আল আরাফ

২০৬ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
৬১ ) নূহ বলেঃ হে আমার সম্প্রদায়ের ভাইয়েরা! আমি কোন গোমরাহীতে লিপ্ত হইনি বরং আমি রব্বুল আলামীনের রসূল।
قَالَ يَٰقَوْمِ لَيْسَ بِى ضَلَٰلَةٌ وَلَٰكِنِّى رَسُولٌ مِّن رَّبِّ ٱلْعَٰلَمِينَ ٦١
৬২ ) তোমাদের কাছে আমার রবের বাণী পৌঁছে দিচ্ছি। আমি তোমাদের কল্যাণকামী। আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি এমন সব কিছু জানি যা তোমার জান না।
أُبَلِّغُكُمْ رِسَٰلَٰتِ رَبِّى وَأَنصَحُ لَكُمْ وَأَعْلَمُ مِنَ ٱللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ ٦٢
৬৩ ) তোমরা কি এ জন্য অবাক হচ্ছো যে, তোমাদের কাছে তোমাদের স্বীয় সম্প্রদায়েরই এক ব্যক্তির মাধ্যমে তোমাদের রবের স্মারক এসেছে, তোমাদেরকে সতর্ক করার জন্য যাতে তোমরা ভুল পথে চলা থেকে রক্ষা পাও এবং তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করা হয়? ৪৯
أَوَعَجِبْتُمْ أَن جَآءَكُمْ ذِكْرٌ مِّن رَّبِّكُمْ عَلَىٰ رَجُلٍ مِّنكُمْ لِيُنذِرَكُمْ وَلِتَتَّقُوا۟ وَلَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ٦٣
৬৪ ) কিন্তু তারা তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করলো। অবশেষে আমি তাকে ও তার সাথীদেরকে একটি নৌকায় (আরোহণ করিয়ে) রক্ষা করি এবং আমার আয়াতকে যারা মিথ্যা বলেছিল তাদেরকে ডুবিয়ে দেই। ৫০ নিঃসন্দেহে তারা ছিল দৃষ্টিশক্তিহীন জনগোষ্ঠি।
فَكَذَّبُوهُ فَأَنجَيْنَٰهُ وَٱلَّذِينَ مَعَهُۥ فِى ٱلْفُلْكِ وَأَغْرَقْنَا ٱلَّذِينَ كَذَّبُوا۟ بِـَٔايَٰتِنَآ إِنَّهُمْ كَانُوا۟ قَوْمًا عَمِينَ ٦٤
৬৫ ) আর 'আদ' (জাতি) র ৫১ কাছে আমি পাঠাই তাদের ভাই হূদকে। সে বলেঃ “হে আমার সম্প্রদায়ের ভাইয়েরা! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। এরপরও কি তোমরা ভুল পথে চলার ব্যাপারে সাবধান হবে না?”
وَإِلَىٰ عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًا قَالَ يَٰقَوْمِ ٱعْبُدُوا۟ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُۥٓ أَفَلَا تَتَّقُونَ ٦٥
৬৬ ) তার সম্প্রদায়ের প্রধানরা যারা তার কথা মানতে অস্বীকার করছিল, তারা বললোঃ “আমরা তো তোমাকে নির্বুদ্ধিতায় লিপ্ত মনে করি এবং আমাদের ধারণা তুমি মিথ্যুক।”
قَالَ ٱلْمَلَأُ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ مِن قَوْمِهِۦٓ إِنَّا لَنَرَىٰكَ فِى سَفَاهَةٍ وَإِنَّا لَنَظُنُّكَ مِنَ ٱلْكَٰذِبِينَ ٦٦
৬৭ ) সে বললোঃ “হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা! আমি নির্বুদ্ধিতায় লিপ্ত নই। বরং আমি রব্বুল আলামীনের রসূল,
قَالَ يَٰقَوْمِ لَيْسَ بِى سَفَاهَةٌ وَلَٰكِنِّى رَسُولٌ مِّن رَّبِّ ٱلْعَٰلَمِينَ ٦٧
৬৮ ) আমার রবের বাণী তোমাদের কাছে পৌঁছাই এবং আমি তোমাদের এমন হিতাকাংখী যার ওপর ভরসা করা যেতে পারে।”
