আত তওবা

১২৯ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
আয়াত
-
১২১ ) অনুরূপভাবে তারা যখনই (আল্লাহর পথে) কম বা বেশী কিছু সম্পদ ব্যয় করবে এবং (সংগ্রাম সাধনায়) যখনই কোন উপত্যকা অতিক্রম করবে, অমনি তা তাদের নামে লেখা হয়ে যাবে, যাতে আল্লাহ‌ তাদেরকে তাদের এ ভাল কাজের পুরস্কার দান করেন।
وَلَا يُنفِقُونَ نَفَقَةً صَغِيرَةً وَلَا كَبِيرَةً وَلَا يَقْطَعُونَ وَادِيًا إِلَّا كُتِبَ لَهُمْ لِيَجْزِيَهُمُ ٱللَّهُ أَحْسَنَ مَا كَانُوا۟ يَعْمَلُونَ ١٢١
১২২ ) আর মুমিনদের সবার এক সাথে বের হয়ে পড়ার কোন দরকার ছিল না। কিন্তু তাদের জনবসতির প্রত্যেক অংশের কিছু লোক বেরিয়ে এলে ভাল হতো। তারা দ্বীন সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করতো এবং ফিরে গিয়ে নিজের এলাকার লোকদের কে সতর্ক করতো, যাতে তারা (অমুসলমানী আচরণ থেকে) বিরত থাকতো, এমনটি হলো না কেন? ১২০
وَمَا كَانَ ٱلْمُؤْمِنُونَ لِيَنفِرُوا۟ كَآفَّةً فَلَوْلَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَآئِفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُوا۟ فِى ٱلدِّينِ وَلِيُنذِرُوا۟ قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوٓا۟ إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ ١٢٢
১২৩ ) হে ঈমানদারগণ! সত্য অস্বীকারকারীদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তীতাদের সাথে যুদ্ধ করো। ১২১ তারা যেন তোমাদের মধ্যে কঠোরতা দেখতে পায়। ১২২ জেনে রাখো আল্লাহ‌ মুত্তাকীদের সাথে আছেন। ১২৩
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ قَٰتِلُوا۟ ٱلَّذِينَ يَلُونَكُم مِّنَ ٱلْكُفَّارِ وَلْيَجِدُوا۟ فِيكُمْ غِلْظَةً وَٱعْلَمُوٓا۟ أَنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلْمُتَّقِينَ ١٢٣
১২৪ ) যখন কোন নতুন সূরা নাযিল হয় তখন তাদের কেউ কেউ (ঠাট্টা করে মুসলমানদের) জিজ্ঞেস করে, বলো, এর ফলে তোমাদের কার ঈমান বেড়ে গেছে? (এর জবাব হচ্ছে) যারা ঈমান এনেছে (প্রত্যেকটি অবতীর্ণ সুরা) যথার্থই ঈমান বাড়িয়েই দিয়েছে এবং তারা এর ফলে আনন্দিত।
وَإِذَا مَآ أُنزِلَتْ سُورَةٌ فَمِنْهُم مَّن يَقُولُ أَيُّكُمْ زَادَتْهُ هَٰذِهِۦٓ إِيمَٰنًا فَأَمَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ فَزَادَتْهُمْ إِيمَٰنًا وَهُمْ يَسْتَبْشِرُونَ ١٢٤
১২৫ ) তবে যাদের অন্তরে (মুনাফিকী) রোগ বাসা বেঁধেছিল তাদের পূর্ব কলুষতার ওপর (প্রত্যেকটি নতুন সূরা) আরো একটি কলুষতা বাড়িয়ে দিয়েছে ১২৪ এবং তারা মৃত্যু পর্যন্ত কুফরীতে লিপ্ত রয়েছে।
وَأَمَّا ٱلَّذِينَ فِى قُلُوبِهِم مَّرَضٌ فَزَادَتْهُمْ رِجْسًا إِلَىٰ رِجْسِهِمْ وَمَاتُوا۟ وَهُمْ كَٰفِرُونَ ١٢٥
১২৬ ) এরা কি দেখে না, প্রতি বছর এদেরকে দুএকটি পরীক্ষার মুখোমুখি করা হয়? ১২৫ কিন্তু এরপরও এরা তাওবাও করে না কোন শিক্ষাও গ্রহণ করে না।
أَوَلَا يَرَوْنَ أَنَّهُمْ يُفْتَنُونَ فِى كُلِّ عَامٍ مَّرَّةً أَوْ مَرَّتَيْنِ ثُمَّ لَا يَتُوبُونَ وَلَا هُمْ يَذَّكَّرُونَ ١٢٦
