এ প্রসঙ্গে কুরআন মজীদ নীতিগতভাবে কয়েকটি কথা দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বর্ণনা করেঃ
একঃ কাফের, মুশরিক ও মোনাফেকের কর্মকাণ্ড (অর্থাৎ এমনসব কর্মকাণ্ড যেগুলোকে নেকী মনে করা হয়) নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। আখেরাতে তারা এর কোন প্রতিদান পাবে না। এগুলোর যা প্রতিদান, তা তারা দুনিয়াতেই পেয়ে যাবে। এ জন্য উদাহরণস্বরূপ দেখুন আল আরাফ ১৪৭, আত তাওবা ১৭, ৬৭-৬৯, হুদ ১৫-১৬, ইবরাহীম ১৮, আল কাহফ ১০৪-১০৫, আন নূর ৩৯, আল ফুরকান ২৩, আল আহযাব ১৯, আয যুমার ৬৫ এবং আল আহকাফ ২০ আয়াত)
দুইঃ পাপের শাস্তি ততটুকু দেয়া হবে যতটুকু পাপ করা হয়। কিন্তু নেকীর পুরস্কার মূল কাজের তুলনায় বেশী দেয়া হবে। বরং কোথাও বলা হয়েছে, আল্লাহ নিজের ইচ্ছেমতো নেকীর প্রতিদান বাড়িয়ে দেবেন। দেখুন আল বাকারাহ ২৬১, আল আনআম ১৬০, ইউনুস ২৬-২৭, আন নূর ৩৮, আল কাসাস ৮৪, সাবা ৩৭ এবং আল মু’মিন ৪০ আয়াত।
তিনঃ মু’মিন যদি বড় বড় গোনাহ থেকে দূরে থাকে তাহলে তার ছোট গোনাহগুলো মাফ করে দেয়া হবে। দেখুন আন নিসা ৩১, আশ শূরা ৩৭ এবং আন নাজম ৩২ আয়াত।
চারঃ সৎ মু’মিনের কাছ থেকে হালকা হিসেব নেয়া হবে। তার গোনাহগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া হবে। তার ভালো ও উত্তম আমলগুলোর দৃষ্টিতে বিচার করে তাকে প্রতিদান দেয়া হবে। দেখুন আনকাবুত ৭, আযযুমার ৩৫, আল আহকাফ ১৬ এবং আল ইনশিকাক ৮ আয়াত।
হাদীসের বক্তব্য এ বিষয়টিকে একেবারে পরিষ্কার করে দেয়। ইতিপূর্বে সূরা ইনশিকাকের ব্যাখ্যার কিছু হাদীস উল্লেখ করেছি। কিয়ামতের দিন হালকা ও কড়া হিসেবের বিষয়টিকে বুঝাবার জন্য রসূলুল্লাহ ﷺ এর ব্যাখ্যা করেছেন। (এ জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল ইনশিকাক ৬ টীকা) হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আহার করেছিলেন এমন সময় এই আয়াতটি নাযিল হয়। হযরত আবু বকর (রা.) খাবার থেকে হাত গুঁটিয়ে নেন। তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহর রসূল! যে অণু পরিমাণ খারাপ কাজ আমি করেছি তার ফলও কি আমি দেখে নেবো? ” জবাব দেনঃ “হে আবু বকর! দুনিয়ায় যেসব বিষয়েরই তুমি সম্মুখীন হও তার মধ্যে যেগুলো তোমার অপছন্দনীয় ও অপ্রীতিকর ঠেকে সেগুলোই তুমি যেসব অণু পরিমাণ অসৎকাজ করেছো তার বদলা এবং সেসব অণু পরিমাণ নেকীর কাজই তুমি করো সেগুলো আল্লাহ আখেরাতে তোমার জন্য সংরক্ষণ করে রাখছেন।” (ইবনে জারীর, ইবনে আবী হতেম, তাবারনী ফিল আওসাত, বাইহাকী ফিশ শু’আব, ইবনুল মুনযির, হাকেম, ইবনে মারদুইয়া ও আবদ ইবনে হুমাইদ) এই আয়াতটি সম্পর্কে রসূলুল্লাহ ﷺ হযরত আবু আইউব আনসারীকেও বলেছিলেনঃ “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই নেকী করবে তার পুরস্কার সে পাবে আখেরাতে। আর যে ব্যক্তি কোন খারাপ কাজ করবে বিপদ-আপদ ও রোগের আকারে এই দুনিয়ায় তার শাস্তি পেয়ে যাবে।” (ইবনে মারদুইয়া)। কাতাদাহ হযরত আনাসের (রা.) বরাত দিয়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিম্নোক্ত বাণীটি উদ্ধৃত করেছেনঃ “আল্লাহ মু’মিনের প্রতি জুলুম করেন না। দুনিয়ায় তার নেকীর প্রতিদানে তাকে রিযিক দান করেন এবং আখেরাতে আবার এর পুরস্কার দেবেন। আর কাফেরের ব্যাপারে দুনিয়ায় তার সৎকাজের প্রতিদান দিয়ে দেন, তারপর যখন কিয়ামত হবে তখন তার খাতায় কোন নেকী লেখা থাকবে না।” (ইবনে জারীর) মাসরূক হযরত আয়েশা (রা.) থেকে রেওয়ায়াত করেছেনঃ তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করেন, “আবদুল্লাহ ইবনে জুদ’আন জাহেলীযুগে আত্মীয়দের সাথে সদ্ব্যবহার করতো, মিসকিনকে আহার করাতো, মেহমানদের আপ্যায়ন করাতো, বন্দিদের মুক্তি দান করতো। আখেরাতে এগুলো কি তার জন্য উপকারী হবে? ”রসূলুল্লাহ ﷺ জবাব দেন “না, সে মরার সময় পর্যন্ত একবারও বলেনি, رَبِّ اغْفِرْلِى خَطِيْئَتِىْ يَوْمَ الدِّيْنِ (হে আমার রব! শেষ বিচারের দিন আমার ভুল ত্রুটিগুলো মাফ করে দিয়ো।)”