۞ رَبِّ قَدْ ءَاتَيْتَنِى مِنَ ٱلْمُلْكِ وَعَلَّمْتَنِى مِن تَأْوِيلِ ٱلْأَحَادِيثِ ۚ فَاطِرَ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ أَنتَ وَلِىِّۦ فِى ٱلدُّنْيَا وَٱلْـَٔاخِرَةِ ۖ تَوَفَّنِى مُسْلِمًۭا وَأَلْحِقْنِى بِٱلصَّـٰلِحِينَ
হে আমার রব! তুমি আমাকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করেছো এবং আমাকে কথার গভীরে প্রবেশ করা শিখিয়েছো। হে আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা! দুনিয়ায় ও আখেরাতে তুমিই আমার অভিভাবক। ইসলামের ওপর আমাকে মৃত্যু দান করো এবং পরিণামে আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত করো।” ৭১
৭১
এ সময় হযরত ইউসুফের (আ) কণ্ঠ নিঃসৃত এ বাক্য ক’টি আমাদের সামনে একজন সাচ্চা মু’মিনের চরিত্রের একটা অদ্ভূত মনোমুগ্ধকর চিত্র তুলে ধরে। মরু পশুপালক পরিবারের এক ব্যক্তি, যাঁকে তাঁর হিংসুটে ভাইয়েরা মেরে ফেলতে চেয়েছিল, জীবনের উত্থান-পতন দেখতে দেখতে অবশেষে পার্থিব উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেন। তাঁর দুর্ভিক্ষ পীড়িত পরিবারবর্গ তাঁরই করুণা ভিখারী হয়ে তাঁর সামনে এসে হাযির হয়েছে এবং এ সাথে এসেছে তাঁর সেই হিংসুটে ভাইয়েরা যারা তাঁকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। তারা সবাই তাঁর রাজকীয় সিংহাসনের সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। দুনিয়ার সাধারণ রীতি অনুযায়ী এটি ছিল অহংকার, অভিযোগ ও দোষারোপ করার এবং তিরষ্কার ও ভর্ৎসনার তীর বর্ষণ করার উপযুক্ত সময়। কিন্তু আল্লাহর সত্যিকার অনুগত একজন মানুষ এ সময় কিছুটা ভিন্ন ধরনের চারিত্রিক গুণাবলীর প্রকাশ ঘটান। তিনি নিজের এ উন্নতির জন্য অহংকার করার পরিবর্তে যে আল্লাহ তাঁকে এ মর্যাদা দান করেছেন তাঁর অনুগ্রহের স্বীকৃতি দেন। তাঁর পরিবারের লোকেরা জীবনের প্রথম দিকে তাঁর ওপর যে জুলুম অত্যাচার চালিয়েছিল সেজন্য তিনি তাদেরকে তিরষ্কার ও ভর্ৎসনা করেন না। বরং আল্লাহ এত দীর্ঘদিনের বিচ্ছিন্নতার পর তাদেরকে আমার সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন এ বলে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি হিংসুটে ভাইদের বিরুদ্ধে মুখে অভিযোগের একটি শব্দও উচ্চারণ করেন না। এমন কি একথা বলেন না যে, তারা আমার সাথে দুর্ব্যবহার করেছিল। বরং নিজেই এভাবে তাদের সাফাই গাইছেন যে, শয়তান আমার ও তাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে দিয়েছে। আবার সেই বিরোধের খারাপ দিক বাদ দিয়ে তার এ ভালো দিকটি পেশ করছেন যে, আল্লাহ আমাকে যে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে চাচ্ছিলেন সেজন্য এ সূক্ষ্ম কৌশল অবলম্বন করেছেন। অর্থাৎ ভাইদের দ্বারা শয়তান যা কিছু করায় তার মধ্যে আল্লাহর জ্ঞান অনুযায়ী আমার জন্য কল্যাণ ছিল। কয়েক শব্দে এসব কিছু প্রকাশ করার পর তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজের প্রভু--- আল্লাহর সামনে নত হন এবং তাঁর প্রতি এ বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনঃ তুমিই আমাকে বাদশাহী দান করেছো এবং এমন সব যোগ্যতা দান করেছো যার বদৌলতে আমি জেলখানায় পচে মরার বদলে আজ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রটির ওপর শাসন কর্তৃত্ব চালাচ্ছি। সবশেষে তিনি আল্লাহর কাছে যা কিছু চান তা হচ্ছে এই যে, দুনিয়ায় যতদিন বেঁচে থাকি ততদিন যেন তোমার বন্দেগী ও দাসত্বে অবিচল থাকি আর যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নেই তখন আমাকে সৎ বান্দাদের সাথে মিশিয়ে দিয়ো। কতই উন্নত, পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র এ চারিত্রিক আদর্শ!
হযরত ইউসুফের এ মূল্যবান ভাষণটিও বাইবেল ও তালমূদে কোন স্থান পায়নি। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এ কিতাব দু’টি অপ্রয়োজনীয় গল্প কাহিনীর বিস্তারিত বিবরণে ভরা। অথচ যেসব বিষয় নৈতিক মূল্যমান ও মূল্যবোধের সাথে সম্পর্ক রাখে এবং যার সাহায্যে নবীগণের মূল শিক্ষা, তাঁদের যথার্থ মিশন এবং তাঁদের সীরাতের শিক্ষণীয় দিকগুলোর ওপর আলোকপাত হয়, এ কিতাব দু’টিতে সেগুলোর কোন উল্লেখই নেই।
এখানে এ কাহিনী শেষ হচ্ছে। তাই পাঠকদেরকে পুনর্বার এ সত্যটির ব্যাপারে সজাগ করে দেয়া জরুরী মনে করি যে, হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে কুরআনের এ বর্ণনাটি একান্তই তার নিজস্ব ও স্বতন্ত্র বর্ণনা। এটি বাইবেল বা তালমূদের চর্বিতচর্বন নয়। তিনটি কিতাবের তুলনামূলক অধ্যয়নের পর একথা অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কাহিনীটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশে কুরআনের বর্ণনা অন্য দু’টি থেকে আলাদা। কোন কোন জিনিস কুরআন তাদের চেয়ে বেশী বর্ণনা করে, কোন কোনটা কম এবং কোন কোনটায় তাদের বর্ণনার প্রতিবাদ করে। কাজেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনী ইরসাঈলের থেকে এ কাহিনীটি শুনে থাকবেন এবং তারই ভিত্তিতে এটি বর্ণনা করেন, একথা বলার সুযোগই কারোর নেই।