أُبَلِّغُكُمْ رِسَٰلَٰتِ رَبِّى وَأَنَا۠ لَكُمْ نَاصِحٌ أَمِينٌ ٦٨
৬৯ ) তোমরা কি এ জন্য অবাক হচ্ছো যে, তোমাদেরকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে তোমাদেরই স্বগোত্রীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে তোমাদের রবের স্মারক তোমাদের কাছে এসেছে? ভুলে যেয়ো না, তোমাদের রব নূহের সম্প্রদায়ের পর তোমাদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেন এবং অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান ও সুঠামদেহের অধিকারী করেন। কাজেই আল্লাহর অপরিসীম শক্তির কথা স্মরণ রাখো, ৫২ আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে।
أَوَعَجِبْتُمْ أَن جَآءَكُمْ ذِكْرٌ مِّن رَّبِّكُمْ عَلَىٰ رَجُلٍ مِّنكُمْ لِيُنذِرَكُمْ وَٱذْكُرُوٓا۟ إِذْ جَعَلَكُمْ خُلَفَآءَ مِنۢ بَعْدِ قَوْمِ نُوحٍ وَزَادَكُمْ فِى ٱلْخَلْقِ بَصْۜطَةً فَٱذْكُرُوٓا۟ ءَالَآءَ ٱللَّهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ٦٩
৭০ ) তারা জবাব দিলোঃ “তুমি কি আমাদের কাছে এ জন্য এসেছো যে, আমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবো এবং আমাদের বাপ-দাদারা যাদের ইবাদত করে এসেছে তাদেরকে পরিহার করবো? ৫৩ বেশ, যদি তুমি সত্যবাদী হও, তাহলে আমাদের যে আযাবের হুমকি দিচ্ছো, তা নিয়ে এসো।”
قَالُوٓا۟ أَجِئْتَنَا لِنَعْبُدَ ٱللَّهَ وَحْدَهُۥ وَنَذَرَ مَا كَانَ يَعْبُدُ ءَابَآؤُنَا فَأْتِنَا بِمَا تَعِدُنَآ إِن كُنتَ مِنَ ٱلصَّٰدِقِينَ ٧٠
৪৯.
এ ব্যাপারটি ঘটেছিল হযরত নূহ (আ) ও তাঁর জাতির মধ্যে। ঠিক এ একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল হযরত মুহাম্মাদ ﷺ ও তাঁর সম্প্রদায়ের মধ্যে। হযরত মুহাম্মাদ ﷺ ও হযরত নূহ (আ) এর মত একই বাণী এনেছিলেন। মক্কার সরদাররা হযরত মুহাম্মাদ ﷺ এর নবুওয়াতের বিরুদ্ধে যেসব সন্দেহ প্রকাশ করছিল সেই একই ধরনের সন্দেহ হাজার হাজার বছর আগে হযরত নূহের সম্প্রদায়ের প্রধানরাও পেশ করেছিল। আবার এসবের জবাবে হযরত নূহ (আ) যেসব কথা বলতেন, হযরত মুহাম্মাদ ﷺ ও সেই একই কথা বলতেন। পরবর্তীতে অন্যান্য নবীদের ও তাদের জাতির যেসব ঘটনা ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে সেখানেও এটাই দেখানো হয়েছে যে, প্রত্যেক নবীর জাতির ভূমিকা মক্কাবাসীদের ভূমিকার সাথে এবং প্রত্যেক নবীর ভাষণ মুহাম্মাদ ﷺ এর ভাষণের সাথে পুরোপুরি সাদৃশ্য রাখে। এর সাহায্যে কুরআন তার পাঠক ও শ্রোতাদেরকে একথা বুঝাতে চায় যে, প্রতি যুগে মানুষের গোমরাহী মূলগতভাবে একই ধরনের ছিল এবং আল্লাহর পাঠানো মানবতার শিক্ষকদের দাওয়াতও প্রতিযুগে প্রত্যেকটি দেশে একই রকম ছিল। অনুরূপভাবে যারা নবীদের দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং নিজেদের গোমরাহীর নীতিতে অবিচল থেকেছে তাদের পরিণামও একই হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে।
৫০.
কুরআনের বর্ণনাভঙ্গির সাথে যাদের ভাল পরিচয় নেই তারা অনেক সময় এ সন্দেহে পড়ে যান যে, সম্ভবত এই সমগ্র ব্যাপারটি একটি বা দু’টি বৈঠকেই সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। গোটা কার্যধারা এরূপ ছিল বলে মনে হয় যে, নবী এলেন এবং তিনি নিজের দাওয়াত পেশ করলেন। লোকেরা আপত্তি ও প্রশ্ন উত্থাপন করলো এবং তিনি তার জবাব দিলেন। তারপর লোকেরা তাঁর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলো আর অমনি আল্লাহ‌ আযাব পাঠিয়ে দিলেন। অথচ ব্যাপারটি ঠিক এমন নয়। যেসব ঘটনাকে যুথবদ্ধ করে এখানে মাত্র কয়েকটি বাক্যে বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলো সংঘটিত হতে সুদীর্ঘকাল ও বছরের পর বছর সময় লেগেছিল। কুরআনের একটি বিশেষ বর্ণনা পদ্ধতি হচ্ছে, কুরআন শুধুমাত্র গল্প বলার জন্য ঘটনা বা কাহিনী বর্ণনা করে যায় না বরং শিক্ষা দেবার জন্য বর্ণনা করে যায়। তাই সর্বত্র ঐতিহাসিক ঘটনাবলী বর্ণনা করার সময় কাহিনীর কেবলমাত্র সেই অংশটুকুই কুরআন উপস্থাপন করে, যার সাথে উদ্দেশ্য ও মূল বিষয়বস্তুর কোন সম্পর্ক থাকে। এছাড়া কাহিনীর অন্যান্য বিস্তারিত বিবরণকে সম্পূর্ণ বাদ দেয়। আবার যদি কোন কাহিনীকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বর্ণনা করে থাকে তাহলে সর্বত্র উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন বিস্তারিত বিবরণও পেশ করে থাকে। যেমন এই নূহ আলাইহিস সালামের কাহিনীটির কথাই ধরা যাক। নবীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করার ও তাকে মিথ্যুক বলার পরিণাম বর্ণনা করাই এখানে এর উদ্দেশ্য। কাজেই নবী যত দীর্ঘকাল পর্যন্ত নিজের জাতিকে দাওয়াত দিতে থেকেছেন, সে কথা বলার এখানে কোন প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু যেখানে মুহাম্মাদ ﷺ ও তাঁর সাথীদেরকে সবর করার উপদেশ দেয়ার উদ্দেশ্যে এ কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে সেখানে বিশেষভাবে নূহ আলাইহিস সালামের দাওয়াতের দীর্ঘ সময়ের উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম ও তাঁর সাথী গণ নিজেদের মাত্র কয়েক বছরের প্রচেষ্টা ও সাধনা ফলপ্রসূ হতে না দেখে হতোদ্যম না হয়ে পড়েন এবং অন্যদিকে তারা যেন নূহ আলাইহিস সালামের সবরের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন, যিনি সুদীর্ঘকাল অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক পরিবেশে সত্যের দাওয়াত দেয়া অব্যাহত রেখেছেন এবং কোন সময় একটুও হতাশ হননি। (সূরা আনকাবুত, আয়াত-১৪)

এখানে আর একটি সন্দেহও দেখা দেয়। এটি দূর করাও প্রয়োজন।কোন ব্যক্তি যখন বারবার কুরআনে পড়তে থাকে, অমুক জাতি নবীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেছিল, নবী তাদেরকে আল্লাহর আযাব অবতীর্ণ হবার খবর দিয়েছিলেন এবং অকস্মাৎ একদিন আল্লাহর আযাব এসে সেই জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। এ সময় তার মনে প্রশ্ন জাগে, এ ধরনের ঘটনা এখন ঘটে না কেন? যদিও এখনো বিভিন্ন জাতির উত্থান পতন হয় কিন্তু এ উত্থান পতনের ধরনই আলাদা। এখন তো এমন হয় না যে, একটি সতর্কবাণী উচ্চারণ করার পর ভূমিকম্প, প্লাবন বা ঝড় এলো এবং পুরো এক একটি জাতি ধ্বংস হয়ে গেলো। এর জবাবে বলা যায়, প্রকৃতপক্ষে একজন নবী সরাসরি যে জাতিকে দাওয়াত দেন তার ব্যাপারটি অন্য জাতিদের ব্যাপার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের। যে জাতির মধ্যে কোন নবীর জন্ম হয়, তিনি সরাসরি তার ভাষায় তার কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে দেন এবং নিজের নিখুঁত ব্যক্তি চরিত্রের মাধ্যমে নিজের বিশ্বস্ততা ও সত্যতার জীবন্ত আদর্শ তার সামনে তুলে ধরেন, এতে করে তার সামানে আল্লাহর যুক্তি প্রমাণ তথা তার দাওয়াত পূর্ণরূপে উপস্থাপিত হয়েছে বলে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়ে যায়। তার জন্য ওযর-আপত্তি পেশ করার আর কোন অবকাশই থাকেনা। আল্লাহর পাঠানো রসূলকে সামনা-সামনি অস্বীকার করার পর তার অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছে, যার ফলে ঘটনাস্থলেই তার সম্পর্কে চূড়ান্ত ফয়সালা হয়ে যাওয়া জরুরী হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে, যেসব জাতির কাছে আল্লাহর বাণী সরাসরি নয় বরং বিভিন্ন মাধ্যমে এসে পৌঁছেছে তাদের ব্যাপারটির ধরন এর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কাজেই নবীদের সময় যেসব ঘটনার অবতারণা হতে দেখা যেতো এখন যদি আর সে ধরনের কোন ঘটনা না ঘটে থাকে তাহলে তাতে অবাক হবার কিছুই নেই। কারণ, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর নবুওয়াতের সিলসিলা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে হাঁ, কোন নবীকে সামনা সামনি প্রত্যাখ্যান করার পর কোন জাতির ওপর যে আযাব আসতো তেমনি ধরনের কোন আযাব যদি বর্তমানে কোন জাতির ওপর আসে তাহলে তাতেই বরং অবাক হতে হবে।

কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, বর্তমানে যেসব জাতি আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক আচরণ করছে এবং নৈতিক ও চিন্তাগত দিক দিয়ে গোমরাহীতে লিপ্ত হয়েছে, তাদের ওপর আল্লাহর আযাব আসা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে, এখনো এসব জাতির ওপর আযাব আসছে। কখনো সতর্ককারী ছোট ছোট আযাব, আবার কখনো চূড়ান্ত ফায়সালাকারী বড় বড় আযাব। কিন্তু আম্বিয়া আলাহিমুস সালাম ও আসমানী কিতাবগুলোর মত এ আযাবগুলোর নৈতিক তাৎপর্যের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকৃষ্ট করার দায়িত্ব কেউ গ্রহণ করছে না। বরং এর বিপরীত পক্ষে স্থুল দৃষ্টির অধিকারী বিজ্ঞানী, সত্য সম্পর্কে অজ্ঞ, ঐতিহাসিক ও দার্শনিকদের একটি বিরাট গোষ্ঠী মানব জাতির ঘাড়ে চেপে বসে আছে। তারা এ ধরনের যাবতীয় ঘটনার ব্যাখ্যা করে প্রাকৃতিক আইন বা ঐতিহাসিক কার্যকারণের মানদণ্ডে। এভাবে তারা মানুষকে অসচেতনতা ও বিস্মৃতির মধ্যে নিক্ষেপ করতে থাকে। তারা মানুষকে কখনো একথা বুঝার সুযোগ দেয়না যে, উপরে একজন আল্লাহ‌ আছেন, তিনি অসৎকর্মশীল জাতিদেরকে প্রথমে তাদের অসৎ কর্মের জন্য সতর্ক করে দেন, তারপর যখন তারা তাঁর পাঠানো সতর্ক সংকেতসমূহ থেকে চোখ বন্ধ করে নিয়ে নিজেদের অসৎকর্ম চালিয়ে যেতে থাকে অবিশ্রান্ত ভাবে, তখন তিনি তাদেরকে ধ্বংসের আবর্তে নিক্ষেপ করেন।

৫১.
'আদ' ছিল আরবের প্রাচীনতম জাতি। আরবের সাধারণ মানুষের মুখে মুখে এদের কাহিনী প্রচলিত ছিল। ছোট ছোট শিশুরাও তাদের নাম জানতো। তাদের অতীত কালের প্রতাপ-প্রতিপত্তি ও গৌরব গাঁথা প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছিল। তারপর দুনিয়ার বুক থেকে তাদের নাম-নিশানা মুছে যাওয়াটাও প্রবাদের রূপ নিয়েছিল। আদ জাতির এ বিপুল পরিচিতির কারণেই আরবী ভাষায় প্রত্যেকটি প্রাচীন ও পুরাতন জিনিসের জন্য 'আদি' শব্দ ব্যবহার করা হয়। প্রাচীন ধ্বংসাবশেষকে 'আদিয়াত' বলা হয়। যে জমির মালিক বেঁচে নেই এবং চাষাবাদকারী না থাকার কারণে যে জমি অনাবাদ পড়ে থাকে তাকে 'আদি-উল-আরদ' বলা হয়। প্রাচীন আরবী কবিতায় আমরা এ জাতির নামের ব্যবহার দেখি প্রচুর পরিমাণে। আরবের বংশধারা বিশেষজ্ঞগণও নিজেদের দেশের বিলুপ্ত জাতিদের মধ্যে সর্বপ্রথম এ জাতিটির নামোচ্চারণ করে থাকেন। হাদীসে বলা হয়েছে, একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বনু যহল ইবনে শাইবান গোত্রের এক ব্যক্তি আসেন। তিনি আদ জাতির এলাকার অধিবাসী ছিলেন। তিনি প্রাচীনকাল থেকে তাদের এলাকার লোকদের মধ্যে আদজাতি সম্পর্কে যেসব কিংবদন্তী চলে আসছে তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শুনান।

কুরআনের বর্ণনা মতে এ জাতিটির আবাসস্থল ছিল 'আহকাফ' এলাকা। এ এলাকাটি হিজায, ইয়ামন ও ইয়ামামার মধ্যবর্তী 'রাবয়ুল খালী'র দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত। এখন থেকে অগ্রসর হয়ে তারা ইয়ামনের পশ্চিম সমুদ্রোপকূল এবং ওমান ও হাজরা মাউত থেকে ইরাক পর্যন্ত নিজেদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বিস্তৃত করেছিল। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে এ জাতিটির নিদর্শনাবলী দুনিয়ার বুক থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কিন্তু দক্ষিণ আরবের কোথাও কোথাও এখনো কিছু পুরাতন ধ্বংস স্তূপ দেখা যায়। সেগুলোকে আদ জাতির নিদর্শন মনে করা হয়ে থাকে। হাজরা মাউতে এক জায়গায় হযরত হূদ আলাইহিস সালামের নামে একটি কবরও পরিচিত লাভ করেছে। ১৮৩৭ খৃস্টাব্দে James R.Wellested নামক একজন ইংরেজ নৌ-সেনাপতি 'হিসনে গুরাবে' একটি পুরাতন ফলকের সন্ধান লাভ করেন। এতে হযরত হূদ আলাইহিস সালামের উল্লেখ রয়েছে। এ ফলকে উৎকীর্ণ লিপি থেকে পরিষ্কার জানা যায়, এটি হযরত হূদের শরীয়াতের অনুসারীদের লেখা ফলক। (আল আহকাফ দেখুন)।

৫২.
মূল শব্দটি হচ্ছে 'আলা'-। এর আভিধানিক অর্থ নিয়ামতসমূহ, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির প্রতীকসমূহ এবং প্রশংসনীয় চারিত্রিক গুণাবলী। আয়াতের সার্বিক মর্ম এই যে, আল্লাহর অপার অনুগ্রহের কথাও মনে রেখো, আবার এটাও ভুলে যেও না যে, তিনি তোমাদের কাছ থেকে প্রদত্ত অনুগ্রহ ছিনিয়ে নেয়ারও ক্ষমতা রাখেন।
৫৩.
এখানে আবার একথাটি উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এ জাতিটিও আল্লাহকে অস্বীকার করতো না, আল্লাহ‌ সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল না। অথবা তাঁর ইবাদাত করতে অস্বীকার করছিল না। আসলে তারা হযরত হূদের 'একমাত্র আল্লাহ‌ বন্দেগী করতে হবে এবং তাঁর বন্দেগীর সাথে আর কারোর বন্দেগী যুক্ত করা যাবে না’-এ বক্তব্যটিই মেনে নিতে অস্বীকার করছিল।
অনুবাদ: