আয়াত
১১ ) আর সেই সময়, যখন আল্লাহ নিজের পক্ষ থেকে তন্দ্রার আকারে তোমাদের জন্য নিশ্চিন্ততা ও নির্ভীকতার পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন ৮ এবং আকাশ থেকে তোমাদের ওপর পানি বর্ষণ করেছিলেন, যাতে তোমাদের পাক-পবিত্র করা যায়, শয়তান তোমাদের ওপর যে নাপাকী ফেলে দিয়েছিল তা তোমাদের থেকে দূর করা যায়, তোমাদের সাহস যোগানো যায় এবং তার মাধ্যমে তোমাদেরকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। ৯
إِذْ يُغَشِّيكُمُ ٱلنُّعَاسَ أَمَنَةً مِّنْهُ وَيُنَزِّلُ عَلَيْكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءً لِّيُطَهِّرَكُم بِهِۦ وَيُذْهِبَ عَنكُمْ رِجْزَ ٱلشَّيْطَٰنِ وَلِيَرْبِطَ عَلَىٰ قُلُوبِكُمْ وَيُثَبِّتَ بِهِ ٱلْأَقْدَامَ ١١
১২ ) আর সেই সময়, যখন তোমার রব ফেরেশতাদেরকে ইঙ্গিত করেছিলেন এই বলেঃ “আমি তোমাদের সাথে আছি, তোমরা ঈমানদারদেরকে অবিচল রাখো, আমি এখনই এ কাফেরদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে দিচ্ছি। কাজেই তোমরা তাদের ঘাড়ে আঘাত করো এবং প্রতিটি জোড়ে ও গ্রন্থী-সন্ধিতে ঘা মারো।” ১০
إِذْ يُوحِى رَبُّكَ إِلَى ٱلْمَلَٰٓئِكَةِ أَنِّى مَعَكُمْ فَثَبِّتُوا۟ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ سَأُلْقِى فِى قُلُوبِ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ ٱلرُّعْبَ فَٱضْرِبُوا۟ فَوْقَ ٱلْأَعْنَاقِ وَٱضْرِبُوا۟ مِنْهُمْ كُلَّ بَنَانٍ ١٢
১৩ ) এটা করার কারণ, তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি বিদ্রোহ পোষণ করেছে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি বিদ্রোহ করে, আল্লাহ তার জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। আর আল্লাহর পাকড়াও বড়ই কঠিন। ১১
ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ شَآقُّوا۟ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَمَن يُشَاقِقِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَإِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلْعِقَابِ ١٣
১৪ ) -এটা ১২ হচ্ছে তোমাদের শাস্তি, এখন এর মজা উপভোগ কর। আর তোমাদের জানা উচিত, সত্য অস্বীকারকারীদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আযাব।
ذَٰلِكُمْ فَذُوقُوهُ وَأَنَّ لِلْكَٰفِرِينَ عَذَابَ ٱلنَّارِ ١٤
১৫ ) হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা একটি সেনাবাহিনীর আকারে কাফেরদের মুখোমুখি হও, তখন তাদের মোকাবিলায় পৃষ্ঠ প্রদর্শন করো না।
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ إِذَا لَقِيتُمُ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ زَحْفًا فَلَا تُوَلُّوهُمُ ٱلْأَدْبَارَ ١٥
১৬ ) যে ব্যক্তি এ অবস্থায় পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে, সে আল্লাহর গযবে ঘেরাও হয়ে যাবে। তার আবাস হবে জাহান্নাম এবং ফিরে যাবার জন্য তা বড়ই খারাপ জায়গা। ১৩ তবে হ্যাঁ,, যুদ্ধের কৌশল হিসেবে এমনটি করে থাকলে অথবা অন্য কোন সেনাদলের সাথে যোগ দেবার জন্য করে থাকলে তা ভিন্ন কথা।
وَمَن يُوَلِّهِمْ يَوْمَئِذٍ دُبُرَهُۥٓ إِلَّا مُتَحَرِّفًا لِّقِتَالٍ أَوْ مُتَحَيِّزًا إِلَىٰ فِئَةٍ فَقَدْ بَآءَ بِغَضَبٍ مِّنَ ٱللَّهِ وَمَأْوَىٰهُ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ ٱلْمَصِيرُ ١٦
১৭ ) কাজেই সত্য বলতে কি, তোমরা তাদেরকে হত্যা করনি বরং আল্লাহই তাদেরকে হত্যা করেছেন। আর তোমরা নিক্ষেপ করনি বরং আল্লাহ নিক্ষেপ করেছেন। ১৪ (আর এ কাজে মুমিনদের হাত ব্যবহার করা হয়েছিল) এ জন্য যে, আল্লাহ মুমিনদেরকে একটি চমৎকার পরীক্ষার মধ্য দিয়ে সফলতার সাথে পার করে দেবেন। অবশ্যি আল্লাহ সবকিছু শুনেন ও জানেন।
