ارْكُضْ بِرِجْلِكَ هَذَا مُغْتَسَلٌ بَارِدٌ وَشَرَابٌ
“নিজের পা দিয়ে আঘাত করো, এ ঠাণ্ডা পানি মজুদ আছে গোসল ও পান করার জন্য।”
এ থেকে জানা যায়, মাটিতে পা ঠুকবার সাথে সাথেই আল্লাহ তাঁর জন্য একটি প্রাকৃতিক ঝরণা-ধারা প্রবাহিত করেন। এ ঝরণার পানির বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, এ পানি পান ও এতে গোসল করার সাথে সাথেই তিনি রোগমুক্ত হয়ে যান। এ রোগ নিরাময়ে এদিকে ইঙ্গিত করে যে, তাঁর কোন মারাত্মক চর্মরোগ হয়েছিল। বাইবেলের বর্ণনাও এর সমর্থক। বাইবেল বলছে, তাঁর সমস্ত শরীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত ফোঁড়ায় ভরে গিয়েছিল। (ইয়োব ২: ৭)
বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এ পুস্তকের প্রথম অংশ এক ধরনের কথা বলে, মাঝখানের অংশ বলে ভিন্ন কথা এবং শেষে ফলাফল দেখা যায় সম্পূর্ণ অন্য কিছু। এ তিন অংশের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য ও সাদৃশ্য নেই। প্রথম অংশ বলে, আইয়ুব একজন বড়ই সত্যনিষ্ঠ, খোদাভীরু ও কুকর্ম ত্যাগকারী সিদ্ধ পুরুষ ছিলেন। এই সঙ্গে তিনি এতই ধনাঢ্য ছিলেন যে, “পূর্ব দেশের লোকদের মধ্যে তিনি-ই ছিলেন সর্বাপেক্ষা বড়লোক।” একদিন আল্লাহর কাছে তাঁর (অর্থাৎ আল্লাহর নিজের পুত্রগণ হাজির হন। তাদের সাথে শয়তানও আসে। আল্লাহ সেই মজলিসে তাঁর বান্দা আইয়ুবের জন্য গর্ব করেন। শয়তান বলে, আপনি তাঁকে যা কিছু দিয়ে রেখেছেন তারপর সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করলে আর কি করবে? তার প্রতি যেসব অনুগ্রহ করেছেন সেগুলো একবার ছিনিয়ে নেন তারপর দেখুন সে যদি আপনার মুখের ওপর আপনাকে অস্বীকার না করে থাকে তাহলে আমার নাম শয়তান নয়। আল্লাহ বলেন, ঠিক আছে তাঁর সব কিছু তোমার হস্তগত করে দেয়া হচ্ছে, শুধুমাত্র তাঁর শারীরিক কোন ক্ষতি করো না। শয়তান গিয়ে আইয়ুবের সমস্ত ধন-দৌলত ও পরিবার-পরিজন ধ্বংস করে দেয়। আইয়ুব সবকিছু থেকে বঞ্চিত হয়ে শুধুমাত্র একাই থেকে যান। কিন্তু এতে আইয়ুবের মনে কোন দুঃখ ও ক্ষোভ জাগেনি। তিনি আল্লাহকে সিজদা করেন এবং বলেন, “আমি মায়ের গর্ভ থেকে উলংগ এসেছি এবং উলংগই ফিরে যাবো; খোদাই দিয়েছেন আবার খোদাই নিয়েছেন, খোদার নাম ধন্য হোক।” আবার এক দিন আল্লাহর দরবারে একই ধরনের একটি মজলিস বসে। তাঁর ছেলেরা আসে, শয়তানও আসে। আল্লাহ শয়তানকে বলেন, আইয়ুব কেমন সত্যনিষ্ঠ প্রমাণিত হয়েছে দেখে নাও। শয়তান বলে, আচ্ছা জনাব, তার শরীরকে একবার বিপদগ্রস্ত করে দেখুন সে আপনার মুখের ওপর আপনার কুফরী করবে। আল্লাহ বলেন, ঠিক আছে যাও, তাঁকে তোমার হাতে দেয়া হচ্ছে, তবে তাঁর প্রাণটি যেন সংরক্ষিত থাকে। অতঃপর শয়তান ফিরে যায়। সে “আইয়ুবকে মাথার চাঁদি থেকে পায়ের তালু পর্যন্ত ভয়ংকর যন্ত্রণাদায়ক ফোঁড়ায় ভরে দেয়।” তাঁর স্ত্রী তাঁকে বলে, “এখনো কি তুমি তোমার সত্যনিষ্ঠার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে? আল্লাহকে অমান্য করো এবং প্রাণত্যাগ করো।” তিনি জবাব দেন, “তুমি মুঢ়া স্ত্রীর মতো কথা বলছো। আমরা কি আল্লাহর কাছ থেকে শুধু সুখ পাবো, দুঃখ পাবো না।”
এ হচ্ছে আইয়ুবের সহীফার (ইয়োব পুস্তক) প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত সার। কিন্তু এরপর তৃতীয় অধ্যায়ে একটি ভিন্নতর বিষয়বস্তু শুরু হয়েছে। এটি বিয়াল্লিশতম অধ্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে। এসব অধ্যায়ে হযরত আইয়ুবের ধৈর্যহীনতা এবং আল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ ও দোষারোপের একটি ধারাবাহিক কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। তা থেকে একথা পুরোপুরি প্রমাণিত হয়ে যায় যে, হযরত আইয়ুবের সম্পর্কে আল্লাহর অনুমান ভুল ও শয়তানের অনুমান সঠিক ছিল। তারপর বিয়াল্লিশতম অধ্যায়ের শেষের দিকে আল্লাহর সাথে একচোট তর্ক বিতর্ক করার পর ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা ও তাওয়াক্কুলের ভিত্তিতে নয় বরং আল্লাহর তিরস্কার ও ধমক খেয়ে আইয়ুব তাঁর কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেন এবং তিনি তা গ্রহণ করে তার সমস্ত কষ্ট দূর করে দেন। এরপর তাঁকে পূর্বের চেয়ে কয়েকগুণ বেশী সম্পদ দান করেন। এ শেষ অংশটি পড়তে গিয়ে মনে হবে আইয়ুব ও আল্লাহ উভয়েই শয়তানের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছেন। তারপর নেহাত নিজের কথা রাখার জন্যই আল্লাহ ধমক দিয়ে তাঁকে মাফ চাইতে বাধ্য করেন এবং মাফ চাওয়ার সাথে সাথেই তা গ্রহণ করে নেন, যাতে শয়তানের সামনে তাঁকে লজ্জিত হতে না হয়।
এ পুস্তকটি নিজ মুখেই একথা ঘোষণা করছে যে, এটি আল্লাহর বা হযরত আইয়ুবের বাণী নয়। বরং হযরত আইয়ুবের জামানার বইও নয় এটি। তাঁর ইন্তেকালের শত শত বছর পরে কোন এক ব্যক্তি আইয়ুবের ঘটনাকে ভিত্তি করে “ইউসুফ যোলায়কা” ধরনের একটি চমকপ্রদ কাহিনী কাব্য রচনা করেন। তাতে আইয়ুব (ইয়োব), তৈমনীয় ইলীফস, শূহীয় বিলদদ, নামাথীয় সোফর, বুষীয় বারখেলের পুত্র ইলীহূ প্রমুখ কয়েকটি চরিত্র উপস্থাপন করে তাদের মুখ দিয়ে বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আসলে তিনি নিজের মনগড়া দর্শন বর্ণনা করেছেন। তার কাব্য প্রতিভা ও চমৎকার বর্ণনা ভংগীর যতই প্রশংসা করতে পারেন করুন কিন্তু তাকে পবিত্র কিতাব ও আসমানী সহীফার অন্তর্ভুক্ত করার কোন অর্থ নেই। আইয়ুব আলাইহিস সালামের জীবনী ও সীরাতের সাথে তার সম্পর্ক ঠিক ততটুকু যতটুকু সম্পর্ক আছে “ইউসুফ যোলায়খা”র সাথে ইউসুফ আলাইহিস সালামের। বরং সম্ভবত অতটুকুও নেই। বড়জোর আমরা এতটুকু বলতে পারি যে, এ পুস্তকের প্রথম ও শেষ অংশে যেসব ঘটনা বলা হয়েছে তার মধ্যে সঠিক ইতিহাসের একটি উপাদান পাওয়া যায়। কবি তা শ্রুতি থেকে গ্রহণ করে থাকবেন, যা তাঁর যুগে মুখে মুখে প্রচলিত ছিল অথবা বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য এমন কোন সহীফাহ থেকে নিয়ে থাকবেন।