আলে ইমরান

২০০ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
আয়াত
-
১ ) আলিফ লাম-মীম।
الٓمٓ ١
২ ) আল্লাহ্‌ এক চিরঞ্জীব ও শাশ্বত সত্ত্বা, যিনি বিশ্ব –জাহানের সমগ্র ব্যবস্থাপনাকে ধারণ করে আছেন, আসলে তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ্‌ নেই।
ٱللَّهُ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلْحَىُّ ٱلْقَيُّومُ ٢
৩ ) তিনি তোমার ওপর এই কিতাব নাযিল করেছেন, যা সত্যের বাণী বহন করে এনেছে এবং আগের কিতাবগুলোর সত্যতা প্রমাণ করছে। এর আগে তিনি মানুষের হিদায়াতের জন্য তাওরাত ও ইঞ্জিল নাযিল করেছিলেন। আর তিনি মানদণ্ড নাযিল করেছেন (যা সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করে দেয়)।
نَزَّلَ عَلَيْكَ ٱلْكِتَٰبَ بِٱلْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ وَأَنزَلَ ٱلتَّوْرَىٰةَ وَٱلْإِنجِيلَ ٣
৪ ) এখন যারা আল্লাহ‌র বিধানসমূহ মেনে নিতে অস্বীকার করবে, তারা অবশ্যই কঠিন শাস্তি পাবে। আল্লাহ‌ অসীম ক্ষমতার অধিকারী এবং তিনি অন্যায়ের শাস্তি দিয়ে থাকেন।
مِن قَبْلُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَأَنزَلَ ٱلْفُرْقَانَ إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ بِـَٔايَٰتِ ٱللَّهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ وَٱللَّهُ عَزِيزٌ ذُو ٱنتِقَامٍ ٤
৫ ) পৃথিবী ও আকাশের কোন কিছুই আল্লাহ‌র কাছে গোপন নেই।
إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَخْفَىٰ عَلَيْهِ شَىْءٌ فِى ٱلْأَرْضِ وَلَا فِى ٱلسَّمَآءِ ٥
৬ ) তিনি মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় যেভাবে ইচ্ছা তোমাদের আকৃতি গঠন করেন। এই প্রবল পরাক্রান্ত মহাজ্ঞানের অধিকারী সত্ত্বা ছাড়া আর কোন ইলাহ্‌ নেই।
هُوَ ٱلَّذِى يُصَوِّرُكُمْ فِى ٱلْأَرْحَامِ كَيْفَ يَشَآءُ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْحَكِيمُ ٦
৭ ) তিনিই তোমাদের প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছেন। এ কিতাবে দুই ধরনের আয়াত আছেঃ এক হচ্ছে, মুহকামাত, যেগুলো কিতাবের আসল বুনিয়াদ এবং দ্বিতীয় হচ্ছে, মুতাশাবিহাত। যাদের মনে বক্রতা আছে তারা ফিতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সবসময় মুতাশাবিহাতের পিছনে লেগে থাকে এবং তার অর্থ করার চেষ্টা করে থাকে। অথচ সেগুলোর আসল অর্থ আল্লাহ‌ ছাড়া আর কেউ জানে না। বিপরীত পক্ষে পরিপক্ক জ্ঞানের অধিকারীরা বলেঃ “আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি, এসব আমাদের রবের পক্ষ থেকেই এসেছে”। আর প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানবান লোকেরাই কোন বিষয় থেকে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে।
هُوَ ٱلَّذِىٓ أَنزَلَ عَلَيْكَ ٱلْكِتَٰبَ مِنْهُ ءَايَٰتٌ مُّحْكَمَٰتٌ هُنَّ أُمُّ ٱلْكِتَٰبِ وَأُخَرُ مُتَشَٰبِهَٰتٌ فَأَمَّا ٱلَّذِينَ فِى قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَٰبَهَ مِنْهُ ٱبْتِغَآءَ ٱلْفِتْنَةِ وَٱبْتِغَآءَ تَأْوِيلِهِۦ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُۥٓ إِلَّا ٱللَّهُ وَٱلرَّٰسِخُونَ فِى ٱلْعِلْمِ يَقُولُونَ ءَامَنَّا بِهِۦ كُلٌّ مِّنْ عِندِ رَبِّنَا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّآ أُو۟لُوا۟ ٱلْأَلْبَٰبِ ٧
৮ ) তারা আল্লাহ‌র কাছে দোয়া করতে থাকেঃ “হে আমাদের রব! যখন তুমি আমাদের সোজা পথে চালিয়েছো তখন আর আমাদের অন্তরকে বক্রতায় আচ্ছন্ন করে দিয়ো না, তোমার দান ভাণ্ডার থেকে আমাদের জন্য রহমত দান করো কেননা তুমিই আসল দাতা।
رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنتَ ٱلْوَهَّابُ ٨
৯ ) হে আমাদের রব! অবশ্যি তুমি সমগ্র মানব জাতিকে একদিন একত্রে সমবেত করবে, যে দিনটির আগমনের ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তুমি কখনো ওয়াদা থেকে বিচ্যুত হও না।”
رَبَّنَآ إِنَّكَ جَامِعُ ٱلنَّاسِ لِيَوْمٍ لَّا رَيْبَ فِيهِ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُخْلِفُ ٱلْمِيعَادَ ٩
১০ ) যারা কুফরী নীতি অবলম্বন করেছে, তাদের না ধন–সম্পদ, না সন্তান–সন্ততি আল্লাহ‌র মোকাবিলায় কোন কাজে লাগবে। তারা দোজখের ইন্ধনে পরিণত হবেই।
إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ لَن تُغْنِىَ عَنْهُمْ أَمْوَٰلُهُمْ وَلَآ أَوْلَٰدُهُم مِّنَ ٱللَّهِ شَيْـًٔا وَأُو۟لَٰٓئِكَ هُمْ وَقُودُ ٱلنَّارِ ١٠
১.
এর ব্যাখ্যা জানার জন্য সূরা আল বাকারার ২৭৮ টীকা দেখুন।
২.
সাধারণভাবে লোকেরা তাওরাত বলতে বাইবেলের ওল্‌ড টেস্টামেন্টের (পুরাতন নিয়ম) প্রথম দিকের পাঁচটি পুস্তক এবং ইঞ্জিল বলতে নিউ টেস্টামেণ্টের (নতুন নিয়ম) চারটি প্রসিদ্ধ ইঞ্জিল মনে করে থাকে। তাই এ পুস্তকগুলো সত্যিই আল্লাহ‌র কালাম কিনা, এ প্রশ্ন দেখা দেয়। আর এই সঙ্গে এ প্রশ্নও দেখা দেয় যে, এই পুস্তকগুলোতে যেসব কথা লেখা আছে যথার্থই কুরআন সেগুলোকে সত্য বলে কিনা। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই যে, তাওরাত বাইবেলের প্রথম পাঁচটি পুস্তকের নাম নয় বরং এগুলোর মধ্যে তাওরাত নিহিত রয়েছে এবং ইঞ্জিল নিউ টেস্টামেন্টের চারটি ইঞ্জিলের নাম নয় বরং এগুলোর মধ্যে ইঞ্জিল পাওয়া যায়।

আসলে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের নবুওয়াত লাভের পর থেকে তাঁর ইন্তিকাল পর্যন্ত প্রায় চল্লিশ বছর ধরে তাঁর ওপর যেসব বিধান অবতীর্ণ হয়েছিল সেগুলোই তাওরাত। এর মধ্যে পাথরের তক্তার গায়ে খোদাই করে দশটি বিধান আল্লাহ‌ তাঁকে দান করেছিলেন। অবশিষ্ট বিধানগুলো হযরত মূসা (আঃ) লিখিয়ে তার বারোটি অনুলিপি করে বারোটি গোত্রকে দান করেছিলেন এবং একটি কপি সংরক্ষণ করার জন্য দান করেছিলেন বণী লাবীকে। এ কিতাবের নাম ছিল তাওরাত। বাইতুল মাকদিস প্রথমবার ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত এটি একটি স্বতন্ত্র কিতাব হিসেবে সংরক্ষিত ছিল। বনি লাবীকে যে কপিটি দেয়া হয়েছিল, পাথরের তক্তা সহকারে সেটি ‘অঙ্গীকারের সিন্দুকে’র মধ্যে রাখা হয়েছিল। বনী ইসরাঈল সেটিকে ‘তাওরীত’ নামেই জানতো। কিন্তু তার ব্যাপারে তাদের গাফলতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যার ফলে ইয়াহুদীয়ার বাদশাহ ইউসিয়ার আমলে যখন ‘হাইকেলে সুলাইমানী’ মেরামত করা হয়েছিল তখন ঘটনাক্রমে ‘কাহেন’ প্রধান (অর্থাৎ হাইকেল বা উপাসনা গৃহের গদীনশীন এবং জাতির প্রধান ধর্মীয় নেতা)। খিলকিয়াহ একস্থানে তাওরীত সুরক্ষিত অবস্থায় পেয়ে গেলেন। তিনি একটি অদ্ভুত বস্তু হিসেবে এটি বাদশাহর প্রধান সেক্রেটারীকে দিলেন। সেক্রেটারী সেটিকে এমনভাবে বাদশাহর-সামনে পেশ করেন যেন ঐটি একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার (২-রাজাবলী, অধ্যায় ২২, শ্লোক ৮-১৩ দেখুন)। এ কারণেই বখ্‌তে নসর যখন জেরুসালেম জয় করে হাইকেলসহ সারা শহর ধ্বংস করে দিল তখন বনী ইসরাঈলরা তাওরাতের যে মূল কপিটিকে বিস্মৃতির সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছিল এবং যার অতি অল্প সংখ্যক অনুলিপি তাদের কাছে ছিল, সেগুলো হারিয়ে ফেললো চিরকালের জন্য। তারপর আযরা (উযাইর) কাহেনের যুগে বনী ইসরাঈলদের অবশিষ্ট লোকেরা বেবিলনের কারাগার থেকে জেরুসালেমে ফিরে এলো এবং বাইতুল মাকদিস পূনর্নিমান করা হলো। এ সময় উযাইর নিজের জাতির আরো কয়েকজন মনীষীর সহায়তায় বনী ইসরাঈলদের পূর্ণ ইতিহাস লিখে ফেললেন। বর্তমান বাইবেলের প্রথম সতেরোটি পরিচ্ছেদ এ ইতিহাস সম্বলিত। এ ইতিহাসের চারটি অধ্যায় অর্থাৎ যাত্রা, লেবীয়, গণনা ও দ্বিতীয় বিবরণে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের জীবনী লিপিবদ্ধ হয়েছে। আযরা ও তার সহযোগীরা তাওরাতের যতগুলো আয়াত সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন এই জীবন ইতিহাসের বিভিন্ন স্থানে অবতীর্ণের সময়-কাল ও ধারাবাহিকতা অনুযায়ী ঠিক জায়গা মতো সেগুলো সন্নিবেশিত হয়েছে। কাজেই এখন মূসা আলাইহিস সালামের জীবন ইতিহাসের মধ্যে সেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অংশের নামই তাওরাত। এগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য আমরা কেবলমাত্র নিম্নোক্ত আলামতের ওপর নির্ভর করতে পারি। এ ঐতিহাসিক বর্ণনার মাঝখানে যেখানে লেখক বলেন, প্রভু মূসাকে একথা বললেন অথবা মূসা বলেন, সদাপ্রভু তোমাদের প্রভু একথা বললেন, সেখান থেকে তাওরাতের একটি অংশ শুরু হচ্ছে, তারপর আবার যেখান থেকে জীবনী প্রসঙ্গ শুরু হয়ে গেছে সেখান থেকে ঐ অংশ খতম হয়ে গেছে ধরে নিতে হবে। মাঝখানে যেখানে যেখানে বাইবেলের লেখক ব্যাখ্যা বা টীকা আকারে কিছু অংশ বৃদ্ধি করেছে, সেগুলো চিহ্নিত করে ও বাছাই করে আসল তাওরাত থেকে আলাদা কিতাবসমূহের গভীর জ্ঞান রাখেন, তারা ঐসব অংশের কোথায় কোথায় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ মূলক বৃদ্ধি করা হয়েছে কিছুটা নির্ভুলভাবে