হাদীস থেকে জানা যায়, কিছুদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অহী নাযিল বন্ধ ছিল। এ সময়টা কতদিনের ছিল, এ সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীসে বিভিন্ন বক্তব্য এসেছে। ইবনে জুরাইজ ১২ দিন, কালবী ১৫ দিন, ইবনে আব্বাস ২৫ দিন, সুদ্দী ও মুকাতিল এর মেয়াদ ৪৫দিন বলে বর্ণনা করেছেন। মোটকথা, সময়টা এত দীর্ঘ ছিল যে রসুলুল্লাহ ﷺ নিজে এ জন্য ম্রিয়মান হয়ে পড়েছিলেন এবং বিরোধীরাও তাঁকে বিদ্রূপ করতে শুরু করেছিল। কারণ তাঁর ওপর নতুন নতুন সূরা নাযিল হলে তিনি তা লোকদের শুনাতেন। তাই দীর্ঘদিন যখন তিনি লোকদেরকে কোন অহী শুনালেন না তখন বিরোধীরা মনে করলো এ কালাম যেখান থেকে আসতো সে উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। জন্দুব ইবনে আবদুল্লাহ আল বাজালী (রা.) রেওয়ায়াত করেন, যখন জিব্রীল আলাইহিস সালামের আসার সিলসিলা থেমে গেলো, মুশরিকরা বলতে শুরু করলোঃ মুহাম্মাদকে ﷺ তাঁর রব পরিত্যাগ করেছেন। (ইবনে জারীর, তাবারানী, আবদ ইবনে হুমাইদ, সাঈদ ইবনে মনসূর ও ইবনে মারদুইয়া) অন্যান্য বিভিন্ন রেওয়ায়াত থেকে জানা যায়, রসূল ﷺ এর চাচী আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীলের ঘর ছিল তাঁর ঘরের সাথে লাগোয়া। সে তাঁকে ডেকে বললোঃ “মনে হচ্ছে তোমার শয়তান তোমাকে পরিত্যাগ করেছে।” আউফী ও ইবনে জারীর হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করে বলেনঃ কয়েকদিন পর্যন্ত জিব্রীলের আসা বন্ধ থাকার কারণে রসূলুল্লাহ ﷺ পেরেশান হয়ে পড়েছিলেন। অন্যদিকে মুশরিকরা বলতে শুরু করলো, তার রব তার প্রতি নারাজ হয়ে গেছেন এবং তিনি তাকে পরিত্যাগ করেছেন। কাতাদাহ ও যাহহাক বর্ণিত মুরসাল* হাদীসেও প্রায় এই একই ধরনের বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে। এ অবস্থায় বিভিন্ন হাদীসে রসূলুল্লাহ ﷺ গভীর দুঃখ ও মর্মব্যাথার কথাও বর্ণিত হয়েছে। আর এমনটি হওয়াই তো স্বাভাবিক ছিল। কারণ প্রেমাম্পদের দিক থেকে বাহ্যত অমনোযোগিতা ও উপেক্ষা, কুফর ও ঈমানের মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে যাবার পর এই প্রাণন্তকর সংঘাত সংগ্রামের মাঝ দরিয়ায় যে শক্তিটি ছিল তাঁর একমাত্র সহায় তার সাহায্য থেকে বাহ্যত বঞ্চিত হওয়া এবং এর ওপর বাড়তি বিপদ হিসেবে শত্রুদের বিদ্রূপ-ভর্ৎসনা ইত্যাদি এসব কিছু মিলে অবশ্যি তাঁর জন্য মারাত্মক ধরনের পেরেশানী সৃষ্টি করে দিয়েছিল। এ অবস্থায় তাঁর মনে বারবার এ সন্দেহ জেগে থাকবে যে, তিনি এমন কোন ভুল তো করেননি যার ফলে তাঁর রব তাঁর প্রতি নারাজ হয়ে গেছেন এবং তিনি হক ও বাতিলের এই লড়াইয়ে তাঁকে একাকী ছেড়ে দিয়েছেন।
এই অবস্থায় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সান্ত্বনা দেবার জন্য সূরাটি নাযিল হয়। এতে দিনের আলোর ও রাতের নিরবতার কসম খেয়ে রসূলুল্লাহকে ﷺ বলা হয়েছেঃ তোমার রব তোমাকে পরিত্যাগ করেননি এবং তোমার প্রতি নারাজও হননি। একথার জন্য যে সম্বন্ধের ভিত্তিতে এই দু’টি জিনিসের কসম খাওয়া হয়েছে তা হচ্ছে এই যে দিনের আলোক মালায় উদ্ভাসিত হওয়া এবং রাতের নিঝুমতা ও অন্ধকারে আচ্ছন্ন হওয়াযেমন আল্লাহর দিনে মানুষের প্রতি সন্তুষ্ট এবং রাতে তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট থাকার জন্য নয় বরং একটি বিরাট বিজ্ঞানময় ব্যবস্থা ও উদ্দেশ্যের আওতাধীনে এই দু’টি অবস্থার উদ্ভব ঠিক তেমনি তোমার কাছে কখনো অহী পাঠানো এবং তা পাঠানো বন্ধ করাও একটি বিরাট বিজ্ঞানময় ব্যবস্থাও উদ্দেশ্যের আওতাধীনেই হয়ে থাকে। মহান আল্লাহ তোমার প্রতি সন্তুষ্ট থাকলে অহী পাঠান এবং যখন অহী পাঠান না তখন মনে করতে হবে, তিনি তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট এবং তোমাকে ত্যাগ করেছেন--এ ধরনের কোন কথা বা বক্তব্যের কোন সম্পর্ক এখানে নেই। এছাড়া এই বিষয়বস্তুর সাথে এই কসমের আরো সম্পর্ক রয়েছে। তা হচ্ছে এই যে, দিনে সূর্যের কিরণ যদি অনবরত মানুষের ওপর পড়তে থাকে তাহলে তা তাকে ক্লান্ত ও অবশ করে দেবে। তাই একটি বিশেষ সময় পর্যন্ত দিনের আলো বিরাজ করে। এরপরে রাতের আসা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এভাবে মানুষ ক্লান্তি দূর করতে ও প্রশান্তি লাভ করতে পারে। অনুরূপভাবে অহীর কিরণ যদি অনবরত তোমার ওপর পড়তে থাকে তাহলে তা তোমার স্নায়ুর সহ্যের অতীত হয়ে পড়বে। তাই মাঝে মধ্যে ফাতরাতুল অহীর (অহী নাযিলের সিলসিলা বন্ধ হয়ে যাওয়া) একটি সময়ও আল্লাহ ঠিক করে রেখেছেন। এভাবে অহী নাযিল হওয়ার কারণে তোমার ওপর যে চাপ পড়ে তার প্রভাব খতম যাবে এবং তুমি মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে পারবে। অর্থাৎ অহীসূর্যের উদয় যেন উজ্জ্বল দিনের সমতুল্য এবং ফাতরাতুল অহীর সময়টি রাতের প্রশান্তির পর্যায়ভুক্ত।
*মুরসাল এমন এক ধরনের হাদীসকে বলা হয় যেখানে হাদীসের মূল বর্ণনাকারী হিসেবে সাহাবীর নাম উল্লেখিত হয়নি অর্থাৎ তাবেয়ী সাহাবীর নাম উল্লেখ ছাড়াই রসূলুল্লাহ ﷺ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইমামদের মধ্যে আবু হানিফা(র) ও মালিক (র)-ই একমাত্র এ ধরনের হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন, এক বর্ণনামতে ইমাম ইবনে হাম্বল (রা.) মুরসাল হাদীসের ভিত্তিতে ফতওয়া দিয়েছেন এবং এর বিপরীত রায়কে রদ করেছেন। (আ’ লামূল মুকিইন, ইবনে কাইয়েম)-অনুবাদক