وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ تَتَابَعْتُمْ حَتَّى لَمْ يَبْقَ مِنْكُمْ أَحَدٌ لَسَالَ بِكُمُ الْوَادِىْ نَارًا-
“তোমরা সবাই যদি চলে যেতে এবং একজনও অবশিষ্ট না থাকত তাহলে এ উপত্যকা আগুনের প্রবাহে প্লাবিত হয়ে যেত। “
ইবনে মারদুইয়া হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে এবং ইবনে জারীর কাতাদা থেকে প্রায় এর অনুরূপ বিষয় বর্ণনা করেছেন।
শিয়াগণ এ ঘটনাটিকেও সাহাবীদের (রা.) প্রতি কটাক্ষ করার জন্য ব্যবহার করেছেন। তাঁরা বলেনঃ এত বিপুল সংখ্যক সাহাবীর খোতবা এবং নামায ছেড়ে ব্যবসায়-বাণিজ্য ও খেল তামাশার দিকে ছুটে যাওয়া প্রমাণ করে, তারা দুনিয়াকে আখেরাতের চেয়ে অগ্রাধিকার দিতেন। কিন্তু এটি এমন একটি কঠোর অমূলক দোষারোপ যা শুরু বাস্তব থেকে চোখ বন্ধ করেই করা যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এ ঘটনাটি ঘটেছিল হিজরাতের অব্যবহিত পরে। সে সময় একদিকে সাহাবীদের সামষ্টিক প্রশিক্ষণ ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে অন্যদিকে মক্কার কাফেররা তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি দ্বারা মদীনার অধিবাসীদের কঠোরভাবে অবরোধ করে রেখেছিল যার কারণে মদীনায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দুষ্প্রাপ্য হয়ে গিয়েছিল। হযরত হাসান বসরী বলেন, সেই সময় মদীনায় মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছিল, কিন্তু জিনিসপত্রের দাম ছিল আকাশ ছোয়া (ইবনে জারীর)। ঠিক এই পরিস্থিতিতে মদীনায় একটি বাণিজ্য কাফেলা এসে হাজির হলে নামাযরত লোকজন এই ভেবেআশঙ্কাবোধ করলো, আমরা নামায শেষ করতে করতে সব জিনিসপত্র বিক্রি না হয়ে যায়। এই ভয়ে তারা সেদিকে ছুটে গিয়েছিল। এটা ছিল এমন একটি ত্রুটি ও দুর্বলতা যা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব ও কঠোর পরিস্থিতির কারণে হঠাৎ করে সেই সময় দেখা দিয়েছিল। কিন্তু তার পরবর্তী সময়ে এসব সাহাবী ইসলামের জন্য যেসব কুরবানী ও ত্যাগ-তিতিক্ষা দেখিয়েছেন, তা যদি কেউ দেখে এবং ইবাদাত-বন্দেগী ও সামষ্টিক কাজ-কর্মে তাদের জীবন যে অতুলনীয় আল্লাহভীতির সাক্ষ্য দেয় তাও দেখে তাহলে সে একথা বলে তাদের ওপর দোষারোপ করার দুঃসাহস দেখাতে পারবে না যে, তাদের মধ্যে আখেরাতের চেয়ে দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দেয়া ব্যাধি ছিল। তবে তার নিজের হৃদয় মনে যদি সাহাবীদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষের ব্যাধি থেকে থাকে তাহলে ভিন্ন কথা।
এ ঘটনা সাহাবীদের (রা.) প্রতি কটাক্ষকারীদের যেমন সমর্থন করে না তেমনি সেসব লোকের ধ্যান-ধারণার প্রতিও সমর্থন জানায় না যারা সাহাবীদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধার আতিশয্যে দাবী করেন যে, তাদের দ্বারা কখনো কোন ভুল হয়নি, কিংবা হয়ে থাকলেও কখনো তা উল্লেখ করা উচিত নয়। কারণ তাঁদের ভুল-ত্রুটির উল্লেখ করা এবং তাকে ভুল-ত্রুটি বলা তাদের অপমান করার শামিল। এতে হৃদয় মনে তাদের প্রতি মর্যাদা ও শ্রদ্ধাবোধ অবশিষ্ট থাকে না। তাছাড়া তাদের ভুল-ত্রুটির উল্লেখ সেসব আয়াত ও হাদীসেরও পরিপন্থী যার মধ্যে স্পষ্ট ভাষায় সাহাবীদের ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়া আল্লাহর নিকট প্রিয় হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এসব কথা স্পষ্ট বাড়াবাড়ি। এর সমর্থনে কুরআন ও হাদীসে কোন দলীল নেই। এখানে যে কেউ দেখতে পারেন, বিপুল সংখ্যক সাহাবীর (রা.) একটি দল কর্তৃক যে ত্রুটি হয়েছিল আল্লাহ তা’আলা নিজে এখানে তাদের সেই ত্রুটির উল্লেখ করেছেন। এমন গ্রন্থে তা উল্লেখ করেছেন যা কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত উম্মাতকে পড়তে হবে। সেই গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে গ্রন্থে তাদের ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়া এবং আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়ার কথাও স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া হাদীস ও তাফসীরের সমস্ত গ্রন্থে সাহাবা কিরাম (রা.) থেকে পরবর্তীকালের আহলে সুন্নাত ওয়া জামায়াতের বড় বড় মনীষীগণ পর্যন্ত তাদের এই ত্রুটি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। এর অর্থ কি এই যে, আল্লাহ তায়ালা মানুষের মন থেকে ঐ সব সাহাবীর প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে ঐ ত্রুটির উল্লেখ করেছেন যা তিনি নিজেই মানুষের মনে কায়েম করতে চান? অথবা এর অর্থ কি এই যে, এসব অন্ধ ও গোঁড়া ভক্তগণ শরীয়াতের যে মাসয়ালাটি বলে থাকেন সাহাবায়ে কিরাম (রা.), তাবেয়ীগণ, মুহাদ্দিসগণ এবং মুফাসসিরগণের সে মাসায়ালাটি জানা থাকার কারণে এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ তারা উল্লেখ করেছেন? আর যারা সূরা জুম’আ পড়েন এবং তার তাফসীর অধ্যয়ন করেন তাদের মন থেকে কি সত্যি সত্যিই সাহাবা কিরামের (রা.) প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা উধাও হয়ে গেছে? এ সব প্রশ্নের জবাব যদি নেতিবাচক হয়, আর নেতিবাচক তো অবশ্যই হবে তাহলে সাবাহায়ে কিরামের (রা.) মর্যাদার নামে কিছু লোক যেসব অনর্থক এবং বাড়াবাড়ি অতিরঞ্জিত ও অতিশয়োক্তিমূলক কথাবার্তা বলে থাকেন তা অবশ্যই ভ্রান্ত।
প্রকৃতপক্ষে সাহাবায়ে কিরাম কোন আসমানী মাখলুক ছিলেন না। বরং এই পৃথিবীতে জন্মলাভকারী মানুষ ছিলেন। তারা যা কিছু হয়েছিলেন তা হয়েছিলেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষার গুণে। তাদের এ শিক্ষা দেয়া হয়েছিল ক্রমান্বয়ে বছরের পর বছর ধরে। কুরআন ও হাদীসে আমরা এ শিক্ষার যে নিয়ম-পদ্ধতি দেখতে পাই, তা হচ্ছে যখনই তাদের মধ্যে কোন দুর্বলতা দেখা দিয়েছে আল্লাহ ও আল্লাহর রসূল যথাসময়ে সেদিকে মনোনিবেশ করেছেন এবং দুর্বলতার সেই বিশেষ ক্ষেত্রে অনতিবিলম্বে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণদানের একটি কর্মসূচী শুরু করা হয়েছে। জুম’আর নামাযের এই ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাই যে, বাণিজ্য কাফেলা সংক্রান্ত ঘটনাটি ঘটলে আল্লাহ তা’আলা সূরা জুম’আর এ রুকূ’র আয়াতসমূহ নাযিল করে এ বিষয়ে সতর্ক করলেন এবং জুম’আর নামাযের নিয়ম-কানুন ও আদব-কায়দা অবহিত করলেন। তাছাড়া রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুম’আর অনেকগুলো খোতবায় লোকজনের মনে জুম’আ ফরয হওয়ার গুরুত্ব বদ্ধমূল করে দিলেন এবং বিস্তারিতভাবে তাদেরকে জুম’আর নিয়ম-কানুন ও আদব-কায়দা শিক্ষা দিলেন। আমরা বিভিন্ন হাদীস থেকে এসব হিদায়াত ও নির্দেশনা স্পষ্টভাবে পেয়ে থাকি। আমরা এ বিষয়ে ১৫ নং টীকায় উল্লেখ করেছি। হযরত আবু সাঈদ খুদরী বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ জুম’আর দিন প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য গোসল করা, দাঁত পরিষ্কার করা, যে উত্তম পোশাক তার আছে তা পরিধান করা এবং যদি সম্ভব হয় সুগন্ধি ব্যবহার করা। (মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী) হযরত সালমান ফারসী বলেন, নবী (সা.) বলেছেনঃ যে মুসলমান জুম’আর দিনে গোসল করবে এবং সাধ্যমত নিজেকে বেশী করে পাক পবিত্র ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করবে, মাথায় তেল দেবে, ঘরে যে খোশবুই থাক না কেন ব্যবহার করবে, তারপর মসজিদে যাবে এবং দুই জন মানুষকে সরিয়ে দিয়ে তাদের মাঝে বসবে না, তারপর আল্লাহর দেয়া সমর্থ অনুসারে নামায (নফল) পড়বে এবং ইমাম যখন খোতবা দিবেন তখন চুপ থাকবে, এক জুম’আর থেকে পরবর্তী জুম’আ পর্যন্ত তার কৃত অপরাধসমূহ মাফ হয়ে যায়। (বুখারী, মুসনাদে আহমাদ)। হযরত আবু আইয়ূব আনসারী (রা.), হযরত আবু হুরাইরা (রা.) এবং হযরত নুবাইশাতুল হুযালী (রা.) ও তাদের বর্ণনায় নবী (সা.) থেকে প্রায় অনুরূপ বিষয়বস্তু বর্ণনা করেছেন (মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, তাবারানী)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সা.) বলেছেনঃ ইমাম যখন খোতবা দেন, তখন যে ব্যক্তি কথা বলে সে গাধার মত যার পিঠে বই পুস্তকের বোঝা চাপানো আছে। আর যে ব্যক্তি তাকে বলেঃ চুপ কর তারও কোন জুম’আ হয়নি (মুসনাদে আহমাদ) হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত। নবী (সা.) বলেছেনঃ জুম’আর দিন খোতবার সময় যে ব্যক্তি কথা বলে তাকে যদি তোমরা বলো, “চুপ করো” তাহলে তোমরাও অর্থহীন কাজ করলে (বুখারী মুসলিম, নাসায়ী, তিরমিযী, আবু দাউদ)। ইমাম আহমাদ, আবু দাউদ ও তাবারানী হযরত আলী (রা.) ও হযরত আবদু দারদা (রা.) থেকে প্রায় অনুরূপ কিছু সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন। সেই সাথে নবী (সা.) খতীবদেরকেও দীর্ঘ খোতবা দিয়ে মানুষকে বিরক্ত ও অতিষ্ট না করতে উপদেশ দিয়েছেন। তিনি নিজে জুম’আর দিন সংক্ষিপ্ত খোতবা দিতেন এবং নামাযও খুব দীর্ঘ করে পড়াতেন না। হযরত জাবের (রা.) ইবনে সামুরা বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সা.) খোতবা দীর্ঘায়িত করতেন না। তাঁর খোতবা হতো কয়েকটি সংক্ষিপ্ত কথার সমষ্টি (আবু দাউদ)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফ বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খোতবা নামাযের তুলনায় সংক্ষিপ্ত হতো এবং নামায খোতবার চেয়ে দীর্ঘ হতো (নাসায়ী)। হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির বর্ণনা করেনঃ নবী (সা.) বলেছেনঃ কোন ব্যক্তি নামায দীর্ঘ হওয়া এবং খোতবা সংক্ষিপ্ত হওয়া প্রমাণ করে সে দ্বীনের ব্যাপারে জ্ঞানের অধিকারী (মুসনাদে আহমাদ, মুসলিম)। বাযযার আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে প্রায় অনুরূপ বিষয়বস্তু সম্বলিত হাদীস বর্ণনা করেছেন। নবী (সা.) লোকজনকে কিভাবে জুম’আর নামাযের নিয়ম-কানুন ও আদব-কায়দা শিখাতেন এসব হাদীসের ভাষ্য থেকে তা অনুমান করা যায়। এভাবে এ নামাযের এমন একটি মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যার নজীর পৃথিবীর কোন জাতির সামষ্টিক ইবাদতে দেখা যায় না।