ٱلْأَعْرَابُ أَشَدُّ كُفْرًۭا وَنِفَاقًۭا وَأَجْدَرُ أَلَّا يَعْلَمُوا۟ حُدُودَ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ عَلَىٰ رَسُولِهِۦ ۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌۭ
এ বেদুইন আরবরা কুফরী ও মুনাফিকীতে বেশী কঠোর এবং আল্লাহ তাঁর রসূলের প্রতি যে দ্বীন নাযিল করেছেন তার সীমারেখা সম্পর্কে তাদের অজ্ঞ হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। ৯৫ আল্লাহ সবকিছু জানেন, তিনি জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়।
৯৫
আমরা আগেই বলে এসেছি, বেদুঈন আরব বলতে এখানে গ্রামীণ ও মরুবাসীদের কথা বলা হয়েছে। এরা মদীনার আশপাশে বসবাস করতো। মদীনায় একটি মজবুত ও সংগঠিত শক্তির উত্থান ঘটতে দেখে এরা প্রথমে শংকিত হয়। তারপর ইসলাম ও কুফরের সংঘাতকালে বেশ কিছুকাল তারা সুযোগ সন্ধানী নীতি অবলম্বন করতে থাকে। এরপর ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব হেজায ও নজদের একটি বড় অংশ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে এবং তার মোকাবিলায় বিরোধী গোত্রগুলোর শক্তি ভেঙ্গে পড়তে থাকলে তারা ইসলামের গণ্ডির মধ্যে প্রবেশ করাকেই সে সময় নিজেদের জন্য সুবিধাজনক ও নিরাপদ মনে করে। কিন্তু তাদের মধ্যে খুব কম লোকই ইসলামকে যথার্থ আল্লাহর সত্য দ্বীন মনে করে সাচ্চা দিলে ঈমান আনে এবং আন্তরিকতার সাথে তার দাবীসমূহ পূর্ণ করতে উদ্যোগী হয়। অধিকাংশ বেদুঈনের জন্য ইসলাম গ্রহণ করা ঈমান ও আকিদার ব্যাপার নয় বরং নিছক স্বার্থ, সুবিধা ও কৌশলের ব্যাপার ছিল। তারা চাচ্ছিল, ক্ষমতাসীন দলের সদস্যপদ লাভ করার ফলে যেসব সুবিধা ভোগ করা যায় শুধু সেগুলোই তাদের ভাগে এসে যাক। কিন্তু ইসলাম তাদের ওপর যেসব নৈতিক বিধি-নিষেধ আরোপ করেছিল ইসলাম গ্রহণ করার পরপরই তাদের ওপর নামায পড়ার ও রোযা করার যে বিধান আরোপিত হতো, যথারীতি তহশীলদার নিযুক্ত করে তাদের খেজুর বাগান ও শস্যগুলো থেকে যে যাকাত উসূল করা হতো, তাদের জাতীয় ইতিহাসে এ প্রথম বারের মতো তাদেরকে যে আইন-শৃংখলার রশিতে শক্তভাবে বাঁধা হয়েছিল এবং লুটতরাজের যুদ্ধের জন্য নয় বরং খালেস আল্লাহর পথে জিহাদের জন্য দিনের পর দিন তাদের কাছে থেকে যে জানমালের কুরবানী চাওয়া হচ্ছিল-এসব জিনিস তাদের কাছে ছিল অতিশয় অপ্রীতিকর, বিরক্তিকর এবং এগুলোর হাত থেকে বাঁচার জন্য তারা নানা ধরনের চালবাজী ও টালবাহানার আশ্রয় নিতো। সত্য কি এবং তাদের ও সমস্ত মানুষের যথার্থ কল্যাণ কিসে, তা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথা ছিল না। তারা শুধুমাত্র নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ, নিজেদের আয়েশ-আরাম, নিজেদের জমি, উট, ছাগল-ভেড়া এবং নিজেদের তাঁবুর চারপাশের জগত নিয়ে মাথা ঘামাতো। এ ঊর্ধ্বের কোন জিনিসের প্রতি তাদের কোন আকর্ষণ ছিল না। অবশ্য পীর-ফকীরদের কাছে যেমন নযরানা পেশ করা হয় এবং তার বিনিময়ে তারা আয় বৃদ্ধি, বিপদ থেকে নিষ্কৃতি এবং এ ধরনের আরো বিভিন্ন উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য ঝাড়ফূঁক করেন, তাবীজ দেন ও তাদের জন্য দোয়া করেন ঠিক তেমনি ধরনের কোন কাল্পনিক জিনিসের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা পোষণের প্রবণতা হয়তো তাদের ছিল। কিন্তু এমন কোন ঈমান ও আকীদার জন্য তারা তৈরী ছিলো না, যা তাদের সমগ্র তামাদ্দুনিক ও সামাজিক জীবনকে একটি নৈতিক ও আইনগত বাঁধনে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলবে এবং এ সঙ্গে একটি বিশ্বজনীন সংস্কার কার্যক্রমের জন্য তাদের কাছে জান-মালের কুরবানীরও দাবী জানাবে।
তাদের এ অবস্থাটিকেই এখানে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, নগরবাসীদের তুলনায় এ গ্রামীন ও মরুবাসী লোকেরাই বেশী মুনাফিকী ও ভণ্ডালীর আচরণ অবলম্বন করে থাকে এবং সত্যকে অস্বীকার করার প্রবণতা এদের মধ্যে বেশী দেখা যায়। আবার এর কারণও বলে দেয়া হয়েছে যে, নগরবাসীরা তো জ্ঞানীগুণী ও সত্যানুসারী লোকদের সাহচর্যে এসে দ্বীন ও তার বিধি-বিধান সম্পর্কে কিছু না কিছু জ্ঞান লাভ করতেও পারে কিন্তু এ বেদুইনরা যেহেতু সারাটা জীবন নিরেট খাদ্যন্বেষী জীব-জানোয়ারের মতো দিন রাত কেবল রুজী রোজগারের ধান্দায় লেগে থাকে এবং পশু জীবনের প্রয়োজনের চাইতে উন্নত পর্যায়ের কোন জিনিসের প্রতি দৃষ্টি দেবার সময়ই তাদের থাকে না, তাই ইসলাম ও তার বিধি-বিধান সম্পর্কে তাদের অজ্ঞ থাকার সম্ভাবনাই বেশী।
এখানে এ বাস্তব সত্যটির প্রতি ইঙ্গিত করাও অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, এ আয়াতগুলো নাযিলের প্রায় দু'বছর পর হযরত আবু বকরের (রা.) খিলাফতের প্রাথমিক যুগে মুরতাদ হওয়ার ও যাকাত বর্জনের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল আলোচ্য আয়াতগুলোতে বর্ণিত ও কারণটি তার অন্যতম ছিল।