(ইবনে জারীর) অন্যান্য আরো কিছু লোকের ব্যাপারেও রসূলুল্লাহ ﷺ এই একই জবাব দেন। তারা জাহেলী যুগে সৎকাজ করতো কিন্তু কাফের ও মুশরিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন কোন বাণী থেকে জানা যায়, কাফেরের সৎকাজ তাকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবে না ঠিকই তবে জালেম ফাসেক ব্যভিচারী কাফেরকে জাহান্নামে যে ধরনের কঠিন শাস্তি দেয়া হবে তার শাস্তি তেমনি পর্যায়ের হবে না। যেমন হাদীসে বলা হয়েছেঃ হাতেম তাঈ এর দানশীলতার কারণে তাকে হালকা আযাব দেয়া হবে। (রূহুল মা’আনী)
তবুও এ আয়াতটি মানুষকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের ব্যাপারে সজাগ করে দেয়। সেটি হচ্ছে, প্রত্যেকটি সামান্যতম ও নগণ্যতম সৎকাজেরও একটি ওজন ও মূল্য রয়েছে এবং অনুরূপ অবস্থা অসৎকাজেরও। অর্থাৎ অসৎকাজ যত ছোটই হোক না কেন অবশ্যি তার হিসেব হবে এবং তা কোন ক্রমেই উপেক্ষা করার মতো নয়। তাই কোন ছোট সৎকাজকে ছোট মনে না করা উচিত। কারণ এই ধরনের অনেকগুলো ছোট গোনাহ একত্র হয়ে একটি বিরাট গোনাহের স্তূপ জমে উঠতে পারে। একথাটিই রসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর হাদীসে ব্যক্ত করেছেন। বুখারী ও মুসলিমে হযরত আদী ইবনে হাতেম (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ “জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো-তা এক টুকরা খেজুর দান করার বা একটি ভালো কথা বলার বিনিময়েই হোক না কেন।” হযরত আদী ইবনে হাতেম থেকে সহীহ রেওয়ায়াতের মাধ্যমে আরো বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ “কোন সৎকাজকেও সামান্য ও নগণ্য মনে করো না, যদিও তা কোন পানি পানেচ্ছু ব্যক্তির পাত্রে এক মগ পানি ঢেলে দেয়াই হয় অথবা তোমার কোন ভাইয়ের সাথে হাসি মুখে সাক্ষাত করাই হয়।” বুখারী শরীফে হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে একটি রেওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে। তাতে রসূলুল্লাহ ﷺ মেয়েদেরকে সম্বোধন করে বলেছেনঃ “হে মুসলিম মেয়েরা! কোন প্রতিবেশী তার প্রতিবেশীনীর বাড়িতে কোন জিনিস পাঠানোকে সামান্য ও নগণ্য মনে করো না, তা ছাগলের পায়ের একটি খুর হলেও।” মুসনাদে আহমাদ, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ-এ হযরত আয়েশার (রা.) একটি রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে। রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ “হে আয়েশা! যেসব গোনাহকে ছোট মনে করা হয় সেগুলো থেকে দূরে থাকো। কারণ আল্লাহর দরবারে সেগুলো সম্পর্কেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” মুসনাদে আহমাদে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রা.) বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ “সাবধান, ছোট গোনাহসমূহ থেকে নিজেকে রক্ষা কর। কারণ সেগুলো সব মানুষের ওপর একত্র হয়ে তাকে ধ্বংস করে দেবে।” (গোনাহ কবীরা ও গোনাহ সগীরার পার্থক্য বুঝার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আন নিসা ৫৩ টীকা ও আন নাজম ৩২ টীকা)।