আল কাহফ

১১০ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
আয়াত
-
১ ) প্রশংসা আল্লাহরই যিনি তাঁর বান্দার প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছেন এবং এর মধ্যে কোন বক্রতা রাখেননি।
ٱلْحَمْدُ لِلَّهِ ٱلَّذِىٓ أَنزَلَ عَلَىٰ عَبْدِهِ ٱلْكِتَٰبَ وَلَمْ يَجْعَل لَّهُۥ عِوَجَا ١
২ ) একদম সোজা কথা বলার কিতাব, যাতে লোকদেরকে আল্লাহর কঠিন শাস্তি থেকে সে সাবধান করে দেয় এবং ঈমান এনে যারা সৎকাজ করে তাদেরকে সুখবর দিয়ে দেয় এ মর্মে যে, তাদের জন্য রয়েছে ভাল প্রতিদান।
قَيِّمًا لِّيُنذِرَ بَأْسًا شَدِيدًا مِّن لَّدُنْهُ وَيُبَشِّرَ ٱلْمُؤْمِنِينَ ٱلَّذِينَ يَعْمَلُونَ ٱلصَّٰلِحَٰتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا حَسَنًا ٢
৩ ) সেখানে তারা থাকবে চিরকাল।
مَّٰكِثِينَ فِيهِ أَبَدًا ٣
৪ ) আর যারা বলে, আল্লাহ‌ কাউকে সন্তানরূপে গ্রহণ করেছেন, তাদেরকে ভয় দেখায়।
وَيُنذِرَ ٱلَّذِينَ قَالُوا۟ ٱتَّخَذَ ٱللَّهُ وَلَدًا ٤
৫ ) এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই এবং তাদের বাপ-দাদারও ছিল না। তাদের মুখ থেকে বেরুনো একথা অত্যন্ত সাংঘাতিক! তারা নিছক মিথ্যাই বলে।
مَّا لَهُم بِهِۦ مِنْ عِلْمٍ وَلَا لِءَابَآئِهِمْ كَبُرَتْ كَلِمَةً تَخْرُجُ مِنْ أَفْوَٰهِهِمْ إِن يَقُولُونَ إِلَّا كَذِبًا ٥
৬ ) হে মুহাম্মাদ! যদি এরা এ শিক্ষার প্রতি ঈমান না আনে, তাহলে দুশ্চিন্তায় তুমি হয়তো এদের পেছনে নিজের প্রাণটি খোয়াবে।
فَلَعَلَّكَ بَٰخِعٌ نَّفْسَكَ عَلَىٰٓ ءَاثَٰرِهِمْ إِن لَّمْ يُؤْمِنُوا۟ بِهَٰذَا ٱلْحَدِيثِ أَسَفًا ٦
৭ ) আসলে পৃথিবীতে এ যা কিছু সাজ-সরঞ্জামই আছে এগুলো দিয়ে আমি পৃথিবীর সৌন্দর্য বিধান করেছি তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য যে, তাদের মধ্য থেকে কে ভাল কাজ করে।
إِنَّا جَعَلْنَا مَا عَلَى ٱلْأَرْضِ زِينَةً لَّهَا لِنَبْلُوَهُمْ أَيُّهُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا ٧
৮ ) সবশেষে এসবকে আমি একটি বৃক্ষ-লতাহীন ময়দানে পরিণত করবো।
وَإِنَّا لَجَٰعِلُونَ مَا عَلَيْهَا صَعِيدًا جُرُزًا ٨
৯ ) তুমি কি মনে করো গূহা ও ফলক ওয়ালারা আমার বিস্ময়কর নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত ছিলো?
أَمْ حَسِبْتَ أَنَّ أَصْحَٰبَ ٱلْكَهْفِ وَٱلرَّقِيمِ كَانُوا۟ مِنْ ءَايَٰتِنَا عَجَبًا ٩
১০ ) যখন ক’জন যুবক গূহায় আশ্রয় নিলো এবং তারা বললোঃ হে আমাদের রব! তোমার বিশেষ রহমতের ধারায় আমাদের প্লাবিত করো এবং আমাদের ব্যাপার ঠিকঠাক করে দাও।”
إِذْ أَوَى ٱلْفِتْيَةُ إِلَى ٱلْكَهْفِ فَقَالُوا۟ رَبَّنَآ ءَاتِنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً وَهَيِّئْ لَنَا مِنْ أَمْرِنَا رَشَدًا ١٠
১.
অর্থাৎ এর মধ্যে এমন কোন কথাবার্তা নেই যা বুঝতে পারা যায় না। আবার সত্য ও ন্যায়ের সরল রেখা থেকে বিচ্যুত এমন কোন কথাও নেই যা মেনে নিতে কোন সত্যপন্থী লোক ইতস্তত করতে পারে।
২.