فَلَمْ تَقْتُلُوهُمْ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ قَتَلَهُمْ وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ رَمَىٰ وَلِيُبْلِىَ ٱلْمُؤْمِنِينَ مِنْهُ بَلَآءً حَسَنًا إِنَّ ٱللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ١٧
১৮ ) এ ব্যাপারটি তো তোমাদের সাথে! আর কাফেরদের সাথে যে আচরণ করা হবে তা হচ্ছে আল্লাহ তাদের কৌশলগুলো দুর্বল করে দেবেন।
ذَٰلِكُمْ وَأَنَّ ٱللَّهَ مُوهِنُ كَيْدِ ٱلْكَٰفِرِينَ ١٨
১৯ ) (এ কাফেরদের বলে দাও) যদি তোমরা ফায়সালা চেয়ে থাকো, তাহলে এই নাও ফায়সালা তোমাদের সামনে এসে গেছে। ১৫ এখন যদি ক্ষান্ত হও, তাহলে তো তোমাদের জন্যই ভাল হবে। নয়তো যদি ফিরে আবার সেই বোকামির পুনরাবৃত্তি করো, তাহলে আমিও সেই শাস্তির পুনরাবৃত্তি করবো এবং তোমাদের দলবল যত বেশীই হোক না কেন, তা তোমাদের কোন কাজে আসবে না। আল্লাহ অবশ্যি মুমিনদের সাথে রয়েছেন।
إِن تَسْتَفْتِحُوا۟ فَقَدْ جَآءَكُمُ ٱلْفَتْحُ وَإِن تَنتَهُوا۟ فَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ وَإِن تَعُودُوا۟ نَعُدْ وَلَن تُغْنِىَ عَنكُمْ فِئَتُكُمْ شَيْـًٔا وَلَوْ كَثُرَتْ وَأَنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلْمُؤْمِنِينَ ١٩
২০ ) হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো এবং হুকুম শোনার পর তা অমান্য করো না।
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ أَطِيعُوا۟ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَلَا تَوَلَّوْا۟ عَنْهُ وَأَنتُمْ تَسْمَعُونَ ٢٠
৮.
অহোদ যুদ্ধেও মুসলমানদের এ একই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। সূরা আলে ইমরানের ১১ রুকূ’তে একথা আলোচিত হয়েছে। উভয় জায়গায় কারণ একটিই ছিল। অর্থাৎ যখনই প্রচণ্ড ভীতি ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে, তখনই আল্লাহ মুসলমানদের দিল বিপুল নিশ্চিন্ততায় ভরে দিয়েছেন। এর ফলে তারা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল।
৯.
যে রাতটি পোহাবার পরের দিন সকালে বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, এটি ছিল সেই রাতের ঘটনা। এ বৃষ্টির সুফল ছিল তিনটি। এক, মুসলমানরা বিপুল পরিমাণ পানি পেয়ে গিয়েছিল। তারা সঙ্গে সঙ্গেই জলাধার তৈরী করে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। দুই, মুসলমানরা উপত্যকার ওপরের দিকে অবস্থান করছিল। কাজেই বৃষ্টির ফলে বালি জমাট বেঁধে যথেষ্ট শক্ত হয়ে গিয়েছিল। তার ওপর দিয়ে মুসলমানদের বলিষ্ঠভাবে চলাফেরা করা সহজ হয়েছিল। তিন, কাফেরদের সেনাদল ছিল নীচের দিকে। বৃষ্টির পানি সেখানে জমে গিয়ে কাদা হয়ে গিয়েছিল। ফলে সেখানে হাটতে গেলেই পা দেবে যাচ্ছিল।
মুসলমানদের মধ্যে প্রথম দিকে যে ভীতির অবস্থা বিরাজমান ছিল, তাকেই শয়তানের ছুঁড়ে দেয়া নাপাকী বলা হয়েছে।
১০.
কুরআন থেকে আমরা যে নীতিগত কথাগুলো জানতে পারি তার ভিত্তিতে আমরা মনে করি, যুদ্ধ ক্ষেত্রে ফেরেশতারা হয়তো প্রত্যক্ষভাবে লড়াই করেননি এবং তরবারি হাতে নিয়ে সরাসরি মারামারি-কাটাকাটিতে অংশও নেননি। সম্ভবত তারা এভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল যে, কাফেরদের ওপর মুসলমানরা যে আঘাত হানছিল তা ফেরেশতাদের সহযোগিতায় সঠিক জায়গায় পড়ছিল এবং প্রতিটি আঘাত হচ্ছিল চূড়ান্ত ও মারাত্মক। অবশ্যি সঠিক ব্যাপার আল্লাহই ভাল জানেন।
১১.
এ পর্যন্ত এক এক করে বদর যুদ্ধের যে ঘটনাবলী স্মরণ করিয়ে দেয়া হলো, “আনফাল” শব্দের অন্তর্নিহিত তত্ব উদঘাটন করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। শুরুতে বলা হয়েছিল, কেমন করে তোমরা এ গনীমতের মালকে নিজেদের প্রচেষ্টা ও মেহনতের ফল মনে করে এর মালিক বনে যেতে চাচ্ছো? এতো আসলে আল্লাহর দান। দাতা নিজেই তার সম্পদের ওপর পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী। এর স্বপক্ষে প্রমাণ হিসেবে এ ঘটনাগুলো শুনিয়ে দেয়া হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, তোমরা নিজেরাই হিসাব লাগিয়ে দেখে নাও, এ ব্যাপারে তোমাদের নিজেদের প্রচেষ্টা, মেহনত ও সাহসিকতার অংশ কি পরিমাণ ছিল এবং আল্লাহর দান ও অনুগ্রহের অংশ ছিল কি পরিমাণ?
১২.
এখান থেকে হঠাৎ কাফেরদেরকে সম্বোধন করা শুরু হয়েছে। যাদেরকে একটু আগে শাস্তি লাভের যোগ্য বলা হয়েছিল।
১৩.
শত্রুর প্রবল চাপের মুখে নিজেদের পেছনের কেন্দ্রে ফিরে আসা অথবা নিজেদেরই সেনাদলের অন্য কোন অংশের সাথে যোগ দেবার জন্য সুপরিকল্পিত পশ্চাদপসরণ (Orderly Retreat) নাজায়েয নয়। তবে যুদ্ধের উদ্দেশ্য নিয়ে নয় বরং নিছক কাপুরুষতা ও পরাজিত মানসিকতার কারণে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালানো (Rout) হারাম। কারণ এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের তুলনায় মানুষের প্রাণটাই তার কাছে বেশী প্রিয় হয়ে উঠে। এ পালানোকে কবীরা গুনাহের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। তাই নবী ﷺ বলেন, তিনটি গুনাহ এমন যে, তার সাথে কোন নেকী সংযুক্ত হলে কোন লাভ নেই। এক, শিরক। দুই, বাপ-মায়ের অধিকার নষ্ট করা। তিন, আল্লাহর পথে লড়াই এর ময়দান থেকে পালানো। এভাবে তিনি আর একটি হাদীসে এমন সাতটি বড় বড় গুনাহের কথা বর্ণনা করেছেন, যা মানুষের জন্য ধ্বংসকর এবং পরকালেও তাকে ভয়াবহ পরিণামের মুখোমুখি করবে। এর মধ্যে একটি গুনাহ হচ্ছে, কুফর ও ইসলামের যুদ্ধে কাফেরদের সামনে থেকে পালানো। এটা একটা কাপুরুষোচিত কাজ বলেই যে একে এতবড় গুনাহ গণ্য করা হয়েছে তা নয়। বরং এর কারণ হচ্ছে, একজন সৈনিকের ছুটাছুটি, দৌড়াদৌড়ি এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে বেরিয়ে যাওয়া অনেক সময় পুরো একটি বাহিনীকে ভীত-সন্ত্রস্ত ও দিশেহারা করে দেয় এবং পালাতে উদ্বুদ্ধ করে। আর একবার যখন একটি সেনাদলের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি ও পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়, তখন তাদের বিপর্যয় ও ধ্বংস যে কতদূর গিয়ে ঠেকাবে তা বলা যায় না। এ ধরনের ছুটাছুটি ও পলায়নপরতা শুধু সেনাদলের জন্যই ধ্বংসকর নয় বরং যে দেশের সেনাদল এ ধরনের পরাজয় বরণ করে, তার জন্যও বিপর্যয়কর।
১৪.
বদরের যুদ্ধে যখন মুসলমান ও কাফেরদের সেনাদল ময়দানে পরস্পরের মুখোমুখি হলো এবং আঘাত-পাল্টা আঘাতের সময় এসে গেলো তখন নবী (সা.) এক মুঠো বালি হাতে নিয়েشَاهَتِ الْوُجُوهُ(শত্রুদলের চেহারাগুলো বিগড়ে যাক) বলে কাফেরদের দিকে ছুড়ে দিলেন। এই সঙ্গে তার ইঙ্গিতে মুসলমানরা অকস্মাৎ কাফেরদের ওপর আক্রমণ করলো। এখানে এ ঘটনাটির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
১৫.
মক্কা থেকে রওয়ানা হবার সময় মুশরিকরা কাবা শরীফের পর্দা দু'হাতে আঁকড়ে ধরে দোয়া করেছিল, হে আল্লাহ! উভয় দলের মধ্যে যে দলটি ভাল তাকে বিজয় দান করো। আর আবু জেহেল বিশেষ করে বলেছিল, হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যে দলটি সত্য পথে আছে তাকে বিজয় দান করো এবং যে দলটি জুলুমের পথ অবলম্বন করেছে তাকে লাঞ্ছিত করো। বস্তুত আল্লাহ তাদের নিজ মুখে উচ্চারিত আবদার অক্ষরে অক্ষরে পূর্ণ করলেন এবং দুই দলের মধ্যে কোনটি ভাল ও সত্যপন্থী তার মীমাংসা করে দিলেন।