সূরার এ অংশটি অনুধাবন করার ব্যাপারে আরো একটি বড় ধরনের ভুল হয়ে থাকে। বিভিন্ন দুর্বল হাদীসের বর্ণনা এ ভুলের ভিতকে আরো শক্তিশালী করে দিয়েছে। শুরুতে একটি মাত্র প্রাণ থেকে মানব জাতির জন্মের সূচনা হবার কথা বলা হয়েছে। এ প্রথম মানব প্রাণটি হচ্ছে হযরত আদম আলাইহিস সালাম। তারপর তার সাথে সাথেই একটি পুরুষ ও একটি নারীর কথা বলা হয়েছে। তারা প্রথমে সুস্থ ও পূর্ণাবয়ব সম্পন্ন শিশুর জন্মের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করে। তারপর যখন শিশু ভূমিষ্ঠ হয়, তখন তারা আল্লাহর দানের সাথে অন্যদেরকেও শরীক করে নেয়। এ বর্ণনাভঙ্গীর কারণে একদল লোক মনে করে নিয়েছে যে, আল্লাহর সাথে শরীককারী এ স্বামী-স্ত্রী নিশ্চয়ই হযরত আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস সালামই হবেন। মজার ব্যাপার এই যে, এ ভুল ধারণার সাথে আবার কিছু দুর্বল হাদীসের মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গল্প রচনা করা হয়েছে। গল্পটি এ রকম যে, হযরত হাওয়ার ছেলে-মেয়ে পয়দা হবার পর মরে যেতো। অবশেষে এক সন্তান জন্মের পর শয়তানের প্ররোচনায় তিনি তার নাম আবদুল হারেস (শয়তানের বান্দা) রাখতে উদ্বুদ্ধ হন। সবচেয়ে মারাত্বক ও সর্বনাশা ব্যাপার হচ্ছে এই যে, এ হাদীসগুলোর মধ্য থেকে কোন কোনটির সনদ খোদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্তও পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু মূলত এ জাতীয় সমস্ত হাদীসই ভুল। কুরআনের বক্তব্যও এর সমর্থন করে না। কুরআন কেবল এতটুকুই বলছেঃ মানব জাতির যে প্রথম দম্পত্তির মাধ্যমে পৃথিবীতে মানব বংশের সূচনা হয়েছিল, তার স্রষ্টাও ছিলেন আল্লাহ, অন্য কেউ নয়। তাই সৃষ্টিকর্মে কেউ তার সাহায্যকারী ছিল না। তারপর প্রত্যেকটি পুরুষ ও নারীর মিলনে যে শিশু জন্ম নেয়, তার স্রষ্টাও সেই একই আল্লাহ, যার সাথে কৃত অঙ্গীকারের ছাপ তোমাদের সবার হৃদয়ে সংরক্ষিত আছে। তাই এ অঙ্গীকারের কারণে তোমরা আশা-নিরাশার দোলায় আন্দোলিত হয়ে যখন দোয়া করো, তখন সেই আল্লাহর কাছেই দোয়া করে থাকো। কিন্তু পরে আশা পূর্ণ হয়ে গেলে তোমাদের মাথায় আবার শিরকের উদ্ভব হয়। এ আয়াতে কোন বিশেষ পুরুষ ও বিশেষ নারীর কথা বলা হয়নি বরং মুশরিকদের প্রত্যেকটি পুরুষ ও নারীর অবস্থা এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আর একটি কথাও প্রণিধানযোগ্য। এসব আয়াতে আল্লাহ যাদের নিন্দাবাদ করেছেন তারা ছিল আরবের মুশরিক সম্প্রদায়। তাদের অপরাধ ছিল, তারা সুস্থ, সবল ও পূর্ণাবয়ব সম্পন্ন সন্তান জন্মের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতো কিন্তু সন্তানের জন্মের পর আল্লাহর এ দানে অন্যদেরকে অংশীদার করতো। নিঃসন্দেহে তাদের এ অবস্থা ছিল অত্যন্ত খারাপ। কিন্তু বর্তমানে তাওহীদের দাবীদারদের মধ্যে আমরা যে শিরকের চেহারা দেখছি তা তার চাইতেও খারাপ। এ তাওহীদের তথাকথিত দাবীদাররা সন্তানও চায় আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদের কাছে। গর্ভসঞ্চারের পর আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদের নামে মানত মানে এবং সন্তান জন্মের পর তাদেরই আস্তানায় যেয়ে নজরানা নিবেদন করে। এরপরও জাহেলী যুগের আরবরাই কেবল মুশরিক, আর এরা নাকি পাক্কা তাওহীদবাদী! তাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত ছিল আর এদের জন্য রয়েছে নাজাতের গ্যারান্টি। তাদের গোমরাহীর কঠোর সমালোচনা ও নিন্দা করা হয়, কিন্তু এদের গোমরাহীর সমালোচনা করলে ধর্মীয় নেতাদের দরবারে বিরাট অস্থিরতা দেখা দেয়। কবি আলতাফ হোসাইন হালী তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘মুসাদ্দাস’-এ এ অবস্থারই চিত্র এঁকেছেনঃ
-------------------------------------
“অন্যে করে মূর্তি পূজা
সে হয় কাফের সন্দেহ নেই
অন্যে বানায় খোদার পুত্র
সে হয় কাফের সন্দেহ নেই
অগ্নিতে যে নোয়ায় মাথা
সে হয় কাফের সন্দেহ নেই
তারার শক্তি মানলে তুমি
কাফের হবে সন্দেহ নেই,
কিন্তু মু’মিন তারা তাই প্রশস্ত এসব পথই তাদের জন্য
করুক পূজা ইচ্ছা যাকে অনেক খোদার ভিন্ন ভিন্ন!
নবীকে বসাও যদি আল্লাহর আসনে
ইমামকে বসাও যদি নবীজির সামনে
পীরের মাজারে চাও সিন্নী চড়াও
শহীদের কবরে গিয়ে দোয়া যদি চাও
তবুও তাওহীদের গায়ে লাগে না আঁচড়
ঈমান অটুট থাকে ইসলাম অনঢ়।"