অর্থাৎ যারা আল্লাহর সন্তান-সন্তুতি আছে বলে দাবী করে। এদের মধ্যে রয়েছে খৃস্টান, ‌ ইহুদী ও আরব মুশরিকরা।
৩.
অর্থাৎ তাদের এ উক্তি যে, অমুক আল্লাহর পুত্র অথবা অমুককে আল্লাহ পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন, এগুলো তারা এজন্য বলছে না যে, তাদের আল্লাহর পুত্র হবার বা আল্লাহর কাউকে পুত্র বানিয়ে নেবার ব্যাপারে তারা কিছু জানে। বরং নিছক নিজেদের ভক্তি শ্রদ্ধার বাড়াবাড়ির কারণে তারা একটি মনগড়া মত দিয়েছে এবং এভাবে তারা যে কত মারাত্মক গোমরাহীর কথা বলছে এবং বিশ্ব-জাহানের মালিক ও প্রভু আল্লাহর বিরুদ্ধে যে কত বড় বেয়াদবী ও মিথ্যাচার করে যাচ্ছে তার কোন অনুভূতিই তাদের নেই।
৪.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে সে সময় যে মানসিক অবস্থার টানাপোড়ন চলছিল এখানে সেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ থেকে পরিষ্কার জানা যায়, তাঁকে ও তাঁর সাথীদেরকে যেসব কষ্ট দেয়া হচ্ছিল সেজন্য তাঁর মনে কোন দুঃখ ছিল না। বরং যে দুঃখটি তাঁকে ভিতরে ভিতরে কুরে কুরে খাচ্ছিল সেটি ছিল এই যে, তিনি নিজের জাতিকে নৈতিক অধঃপতন, ভ্রষ্টাচার ও বিভ্রান্তি থেকে বের করে আনতে চাচ্ছিলেন এবং তারা কোনক্রমেই এ পথে পা বাড়াবার উদ্যোগ নিচ্ছিল না। তাঁর পূর্ণ বিশ্বাস ছিল, এ ভ্রষ্টতার অনিবার্য ফল ধ্বংস ও আল্লাহর আযাব ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি তাদেরকে এ পরিণতি থেকে রক্ষা করার জন্য দিনরাত প্রাণান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তারা আল্লাহর আযাবের সম্মুখীন হবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লাম নিজেই তাঁর এ মানসিক অবস্থাকে একটি হাদীসে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ “আমার ও তোমাদের দৃষ্টান্ত এমন এক ব্যক্তির মতো যে আলোর জন্য আগুন জ্বালালো কিন্তু পতংগরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করলো পুড়ে মরার জন্য। সে এদেরকে কোনক্রমে আগুন থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করে কিন্তু এ পতংগরা তার কোন প্রচেষ্টাকেই ফলবতী করতে দেয় না। আমার অবস্থা অনুরূপ। আমি তোমাদের হাত ধরে টান দিচ্ছি কিন্তু তোমরা আগুনে লাফিয়ে পড়ছো।” (বুখারী ও মুসলিম। আর ও তুলনামূলক আলোচনার জন্য সূরা আশ্ শু’আরা ৩ আয়াত দেখুন)

এ আয়াতে বাহ্যত শুধু এতটুকু কথাই বলা হয়েছে যে, সম্ভবত তুমি এদের পেছনে নিজের প্রাণটি খোয়াবে। কিন্তু এর মাধ্যমে সূক্ষ্মভাবে নবীকে এ মর্মে সান্তনাও দেয়া হয়েছে যে, এদের ঈমান না আনার দায়-দায়িত্ব তোমার ওপর বর্তায় না, কাজেই তুমি কেন অনর্থক নিজেকে দুঃখ ও শোকে দগ্ধীভূত করছো? তোমার কাজ শুধুমাত্র সুখবর দেয়া ও ভয় দেখানো। লোকদেরকে মু’মিন বানানো নয়। কাজেই তুমি নিজের প্রচারের দায়িত্ব পালন করে যাও। যে মেনে নেবে তাকে সুখবর দেবে এবং যে মেনে নেবে না তাকে তার অশুভ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে দেবে।

৫.
প্রথম আয়াতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছিল। আর এ দু’টি আয়াতে কাফেরদেরকে উদ্দেশ্য করে কথা বলা হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একটি সান্তনা বাক্য শুনিয়ে দেবার পর এখন তাঁর অস্বীকারকারীদেরকে সরাসরি সম্বোধন না করেই একথা শুনানো হচ্ছে যে, পৃথিবী পৃষ্ঠে তোমরা এই যেসব সাজ-সরঞ্জাম দেখছো এবং যার মন ভুলানো চাকচিক্যে তোমরা মুগ্ধ হয়েছো, এতো নিছক একটি সাময়িক সৌন্দর্য, নিছক তোমাদের পরীক্ষার জন্য এর সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। এসব কিছু আমি তোমাদের আয়েশ-আরামের জন্য সরবরাহ করেছি, তোমরা এ ভুল ধারণা করে বসেছো। তাই জীবনের মজা লুটে নেয়া ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যের প্রতি তোমরা কোন ভ্রুক্ষেপই করছো না। এজন্য কি তোমরা কোন উপদেশদাতার কথায় কান দিচ্ছো না। কিন্তু আসলে তো এগুলো আয়েশ-আরামের জিনিস নয় বরং পরীক্ষার উপকরণ। এগুলোর মাঝখানে তোমাদের বসিয়ে দিয়ে দেখা হচ্ছে, তোমাদের মধ্যে কে তার নিজের আসল স্বরূপ ভুলে গিয়ে দুনিয়ার এসব মন মাতানো সামগ্রীর মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে এবং কে তার আসল মর্যাদার (আল্লাহর বন্দেগী) কথা মনে রেখে সঠিক নীতি অবলম্বন করছে। যেদিন এ পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে সেদিনই ভোগের এসব সরঞ্জাম খতম করে দেয়া হবে এবং তখন এ পৃথিবী একটি লতাগুল্মহীন ধূ ধূ প্রান্তর ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।
৬.
আরবী ভাষায় বড় ও বিস্তৃত গুহাকে ‘কাহফ’ বলা হয় এবং সংকীর্ণ গহ্বরকে বলা হয় “গার।”
৭.
মূল শব্দ হচ্ছে “আর রকীম।” এর বিভিন্ন অর্থ করা হয়েছে। কোন কোন সাহাবী ও তাবেঈর বর্ণনা মতে আসহাবে কাহফের ঘটনাটি যে জনপদে সংঘটিত হয়েছিল সেই জনপদটির নাম ছিল আর রকীম। এটি “আইলাহ” (অর্থাৎ আকাবাহ) ও ফিলিস্তীনের মাঝামাঝি একটি স্থানে অবস্থিত ছিল। আবার অনেক পুরাতন মুফাস্সির বলেন, এর অর্থ হচ্ছে, এ নাম দিয়ে গুহা মুখে আসহাবে কাহফের স্মৃতি রক্ষার্থে সে ফলক বা শিলালিপিটি লাগানো হয়েছিল। মাওলানা আবুল কালাম আযাদ তাঁর 'তরজমানুল কুরআন’ তাফসীর গ্রন্থে প্রথম অর্থটিকে প্রাধান্য দিয়ে বলেছেন, এ স্থানটিকে বাইবেলের যিহোশূয় পুস্তকের ১৮ঃ২৬ শ্লোকে রেকম বা রাকম বলা হয়েছে। এরপর তিনি একে ফিলিস্তীনের বিখ্যাত ঐতিহাসিক কেন্দ্র পেট্টা-এর প্রাচীন নাম হিসেবে গণ্য করেছেন। কিন্তু তিনি একথা চিন্তা করেননি যে, যিহোশূয় পুস্তকে রেকম বা রাকমের আলোচনা এসেছে বনী বিন ইয়ামীনের (বিন্যামীন সন্তান) মীরাস প্রসঙ্গে। এ সংশ্লিষ্ট পুস্তকের নিজের বর্ণনামতে এ গোত্রের মীরাসের এলাকা জর্দান নদী ও লূত সাগরের (Dead sea) পশ্চিম দিকে অবস্থিত ছিল। সেখানে পেট্টার অবস্থানের কোন সম্ভাবনাই নেই। পেট্টার ধ্বংসাবশেষ যে এলাকায় পাওয়া গেছে তার ও বনী বিন ইয়ামীনের মীরাসের এলাকার মধ্যে ইয়াহুদা (যিহোদ) ও আদুমীয়ার পুরো এলাকা অবস্থিত ছিল। এ কারণে আধুনিক যুগের প্রত্নতত্ববিদগণ পেট্টা ও রেকম একই জায়গার নাম এ ধারণার কঠোর বিরোধিতা করেছেন। (দেখুন ইনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ১৯৪৬ সালে মুদ্রিত, ১৭ খণ্ড, ৬৫৮ পৃষ্ঠা) আমি মনে করি “আর রকীম” মানে ফলক বা শিলালিপি, এ মতটিই সঠিক।
৮.
অর্থাৎ যে আল্লাহ এ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তাঁর শক্তিমত্তার পক্ষে কয়েকজন লোককে দু’তিন শো বছর পর্যন্ত ঘুম পাড়িয়ে রাখা এবং তারপর তাদেরকে ঘুমাবার আগে তারা যেমন তরুণ তাজা ও সুস্থ-সবল ছিল ঠিক তেমনি অবস্থায় জাগিয়ে তোলা কি তুমি কিছু অসম্ভব বলে মনে করো? যদি চন্দ্র, সূর্য ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে তুমি কখনো চিন্তা-ভাবনা করতে তাহলে তুমি একথা মনে করতে না যে, আল্লাহর জন্য এটা কোন কঠিন কাজ।
অনুবাদ: