তিনি সাধারণ মুসলমানদের হুকুম দিলেন, আল্লাহর নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তাদের সাথে কোন প্রকার সামাজিক সম্পর্ক রাখা যাবে না। এ বিষয়টির ফয়সালা করার জন্য এ আয়াত নাযিল হয়। (এখানে একথাটি অবশ্যই) সামনে রাখতে হবে যে, ৯৯ টীকায় যে সাতজন সাহাবীর আলোচনা এসেছে তাদের ব্যাপারটি কিন্তু এদের থেকে স্বতন্ত্র। তারা তো জবাবদিহির আগেই নিজেরাই নিজেদের শাস্তি দিয়েছিলেন।
এ তিন জনের মধ্য থেকে হযরত কাব ইবনে মালেক অত্যন্ত বিস্তারিত ভাবে নিজের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। এ ঘটনা বড়ই শিক্ষাপ্রদ। বৃদ্ধ বয়সে তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এ সময় তার ছেলে আবদুল্লাহ তাকে হাত ধরে নিয়ে চলাফেরা করতেন। আবদুল্লাহকে তিনি নিজেই এ ঘটনা এভাবে শুনানঃ
তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে নবী (সা.) যখনই মুসলমানদেরকে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার আবেদন জানাতেন তখনই আমি মনে মনে সংকল্প করে নিতাম যে, যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নেবো। কিন্তু ফিরে এসে আমাকে অলসতায় পেয়ে বসতো এবং আমি বলতাম, এখনই এতো তাড়াহুড়া কিসের, রওয়ানা দেবার সময় যখন আসবে তখন তৈরী হতে কতটুকু সময়ই বা লাগবে। এভাবে আমার প্রস্তুতি পিছিয়ে যেতে থাকলো। তারপর একদিন সেনাবাহিনীর রওয়ানা দেবার সময় এসে গেল। অথচ তখনো আমি তৈরী ছিলাম না। আমি মনে মনে বললাম, সেনাবাহিনী চলে যাক, আমি এক দুদিন পরে পথে তাদের সাথে যোগ দেবো। কিন্তু তখনো একই অলসতা আমার পথের বাধা হয়ে দাঁড়ালো। এভাবে সময় পার হয়ে গেলো।
এ সময় যখন আমি মদীনায় থেকে গিয়েছিলাম আমার মন ক্রমেই বিষিয়ে উঠেছিল। কারণ আমি দেখছিলাম যাদের সাথে এ শহরে আমি রয়েছি তার হয়, মুনাফিক, নয়তো দুর্বল, বৃদ্ধ ও অক্ষম লোক, যাদেরকে আল্লাহ অব্যাহতি দিয়েছেন।
নবী (সা.) তাবুক থেকে ফিরে এসে যথারীতি মসজিদে প্রবেশ করে দু’রাকাত নফল নামায পড়লেন। তারপর তিনি লোকদের সাথে সাক্ষাত করার জন্য বসলেন। মুনাফিকরা এ মজলিসে এসে লম্বা লম্বা কসম খেয়ে তাদের ওযর পেশ করতে লাগলো। এদের সংখ্যা ছিল ৮০ এর চাইতেও বেশী। রসূলুল্লাহ ﷺ তাদের প্রত্যেকের বনোয়াট ও সাজানো কথা শুনলেন। তাদের লোক দেখানো ওযর মেনে নিলেন এবং তাদের অন্তরের ব্যাপার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, আল্লাহ তোমাদের মাফ করুন। তারপর আমার পালা এলো। আমি সামনে গিয়ে সালাম দিলাম। তিনি আমার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বললেন, আসুন! আপনাকে কিসে আটকে রেখেছিল? আমি বললাম, আল্লাহর কসম! যদি আমি কোন দুনিয়াদারের সামনে হাযির হতাম তাহলে অবশ্যই কোন না কোন কথা বানিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতাম। কথা বানিয়ে বলার কৌশল আমিও জানি। কিন্তু আপনার ব্যাপারে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি এখন কোন মিথ্যা ওযর পেশ করে আমি আপনাকে সন্তুষ্ট করেও নেই তাহলে আল্লাহ নিশ্চয়ই আপনাকে আমার প্রতি আবার নারাজ করে দেবেন। তবে যদি আমি সত্য বলি তাহলে আপনি নারাজ হয়ে গেলেও আমি আশা রাখি আল্লাহ আমার জন্য ক্ষমার কোন পথ তৈরী করে দেবেন। আসলে পেশ করার মতো, কোন ওযরই আমার নেই। যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে আমি পুরোপুরি সক্ষম ছিলাম। একথা শুনে রসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, এ ব্যক্তি সত্য কথা বলেছে। ঠিক আছে, চলে যাও এবং আল্লাহ তোমার ব্যাপারে কোন ফয়সালা না দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকো। আমি উঠে নিজের গোত্রের লোকদের মধ্যে গিয়ে বসলাম। এখানে সবাই আমার পিছনে লাগলো। তারা আমাকে এ বলে তিরস্কার করতে লাগলো যে, তুমি ও কোন মিথ্যা ওযর পেশ করলে না কেন এসব কথা শুনে আবার রসূলের কাছে গিয়ে কিছু বানোয়াট ওযর পেশ করার জন্য আমার মনে আগ্রহ সৃষ্টি হলো। কিন্তু যখন শুনলাম আরো দুজন সৎ লোক (মুরারাহ ইবনে রুবাই ও হেলাল ইবনে উমাইয়াহ) আমার মতো একই সত্য কথা বলেছেন তখন আমি মানসিক প্রশান্তি অনুভব করলাম এবং আমার সত্য কথার ওপর অটল থাকলাম।
এরপর নবী (সা.) সাধারণ হুকুম জারি করলেন, আমাদের তিন জনের সাথে কেউ কথা বলতে পারবে না। অন্য দুজন তো ঘরের মধ্যে বসে রইলো কিন্তু আমি বাইরে বের হতাম, জামায়াতে নামায পড়তাম এবং বাজারে ঘোরাফেরা করতাম। কিন্তু কেউ আমার সাথে কথা বলতো না। মনে হয়তো, এ দেশটি একদম বদলে গেছে। আমি যেন এখানে একজন অপরিচিত আগন্তুক। এ জনপদের কেউ আমাকে জানে না, চেনা না। মসজিদে নামায পড়তে গিয়ে যথারীতি নবী (সা.) কে সালাম করতাম। আমার সালামের জবাবে তার ঠোঁট নড়ে উঠছে কিনা তা দেখার জন্য আমি অপেক্ষা করতাম। কিন্তু শুধু অপেক্ষা করাই সার হতো। তার নজর আমার ওপর কিভাবে পড়ছে তা দেখার জন্য আমি আড়চোখে তার প্রতি তাকাতাম। কিন্তু অবস্থা ছিল এই যে, যতক্ষণ আমি নামায পড়তাম ততক্ষণ তিনি আমাকে দেখতে থাকতেন এবং যেই আমি নামায শেষ করতাম অমনি আমার ওপর থেকে তিনি চোখ ফিরিয়ে নিতেন। একদিন ঘাবড়ে গিয়ে আমার চাচাত ভাই ও ছেলে বেলার বন্ধু আবু কাতাদার কাছে গেলাম। তার বাগানের পাঁচিলের ওপর উঠে তাকে সালাম দিলাম। কিন্তু আল্লাহর সেই বান্দাটি আমার সালামের জবাবও দিলো না। আমি বললামঃ হে আবু কাতাদাহ! আমি তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি আমি কি আল্লাহ ও তার রসূলকে ভালবাসি না? সে নীরব রইলো। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, সে নীরব রইলো। তৃতীয়বার যখন আমি কসম দিয়ে তাকে এ প্রশ্ন করলাম তখন সে শুধুমাত্র এতটুকু বললোঃ আল্লাহ ও তার রসূলই ভাল জানেন। একথায় আমার চোখে পানি এসে গেলো। আমি পাঁচিল থেকে নেমে এলাম। এ সময় আমি একদিন বাজার দিয়ে যাচ্ছিলাম। এমন সময় সিরিয়ার নাবতী বংশীয় এক লোকের সাথে দেয়া হলো। সে রেশমে মোড়া গাসসান রাজার একটি পত্র আমার হাতে দিল। আমি পত্রটি খুলে পড়লাম। তাতে লেখা ছিল, আমরা শুনেছি, তোমার নেতা তোমার ওপর উৎপীড়ন করছে। তুমি কোন নগণ্য ব্যক্তি নও। তোমাকে ধ্বংস হতে দেয়া যায় না। আমাদের কাছে চলে এসো। আমরা তোমাকে মর্যাদা দান করবো। আমি বললাম, এ দেখি আর এক আপদ! তখনই চিঠিটাকে চুলোর আগুনে ফেলে দিলাম।
চল্লিশটা দিন এভাবে কেটে যাবার পর রসূলুল্লাহ ﷺ কাছে থেকে তার দূত এই হুকুম নিয়ে এলেন, যে নিজের স্ত্রী থেকে ও আলাদা হয়ে যাও। আমি জিজ্ঞেস করলাম তাকে কি তালাক দিয়ে দিবো? জবাব এলো, না, তালাক নয়। শুধু আলাদা থাকো। কাজেই আমি স্ত্রীকে বলে দিলাম, তুমি বাপের বাড়ি চলে যাও এবং আল্লাহ এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকো।
এভাবে উনপঞ্চাশ দিন পার হয়ে পঞ্চাশ দিন পড়লো। সেদিন সকালে নামাযের পরে আমি নিজের ঘরের ছাদের ওপর বসে ছিলাম। নিজের জীবনের প্রতি আমার ধিক্কার জাগছিল হঠাৎ এক ব্যক্তি চেঁচিয়ে বললোঃ কাব ইবনে মালিককে অভিনন্দন। একথা শুনেই আমি সিজদায় নত হয়ে গেলাম। আমি নিশ্চিত হলাম যে, আমার ক্ষমার ঘোষণা জারি হয়েছে। এরপর লোকেরা দলে দলে ছুটে আসতে লাগলো। তারা প্রত্যেকে পাল্লা দিয়ে আমাকে মুবারকবাদ দিচ্ছিল। তারা বলছিল তোমার তওবা কবুল হয়েছে। আমি উঠে সোজা মসজিদে নববীর দিকে গেলাম। দেখলাম, নবী (সা.) এর চেহারা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আমি সালাম দিলাম। তিনি বললেন, তোমাকে মোবারকবাদ! আজকের দিনটি তোমার জীবনের সর্বোত্তম দিন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ ক্ষমা কি আপনার পক্ষ থেকে না আল্লাহর পক্ষ থেকে? বললেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং এ সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট আয়াত শুনিয়ে দিলেন। আমি বললামঃ হে আল্লাহর রসূল! আমার সমস্ত ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে সদকা করে দিতে চাই। এটাও আমার তাওবার অংশ বিশেষ। বললেনঃ কিছু রেখে দাও, এটাই তোমার জন্য ভাল। এ বক্তব্য অনুযায়ী আমি নিজের খয়বরের সম্পত্তির অংশটুকু রেখে দিলাম। বাদবাকি সব সাদকা করে দিলাম। তারপর আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করলাম, যে সত্য কথা বলার কারণে আল্লাহ আমাকে মাফ করে দিয়েছেন তার ওপর আমি সারা জীবন প্রতিষ্ঠিত থাকবো। কাজেই আজ পর্যন্ত আমি জেনে বুঝে যথার্থ সত্য ও প্রকৃত ঘটনা বিরোধী কোন কথা বলিনি এবং আশা করি আল্লাহ আগামীতেও তা থেকে আমাকে বাঁচাবেন।
এ ঘটনার মধ্যে শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে। প্রত্যেক মু’মিনের মনে তা বদ্ধমূল হয়ে যাওয়া উচিত।
