একঃ সার্বভৌম কর্তৃত্ব, যার দাসত্ব ও বন্দেগী করতে হবে এবং যার প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে নৈতিক ও তামাদ্দুনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, তা একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত বলে স্বীকার করতে হবে।
দুইঃ ঐ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারীর প্রতিনিধি হিসেবে নবীর নির্দেশের আনুগত্য করতে হবে।
তিনঃ মানুষের জীবনকে হালাল ও হারাম এবং বৈধতা ও অবৈধতার বিধিনিষেধে আবদ্ধকারী আইন ও বিধিবিধান একমাত্র আল্লাহ দান করবেন। অন্যদের চাপানো সমস্ত আইন ও বিধিবিধান বাতিল করতে হবে।
কাজেই হযরত ঈসা (আঃ), হযরত মূসা (আঃ), হযরত মুহাম্মাদ ﷺ ও অন্যান্য নবীদের মিশনের মধ্যে আসলে সামান্যতম পার্থক্যও নেই। যারা বিভিন্ন নবীর মিশন বিভিন্ন বলে গণ্য করেছেন এবং তাদের মিশনের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতির মধ্যে পার্থক্য দেখিয়েছেন, তারা মারাত্মক ভুল করেছেন। বিশ্ব-জাহানের সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারীর পক্ষ থেক তাঁর প্রজাদের দিকে যে ব্যক্তিই নিযুক্ত হয়ে আসবেন তাঁর আসার উদ্দেশ্য এছাড়া আর দ্বিতীয় কিছুই হতে পারে না যে, তিনি প্রজাদেরকে নাফরমানী, স্বেচ্ছাচারিতা ও শিরক (অর্থাৎ সার্বভৌম প্রভুত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে বিশ্ব-জাহানের একচ্ছত্র মালিক ও প্রভু আল্লাহর সাথে আর কাউকে অংশীদার করা এবং নিজের বিশ্বস্ততা ও ইবাদাত বন্দেগীকে তাদের মধ্যে বিভক্ত করে দেয়া) থেকে বিরত রাখবেন এবং আসল ও প্রকৃত মালিকের নির্ভেজাল আনুগত্য, দাসত্ব, পূজা, আরাধনা ও বন্দেগী করার আহ্বান জানাবেন।
দুঃখের বিষয়, ঈসা আলাইহিস সালামের মিশনকে ওপরে কুরআনে যেমন সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে বর্তমান ইনজীলে তেমনটি করা হয়নি। তবুও উপরে যে তিনটি মৌলিক বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে তা বিক্ষিপ্তভাবে ইশারা ইংগিতের আকারে হলেও বর্তমানে ইনজীলে দেখতে পাওয়া যায়। যেমন, হযরত ঈসা (আ) একমাত্র আল্লাহর বন্দেগীর দাওয়াত দিয়েছিলেন, একথা ইনজীলের নিম্নোক্ত ইংগিত থেকে সুস্পষ্ট হয়ঃ
‘‘তোমার ঈশ্বর প্রভূকে প্রণিপাত (সিজদা) করো এবং একমাত্র তাঁরই আরাধনা করো।’’ (মথি ৪: ১০)।
তিনি যে কেবল এরই দাওয়াত দিয়েছিলেন তা নয় বরং তাঁর সমস্ত প্রচেষ্টার উদ্দেশ্যই ছিল, আকাশ রাজ্যে যেমন সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন আল্লাহর নিরংকুশ আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনুরূপভাবে পৃথিবীতেও একমাত্র তাঁরই শরিয়াতী বিধানের আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