তা অনুধাবন করতে পারেন। এ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অংশগুলোকেই কুরআন তাওরাত নামে আখ্যায়িত করেছে। কুরআন এগুলোকেই সত্য বলে ঘোষণা দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ অংশগুলোকে একত্র করে কুরআনের পাশাপাশি দাঁড় করালে কোন কোন স্থানে ছোট খাটো ও খুঁটিনাটি বিধানের মধ্যে কিছু বিরোধ দেখা গেলেও মৌলিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সামান্যতম পার্থক্যও পাওয়া যাবে না। আজও একজন সচেতন পাঠক সুস্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারেন যে, এ দু’টি স্রোতধারা একই উৎস থেকে উৎসারিত।

অনুরূপভাবে ইঞ্জিল হচ্ছে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের ইলহামী ভাষণ ও বাণী সমষ্টি, যা তিনি নিজের জীবনের শেষ আড়াই-তিন বছরে নবী হিসেবে প্রচার করেন। এ পবিত্র বাণীসমূহ তাঁর জীবদ্দশায় লিখিত, সংকলিত ও বিন্যস্ত হয়েছিল কিনা সে সম্পর্কে জানার কোন উপায় আমাদের কাছে নেই। হতে পারে কিছু লোক সেগুলো নোট করে নিয়েছিলেন। আবার এমনও হতে পারে, শ্রবণকারী ভক্তবৃন্দ সেগুলো কণ্ঠস্থ করে ফেলেছিলেন। যাহোক দীর্ঘকাল পরে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জীবন বৃত্তান্ত সম্বলিত বিভিন্ন পুস্তিকা রচনা কালে তাতে ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সাথে সাথে ঐ পুস্তিকাগুলোর রচয়িতাদের কাছে মৌখিক বাণী ও লিখিত স্মৃতিকথা আকারে হযরত ঈসার (আঃ) যেসব বাণী ও ভাষণ পৌঁছেছিল সেগুলোও বিভিন্ন স্থানে জায়গা মতো সংযোজিত হয়েছিল। বর্তমানে মথি, র্মাক, লুক ও যোহন লিখিত যেসব পুস্তককে ইঞ্জিল বলা হয় সেগুলো আসলে ইঞ্জিল নয়। বরং ইঞ্জিল হচ্ছে ঐ পুস্তকগুলোতে সংযোজিত হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের বাণীসমূহ। আমাদের কাছে সেগুলো চেনার ও জীবনীকারদের নিজেদের কথা থেকে সেগুলো আলাদা করার এছাড়া আর দ্বিতীয় কোন মাধ্যম নেই যে, যেখানে জীবনীকার বলেন, ঈসা বলেছেন অথবা মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন-কেবলমাত্র এ স্থানগুলো আসল ইঞ্জিলের অংশ। কুরআন এ অংশগুলোর সমষ্টিকে ইঞ্জিল নামে অভিহিত করে এবং এরই সত্যতার ঘোষণা দেয়। এ বিক্ষিপ্ত অংশগুলোকে একত্র করে আজ যে কেউ কুরআনের পাশাপাশি রেখে এর সত্যতা বিচার করতে পারেন। তিনি উভয়ের মধ্যে অতি সামান্য পার্থক্যই দেখতে পাবেন। আর যে সামান্য পার্থক্য অনুভূত হবে পক্ষপাতহীন চিন্তা-ভাবনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা সহজেই দূর করা যাবে।

৩.
অর্থাৎ তিনি বিশ্ব-জাহানের যাবতীয় তত্ত্ব ও বাস্তব সত্য জানেন। কাজেই যে কিতাব তিনি নাযিল করেছেন তা পরিপূর্ণ সত্যই হওয়া উচিত। বরং নির্ভেজাল সত্য একমাত্র সেই কিতাবের মধ্যেই পাওয়া যেতে পারে যেটি সেই সর্বজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী সত্ত্বার পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছে।
৪.
এখানে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এক, তোমাদের প্রকৃতিকে তাঁর মতো করে কেউ জানতে পারে না, এমনকি তোমরা নিজেরাও জানতে পারো না। কাজেই তার পথপ্রদর্শন ও পথনির্দেশনার ওপর আস্থা স্থাপন করা ছাড়া তোমাদের গত্যন্তর নেই। দুই, যিনি গর্ভাশয়ে তোমাদের উৎপত্তি থেকে শুরু করে পরবর্তী সকল পর্যায়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে তোমাদের ছোট ছোট প্রয়োজনগুলোও পূর্ণ করার ব্যবস্থা করেছেন, তিনি দুনিয়ার জীবনে তোমাদের হিদায়াত ও পথ প্রদর্শনের ব্যবস্থা করবেন না, এটা কেমন করে সম্ভব হতে পারে? অথচ তোমরা সবচেয়ে বেশী এ জিনিসটিরই মুখাপেক্ষী।
৫.
মুহকাম পাকাপোক্ত জিনিসকে বলা হয়। এর বহুবচন ‘মুহকামাত’। ‘মুহকামাত আয়াত’ বলতে এমন সব আয়াত বুঝায় যেগুলোর ভাষা একেবারেই সুস্পষ্ট, যেগুলোর অর্থ নির্ধারণ করার ব্যাপারে কোনো প্রকার সংশয়-সন্দেহে অবকাশ থাকে না, যে শব্দগুলো দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য উপস্থাপন করে এবং যেগুলোর অর্থ বিকৃত করার সুযোগ লাভ করা বড়ই কঠিন। এ আয়াতগুলো ‘কিতাবের আসল বুনিয়াদ’। অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যে কুরআন নাযিল করা হয়েছে এ আয়াতগুলো সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ করে। এ আয়াতগুলোর মাধ্যমে দুনিয়াবাসীকে ইসলামের দিকে আহবান জানানো হয়েছে। এগুলোতেই শিক্ষা ও উপদেশের কথা বর্ণিত হয়েছে। ভ্রষ্টতার গলদ তুলে ধরে সত্য-সঠিক পথের চেহারা সুস্পষ্ট করা হয়েছে। দ্বীনের মূলনীতি এবং আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদাত, চরিত্রনীতি, দায়িত্ব-কর্তব্য ও আদেশ-নিষেধের বিধান এ আয়াতগুলোতেই বর্ণিত হয়েছে। কাজেই কোন সত্যানুসন্ধানী ব্যক্তি কোন্ পথে চলবে এবং কোন্ পথে চলবে না একথা জানার জন্য যখন কুরআনের শরণাপন্ন হয় তখন 'মুহকাম' আয়াতগুলোই তার পথপ্রদর্শন করে। স্বাভাবিকভাবে এগুলোর প্রতি তার দৃষ্টি নিবন্ধ হয় এবং এগুলো থেকে উপকৃত হবার জন্য সে প্রচেষ্টা চালাতে থাকে।
৬.
‘মুতাশাবিহাত’ অর্থ যেসব আয়াতের অর্থ গ্রহণে সন্দেহ-সংশয়ের ও বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে দেবার অবকাশ রয়েছে।

বিশ্ব-জাহানের অন্তর্নিহিত সত্য ও তাৎপর্য, তার সূচনা ও পরিণতি, সেখানে মানুষের অবস্থান, মর্যাদা ও ভূমিকা এবং এ ধরনের আরো বিভিন্ন মৌলিক বিষয় সম্পর্কিত সর্বনিম্ন অপরিহার্য তথ্যাবলী মানুষকে সরবরাহ না করা পর্যন্ত মানুষের জীবন পথে চলার জন্য কোন পথনির্দেশ দেয়া যেতে পারে না, এটি একটি সর্বজনবিদিত সত্য। আবার একথাও সত্য, মানবিক ইন্দ্রিয়ানুভুতির বাইরের বস্তু-বিষয়গুলো, যেগুলো মানবিক জ্ঞানের আওতায় কখনো আসেনি এবং আসতেও পারে না, যেগুলোকে সে কখনো দেখেনি, স্পর্শ করেনি এবং যেগুলোর স্বাদও গ্রহণ করেনি, সেগুলো বুঝাবার জন্য মানুষের ভাষার ভাণ্ডারে কোন শব্দও রচিত