আল আরাফ

২০৬ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
৪১ ) তাদের জন্য বিছানাও হবে জাহান্নামের এবং ওপরের আচ্ছাদনও হবে জাহান্নামের। এ প্রতিফল আমি জালেমদেরকে দিয়ে থাকি।
لَهُم مِّن جَهَنَّمَ مِهَادٌ وَمِن فَوْقِهِمْ غَوَاشٍ وَكَذَٰلِكَ نَجْزِى ٱلظَّٰلِمِينَ ٤١
৪২ ) অন্যদিকে যারা আমার আয়াত মেনে নিয়েছে এবং সৎকাজ করেছে- আর এ পর্যায়ে আমি কাউকে তার সামর্থের অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পণ করি না- তারা হচ্ছে জান্নাতবাসী। সেখানে তারা থাকবে চিরকাল।
وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّٰلِحَٰتِ لَا نُكَلِّفُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَآ أُو۟لَٰٓئِكَ أَصْحَٰبُ ٱلْجَنَّةِ هُمْ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٤٢
৪৩ ) তাদের মনে পরস্পরের বিরুদ্ধে যা কিছু গ্লানি থাকবে তা আমি বের করে দেবো। ৩২ তাদের নিম্নদেশে ঝরণাধারা প্রবাহিত হবে এবং তারা বলবেঃ “প্রশংসা সব আল্লাহরই জন্য, যিনি আমাদের এ পথ দেখিয়েছেন। আমরা নিজেরা পথের সন্ধান পেতাম না যদি না আল্লাহ‌ আমাদের পথ দেখাতেন। আমাদের রবের পাঠানো রসূলগণ যথার্থ সত্য নিয়েই এসেছিলেন।” সে সময় আওয়াজ ধ্বনিত হবেঃ “তোমাদেরকে এই যে জান্নাতের উত্তরাধিকারী বানানো হয়েছে, এটি তোমরা লাভ করেছো সেই সমস্ত কাজের প্রতিদানে যেগুলো তোমরা অব্যাহতভাবে করতে।” ৩৩
وَنَزَعْنَا مَا فِى صُدُورِهِم مِّنْ غِلٍّ تَجْرِى مِن تَحْتِهِمُ ٱلْأَنْهَٰرُ وَقَالُوا۟ ٱلْحَمْدُ لِلَّهِ ٱلَّذِى هَدَىٰنَا لِهَٰذَا وَمَا كُنَّا لِنَهْتَدِىَ لَوْلَآ أَنْ هَدَىٰنَا ٱللَّهُ لَقَدْ جَآءَتْ رُسُلُ رَبِّنَا بِٱلْحَقِّ وَنُودُوٓا۟ أَن تِلْكُمُ ٱلْجَنَّةُ أُورِثْتُمُوهَا بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ ٤٣
৪৪ ) তারপর জান্নাতের অধিবাসীরা জাহান্নামের অধিবাসীদেরকে ডেকে বলবেঃ “আমাদের রব আমাদের সাথে যে সমস্ত ওয়াদা করেছিলেন তার সবগুলোকেই আমরা সঠিক পেয়েছি, তোমাদের রব যেসব ওয়াদা করেছিলেন, তোমরাও কি সেগুলোকে সঠিক পেয়েছো?” ৩৪
وَنَادَىٰٓ أَصْحَٰبُ ٱلْجَنَّةِ أَصْحَٰبَ ٱلنَّارِ أَن قَدْ وَجَدْنَا مَا وَعَدَنَا رَبُّنَا حَقًّا فَهَلْ وَجَدتُّم مَّا وَعَدَ رَبُّكُمْ حَقًّا قَالُوا۟ نَعَمْ فَأَذَّنَ مُؤَذِّنٌۢ بَيْنَهُمْ أَن لَّعْنَةُ ٱللَّهِ عَلَى ٱلظَّٰلِمِينَ ٤٤
৪৫ ) তারা জবাবে বলবেঃ “হ্যাঁ,”, তখন একজন ঘোষণাকারী তাদের মধ্যে ঘোষণা করবঃ “আল্লাহর লানত সেই জালেমদের ওপর, যারা মানুষকে আল্লাহর পথে চলতে বাধা দিতো এবং তাকে বাঁকা করে দিতে চাইতো আর তারা ছিল আখেরাত অস্বীকারকারী।”
ٱلَّذِينَ يَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِ وَيَبْغُونَهَا عِوَجًا وَهُم بِٱلْءَاخِرَةِ كَٰفِرُونَ ٤٥
৪৬ ) এ উভয় দলের মাঝখানে থাকবে একটি অন্তরাল। এর উচু স্থানে (আ’রাফ) অপর কিছু লোক থাকবে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করেনি ঠিকই কিন্তু তারা হবে তার প্রার্থী।
وَبَيْنَهُمَا حِجَابٌ وَعَلَى ٱلْأَعْرَافِ رِجَالٌ يَعْرِفُونَ كُلًّۢا بِسِيمَىٰهُمْ وَنَادَوْا۟ أَصْحَٰبَ ٱلْجَنَّةِ أَن سَلَٰمٌ عَلَيْكُمْ لَمْ يَدْخُلُوهَا وَهُمْ يَطْمَعُونَ ٤٦
৪৭ ) তারা প্রত্যেককে তার লক্ষণের সাহায্যে চিনে নেবে। জান্নাতবাসীদেরকে ডেকে তারা বলবেঃ “তোমাদের প্রতি শান্তি হোক!” আর যখন তাদের দৃষ্টি জাহান্নামবাসীদের দিকে ফিরবে, তারা বলবেঃ “হে আমাদের রব! এ জালেমদের সাথে আমাদের শামিল করো না।”
وَإِذَا صُرِفَتْ أَبْصَٰرُهُمْ تِلْقَآءَ أَصْحَٰبِ ٱلنَّارِ قَالُوا۟ رَبَّنَا لَا تَجْعَلْنَا مَعَ ٱلْقَوْمِ ٱلظَّٰلِمِينَ ٤٧
৪৮ ) আবার এ আ'রাফের লোকেরা জাহান্নামের কয়েকজন বড় বড় ব্যক্তিকে তাদের আলামত দেখে চিনে নিয়ে ডেকে বলবেঃ “দেখলে তো তোমরা, আজ তোমাদের দলবলও তোমাদের কোন কাজে লাগলো না। আর তোমাদের যেই সাজ-সরঞ্জামকে তোমরা অনেক বড় মনে করতে তাও কোন উপকারে আসলো না।
وَنَادَىٰٓ أَصْحَٰبُ ٱلْأَعْرَافِ رِجَالًا يَعْرِفُونَهُم بِسِيمَىٰهُمْ قَالُوا۟ مَآ أَغْنَىٰ عَنكُمْ جَمْعُكُمْ وَمَا كُنتُمْ تَسْتَكْبِرُونَ ٤٨
৪৯ ) আর এ জান্নাতের অধিবাসীরা কি তারাই নয়, যাদের সম্পর্কে তোমরা কসম খেয়ে বলতে, এদেরকে তো আল্লাহ‌ তাঁর রহমত থেকে কিছুই দেবেন না? আজ তাদেরকেই বলা হয়েছে, প্রবেশ করো জান্নাতে- তোমাদের কোন ভয়ও নেই, দুঃখও নেই।”
أَهَٰٓؤُلَآءِ ٱلَّذِينَ أَقْسَمْتُمْ لَا يَنَالُهُمُ ٱللَّهُ بِرَحْمَةٍ ٱدْخُلُوا۟ ٱلْجَنَّةَ لَا خَوْفٌ عَلَيْكُمْ وَلَآ أَنتُمْ تَحْزَنُونَ ٤٩
৫০ ) আর জাহান্নামবাসীরা জান্নাতবাসীদেরকে ডেকে বলবেঃ “সামান্য একটু পানি আমাদের উপর ঢেলে দাও না। অথবা আল্লাহ‌ তোমাদের যে রিযিক দান করেছেন তা থেকেই কিছু ফেলে দাও না।” তারা জবাবে বলবেঃ “আল্লাহ এ দু’টি জিনিসই সত্য অস্বীকারকারীদের জন্য হারাম করেছেন,
وَنَادَىٰٓ أَصْحَٰبُ ٱلنَّارِ أَصْحَٰبَ ٱلْجَنَّةِ أَنْ أَفِيضُوا۟ عَلَيْنَا مِنَ ٱلْمَآءِ أَوْ مِمَّا رَزَقَكُمُ ٱللَّهُ قَالُوٓا۟ إِنَّ ٱللَّهَ حَرَّمَهُمَا عَلَى ٱلْكَٰفِرِينَ ٥٠
৩২.
অর্থাৎ দুনিয়ার জীবনে এ সৎলোকদের মধ্যে কিছু পারস্পরিক তিক্ততা, মনোমালিন্য ও ভুল বুঝাবুঝি থেকে থাকলেও আখেরাতের জীবনে তা সব দূর করে দেয়া হবে। তাদের মন পরস্পরের ব্যাপারে পরিষ্কার হয়ে যাবে। তারা পরস্পর আন্তরিকতা সম্পন্ন অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। দুনিয়ায় যে ব্যক্তি তাদের বিরোধী ছিল, যে তাদের সাথে লড়াই করেছিল এবং তাদের বিরূপ সমালোচনা করেছিল, তাকে তাদের সাথে জান্নাতের আপ্যায়নে শামিল থাকতে দেখে তাদের কারোর মনে কোন প্রকার কষ্টের উদ্রেক হবে না। এ আয়াতটি পড়ে হযরত আলী (রা.) বলেছিলেনঃ আমি আশা করি, আল্লাহ‌ আমার, উসমানের, তালহার ও যোবাইরের মধ্যে সাফাই করে দেবেন।

এ আয়াতটিকে ব্যাপকতর দৃষ্টিতে দেখলে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, এ দুনিয়ায় সৎলোকদের গায়ে ঘটনাক্রমে যেসব দাগ বা কলঙ্ক লেগে যায়, সেই দাগগুলো সহকারে আল্লাহ‌ তাদেরকে জান্নাতে নিয়ে যাবেন না। বরং সেখানে প্রবেশ করার আগে নিজের বিশেষ অনুগ্রহে তাদেরকে একেবারে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করে নেবেন এবং একটি নিরেট নিষ্কলঙ্ক জীবন নিয়ে তারা সেখানে উপস্থিত হবেন।

৩৩.
বেহেশত এ ধরনের একটি মজার ব্যাপার ঘটবে। জান্নাতবাসীরা নিজেদের কাজের জন্য অহংকারে মেতে উঠবে না। তারা একথা মনে করবে না যে, তারা এমন কাজ করেছিল যার বিনিময়ে তাদের জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে গিয়েছিল। বরং তারা আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে পঞ্চমুখ হয়ে উঠবে। তারা বলবে, এসব আমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ, নয়তো আমরা এর যোগ্য ছিলাম না। অন্যদিকে আল্লাহ‌ তাদের ওপর নিজের অনুগ্রহের বড়াই করবেন না। বরং জবাবে বলবেন, তোমরা নিজেদের কাজের বিনিময়ে এ মর্যাদার অধিকারী হয়েছো। তোমাদেরকে যা কিছু দেয়া হচ্ছে সবই তোমাদের মেহনতের ফসল। এগুলো ভিক্ষে করে পাওয়া নয় বরং তোমাদের প্রচেষ্টার ফল এবং তোমাদের কাজের মজুরী। নিজেদের মেহনতের বিনিময়ে তোমরা এসব সম্মানজনক জীবিকা অর্জনের অধিকার লাভ করছো। অপর দিকে আল্লাহ‌ তাঁর জবাবের কথা এ ভাবে উল্লেখ করেছেন না যে, “আমি একথা বলবো", বরং তিনি বলছেন, “আওয়াজ ধ্বনিত হবে",-এভাবে বর্ণনা করার কারণে বিষয়টি আরো বেশী আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছে।

আসলে এই একই ধরনের সম্পর্ক দুনিয়ায় আল্লাহ‌ ও তাঁর নেক বান্দাদের মধ্যেও রয়েছে। দুরাচারী লোকেরা দুনিয়ায় যে অনুগ্রহে লাভ করে থাকে তারা সেজন্য গর্ব করে বেড়ায়। তারা বলে থাকে, এসব আমাদের যোগ্যতা, প্রচেষ্টা-সাধনা ও কর্মের ফল। আর এ জন্যই তারা প্রত্যেকটি অনুগ্রহলাভের কারণে আরো বেশী অহংকারী ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীতে পরিণত হতে থাকে। বিপরীত পক্ষে সৎলোকেরা যে কোন অনুগ্রহ লাভ করুক না কেন তাকে অবশ্যি আল্লাহ‌ দান মনে করে। সেজন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। আল্লাহর দান যতই বাড়তে থাকে ততই তারা বিনয় প্রকাশ করতে থাকে এবং ততই তাদের দয়া, স্নেহ ও বদান্যতা বেড়ে যেতে থাকে। তারপর আখেরাতের ব্যাপারেও তারা নিজেদের সৎকর্মের জন্য অহংকারে মত্ত হয় না। তারা একথা বলে না যে, তাদের গুনাহখাতা নিশ্চিতভাবেই মাফ করে দেয়া হবে। বরং নিজেদের ভুল-ত্রুটির জন্য তারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে থাকে। নিজেদের কর্মফলের পরিবর্তে আল্লাহর করুণা ও মেহেরবানীর ওপর পূর্ণ আস্থাশীল হয়। তারা সবসময় ভয় করতে থাকে, তাদের আমলনামায় প্রাপ্যের পরিবর্তে কোন দেনার খাত বের হয়ে না আসে। বুখারী ও মুসলিম উভয় হাদীস গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে, নবী ﷺ বলেছেনঃ

وَاعْلَمُوا أَنْ لَنْ يُدْخِلَ أَحَدَكُمْ عَمَلُهُ الْجَنَّةَ

“খুব ভালভাবেই জেনে রাখো, তোমরা নিছক নিজেদের কর্মকাণ্ডের জোরে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” লোকেরা জিজ্ঞাস করলো, হে আল্লাহর রসূল! আপনিও? জবাব দিলেন, হাঁ আমিও-

إِلاَّ أَنْ يَتَغَمَّدَنِىَ اللَّهُ بِرَحْمَةٍ مِنْهُ وَفَضْلٍ

“হাঁ, তবে যদি আল্লাহ‌ আমাকে তাঁর রহমত ও অনুগ্রহের আবরণে ঢেকে নেন।”

৩৪.
অর্থাৎ এ আ'রাফাবাসীরা হবে এমন একদল লোক, যাদের জীবনের ও কর্মকাণ্ডের ইতিবাচক বা ভাল দিক এত বেশী শক্তিশালী হবে না, যার ফলে তারা জান্নাত লাভ করতে সক্ষম হয়, আবার এর নেতিবাচক বা খারাপ দিকও এত বেশী খারাপ হবে না, যার ফলে তাদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করা যেতে পারে। তাই তারা জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে একটি সীমান্ত এলাকায় অবস্থান করবে।
অনুবাদ: