একদল ফিকাহবিদের মতে, সে বাসস্থান ও খোরপোষ উভয়টিই লাভের অধিকারিনী। এ মত পোষণ করেছেন হযরত উমর (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ), হযরত আলী ইবনে হুসাইন (ইমাম যায়নুল আবেদ্বীন), কাজী শুরাইহ এবং ইবরাহীম নাখয়ী। হানাফী মাযহাবের আলেমগণ এ মতটি গ্রহণ করেছেন। ইমাম সুফিয়ান সওরী এবং হাসান ইবনে সালেহ-এর মাযহাবও এটিই। দারু কুতনীর একটি হাদীসে এ মতের সমর্থন পাওয়া যায়।
হাদীসটিতে হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণনা করেন যে, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ الْمُطَلَّقَةُ ثَلَاثًا لَهَا السُّكْنَى وَالنَّفَقَةُ “তিন তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীলোক ইদ্দতকালে বাসস্থান ও খোরপোষ লাভের অধিকারিনী।” এ মতের পক্ষে আরো সমর্থন পাওয়া যায় সেসব হাদীস থেকে যাতে বলা হয়েছে, হযরত ফাতেমা বিনতে কায়েসের হাদীসকে হযরত উমর (রাঃ) এই বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যে, একজন মাত্র নারীর কথার ওপর নির্ভর করে আমি আমার রবের কিতাব ও আমার নবীর সুন্নাত পরিত্যাগ করতে পারি না। এ থেকে জানা যায়, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ সুন্নাতটি হযরত উমরের অবশ্যই জানা ছিল যে, এরূপ স্ত্রীলোকের বাসস্থান ও খোরপোষ লাভের অধিকার আছে। বরং ইবরাহীম রাখয়ীর একটি বর্ণনায় এ কথাও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, হযরত উমর (রাঃ), ফাতেমা বিনতে কায়েসের হাদীসটি প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেনঃ
سَمِعْتُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ لَهَا السُّكْنَى وَالنَّفَقَةُ
“আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, এরূপ স্ত্রীলোক বাসস্থান ও খোরপোষ উভয়টি লাভ করার অধিকারিনী।”
ইমাম আবু বকর জাসসাস তাঁর আহকামুল কুরআন গ্রন্থে এ মাসয়ালা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এ মতের পক্ষে প্রথম প্রমাণ পেশ করেছেন এই যে, আল্লাহ তা’আলা সরাসরি কেবল এতটুকু বলেছেনঃ طَلِّقُوهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ “তাদেরকে তাদের ইদ্দতের জন্য তালাক দাও।” আল্লাহ তা’আলার এই নির্দেশ সেই ব্যক্তির জন্যও তো প্রযোজ্য যে প্রথমে দুই তালাক দিয়ে তারপর ‘রুজু’ করেছে এবং এখন তার কেবল এক তালাক দেয়ার অধিকার আছে। তাঁর দ্বিতীয় প্রমাণ হচ্ছে, রসূলুল্লাহ ﷺ যখন তালাক দেয়ার এ পদ্ধতি বলে দিয়েছেন যে, যে তুহুরে সহবাস করা হয়নি হয় সেই তুহুরে তালাক দেবে, অথবা এমন অবস্থায় তালাক দেবে যখন নারীর গর্ভবতী হওয়ার বিষয় প্রকাশ হয়ে গিয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি প্রথম, দ্বিতীয় এবং শেষ তালাকের মধ্যে কোন পার্থক্য করেননি। অতএব, আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ তোমরা যেখানে থাকো তাদেরকেও সেখানেই রাখো সর্ব প্রকার তালাকের সাথেই সম্পর্কিত বলে ধরে নেয়া হবে। তিনি তৃতীয় যে দলিলটি পেশ করেন তা হচ্ছে, তালাকপ্রাপ্তা গর্ভবতী মহিলা সে রিজয়ী তালাকপ্রাপ্তা হোক বা চূড়ান্ত বিচ্ছেদকারী তালাকপ্রাপ্তা হোক, তাকে বাসস্থান ও খোরপোষ দেয়া স্বামীর জন্য ওয়াজিব। রিজয়ী তালাকপ্রাপ্তা অগর্ভবতী নারীকেও এ দু’টি দেয়া স্বামীর জন্য ওয়াজিব। এ থেকে বুঝা যায় যে, বাসস্থান ও খোরপোষ দেয়া গর্ভবতী হওয়ার কারণে ওয়াজিব নয়, বরং তা এ কারণে ওয়াজিব যে, এ দুই শ্রেণীর তালাকপ্রাপ্তা শরয়ী বিধান অনুসারেই স্বামীর বাড়ি থাকতে বাধ্য। এখন অগর্ভবতী তিন তালাকপ্রাপ্তা নারীর ক্ষেত্রেও যদি এ নির্দেশ হয়ে থাকে তাহলে তার বাসস্থান ও খোরপোষ দেয়া স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য না হওয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না।
অপর একদল ফিকাহবিদের মতে, তিন তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর ইদ্দতকালে বাসস্থান পাওয়ার অধিকার অবশ্যই আছে কিন্তু খোরপোষ পাওয়ার অধিকার নেই। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব, সুলায়মান ইবনে ইয়াসার, আতা, শা’বী আওযায়ী, লাইস এবং আবু উবাইদ রহিমাহুমুল্লাহ এ মত পোষণ করেছেন। আর ইমাম মালেকও এ মতটি গ্রহণ করেছেন। কিন্তু ইমাম শাফেয়ী যে এ মত থেকে ভিন্ন মত পোষণ করতেন মুগনিউল মুহতাজ গ্রন্থে তা বর্ণিত হয়েছে। এ বিষয়ে পরে আলোচনা করা হবে।
তৃতীয় আরেকটি দলের মতে, তিন তালাকপ্রাপ্তা নারীর ইদ্দত চলাকালে বাসস্থান ও খোরপোষ কোনটা লাভের অধিকার নাই। এ মত হাসান বাসরী, হাম্মাদ ইবনে আবী লায়লা, আমর ইবনে দীনার, তাউস, ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ এবং আবু সাওরের। ইবনে জারীরের বর্ণনা মতে হযরত ইবনে আব্বাসও এ মত পোষণ করতেন। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল এবং ইমামিয়াগণও এমত গ্রহণ করেছেন। মুগনিউল মুহতাজ গ্রন্থে শাফেয়ী মাযহাবের এ মত বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে,
تَجِبُ سَكْنَى لِمُعْتَدَّةِ طَلَاقٍ حَئِلٍ اَوْحَامِلٍ وَلَا بَائِنٍ.................. وَالْحَائِلُ الْبَائِنُ لَا نَفَقَةَ لَهَا وَلَاكِسْوَةً- “যে নারী তালাকের কারণে ইদ্দত পালন করছে সে গর্ভবতী হোক বা না হোক তার বাসস্থান লাভের অধিকার আছে এবং তা দেয়া ওয়াজিব……… তবে বায়েন তালাকপ্রাপ্তা অগর্ভবতী নারীর বাসস্থান ও কাপড় চোপড় কোন কিছুই পাওয়ার অধিকার নাই।”
এ মতের স্বপক্ষে একদিকে কুরআনের আয়াত لَا تَدْرِي لَعَلَّ اللَّهَ يُحْدِثُ بَعْدَ ذَلِكَ أَمْرًا “তুমি জান না, এরপরে আল্লাহ তা’আলা হয়তো সমঝোতা ও বুঝাপড়ার কোন উপায় সৃষ্টি করে দেবেন।” এ থেকে তারা যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেন তা হচ্ছে, এ কথা রিজয়ী তালাকপ্রাপ্তা নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে, তিন তালাকপ্রাপ্তাদের ক্ষেত্রে নয়। তাই তালাকপ্রাপ্তা নারীকে বাড়িতে রাখার আদেশও রিজয়ী তালাকপ্রাপ্তাদের জন্যই নির্দিষ্ট। তাদের দ্বিতীয় প্রমাণ হচ্ছে, হাদীস গ্রন্থসমূহে বিপুল সংখ্যক সহীহ সনদে বর্ণিত ফাতেমা বিনতে কায়েসের হাদীস।