১২৭ ) যখন কোন সূরা নাযিল হয়, এরা চোখের ইশারায় একে অন্যকে জিজ্ঞেস করে, তোমাদের কেউ দেখতে পায়নি তো? তারপর চুপে চুপে সরে পড়ে। ১২৬ আল্লাহ তাদের মন বিমুখ করে দিয়েছেন কারণ তারা এমন একদল লোক যাদের বোধশক্তি নেই। ১২৭
وَإِذَا مَآ أُنزِلَتْ سُورَةٌ نَّظَرَ بَعْضُهُمْ إِلَىٰ بَعْضٍ هَلْ يَرَىٰكُم مِّنْ أَحَدٍ ثُمَّ ٱنصَرَفُوا۟ صَرَفَ ٱللَّهُ قُلُوبَهُم بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَّا يَفْقَهُونَ ١٢٧
১২৮ ) দেখো, তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকে একজন রসূল। তোমাদের ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া তার জন্য কষ্টদায়ক। সে তোমাদের কল্যাণকামী। মুমিনদের প্রতি সে স্নেহশীল ও করুণাসিক্ত।
لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُم بِٱلْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ ١٢٨
১২৯ ) - এখন যদি তারা তোমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে হে নবী! তাদেরকে বলে দাও, “আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। আমি তার ওপরই ভরসা করেছি এবং তিনি মহা আরশের অধিপতি।”
فَإِن تَوَلَّوْا۟ فَقُلْ حَسْبِىَ ٱللَّهُ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ ٱلْعَرْشِ ٱلْعَظِيمِ ١٢٩
১২০.
এ আয়াতের অর্থ অনুধাবন করার জন্য এ সূরার ৯৭ আয়াতটি সামনে রাখতে হবে। তাতে বলা হয়েছেঃ

“মরুচারী আরবরা কুফরী ও মুনাফিকীতে অপেক্ষাকৃত শক্ত এবং আল্লাহ‌ তার রসূলের প্রতি যে দ্বীন নাযিল করেছেন তা সীমারেখা সম্পর্কে তাদের অজ্ঞ হওয়ার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত বেশী।”

সেখানে শুধু এতটুকু বলেই শেষ করা হয়েছিল যে, দারুল ইসলামের গ্রামীণ এলাকার বেশীরভাগ জনবসতি মুনাফিকী রোগে আক্রান্ত। কারণ এসব লোক অজ্ঞতার মধ্যে ডুবে আছে। জ্ঞানের কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ না থাকা এবং জ্ঞানবানদের সাহচর্যে না পাওয়ার ফলে এরা আল্লাহর দ্বীনের সীমারেখা জানে না। আর এখানে বলা হচ্ছে, গ্রামীণ জনবসতিকে এ অবস্থায় থাকতে দেয়া যাবে না। বরং তাদের অজ্ঞতা দূর এবং তাদের মধ্যে ইসলামী চেতনা সৃষ্টি করার জন্য এখন যথাযথ ব্যবস্থা হওয়া দরকার। এ জন্য গ্রামীণ এলাকার সমস্ত আরব অধিবাসীদের নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে মদীনায় জামায়েত হবার এবং এখানে বসে জ্ঞান অর্জন করার প্রয়োজন নেই। বরং এ জন্য প্রয়োজন হচ্ছে, প্রত্যেক গ্রাম, পল্লী ও গোত্র থেকে কয়েকজন করে লোক বের হবে। তারা জ্ঞানের কেন্দ্রগুলো যেমন মদীনা ও মক্কা এবং এ ধরনের অন্যান্য জায়গায় আসবে। এখানে এসে তারা দ্বীনের জ্ঞান আহরণ করবে। এখান থেকে তারা নিজেদের জনবসতিতে ফিরে যাবে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্বীনি চেতনা ও জাগরণ সৃষ্টিতে তৎপর হবে।

এটি ছিল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ। ইসলামী আন্দোলনকে শক্তিশালী ও মজবুত করার জন্য সঠিক সময়ে এ নির্দেশটি দেয়া হয়েছিল। শুরুতে ইসলাম যখন আরবে ছিল একেবারেই নতুন এবং একটি চরম প্রতিকূল পরিবেশে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল তখন এ ধরনের নির্দেশের প্রয়োজন ছিল না। কারণ তখন যে ব্যক্তি ইসলাম কে পুরোপুরি বুঝে নিতো এবং সব দিকে দিয়ে তাকে যাচাই করে নিশ্চিত হতে পারতো একমাত্র সে ই ইসলাম গ্রহণ করতে। কিন্তু যখন এ আন্দোলন সাফল্যের পর্যায়ে প্রবেশ করলো এবং পৃথিবীতে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো তখন দলে দলে লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো এবং এলাকার পর এলাকা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিতে থাকলো। এ সময় খুব কম লোকই ইসলামের যাবতীয় চাহিদাও দাবী অনুধাবন করে ভালভাবে জেনে বুঝে ইসলাম গ্রহণ করতো। বেশীর ভাগ লোকই নিছক অবচেতনভাবে, সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে চলে আসছিল। নতুন মুসলিম জনবসতির এ দ্রুত বিস্তার বাহ্যত ইসলামের শক্তিমত্তার কারণ ছিল। কেননা ইসলামের অনুসারীদের সংখ্যা বেড়ে চলছিল। কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের জনবসতি ইসলামী ব্যবস্থার কোন কাজে লাগছিল না বরং তার জন্য ক্ষতিকর ছিল। কারণ তাদের ইসলামী চেতনা ছিল না এবং এ ব্যবস্থার নৈতিক দাবী পূরণ করতেও তারা প্রস্তুত ছিল না। বস্তুত তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতির সময় এ ক্ষতি সুস্পষ্ট আকারে সামনে এসে গিয়েছিল। তাই সঠিক সময়ে মহান আল্লাহ‌ নির্দেশ দিলেন, ইসলামী আন্দোলনের বিস্তৃতির কাজ যে গতিতে চলছে তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তাকে শক্তিশালী ও মজবুত করার ব্যবস্থা করতে হবে। আর সে ব্যবস্থাটি হচ্ছে, প্রত্যেক এলাকার লোকদের মধ্য থেকে কিছু লোককে নিয়ে শিক্ষা ও অনুশীলন দান করতে হবে, তারপর তারা প্রত্যেকে নিজেদের এলাকায় ফিরে গিয়ে সাধারণ মানুষের শিক্ষা ও অনুশীলনের দায়িত্ব পালন করবে। এভাবে সমগ্র মুসলিম জনবসতিতে ইসলামের চেতনা ও আল্লাহর বিধানের সীমারেখা সম্পর্কিত জ্ঞান ছড়িয়ে পড়বে।

এ প্রসঙ্গে এতটুকু কথা অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে যে, এ আয়াতে যে সাধারণ শিক্ষার ব্যবস্থা করার হুকুম দেয়া হয়েছে তার আসল উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষকে নিছক সাক্ষরতা সম্পন্ন করা এবং এদের মধ্যে বইপত্র পড়ার মতো যোগ্যতা সৃষ্টি করা ছিল না। বরং লোকদের মধ্যে দ্বীনের বোধ ও জ্ঞান সৃষ্টি করা এবং তাদেরকে অমুসলিম সুলভ জীবনধারা থেকে রক্ষা করা, সতর্ক ও সজ্ঞান করে তোলা এর আসল উদ্দেশ্য হিসেবে সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়েছিল। এটিই মুসলমানদের শিক্ষার উদ্দেশ্য। মহান আল্লাহ‌ নিজেই চিরকালের জন্য এ উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। প্রত্যেকটি শিক্ষা ব্যবস্থাকে এ দৃষ্টিকোণ থেকে যাচাই করতে হবে। দেখতে হবে এ উদ্দেশ্য সে কতটুকু পূরণ করতে সক্ষম। এর অর্থ এ নয় যে, ইসলাম লোকদেরকে লেখা-পড়া শেখাতে, বই পড়তে সক্ষম করতে তুলতে ও পার্থিব জ্ঞান দান করতে চায় না। বরং এর অর্থ হচ্ছে, ইসলাম লোকদের মধ্যে এমন শিক্ষা বিস্তার করতে চায় যা ওপরে বর্ণিত শিক্ষালাভের জন্য সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত আসল উদ্দেশ্যের দিকে মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়। নয়তো প্রত্যেক ব্যক্তি যদি তার যুগের আইনস্টাইন ও ফ্রয়েড হয়ে যায় কিন্তু দ্বীনের জ্ঞানের ক্ষেত্রে তারা শূন্যের কোঠায় অবস্থান করে এবং অমুসলিম সুলভ জীবনধারায় বিভ্রান্ত হতে থাকে তাহলে ইসলাম এ ধরনের শিক্ষার ওপর অভিশাপ বর্ষণ করে।

এ আয়াতে উল্লেখিত لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ(লিয়াতাফাক্কাহু ফিদ্দ্বীন) বাক্যাংশটির ফলে পরবর্তীকালে লোকদের মধ্যে আশ্চর্য ধরনের ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়ে গেছে। মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা বরং তাদের ধর্মীয় জীবনধারার ওপর এর বিষময় প্রভাব দীর্ঘকাল থেকে মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। আল্লাহ‌ “তাফাক্কুহ্ ফিদ্ দ্বীন” কে শিক্ষার উদ্দেশ্যে পরিণত করেছিলেন। এর অর্থ হচ্ছেঃ দ্বীন অনুধাবন করা বা বুঝা, দ্বীনের ব্যবস্থা সম্পর্কে গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তি ও অন্তর্দৃষ্টি লাভ করা, তার প্রকৃতি ও প্রাণশক্তির সাথে পরিচিত হওয়া এবং এমন যোগ্যতার অধিকারী হওয়া যার ফলে চিন্তা ও কর্মের সকল দিক ও জীবনের প্রত্যেকটি বিভাগে কোন চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি ইসলামের প্রাণশক্তির অনুসারী ত মানুষ জানতে পারে। কিন্তু পরবর্তীকালে যে আইন সম্পর্কিত জ্ঞান পারিভাষিক অর্থে ফিকহ নামে পরিচিত হয় এবং যা ধীরে ধীরে ইসলামী জীবনের নিছক বাহ্যিক কাঠামোর (প্রাণশক্তির মোকাবিলায়) বিস্তারিত জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, লোকেরা শাব্দিক অভিন্নতার কারণে তাকেই আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী শিক্ষার চরম ও পরম লক্ষ মনে করে বসেছে। অথচ সেটিই সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নয়। বরং তা ছিল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের একটি অংশ মাত্র। এ বিরাট ভুল ধারণার ফলে দ্বীন ও তার অনুসারীদের যে ক্ষতি হয়েছে তা বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করতে হলে একটি বিরাট গ্রন্থের প্রয়োজন। কিন্তু এখানে আমরা এ সম্পর্কে সতর্ক করে দেবার জন্য সংক্ষেপে শুধুমাত্র এতটুকু ইঙ্গিত করছি যে, মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষাকে যে জিনিসটি দ্বীনি প্রাণশক্তি বিহীন করে নিছক দ্বীনি কাঠামো ও দ্বীনি আকৃতির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে এবং অবশেষে যার বদৌলতে মুসলমানদের জীবনে একটি নিছক প্রাণহীন বাহ্যিকতা দ্বীনদারীর শেষ মনজিলে পরিণত হয়েছে তা বহুলাংশে এ ভুল ধারণারই ফল।

১২১.