“তোমার রাজ্য আসুক। তোমার ইচ্ছা যেমন আকাশে পূর্ণ হয় তেমনি পৃথিবীতেও পূর্ণ হোক।” (মথি ৬:১০)
আবার ঈসা আলাইহিস সালাম নিজেকে নবী ও আসমানী রাজত্বের প্রতিনিধি হিসেবে পেশ করতেন এবং এ হিসেবেই লোকদেরকে নিজের আনুগত্য করার দাওয়াত দিতেন। তাঁর ভারসাম্যপূর্ণ বক্তব্যগুলো থেকে জানা যায়, তিনি নিজের জন্মভূমি ‘নাসেরা’ (নাজারাথ)-তে নিজের দাওয়াতের সূচনা করলে তাঁর আত্মীয়স্বজন ও শহরবাসীরাই তাঁর বিরোধিতায় নেমে পড়ে। এ সম্পর্কে মথি, মার্ক ও লুক একযোগে বর্ণনা করেছেন যে, “নবী তাঁর স্বদেশে জনপ্রিয় হন না।” তারপর জেরুসালেমে যখন তাঁর হত্যার চক্রান্ত চলতে লাগলো এবং লোকেরা তাঁকে অন্য কোথাও চলে যাবার পরামর্শ দিল তখন তিনি জবাব দিলেনঃ “নবী জেরুসালেমের বাইরে মৃত্যুবরণ করবে, এটা সম্ভব নয়।” (লুক ১৩: ৩৩) শেষবার যখন তিনি জেরুসালেম প্রবেশ করেছিলেন, তখন তাঁর শিষ্যবর্গ উচ্চস্বরে বলতে লাগলোঃ “ ধন্য সেই রাজা যিনি প্রভূর নামে আসছেন।” একথায় ইহুদী আলেমরা অসন্তুষ্ট হলেন এবং তারা হযরত ঈসাকে বললেন, “আপনার শিষ্যদের মুখ বন্ধ করুন।” হযরত ঈসা বললেনঃ “ওরা যদি মুখ বন্ধ করে তাহলে পাথরগুলো চীৎকার করে উঠবে।” (লুক ১৯: ৩৮-৪০) আর একবার তিনি বললেনঃ
“হে শ্রমজীবীরা! হে ভারবহনে পিষ্টলোকেরা! সবাই আমার কাছে এসো। আমি তোমাদের বিশ্রাম দান করবো। আমার জোয়াল তোমাদের কাঁধে উঠিয়ে নাও। ...... আমার জোয়াল সহজে বহনীয় এবং আমার বোঝা হালকা।” (মথি ১১: ২৮-৩০)।
এ ছাড়া ঈসা আলাইহিস সালাম মানব রচিত আইনের পরিবর্তে আল্লাহ প্রদত্ত আইনের আনুগত্য করতে চাইতেন একথাও মথি ও মার্কের বর্ণনা থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রকাশিত হয়। তাদের বর্ণনার সারনির্যাস হচ্ছেঃ ইহুদী আলেমগণ অভিযোগ করলেন, আপনার শিষ্যরা পূর্ববর্তী সম্মানীয় বুযুর্গের ঐতিহ্যের বিপরীত হাত না ধূয়েই আহার করে কেন? হযরত ঈসা (আঃ) এর জবাবে বললেনঃ তোমাদের মতো রিয়াকারদের অবস্থা হচ্ছে ঠিক তেমনি যেমন হযরত ইয়াসইয়া নবীর কন্ঠে এ তিরস্কার করা হয়েছেঃ “এই উম্মত মুখে আমার প্রতি মর্যাদার বাণী উচ্চারণ করে কিন্তু তাদের হৃদয় আমার থেকে দূরে। কারণ এরা মানবিক বিধানের শিক্ষা দেয়।” তোমরা আল্লাহর হুকুমকে বাতিল করে থাক এবং নিজেদের বানোয়াট আইনকে প্রতিষ্ঠিত রাখো। আল্লাহ তাওরাতের মাধ্যমে তোমাদের হুকুম দিয়েছিলেন, মা-বাপের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করো এবং যে ব্যক্তি মা-বাপকে সম্মান করবে না তার প্রাণনাশ করো। কিন্তু তোমরা বলছো যে ব্যক্তি মা-বাপকে একথা বলে দেয়, আমার যে খেদমত তোমার কাজে লাগতে পারে তাকে আমি আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছি, তার জন্য মা-বাপের খেদমত না করা সম্পূর্ণ বৈধ। (মথি ১৫: ৩-৯, মার্ক ৭: ৫-১৩)