এই ফাতেমা (রাঃ) বিনতে কায়েস আল ফিহরিয়া ছিলেন প্রথম পর্যায়ে হিজরাতকারী মহিলাদের একজন। তাঁকে অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মহিলা বলে মনে করা হতো। হযরত উমরের (রাঃ) শাহাদাতের পর তাঁর বাড়িতেই মজলিসে শুরার অধিবেশন হয়েছিল। প্রথমে তিনি আবু আমর ইবনে হাফস ইবনুল মুগীরাতুল মাখযূমীর স্ত্রী ছিলেন। তাঁর স্বামী তাঁকে তিন তালাক দিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটালে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম তাঁকে হযরত উসামা ইবনে যায়েদের সাথে বিয়ে দেন। তার ঘটনা হলো, তাঁর স্বামী আবু আমর তাঁকে প্রথমে দুই তালাক দিয়েছিলেন। পরে হযরত আলীর সাথে যখন তাকে ইয়ামানে পাঠানো হলো, তখন তিনি সেখান থেকে অবশিষ্ট তৃতীয় তালাকটিও দিয়ে দেন। কোন কোন রেওয়ায়াতে উল্লেখিত হয়েছে যে, আবু আমর নিজেই তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের পত্র মারফত জানিয়ে দিয়ে ছিলেন যে, ইদ্দত পালনকালে তারা যেন তাঁকে বাড়িতেই রাখে এবং তার ব্যয়ভার বহন করে। কোন কোন রেওয়ায়াতে উল্লেখিত আছে যে, তিনি নিজেই খোরপোষ ও বাসস্থানের দাবী করেছিলেন। তবে ঘটনা যাই ঘটে থাকুক না কেন, স্বামীর আত্মীয়-স্বজন তাঁর অধিকার স্বীকার করলেন না। এরপর তিনি দাবী নিয়ে নবীর ﷺ কাছে গেলেন। নবী ﷺ এই বলে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন যে, তুমি খোরপোষ ও বাসস্থান কিছুই পাওয়ার অধিকারী নও। একটি রেওয়ায়াতে আছে যে, নবী ﷺ বলেছিলেনঃ
إِنَّمَا النَّفَقَةُ وَالسُّكْنَى لِلْمَرْأَةِ عَلَى زَوْجِهَا مَا كَانَتْ لَهُ عَلَيْهَا رَجْعَةٌ فَإِذَا لَمْ يَكُنْ لَهُ عَلَيْهَا رَجْعَةٌ فَلاَ نَفَقَةَ وَلاَ سُكْنَى-
“স্বামীর ওপর স্ত্রীর খোরপোষ ও বাসস্থান পাওয়ার অধিকার থাকে তখন যখন স্বামীর রুজু করার অধিকার থাকে। কিন্তু যখন রুজু করার অধিকার থাকে না তখন খোরপোষ ও বাসস্থান লাভের অধিকারও থাকে না।” (মুসনাদে আহমাদ)
তাবারানী এবং নাসায়ীও প্রায় অনুরূপ রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন। উক্ত রেওয়ায়াতের শেষ দিকের ভাষা হলো,
فَاِذَا كَانَتْ لَاتُحِلُّ لَهُ حَتَّى تَنْكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ فَلَا نَفْقَةَ وَلَا سُكْنَى
“কিন্তু যেক্ষেত্রে সে অন্য কোন পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আগে আর পূর্ব স্বামীর জন্য হালাল হচ্ছে না সেক্ষেত্রে তার খোরপোষ ও বাসস্থানের কোন অধিকার নাই।”
এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পর নবী ﷺ প্রথমে তাকে উম্মে শারীকের গৃহে থাকার নির্দেশ দেন কিন্তু পরে তাঁকে বলেন, তুমি ইবনে উম্মে মাকতূমের গৃহে অবস্থান করো।
কিন্তু যারা এ হাদীস গ্রহণ করেননি তাদের যুক্তি হলোঃ
প্রথমত, তাঁকে স্বামীর আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি ছাড়তে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল এজন্য যে, তিনি ছিলেন অত্যন্ত কর্কশ ভাষী। স্বামীর আত্মীয়-স্বজন তাঁর বদ মেজাজের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব বলেনঃ ঐ মহিলা তাঁর হাদীস বর্ণনা করে মানুষকে ফিতনার মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে তিনি ছিলেন খুব মুখড়া। তাই তাঁকে ইবনে মাকতূমের গৃহে রাখা হয়েছিল (আবু দাউদ)। আরেকটি রেওয়ায়াতে সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েবের এ উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে যে, তিনি তাঁর স্বামীর আত্মীয়-স্বজনদের কটু কথা বলেছিলেন। তাই তাঁকে বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল (জাসসাস)। সুলায়মান ইবনে ইয়াসার বলেন, “প্রকৃতপক্ষে বদ মেজাজীর কারণে তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলেন” (আবু দাউদ)।
দ্বিতীয়ত, হযরত উমর (রাঃ) এমন এক যুগে তাঁর বর্ণিত হাদীস প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যখন বহু সংখ্যক সাহাবী বেঁচে ছিলেন এবং এ বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়া এবং যাঁচাই বাছাই করা পুরোপুরি সম্ভবপর ছিল। ইবরাহীম নাখায়ী বলেনঃ হযরত উমর (রাঃ) যখন ফাতেমার (রাঃ) এই হাদীস শুনলেন তখন বললেন,
لَسْنَا بِتَارِكِي آيَةٍ فى كِتَابِ اللهِ وَقَوْلَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِقَوْلِ امْرَأَةٍ , لَعَلَّهَا أُوهِمَتْ , سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ لَهَا السُّكْنَى وَالنَّفَقَةُ-
“এমন একজন নারীর কথা অনুসারে আমরা আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াত এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী পরিত্যাগ করতে পারি না, যার হয়তো ভুল ধারণা হয়েছে--- আমি নিজে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিন তালাকপ্রাপ্তা নারীর বাসস্থান ও খোরপোষ উভয়টি লাভের অধিকার আছে” (জাসসাস)। আবু ইসহাক বলেন, আমি কুফার মসজিদে আসওয়াদ ইবনে ইয়াযীদের পাশে বসে ছিলাম। সেখানে শা’বী ফাতেমা বিনতে কায়েসের হাদীস উল্লেখ করলে হযরত আসওয়াদ পাথরের টুকরো তুলে শা’বীর প্রতি ছুঁড়ে মেরে বললেন, হযরত উমরের সময়ে যখন ফাতেমার বর্ণিত এ হাদীস পেশ করা হয়েছিল তখন তিনি বলেছিলেনঃ একজন নারীর কথায় আমরা আল্লাহর কিতাব এবং নবীর সুন্নাতকে পরিত্যাগ করতে পারি না। আমরা জানি না সে সঠিকভাবে মনে রাখতে পেরেছে না ভুলে গিয়েছে। সে খোরপোষ ও বাসগৃহ লাভ করবে। আল্লাহ তা’আলা আদেশ দিয়েছেনঃ لَا تُخْرِجُوهُنَّ مِنْ بُيُوتِهِنَّ মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী এবং নাসায়ীতে শাব্দিক তারতম্যসহ এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।
তৃতীয়ত, মারওয়ানের শাসন আমলে তিন তালাকপ্রাপ্তা নারী সম্পর্কে এক বিতর্কের সুত্রপাত হলে হযরত আয়েশা (রাঃ), ফাতেমা বিনতে কায়েসের বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন। কাসেম ইবনে মুহাম্মাদ বলেনঃ আমি হযরত আয়েশাকে (রাঃ) জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি ফাতেমার কাহিনী জানেন না? তিনি জবাব দিলেনঃ ফাতেমার বর্ণিত হাদীসের কথা না বলাই ভাল (বুখারী)। বুখারী অপর যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাতে হযরত আয়েশার (রাঃ) বক্তব্যের ভাষা হলো, ফাতেমার কি হয়েছে, সে কি আল্লাহকে ভয় করে না? তৃতীয় একটি হাদীসে হযরত উরওয়া ইবনে যুবায়ের বলেন যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেনঃ এ হাদীস বর্ণনা করার মধ্যে ফাতেমার কোন কল্যাণ নেই। অপর এক বর্ণনায় হযরত উরওয়া বলেন, হযরত আয়েশা (রাঃ) ফাতেমার প্রতি তাঁর চরম অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন এবং বলেনঃ “প্রকৃতপক্ষে সে একটি নির্জন গৃহে অবস্থান করছিল যেখানে তার কোন প্রিয়জন বা বান্ধবী ছিল না। সুতরাং তার নিরাপত্তা ও প্রশান্তির জন্য নবী ﷺ তাকে গৃহ পরিবর্তনের আদেশ দিয়েছিলেন।”
চতুর্থত, পরে উসামা ইবনে যায়েদের সাথে ঐ মহিলার বিয়ে হয়েছিল। উসামার ছেলে মুহাম্মাদ বলেন, ফাতেমা যখনই এ হাদীস বলতেন তখনই আমার পিতা হাতের কাছে যা পেতেন তাই তার প্রতি নিক্ষেপ করতেন (জাস্সাস)। এ কথা স্পষ্ট যে, হযরত উসামার জানা মতে, তা রসূলের সুন্নাতের পরিপন্থী না হলে এ হাদীসটি বর্ণনা করার জন্য তিনি এতটা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে পারতেন না।
একঃ হযরত আলী (রাঃ) এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রাঃ) মতে, স্বামীর পরিত্যক্ত মোট সম্পদের ওপর থেকে তাকে খোরপোষ দেয়া ওয়াজিব। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ), কাজী শুরাইহ, আবুল আলীয়া, শা’বী এবং ইবরাহীম নাখায়ী থেকেও মতটি বর্ণিত হয়েছে এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রাঃ) একটি মত এ মতের সমর্থন করে (আলুসী, জাস্সাস)।
দুইঃ ইবনে জারীর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রাঃ) দ্বিতীয় যে মতটি বর্ণনা করেছেন তা হচ্ছে, মৃত ব্যক্তি যদি কোন সম্পদ রেখে গিয়ে থাকে তাহলে সেই সম্পদে তার গর্ভস্থ সন্তানের অংশ থেকে তার জন্য ব্যয় করতে হবে। কিন্তু মৃত ব্যক্তি কোন সম্পদ না রেখে গিয়ে থাকলে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদেরকে তার জন্য খরচ করা কর্তব্য। কারণ, আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ
وَعَلَى الْوَارِثِ مِثْلُ ذَلِكَ (البقرة : 233) ( সূরা বাকারা, আয়াত ২৩৩)
তিনঃ হযরত জাবের (রাঃ) ইবনে আবদুল্লাহ, হযরত আবদুল্লাহ ইবনুয যুবায়ের (রাঃ), হযরত হাসান বাসরী, হযরত সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব এবং হযরত আতা ইবনে আবী রাবাহর মতে, মৃত স্বামীর সম্পদে তার খোরপোষ লাভের কোন অধিকার নেই। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তৃতীয় মতটিও এ মতটিরই অনুরূপ (জাস্সাস)। এর অর্থ, স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পদে উত্তরাধিকারী হিসেবে সে যে অংশ লাভ করেছে তা থেকে সে নিজের ব্যয় নির্বাহ করতে পারে। কিন্তু স্বামীর রেখে যাওয়া মোট সম্পদের ওপর তার খোরপোষের দায়িত্ব বর্তায় না। কারণ, তাতে সমস্ত উত্তরাধিকারীকেই সে বোঝা বহন করতে হয়।
চারঃ ইবনে আবী লায়লার মতে, মৃত স্বামীর সম্পদ থেকে তার খোরপোষ দেয়া ঠিক তেমনি ওয়াজিব, যেমন কোন ঋণদাতার ঋণ পরিশোধ করা ওয়াজিব (জাস্সাস)। অর্থাৎ পরিত্যাক্ত মোট সম্পদ থেকে যেভাবে ঋণ পরিশোধ করা হয় সেভাবে তাকে খোরপোষও দিতে হবে।
পাঁচঃ ইমাম আবু হানীফা (রঃ), ইমাম আবু ইউসূফ (রঃ), ইমাম মুহাম্মাদ (রঃ) ও ইমাম যুফারের মতে, মৃত স্বামীর সম্পদ থেকে তার বাসস্থান বা খোরপোষ কোনটাই পাওয়ার অধিকার নেই। কারণ, মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির কোন মালিকানা স্বত্ব থাকে না। মৃত্যুর পর তা ওয়ারিশদের সম্পদ। তাই তাদের সম্পদে মৃত ব্যক্তির গর্ভবতী বিধবার খোরপোষ কি করে ওয়াজিব হতে পারে (হিদায়া, জাস্সাস)। ইমাম আহমাদ (র) ইবনে হাম্বলও এ মত পোষণ করেন (আল-ইনসাফ)।
ছয়ঃ ইমাম শাফেয়ীর (রঃ) মতে, সে খোরপোষ পেতে পারে না, তবে বাসস্থান পাওয়ার অধিকারী (মুগনিউল মুহতাজ)। তাঁর দলীল হচ্ছে, হযরত আবু সাঈদ খুদরীর (রাঃ) বোন ফুরাইবার স্বামীকে হত্যা করা হলে রসূলুল্লাহ ﷺ তাকে তার স্বামীর বাড়িতেই ইদ্দতকাল কাটানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। (আবু দাউদ, নাসায়ী, তিরমিযী)। তাছাড়া দারু কুতনীর একটি হাদীস থেকেও তিনি প্রমাণ দিয়েছেন। উক্ত হাদীসে রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
ليس للحامل المتو فى عنها زوجها نفقة –
“গর্ভবতী বিধবার জন্য কোন খোরপোষ নেই।” ইমাম মালেকও (রঃ) এ মত পোষণ করেছেন (হাশিয়াতুদ দুসুকী)।
এ বিষয়ে ফিকাহবিদদের মতামত নীচে বর্ণনা করা হলোঃ
দাহ্হাকের মতে, শিশুকে দুধদানের সর্বাধিক অধিকার মায়ের। কিন্তু দুধ পান করানো এবং না করানোর ব্যাপারে তার ইখতিয়ার আছে। তবে শিশু যদি অন্য কোন মহিলার স্তন গ্রহণ না করে তাহলে তাকে দুধ পান করানোর জন্য মাকে বাধ্য করা হবে। কাতাদা, ইবরাহীম নাখায়ী এবং সুফিয়ান সাওরীর মত প্রায় অনুরূপ। ইবরাহীম নাখায়ী এ কথাও বলেন যে, দুধ পান করানোর জন্য মাকে বাধ্য করা হবে। (ইবনে জারীর)
হিদায়া গ্রন্থে বলা হয়েছে, পিতা-মাতার বিচ্ছেদের সময় যদি দুগ্ধপোষ্য শিশু সন্তান থাকে তাহলে তাকে দুধ পান করানো মায়ের জন্য ফরয নয়। তবে যদি দুগ্ধদাত্রী অন্য কোন মহিলাকে পাওয়া না যায় তাহলে তাকে দুগ্ধদানে বাধ্য করা হবে। আর পিতা যদি বলে, শিশুর মাকে বিনিময় দিয়ে দুধ পান করানোর পরিবর্তে অন্য কোন মহিলাকে বিনিময় দিয়ে এ কাজ করাবো, অথচ শিশুর মা উক্ত মহিলার দাবীকৃত অর্থের সমপরিমাণ অর্থই দাবী করছে কিংবা বিনামূল্যে এ কাজ করতে সম্মত হচ্ছে তাহলে এক্ষেত্রে তার অধিকারই অগ্রগণ্য হবে। আর শিশুর মা যদি অধিক বিনিময় দাবী করে তাহলে পিতাকে সেজন্য বাধ্য করা যাবে না।