হয়নি এবং প্রত্যেক শ্রোতার মনে তাদের নির্ভুল ছবি অংকিত করার মতো কোন পরিচিত বর্ণনা পদ্ধতিও পাওয়া যায় না। কাজেই এ ধরনের বিষয় বুঝাবার জন্য এমন সব শব্দ ও বর্ণনা পদ্ধতি অবলম্বন করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে, যেগুলো প্রকৃত সত্যের সাথে নিকটতর সাদৃশ্যের অধিকারী অনুভবযোগ্য জিনিসগুলো বুঝাবার জন্য মানুষের ভাষায় পাওয়া যায়। এ জন্য অতি প্রাকৃতিক তথা মানবিক জ্ঞানের ঊর্ধ্বের ও ইন্দ্রিয়াতীত বিষয়গুলো বুঝাবার জন্য কুরআন মজীদে এ ধরনের শব্দ ও ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। যেসব আয়াতে এ ধরনের ভাষা ও শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলোকেই ‘মুতাশাবিহাত’ বলা হয়।

কিন্তু এ ভাষা ব্যবহারের ফলে মানুষ বড় জোর সত্যের কাছাকাছি পৌঁছতে পারে অথবা সত্যের অস্পষ্ট ধারণা তার মধ্যে সৃষ্টি হতে পারে, এর বেশী নয়। এ ধরনের আয়াতের অর্থ নির্ণয়ের ও নির্দিষ্টকরনের জন্য যত বেশী চেষ্টা করা হবে তত বেশী সংশয়-সন্দেহ ও সম্ভাবনা বাড়তে থাকবে। ফলে মানুষ প্রকৃত সত্যের নিকটতর হবার চাইতে বরং তার থেকে আরো দূরে সরে যাবে। কাজেই যারা সত্যসন্ধানী এবং আজেবাজে অর্থহীন বিষয়ের চর্চা করার মানসিকতা যাদের নেই, তারা ‘মুতাশাবিহাত’ থেকে প্রকৃত সত্য সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা লাভ করেই সন্তুষ্ট থাকে। এতটুকুন ধারণাই তাদের কাজ চালাবার জন্য যথেষ্ট হয়। তারপর তারা ‘মুহ্‌কামাত’ এর পেছনে নিজেদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। কিন্তু যারা ফিত্‌নাবাজ অথবা বাজে কাজে সময় নষ্ট করতে অভ্যস্ত, তাদের কাজই হয় মুতাশাবিহাতের আলোচনায় মশগুল থাকা এবং তার সাহায্যেই তারা পেছন দিয়ে সিঁদ কাটে।

৭.
এখানে এ অমূলক সন্দেহ করার কোন প্রশ্নই ওঠে না যে, মুতাশাবিহাতের সঠিক অর্থ যখন তারা জানে না তখন তারা তার ওপর কেমন করে ঈমান আনে? আসলে একজন সচেতন বিবেক-বুদ্ধির অধিকারী ব্যক্তির মনে মুতাশাবিহাত আয়াতগুলোর দূরবর্তী অসঙ্গত বিশ্লেষণ ও অস্পষ্ট বিকৃত ব্যাখ্যার মাধ্যমে কুরআন আল্লাহ‌র কিতাব হবার বিশ্বাস জন্মে না। এ বিশ্বাস জন্মে মুহকামাত আয়াতগুলো অধ্যয়নের মাধ্যমে। মুহকামাত আয়াতগুলোর মধ্যে চিন্তা-গবেষণা করার পর যখন তার মনে কুরআন আল্লাহ‌র কিতাব হবার ব্যাপারে পরিপূর্ণ নিশ্চিন্ততা আসে তখন মুতাশাবিহাত তার মনে কোনো প্রকার দ্বন্দ্ব ও সংশয় সৃষ্টিতে সক্ষম হয় না। তাদের যতটুকু সরল অর্থ সে অনুধাবন করতে সক্ষম হয় ততটুকুই গ্রহণ করে নেয় আর যেখানে অর্থের জটিলতা দেখা দেয় সেখানে দূরবীণ লাগিয়ে অর্থের গভীরে প্রবেশ করার নামে উল্টা-সিধা অর্থ করার পরিবর্তে সে আল্লাহ‌র কালামের ওপর সামগ্রিকভাবে ঈমান এনে কাজের কথাগুলোর দিকে নিজে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয়।
৮.
এর ব্যাখ্যার জন্য সূরা বাকারার ১৬১ টীকা দেখুন।
অনুবাদ: