌমত্ব বলতে বুঝায়, সার্বভোম ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তি, অসীম ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মালিক হবে। তার আদেশ ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাঁধা সৃষ্টিকারী, তা পরিবর্তনকারী বা পুনর্বিবেচনাকারী কোন আভ্যন্তরীণ বা বাইরের শক্তি থাকবে না এবং তার আনুগত্য করা ছাড়া কারো কোন উপায়ও থাকবে না। এ অসীম ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ধারণার সাথে মানুষের বিবেক-বুদ্ধি অনিবার্যরূপেই দাবী করে যে, যিনি এ ধরনের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী হবেন তাকে নিষ্কলুষ এবং জ্ঞান-বুদ্ধিতে পূর্ণাংগ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। কারণ, এরূপ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সম্পন্ন লোক নির্বোধ, মূর্খ, দয়ামায়াহীন এবং দুশ্চরিত্র হলে তার সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সর্বাত্মক জুলুম ও বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। এ কারনে যেসব দার্শনিক কোন মানুষ বা মানবীয় প্রতিষ্ঠান কিংবা কোন একদল মানুষকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করেছে তাদেরকে একথাও ধরে নিতে হয়েছে যে, তারা ভুল ত্রুটির ঊর্ধ্বে হবে। কিন্তু এ কথা স্পষ্ট যে, কোন মানবীয় কর্তৃত্ব বাস্তবে যেমন কখনো এরূপ নিরস্কুশ ও সীমাহীন সার্বভৌম ক্ষমতা লাভ করতে পারে না তেমনি কোন বাদশাহ বা পার্লামেন্ট, জাতি কিংবা পার্টি সীমিত পরিসরে যে সার্বভৌম ক্ষমতা লাভ করে থাকে তা নির্ভুল পন্থায় কাজে লাগানোও তার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, এমন যুক্তিবুদ্ধি যার মধ্যে অজ্ঞতার লেশমাত্র নেই এবং এমন জ্ঞান যা সংশ্লিষ্ট সব সত্যকে পরিব্যাপ্ত করে---কোন একজন মানুষ, একক কোন প্রতিষ্ঠান বা কোন জাতির ভাগ্যে জুটে যাওয়া তো দূরের কথা, সম্মিলিতভাবে গোটা মানবজাতিও লাভ করেনি। অনুরূপভাবে মানুষ যতক্ষণ মানুষ ততক্ষণ তার পক্ষে নিজের স্বার্থপরতা, ইন্দ্রিয়পরায়ণতা, ভয়ভীতি, লোভ-লালসা, ইচ্ছা-আকাংখা, পক্ষপাতিত্ব, আবেগ তাড়িত সন্তুষ্টি ও ক্রোধ এবং ভালবাসা ও ঘৃণা করা থেকে ঊর্ধ্বে উঠাও সম্ভবপর নয়। এসব সত্যকে সামনে রেখে কেউ যদি গভীরভাবে চিন্তা করে তাহলে সে উপলব্ধি করবে যে, এ বক্তব্যের মধ্যে কুরআন প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌমত্বের সঠিক ও পূর্ণাংগ ধারণা পেশ করেছে। কুরআন বলছেঃ عزيز আযীয এ বিশ্ব-জাহানে অর্থাৎ নিরংকুশ ও অসীম ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ তা’আলা ছাড়া আর কেউ নেই। আর কেবল তিনিই সীমাহীন এই ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী একমাত্র সত্তা যিনি ‘নিষ্কলুষ’ হাকীম’ ও ‘আলীম’ ‘রাহীম’ ও ‘গাফুর’ এবং ‘হামীদ’ ও ‘ওয়াহ্হাব’।