এখানে একজন জ্ঞানানুসন্ধানীর মনে প্রশ্ন জাগে, বনী ইসরাঈল যখন মিসরে প্রবেশ করে তখন হযরত ইউসুফ (আ) সহ তাদের সংখ্যা ছিল ৬৮ এবং প্রায় ৫ শত বছর পর যখন তারা মিসর থেকে বের হয় তখন তাদের সংখ্যা ছিল কয়েক লাখ। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী মিসর ত্যাগ করার পরের বছর সিনাইয়ের মরু এলাকায় হযরত মূসা (আ) তাদের যে আদমশুমারী করান তাতে কেবলমাত্র যুদ্ধ করতে সমর্থ যুবকদের সংখ্যা ৬,০৩,৫৫০ ছিল। এর মানে এ দাঁড়ায়, নারী-পুরুষ-শিশু মিলিয়ে সব শুদ্ধ তাদের সংখ্যা হবে অন্তত ২০ লাখ। কোন হিসেবে কি ৬৮ জন থেকে ৫ শত বছরে বংশবৃদ্ধি পেয়ে ২০ লাখ হতে পারে? যদি ধরা যায়, সারা মিসরের জনসংখ্যা এ সময় ছিল ২ কোটি (যা অবশ্যি খুব বেশী অতিরঞ্জিত বিবেচিত হবে) তাহলে এর অর্থ এ দাঁড়াবে যে, শুধুমাত্র বনী ইসরাঈলের সংখ্যাই সেখানে ছিল শতকরা ১০ ভাগ। শুধুমাত্র বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে একটি পরিবারের লোকসংখ্যা কি এ পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে? এ প্রশ্নটি সম্পর্কে চিন্ত-ভাবনা করলে একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের প্রকাশ ঘটে। একথা ঠিক ৫শত বছরে একটি পরিবারের লোকসংখ্যা এত বেশী বাড়তে পারে না। কিন্তু বনী ইসরাঈল ছিল নবীদের সন্তান। তাদের নেতা হযরত ইউসুফের (আ) বদৌলতে তারা মিসরে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল। এ ইউসুফ (আ) নিজেই ছিলেন নবী। তারপর থেকে চার পাঁচশো বছর পর্যন্ত দেশের শাসন কর্তৃত্ব তাদেরই হাতে ছিল। এ সময় নিশ্চয়ই তারা মিসরে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার করে থাকবেন। মিসরবাসীদের মধ্য থেকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাদের কেবল ধর্মই নয়, তামাদ্দুন এবং সমগ্র জীবন ব্যবস্থাই মিসরীয় অমুসলিমদের থেকে আলাদা হয়ে বনী ইসরাঈলের রঙে রঞ্জিত হয়ে গিয়ে থাকবে। মিসরীয়রা তাদের সবাইকে ঠিক তেমনি আগন্তুক গণ্য করে থাকবে যেমন ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দুরা ভারতীয় মুসলমানদেরকে গণ্য করে থাকে। অনারব মুসলমানদের ওপর আজ ‘মোহামেডান” শব্দটি যেভাবে লাগানো হয় তাদের ওপর ঠিক তেমনিভাবেই ‘ইসরাঈলী’ শব্দটি লাগানো হয়ে থাকবে। আর তাছাড়া তারা নিজেরাও দ্বীনী ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক এবং বিয়ে-শাদীর সম্পর্কের কারণে অমুসলিম মিসরীয়দের থেকে বিচ্ছিন্ন এবং বনী ইসরাঈলের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়ে থাকবে। এ কারণে যখন মিসরে জাতীয়তাবাদের প্রবল জোয়ার উঠলো তখন কেবলমাত্র বনী ইসরাঈলই নির্যাতনের শিকার হলো না বরং মিসরীয় মুসলিমরাও তাদের সাথে একইভাবে নির্যাতীত হলো। আর বনী ইসরাঈল যখন মিসর ত্যাগ করলো তখন মিসরীয় মুসলমানরাও তাদের সাথে বের হলো এবং তাদের সবাইকে বনী ইসরাঈলের সাথে গণ্য করা হতে থাকলো। বাইবেলের বিভিন্ন ইঙ্গিত থেকে আমাদের এ ধারণার সমর্থন মেলে। উদাহরণস্বরূপ “যাত্রা পুস্তকে” যেখানে বনী ইসরাঈলদের মিসর থেকে বের হবার অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে সেখানে বাইবেল লেখক বলছেনঃ “আর তাহাদের সাথে মিশ্রিত লোকদের মহাজনতাও গেলো।” (১২: ৩৮) অনুরূপভাবে “গণনা পুস্তকে”ও তিনি আবার বলছেনঃ “আর তাহাদের মধ্যবর্তী মিশ্রিত লোকেরা লোভাতুর হইয়া উঠিল।” (১১: ৪) তারপর পর্যায়ক্রমে এ অইসরাঈলী মুসলমানদের জন্য “আগন্তুক” ও “পরদেশী” পরিভাষা ব্যবহার করা হতে থাকে। বস্তুত তাওরাতে হযরত মূসাকে যেসব বিধান দেয়া হয় তার মধ্যে আমরা পাইঃ
“তোমরা ও তোমাদের মধ্যে বসবাসকারী বিদেশী লোক, উভয়ের জন্য একই ব্যবস্থা হইবে; ইহা তোমাদের পুরুষানুক্রমে পালনীয় চিরস্থায়ী বিধি। সদা প্রভুর সামনে তোমরা ও বিদেশীয়েরা, উভয়ে সমান। তোমাদের ও তোমাদের মধ্যে বসবাসকারী বিদেশীয়দের জন্য একই ব্যবস্থা ও একই শাসন হইবে।” (গণনা পুস্তক ১৫: ১৫-১৬)
“কি স্বজাতীয় কি বিদেশী যে ব্যক্তি নিসংকোচে পাপ করে, সে সদাপ্রভুর অবমাননা করে, সেই ব্যক্তি আপন লোকদের মধ্য হইতে উচ্ছিন্ন হইবে।” (গণনা পুস্তক ১৫: ৩০)
“তোমরা তোমাদের ভ্রাতাদের মধ্যে, চাই স্বদেশী হোক বা বিদেশী হোক, ন্যায্য বিচার করিও।” (দ্বিতীয় বিবরণ ১: ১৬)
আল্লাহর কিতাবে অইসরাঈলীদের জন্য আসলে কি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল যাকে অনুবাদকরা ‘বিদেশী’ বানিয়ে রেখে দিয়েছে, সেটা এখন অনুসন্ধানের মাধ্যমে জানা কঠিন।