এ থেকে প্রথম যে শিক্ষাটি পাওয়া যায়, তা হচ্ছে, কুফর ও ইসলামের সংঘাতের ব্যাপারটি বড়ই গুরুত্বপূর্ণ ও নাজুক। এ সংঘাতে কুফরের সাথে সহযোগিতা করা তো দূরের কথা, যে ব্যক্তি ইসলামের সাথে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে অসৎ উদ্দেশ্যে নয়, সৎ উদ্দেশ্যে এবং সারা জীবনও নয় বরং কোন একসময় ভুল করে বসে, তারও সারা জীবনের ইবাদত-বন্দেগী ও দ্বীনদারী ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। এমনকি এমন উন্নত মর্যাদাসম্পন্ন লোকও পাকড়াও হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে না যে, বদর ওহোদ আহযাব ও হুনাইনের ভয়াবহ যুদ্ধ ক্ষেত্রে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করেছিল এবং যার ঈমানও আন্তরিকতার মধ্যে বিন্দুমাত্র খাদ ছিলো না।
দ্বিতীয় শিক্ষাটিও এর চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেটি হচ্ছে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে গড়িমসি করা কোন মামুলি ব্যাপার নয়। বরং অনেক সময় শুধুমাত্র গড়িমসি করতে করতে মানুষ এমন কোন ভুল করে বসে যা বড় বড় গোনাহের অন্তর্ভুক্ত। তখন একথা বলে সে নিষ্কৃতি পেতে পারে না। সে অসৎ উদ্দেশ্যে এ কাজটি করেনি।
নবী (সা.) এর নেতৃত্বে যে সমাজ গড়ে উঠেছিল। এ ঘটনা খুবই চমৎকারভাবে তার প্রাণসত্তা উন্মোচন করে দেয়। একদিকে রয়েছে মুনাফিকদের দল। তাদের বিশ্বাসঘাতকতা সবার কাছে সুস্পষ্ট ছিল। এরপরও তাদের বাহ্যিক ওযরসমূহ শোনা হয় এবং সেগুলোর সত্যাসত্য এড়িয়ে যাওয়া হয়। কারণ তাদের কাছ থেকে তো আন্তরিকতার আশাই করা হয়নি কোন দিন। কাজেই এখন আন্তরিকতার অভাব নিয়ে অভিযোগ তোলার কোন প্রশ্নই ওঠে না। অন্যদিকে রয়েছেন একজন পরীক্ষিত মু’মিন। তার উৎসর্গীত প্রাণ কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কারো মনে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশই নেই। তিনি মিথ্যা ও বলেন না। দ্ব্যর্থ হীন ভাষায় নিজের ভুল স্বীকার করে নেন। কিন্তু তার ওপর ক্রোধ বর্ষিত হয়। এ ক্রোধের কারণ এ নয় যে, তার মু’মিন হবার ব্যাপারে সন্দেহ দেখা দিয়েছে বরং এর কারণ হচ্ছে, মু’মিন হওয়া সত্ত্বেও সে মুনাফিক সুলভ কাজ করলো কেন? আসলে এভাবে তাকে একথাই বলা হচ্ছে, যে, তোমরাই পৃথিবীর সার বস্তু। তোমাদের থেকে যদি মৃত্তিকা উর্বরতা লাভ করতে না পারে তাহলে উর্বরতা কোথা থেকে আসবে? তারপর মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ পুরো ঘটনায় নেতা যেভাবে শাস্তি দিচ্ছেন এবং ভক্ত যেভাবে তা মাথা পেতে নিচ্ছেন আর এ সাথে সমগ্র দলটি যেভাবে এ শাস্তি কার্যকর করছে তার প্রত্যেকটি দিকই তুলনাবিহীন। এক্ষেত্রে কে বেশী প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য তা স্থির করাই কঠিন। নেতা অত্যন্ত কঠোর শাস্তি দিচ্ছেন। কিন্তু সেখানে ক্রোধ বা ঘৃণার লেশমাত্র নেই। বরং গভীর স্নেহ ও প্রীতি সহকারে তিনি শাস্তি দিচ্ছেন। ক্রুদ্ধ পিতার ন্যায় তার দৃষ্টি একদিকে অনল বর্ষণ করে চলেছে ঠিকই কিন্তু অন্য দিকে আবার তাকে প্রতি মুহূর্তে একথা জনিয়ে দিচ্ছে যে, তোমার সাথে কোন শত্রুতা নেই বরং তোমার ভুলের কারণে আমার অন্তরটা ব্যাথায় টনটন করছে। তুমি নিজের ভুল শুধরে নিলে তোমাকে এ বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য আমি ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করছি। ভক্ত শাস্তির তীব্রতায় অস্থির হয়ে পড়ছে। কিন্তু তার পদযুগল আনুগত্যের রাজপথ থেকে এক চুল পরিমাণও টলছে না। সে আত্মম্ভরিতা ও জাহেলী দাম্ভিকতারও শিকার হচ্ছে না এবং প্রকাশ্যে অহংকার করে বেড়ানোর তো দূরের কথা, এমনকি নিজের প্রিয় নেতার বিরুদ্ধে মনের গভীরে সামান্যতম অভিযোগও সৃষ্টি হতে দিচ্ছে না। বরং নেতার প্রতি ভালবাসায় তার মন আরো ভরে উঠেছে। শাস্তির পুরো পঞ্চাশ দিন তার দৃষ্টি সবচেয়ে বেশী অধীর হয়ে যে জিনিসটি খুজে বেড়িয়েছে, সেটি হচ্ছে, নেতার চোখে তার প্রতি আগের সেই মমত্ব পূর্ণ দৃষ্টি বহাল আছে কিনা, যা তার সমস্ত আশা আকাংখার শেষ আশ্রয় স্থল। সে যেন একজন দুর্ভিক্ষপীড়িত কৃষক। আকাশের এক কিনারে যে ছোট্ট এক টুকরো মেঘ দেখা যাচ্ছে। সেটিই তার সমস্ত আশার একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু। তারপর দলের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে যে, তার অভূতপূর্ব শৃংখলা বিরাজিত যে, নেতার মুখ থেকে বয়কটের নির্দেশ উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই অপরাধীর ওপর থেকে দলের সমস্ত লোক দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছে। প্রকাশ্যে তো দূরের কথা গোপনেও কোন নিকটতম আত্মীয় এবং সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধুও তার সাথে কথা বলছে না। স্ত্রীও তার থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর দোহাই দিয়ে সে জিজ্ঞেস করছে, আমার আন্তরিকতায় কি তোমাদের কোন সন্দেহ জেগেছে? কিন্তু যারা দীর্ঘকাল তাকে আন্তরিক দেখে আসছিল তারা পরিষ্কার বলে দিচ্ছেঃ আমাদের কাছ থেকে নয়, আল্লাহ ও তার রসূলের কাছ থেকে নিজের আন্তরিকতার সনদ নাও। অন্যদিকে দলের নৈতিক প্রাণসত্তা এত বেশী উন্নত ও পবিত্র যে, এক ব্যক্তির উচু মাথা নীচু হবার সাথে সাথেই নিন্দুকদের কোন দল তার নিন্দায় সোচ্চার হয়ে উঠে না। বরং শাস্তির এ পুরো সময়টায় দলের প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের এ সাজাপ্রাপ্ত ভাইয়ের বিপদে মর্মবেদনা অনুভব করে এবং পুনরায় তাকে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য ব্যকুল থাকে। ক্ষমার কথা ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথেই লোকেরা অতি দ্রুত তার কাছে পৌঁছে তার সাথে সাক্ষাত করার এবং তাকে সুসংবাদ দেবার জন্য দৌড়াতে থাকে। কুরআন যে ধরনের সত্যনিষ্ঠা দল দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করতে চায় এটি হচ্ছে তারই দৃষ্টান্ত।
এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখিত আয়াত বিশ্লেষণ করলে আমাদের কাছে একথাটি সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, এ সাহাবীগণ আল্লাহর দরবার থেকে যে ক্ষমা লাভ করেছিলেন এবং সেই ক্ষমার কথা বর্ণনা করার ভাষায় মধ্যে যে স্নেহ ও করুণা ধারা প্রবাহিত হচ্ছে তার মূলে রয়েছে তাদের আন্তরিকতা। পঞ্চাশ দিনের কঠোর শাস্তি ভোগকালে তারা এ আন্তরিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। ভুল করার পর যদি তারা অহংকার করতেন, নিজেদের নেতার অসন্তোষের জবাবে ক্রোধ ও ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাতেন, শাস্তি লাভের ফলে এমনই বিক্ষুদ্ধ হতেন যেমন স্বার্থবাদী লোকদের আত্মাভিমানে আঘাত লাগলে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সামাজিক বয়কট কালে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে রাজি। কিন্তু নিজের আত্মাভিমানকে আহত করতে রাজি নই-এ নীতি অবলম্বন করতেন এবং যদি এ সমগ্র শাস্তি কালে দলের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে বেড়াতেন এবং অসন্তুষ্ট ও বিক্ষুব্ধ লোকদের খুঁজে বের করে এক সাথে মিলিয়ে জোটবদ্ধ করতেন, তাহলে তাদের ক্ষমা করা তো দূরের কথা বরং নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, দল থেকে তাদেরকে আলাদা করে দেয়া হতো এবং এ শাস্তির মেয়াদ শেষ হবার পর তাদের যোগ্য শাস্তিই তাদেরকে দেয়া হতো। তাদেরকে বলা হতো, যাও তোমরা নিজেদের অহম পূজায় লিপ্ত থাকো। সত্যের কালেমা বুলন্দ করার সংগ্রামে অংশ নেবার সৌভাগ্য তোমাদের আর কখনো হবে না।
কিন্তু এ কঠিন পরীক্ষায় ঐ তিনজন সাহাবী এ পথ অবলম্বন করেননি, যদিও এ পথটি তাদের জন্য খোলা ছিল। তারা বরঞ্চ আমাদের আলোচিত পূর্বোক্ত পথ অবলম্বন করেছিলেন। এ পথ অবলম্বন করে তারা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে, আল্লাহর আনুগত্যের নীতি তাদের হৃদয় থেকে পূজা ও বন্দনা করার মতো সকল মূর্তি অপসারিত করেছে। নিজেদের সমগ্র ব্যক্তিসত্তাকে তারা আল্লাহর পথে সাধনা করার জন্য নিয়োজিত করে দিয়েছে। নিজেদের ফিরে যাবার নৌকা গুলোকে এমনভাবে জ্বালিয়ে দিয়ে ইসলামী জামায়াতে প্রবেশ করেছিলেন যে, পেছনে ফিরে যেতে চাইলেও আর ফেরার কোন জায়গা ছিল না। এখানেই মার খাবেন এবং এখানেই মরবেন। অন্য কোথাও কোন বৃহত্তম সম্মান ও মর্যাদা লাভের নিশ্চয়তা পেলেও এখানকার লাঞ্ছনা ত্যাগ করে তা গ্রহণ করতে এগিয়ে যাবেন না। এরপর তাদেরকে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে না ধরে আর কী করা যেতো? এ কারণেই আল্লাহ তাদের ক্ষমার কথা বলেছেন অত্যন্ত স্নেহ মাখা ভাষায়। তিনি বলেছেনঃ আমি তাদের দিকে ফিরলাম যাতে তারা আমার দিকে ফিরে আসে। এ কয়েকটি শব্দের মাধ্যমে এমন একটি অবস্থার ছবি আঁকা হয়েছে যা থেকে বুঝা যায় যে, প্রভু আগে এ বান্দাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু যখন তারা পালিয়ে না গিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে তারই দোরগাড়ায় বসে পড়লো তখন তাদের বিশ্বস্ততার চিত্র দেখে প্রভু নিজে আর স্থির থাকতে পারলেন না। প্রেমের আবেগে অধীর হয়ে তাকে দরজা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাবার জন্য তিনি নিজেই বের হয়ে এলেন।