মূল আয়াতে যে শব্দ সংযোজিত হয়েছে তার বাহ্যিক অর্থ হচ্ছে, দারুল ইসলামের যে অংশ ইসলামের শত্রুদের এলাকার যে অংশের সাথে মিশে আছে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রাথমিক দায়িত্ব ঐ অংশের মুসলমানদের ওপর আরোপিত। কিন্তু পরে যা বলা হয়েছে তার সাথে-এ আয়াতটিকে মিলিয়ে পড়লে জানা যাবে, এখানে কাফের বলতে এমন সব মুনাফিককে বুঝানো হয়েছে যাদের সত্য অস্বীকার করার বিষয়টি পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে সামনে এসে গিয়েছিল এবং যাদের ইসলামী সমাজের মধ্যে মিশে একাকার হয়ে থাকার কারণে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছিল। ১০ রুকূর শুরুতেও এ ভাষণটি আরম্ভ করার সময় প্রথম কথার সূচনা এভাবেই করা হয়েছিলঃ এবার এ ঘরের শত্রুদের প্রতিহত করার জন্য যথারীতি জিহাদ শুরু করে দিতে হবে। এখানে ভাষণ শেষ করার সময় তাকীদ সহকারে সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। এভাবে মুসলমানরা এর গুরুত্ব অনুধাবন করবে। যে আত্মীয়তা এবং বংশগত ও সামাজিক সম্পর্কের কারণে তারা মুনাফিকদের সাথে সম্পর্ক জুড়ে ছিল এরপর আর তারা তাদের সাথে ঐ সম্পর্কের পরোয়া করবে না। সেখানে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার হুকুম দেয়া হয়েছিল। আর এখানে তার চেয়ে কড়া “কিতাল” শব্দ (সশস্ত্র যুদ্ধ করে হত্যা করা) ব্যবহার করা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, তাদেরকে পুরোপুরি উৎখাত করে দও, তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার ব্যাপারে যেন কোন প্রকার ত্রুটি না থাকে। সেখানে কাফের ও মুনাফিক দুটো আলাদা শব্দ বলা হয়েছিল। আর এখানে শুধুমাত্র কাফের শব্দের ওপরই নির্ভর করা হয়েছে। কারণ তাদের সত্য অস্বীকৃতি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছিল। কাজেই ঈমানের বাহ্যিক স্বীকৃতির অন্তরালে আত্মগোপন করে তা যেকোন প্রকার সুবিধা আদায় করতে না পারে একথাটি ব্যক্ত করাই এর উদ্দেশ্য।
১২২.
অর্থাৎ এ পর্যন্ত তাদের সাথে যে নরম ব্যবহার করা হয়েছে তার এখন পরিসমাপ্তি হওয়া উচিত। দশ রুকূর শুরুতে একথাটিই বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْতাদের সাথে কঠোর ব্যবহার করো।
১২৩.
এ সতর্ক বাণীর দু’টি অর্থ হয়। দুটো অর্থই এখানে সমানভাবে প্রযোজ্য। এক, এ সত্য অস্বীকারকারীদের ব্যাপারে যদি তোমরা নিজেদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের পরোয়া করো তাহলে এটা হবে তাকওয়া বিরোধী। কারণ মুত্তাকী হওয়া এবং আল্লাহর দুশমনদের সাথে মানসিক সম্পর্ক রাখা-এ দুটো বিষয় পরস্পর বিরোধী। কাজেই আল্লাহর সাহায্য পেতে হলে এ ধরনের সম্পর্ক থেকে দূরে থাকতে হবে। দুই, এ কঠোরতা ও যুদ্ধ করার যে হুকুম দেয়া হচ্ছে, এর অর্থ এ নয় যে, তাদের প্রতি কঠোর হবার ব্যাপারে নৈতিকতা ও মানবিকতার সমস্ত সীমারেখা ভেঙ্গে ফেলতে হবে। সমস্ত কাজে আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা অটুট রাখার দায়িত্ব অবশ্যই মানুষের ওপর বর্তায়। মানুষ যদি তা পরিত্যাগ করে তাহলে তার অর্থ দাঁড়াবে, আল্লাহও তাকে পরিত্যাগ করবে।
১২৪ .
ঈমান, কুফরী ও মুনাফিকীর মধ্যে কম-বেশী হওয়ার অর্থ কি? এর আলোচনা দেখুন সূরা আনফালের ২ টীকায়।
১২৫.
অর্থাৎ এমন কোন বছর অতিবাহিত হয় না যখন তাদের ঈমানের দাবী এক দুবার পরীক্ষার সম্মুখীন হয় না এবং এভাবে তার অন্তঃসারশূন্যতা প্রকাশ হয়ে যায় না। কখনো কুরআনে এমন কোন হুকুম আসে যার মাধ্যমে তাদের ইচ্ছা ও প্রবৃত্তির আশা আকাংখার ওপর কোন নতুন বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়। কখনো দ্বীনের এমন কোন দাবী সামনে এসে যায় যার ফলে তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়। কখনো এমন কোন আভ্যন্তরীণ, সংকট সৃষ্টি হয় যার মাধ্যমে তারা নিজেদের পার্থিব সম্পর্ক এবং নিজেদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও গোত্রীয় স্বার্থের মোকাবিলায় আল্লাহর ও তার রসূলের দ্বীনকে কি পরিমাণ ভালবাসে তার পরীক্ষা করাই উদ্দেশ্য হয়। কখনো এমন কোন যুদ্ধ সংঘটিত হয় যার মাধ্যমে তারা যে দ্বীনের ওপর ঈমান আনার দাবী করছে তার জন্য ধন, প্রাণ, সময় ও শ্রম ব্যয় করতে তারা কতটুকু আগ্রহী তার পরীক্ষা হয়ে যায়। এ ধরনের সকল অবস্থায় কেবল তাদের মিথ্যা অঙ্গীকারের মধ্যে যে মুনাফিকীর আবর্জনা চাপা পড়ে আছে তা শুধু উন্মুক্ত হয়ে সামনে চলে আসে না বরং যখন তারা ঈমানদের দাবী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে পালাতে থাকে তখন তাদের ভেতরের ময়লা আবর্জনা আগের চাইতে আরো বেশী বেড়ে যায়।
১২৬.
নিয়ম ছিল, কোন সূরা নাযিল হওয়ার সাথে সাথেই নবী (সা.) মুসলমানদের সম্মেলন আহবান করতেন তারপর সাধারণ সভায় ভাষণের আকারে সূরাটি পড়ে শুনাতেন। এ ধরনের মহফিলে ঈমানদাররা পূর্ণ মনোযোগ সহকারে ভাষণ শুনতেন এবং তার মধ্যে ডুবে যেতেন। কিন্তু মুনাফিকদের ওপর এর ভিন্নতর প্রভাব পড়তো। হাযির হওয়ার হুকুম ছিল বলে তার হাযির হয়ে যেতো। তাছাড়া মাহফিলে শরীক না হলে তাদের মুনাফিকী প্রকাশ হয়ে যাবে, একথা মনে করেও তারা সম্মেলনে হাযির হতো। কিন্তু এ ভাষণের ব্যাপারে তাদের মনে কোন আগ্রহ জাগতো না। অত্যন্ত অনীহা ও বিরক্তি সহকারে তারা সেখানে বসে থাকতো। নিজেদের উপস্থিতি গণ্য করাবার পর তাদের চিন্তা হতো, কিভাবে দ্রুত এখান থেকে পালাবে। তাদের এ অবস্থার চিত্র এখানে আঁকা হয়েছে।
১২৭.
অর্থাৎ এ নির্বোধরা নিজেরাই নিজেদের স্বার্থ বুঝে না। নিজেদের কল্যাণের ব্যাপারে তারা গাফেল এবং নিজেদের ভালর কথা চিন্তা করে না। তারা যে এ কুরআন ও এ পয়গম্বরের মাধ্যমে কত বড় নিয়ামত লাভ করেছে তার কোন অনুভূতিই তাদের নেই। নিজেদের সংকীর্ণ জগত এবং এর নিতান্ত নিম্ন পর্যায়ের কার্যকলাপের মধ্যে তারা কুয়ার ব্যাঙের মতো ডুবে আছে। যার ফলে যে মহা জ্ঞান ও অতি উন্নত পর্যায়ের পথ নির্দেশনার বদৌলতে তারা আরবের এ মরু প্রান্তরের সংকীর্ণ অন্ধকারাচ্ছান্ন গর্ত থেকে বের হয়ে সমগ্র বিশ্ব মানবতার নেতা ও সর্বাধিনায়কে পরিণত হতে পারে এবং শুধুমাত্র এ নশ্বর দুনিয়াতেই নয় বরং পরবর্তী অনন্তকালীণ অবিনশ্বর জীবনেও চিরন্তন সাফল্য লাভ করতে সক্ষম হয়, সেই জ্ঞান ও শিক্ষার মূল্য ও মর্যাদা তারা বুঝতে পারে না। এ অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতার স্বাভাবিক ফলশ্রুতিতে আল্লাহ‌ লাভবান হবার সুযোগ থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করেছেন। যখন কল্যাণ ও সাফল্য এবং শক্তি ও শ্রেষ্ঠত্বের এ সম্পদ বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়ে থাকে এবং সৌভাগ্যবানরা দু'হাতে তা লুটতে থাকে তখন এ দুর্ভাগাদের মন অন্য কোন দিকে বাধা পড়ে এবং এ অবসরে কত বড় মহামূল্যবান সম্পদ থেকে যে তারা বঞ্চিত হয়ে গেছে তা তারা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে না।
অনুবাদ: