إِنَّ رَبَّكُمُ ٱللَّهُ ٱلَّذِى خَلَقَ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضَ فِى سِتَّةِ أَيَّامٍۢ ثُمَّ ٱسْتَوَىٰ عَلَى ٱلْعَرْشِ يُغْشِى ٱلَّيْلَ ٱلنَّهَارَ يَطْلُبُهُۥ حَثِيثًۭا وَٱلشَّمْسَ وَٱلْقَمَرَ وَٱلنُّجُومَ مُسَخَّرَٰتٍۭ بِأَمْرِهِۦٓ ۗ أَلَا لَهُ ٱلْخَلْقُ وَٱلْأَمْرُ ۗ تَبَارَكَ ٱللَّهُ رَبُّ ٱلْعَـٰلَمِينَ
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই তোমাদের রব, যিনি আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। ৪০ তারপর তিনি নিজের কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন হন। ৪১ তিনি রাত দিয়ে দিনকে ঢেকে দেন তারপর রাতের পেছনে দিন দৌড়িয়ে চলে আসে। তিনি সূর্য, চন্দ্র ও তারকা রাজী সৃষ্টি করেন। সবাই তাঁর নির্দেশের আনুগত। জেনে রাখো, সৃষ্টি তারই এবং নির্দেশও তাঁরই। ৪২ আল্লাহ বড়ই বরকতের অধিকারী। ৪৩ তিনি সমগ্র বিশ্বজাহানের মালিক ও প্রতিপালক।
৪০
এখানে দিন শব্দটি প্রচলিত ২৪ ঘণ্টার দিন অর্থে অথবা যুগ বা কাল (PERIOD) অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে। শেষোক্ত অর্থে কুরআনে একাধিক ব্যবহার লক্ষণীয়। যেমন সুরা হজ্জের ৬ রুকূ’তে আয়াত ৪৭ এ বলা হয়েছেঃ
وَإِنَّ يَوْمًا عِنْدَ رَبِّكَ كَأَلْفِ سَنَةٍ مِمَّا تَعُدُّونَ
(আর প্রকৃতপক্ষে তোমরা যে হিসাব কষে থাকো, সেই দৃষ্টিতে তোমার রবের এখানে একটি দিন এক হাজার বছরের সমান)।
আবার সূরা মা’আরিজ-এর ৪নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ
تَعْرُجُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ إِلَيْهِ فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ
(ফেরেশতারা ও জিব্রীল তাঁর দিকে আরোহণ করে একদিনে, যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর)। তবে এখানে ‘দিন’ শব্দের প্রকৃত তাৎপর্য কি, তা আল্লাহই ভাল জানেন। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, সূরা হামীম সাজদা-টীকা ১১-১৫)
৪১
আল্লাহর “ইস্তিওয়া আলাল আরশ”(কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন হওয়া) এর বিস্তারিত স্বরূপ অনুধাবন করা আমাদের পক্ষে কঠিন। খুব সম্ভবত সমগ্র বিশ্ব-জাহান সৃষ্টির পর মহান আল্লাহ কোন একটি স্থানকে তাঁর এ অসীম সাম্রাজ্যের কেন্দ্র নির্ধারণ করেন এবং সেখানে নিজের আলোক রশ্মির বিচ্ছুরণকে কেন্দ্রীভূত করে দেন আর তারই নাম দেন “আরশ” (কর্তৃত্বের আসন)। সেখান থেকে সমগ্র বিশ্বজাহানের নব নব সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলছে ও ক্রমাগত শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটছে, সেই সাথে সৃষ্টি জগতের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাও অব্যাহত রয়েছে। আবার এও সম্ভব হতে পারে যে, আরশ অর্থ শাসন কর্তৃত্ব এবং আরশের ওপর সমাসীন হয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ এ বিশ্ব-জাহান সৃষ্টি করার পর এর শাসন দণ্ড নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। মোটকথা আরশের ওপর সমাসীন হওয়ার বিস্তারিত অর্থ যাই হোক না কেন, মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ যে এ বিশ্ব-জগতের নিছক স্রষ্টাই নন বরং এর পরিচালক ও ব্যবস্থাপকও একথা ভালভাবে হৃদয়ঙ্গম করানোই কুরআনে এর উল্লেখের আসল উদ্দেশ্য। তিনি এ দুনিয়াকে অস্তিত্বশীল করার পর এর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে কোথাও বসে যাননি। বরং কার্যত তিনিই সারা বিশ্ব-জাহানের ছোট বড় প্রত্যেকটি বস্তুর ওপর কর্তৃত্ব করছেন। পরিচালনা ও শাসন কর্তৃত্বের যাবতীয় ক্ষমতা কার্যত তাঁরই হাতে নিবদ্ধ। প্রতিটি বস্তু তাঁর নির্দেশের অনুগত। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণাও তাঁর নির্দেশ মেনে চলে। প্রতিটি বস্তু ও প্রাণীর ভাগ্যই চিরন্তনভাবে তাঁর নির্দেশের সাথে যুক্ত। যে মৌলিক বিভ্রান্তিটির কারণে মানুষ কখনো শিরকের গোমরাহীতে লিপ্ত হয়েছে, আবার কখনো নিজেকে স্বাধীন ক্ষমতা সম্পন্ন ঘোষণা করার মতো ভ্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কুরআন এভাবে তার মূলোৎপাটন করতে চায়। বিশ্ব-জাহানের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা থেকে আল্লাহকে কার্যত সম্পর্কহীন মনে করার অনিবার্য ফল দাঁড়ায় দু’টি। মানুষ নিজের ভাগ্যকে অন্যের হাতে বন্দি মনে করবে এবং তার সামনে মাথা নত করে দেবে অথবা নিজেকেই নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা মনে করবে এবং নিজেকে সর্বময় কর্তৃত্বশালী স্বাধীন সত্তা মনে করে কাজ করে যেতে থাকবে।
এখানে আরো একটি কথা প্রণিধানযোগ্য। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যকার সম্পর্ক সুস্পষ্ট করার জন্য কুরআন মজীদে মানুষের ভাষা থেকে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এমন সব শব্দ পরিভাষা, উপমা ও বর্ণনাভংগী গ্রহণ করা হয়েছে, যা রাজত্ব ও বাদশাহীর সাথে সম্পর্ক রাখে। এ বর্ণনাভংগী কুরআনে এত বেশী স্পষ্ট যে, অর্থ বুঝে কুরআন পাঠকারী যে কোন ব্যক্তিই এ বিষয়টি অনুভব না করে থাকতে পারবেন না। কোন কোন অর্বাচীন সমালোচক স্বীয় বিকৃত চিন্তা ও মানসিকতার কারণে এ বাচনভংগী থেকে বুঝেছেন যে, এ কিতাবটি যে যুগের “রচনা” সে যুগে মানুষের মন-মস্তিষ্কে রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রভাব ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ছিল। তাই এ কিতাবের রচয়িতা (এ বিবেকহীন নিন্দুকদের মতে এর রচয়িতা নাকি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহকে একজন রাজা ও বাদশাহ হিসেবেই পেশ করেছেন। অথচ কুরআন যে শাশ্বত ও অনাদি-অনন্ত সত্য উপস্থাপন করছে তা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সে সত্যটি হচ্ছে, ভুমণ্ডলে ও নভোমণ্ডলে একমাত্র আল্লাহর রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত। সার্বভৌমত্ব (Sovereignty) বলতে যা বুঝায় তা একমাত্র তারই সত্তার একচেটিয়া অধিকার ও বৈশিষ্ট্য। আর বিশ্ব-জাহানের এ ব্যবস্থাপনা একটি পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা বিশেষ, যেখানে ঐ একক সত্তা, সমস্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী। কাজেই এ ব্যবস্থার মধ্যে যে ব্যক্তি বা দল নিজের বা অন্য কারুর আংশিক বা পূর্ণ কর্তৃত্বের দাবীদার হয়, সে নিজেকে নিছক প্রতারণার জালে আবদ্ধ করে রেখেছে। তাছাড়া এ ব্যবস্থার মধ্যে অবস্থান করে মানুষ পক্ষে ঐ একক সত্তাকে একই সাথে ধর্মীয় অর্থেও একমাত্র মাবুদ এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক অর্থেও একমাত্র শাসক (Sovereign) হিসেবে মেনে নেয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোন সঠিক দৃষ্টিভংগী ও কর্মনীতি হতে পারে না।
৪২
”আরশের উপর সমাসীন হলেন” বাক্যটির মাধ্যমে সংক্ষেপে যে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছিল এখানে তারই কিছুটা অতিরিক্ত ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ নিছক স্রষ্টাই নন, তিনি হুকুমকর্তা এবং শাসকও। তিনি সৃষ্টি করার পর নিজের সৃষ্ট বস্তুসমূহকে অন্যের কর্তৃত্বে সোপর্দ করে দেননি অথবা সমগ্র সৃষ্টিকে বা তার অংশ বিশেষকে ইচ্ছামত চলার জন্য স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেননি। বরং কার্যত সমগ্র বিশ্ব-জগতের পরিচালনা ব্যবস্থা আল্লাহর নিজের হাতেই কেন্দ্রীভূত রয়েছে। দিন রাত্রির আবর্তন আপনা আপনিই হচ্ছে না। বরং আল্লাহর হুকুমে হচ্ছে। তিনি যখনই চাইবেন দিন ও রাতকে থামিয়ে দেবেন আবার যখনই চাইবেন এ ব্যবস্থা বদলে দেবেন। সূর্য, চন্দ্র, তারকা এরা কেউ নিজস্ব কোন শক্তির অধিকারী নয়। বরং এরা সবাই সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন। এরা একান্ত অনুগত দাসের মত সেই কাজই করে যাচ্ছে যে কাজে আল্লাহ এদেরকে নিযুক্ত করেছেন।
৪৩
বরকতের আসল অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি, উন্নতি, বিকাশ। এই সঙ্গে এ শব্দটির মধ্যে একদিকে উচ্চতা ও মহত্বের ভাবধারা নিহিত রয়েছে এবং অন্যদিকে রয়েছে স্থীতিশীলতা ও অবিচলতার ভাবধারাও। আবার মঙ্গল ও কল্যাণের ভাবধারাও নিশ্চিতভাবে এসব অর্থের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কাজেই আল্লাহর বড়ই বরকতের অধিকারী হবার অর্থ এ দাঁড়ায় যে, তাঁর মঙ্গল ও কল্যাণের কোন সীমা নেই। তাঁর সত্তা থেকে সীমাহীন কল্যাণ চতুর্দিকে বিস্তৃত হচ্ছে এবং তিনি অতি উন্নত ও শ্রেষ্ঠ এক সত্তা। তাঁর মহত্বের কোন শেষ নেই। আর তাঁর এ কল্যাণ, মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব চিরস্থায়ী ও অনন্তকালীন-সাময়িক নয়। এর ক্ষয়ও নেই। পতনও নেই। (আল-ফুরকান, টীকা ১-১৯ দ্রষ্টব্য)।