১৪১ ) এই মুনাফিকরা তোমাদের ব্যাপারে অপেক্ষা করছে। তারা দেখছে পানি কোন্ দিকে গড়ায়। যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের বিজয় সূচিত হয় তাহলে তারা এসে বলবে, আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না? আর যদি কাফেরদের পাল্লা ভারী থাকে তাহলে তাদেরকে বলবে, আমরা কি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সক্ষম ছিলাম না? এরপরও আমরা মুসলমানদের হাত থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করেছি। ১৭১ কাজেই কিয়ামতের দিন তোমাদের ও তাদের ব্যাপারে ফায়সালা আল্লাহই করে দেবেন। আর (এই ফায়সালায়) আল্লাহ কাফেরদের জন্য মুসলমানদের ওপর বিজয় লাভ করার কোন পথই রাখেননি।
ٱلَّذِينَ يَتَرَبَّصُونَ بِكُمْ فَإِن كَانَ لَكُمْ فَتْحٌ مِّنَ ٱللَّهِ قَالُوٓا۟ أَلَمْ نَكُن مَّعَكُمْ وَإِن كَانَ لِلْكَٰفِرِينَ نَصِيبٌ قَالُوٓا۟ أَلَمْ نَسْتَحْوِذْ عَلَيْكُمْ وَنَمْنَعْكُم مِّنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ فَٱللَّهُ يَحْكُمُ بَيْنَكُمْ يَوْمَ ٱلْقِيَٰمَةِ وَلَن يَجْعَلَ ٱللَّهُ لِلْكَٰفِرِينَ عَلَى ٱلْمُؤْمِنِينَ سَبِيلًا ١٤١
১৪২ ) এই মুনাফিকরা আল্লাহর সাথে ধোঁকাবাজি করছে। অথচ আল্লাহই তাদেরকে ধোঁকার মধ্যে ফেলে রেখে দিয়েছেন। তারা যখন নামাযের জন্য ওঠে, আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে শৈথিল্য সহকারে নিছক লোক দেখাবার জন্য ওঠে এবং আল্লাহকে খুব কমই স্মরণ করে। ১৭২
إِنَّ ٱلْمُنَٰفِقِينَ يُخَٰدِعُونَ ٱللَّهَ وَهُوَ خَٰدِعُهُمْ وَإِذَا قَامُوٓا۟ إِلَى ٱلصَّلَوٰةِ قَامُوا۟ كُسَالَىٰ يُرَآءُونَ ٱلنَّاسَ وَلَا يَذْكُرُونَ ٱللَّهَ إِلَّا قَلِيلًا ١٤٢
১৪৩ ) কুফর ও ঈমানের মাঝে দোদুল্যমান অবস্থায় থাকে, না পুরোপুরি এদিকে, না পুরোপুরি ওদিকে। যাকে আল্লাহ পথভ্রষ্ট করে দিয়েছেন তার জন্য তুমি কোন পথ পেতে পারো না। ১৭৩
مُّذَبْذَبِينَ بَيْنَ ذَٰلِكَ لَآ إِلَىٰ هَٰٓؤُلَآءِ وَلَآ إِلَىٰ هَٰٓؤُلَآءِ وَمَن يُضْلِلِ ٱللَّهُ فَلَن تَجِدَ لَهُۥ سَبِيلًا ١٤٣
১৪৪ ) হে ঈমানদারগণ! মুমিনদের বাদ দিয়ে কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তোমরা কি নিজেদের বিরুদ্ধে আল্লাহর হাতে সুস্পষ্ট প্রমাণ তুলে দিতে চাও?
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تَتَّخِذُوا۟ ٱلْكَٰفِرِينَ أَوْلِيَآءَ مِن دُونِ ٱلْمُؤْمِنِينَ أَتُرِيدُونَ أَن تَجْعَلُوا۟ لِلَّهِ عَلَيْكُمْ سُلْطَٰنًا مُّبِينًا ١٤٤
১৪৫ ) নিশ্চিত জেনো, মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে চলে যাবে এবং তোমরা কাউকে তাদের সাহায্যকারী হিসেবে পাবে না।
إِنَّ ٱلْمُنَٰفِقِينَ فِى ٱلدَّرْكِ ٱلْأَسْفَلِ مِنَ ٱلنَّارِ وَلَن تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا ١٤٥
১৪৬ ) তবে তাদের মধ্য থেকে যারা তাওবা করবে, নিজেদের কর্মনীতি সংশোধন করে নেবে, আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে এবং নিজেদের দ্বীনকে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে নেবে, ১৭৪ তারা মুমিনদের সাথে থাকবে। আর আল্লাহ নিশ্চিয়ই মুমিনদেরকে মহাপুরস্কার দান করবেন।
إِلَّا ٱلَّذِينَ تَابُوا۟ وَأَصْلَحُوا۟ وَٱعْتَصَمُوا۟ بِٱللَّهِ وَأَخْلَصُوا۟ دِينَهُمْ لِلَّهِ فَأُو۟لَٰٓئِكَ مَعَ ٱلْمُؤْمِنِينَ وَسَوْفَ يُؤْتِ ٱللَّهُ ٱلْمُؤْمِنِينَ أَجْرًا عَظِيمًا ١٤٦
১৪৭ ) আল্লাহর কি প্রয়োজন তোমাদের অযথা শাস্তি দেবার, যদি তোমরা কৃতজ্ঞ বান্দা হয়ে থাকো। ১৭৫ এবং ঈমানের নীতির ওপর চলো? আল্লাহ বড়ই পুরস্কার দানকারী ১৭৬ ও সর্বজ্ঞ।
مَّا يَفْعَلُ ٱللَّهُ بِعَذَابِكُمْ إِن شَكَرْتُمْ وَءَامَنتُمْ وَكَانَ ٱللَّهُ شَاكِرًا عَلِيمًا ١٤٧
১৪৮ ) মানুষ খারাপ কথা বলে বেড়াক, এটা আল্লাহ পছন্দ করেন না। তবে কারো প্রতি জুলুম করা হলে তার কথা স্বতন্ত্র। আর আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন। (মজলুম অবস্থায় তোমাদের খারাপ কথা বলার অধিকার থাকলেও)
لَّا يُحِبُّ ٱللَّهُ ٱلْجَهْرَ بِٱلسُّوٓءِ مِنَ ٱلْقَوْلِ إِلَّا مَن ظُلِمَ وَكَانَ ٱللَّهُ سَمِيعًا عَلِيمًا ١٤٨
১৪৯ ) যদি তোমরা প্রকাশ্যে ও গোপনে সৎকাজ করে যাও অথবা কমপক্ষে অসৎকাজ থেকে বিরত থাকো, তাহলে আল্লাহও বড়ই ক্ষমা-গুণের অধিকারী। অথচ তিনি শাস্তি দেবার পূর্ণ ক্ষমতা রাখেন। ১৭৭
إِن تُبْدُوا۟ خَيْرًا أَوْ تُخْفُوهُ أَوْ تَعْفُوا۟ عَن سُوٓءٍ فَإِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَفُوًّا قَدِيرًا ١٤٩
১৫০ ) যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলদের সাথে কুফরী করে, আল্লাহ ও তাঁর রসূলদের মধ্যে পার্থক্য করতে চায় এবং বলে আমরা কাউকে মানবো ও কাউকে মানবো না আর কুফর ও ঈমানের মাঝখানে একটি পথ বের করতে চায়,
إِنَّ ٱلَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦ وَيُرِيدُونَ أَن يُفَرِّقُوا۟ بَيْنَ ٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦ وَيَقُولُونَ نُؤْمِنُ بِبَعْضٍ وَنَكْفُرُ بِبَعْضٍ وَيُرِيدُونَ أَن يَتَّخِذُوا۟ بَيْنَ ذَٰلِكَ سَبِيلًا ١٥٠
১৭১.
এটিই প্রত্যেক যুগের মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য। মৌখিক স্বীকারোক্তি ও ইসলামের গণ্ডীর মধ্যে নামমাত্র প্রবেশের মাধ্যমে মুসলমান হিসেবে যতটুকু স্বার্থ ভোগ করা যায় তা তারা ভোগ করে। আবার অন্যদিকে কাফের হিসেবে যে স্বার্থটুকু ভোগ করা সম্ভব তা ভোগ করার জন্য তারা কাফেরদের সাথে যোগ দেয়। তারা সর্বোতভাবে কাফেরদের বিশ্বাসভাজন হবার চেষ্টা করে। তাদেরকে বলেঃ আমরা মোটেই “গোঁড়া ও বিদ্বেষপরায়ণ” মুসলমান নই। মুসলমাদের সাথে আমাদের অবশ্যি নামের সম্পর্ক আছে কিন্তু আমাদের মানসিক ঝোক, আগ্রহ ও বিশ্বস্ততা রয়েছে তোমাদের প্রতি। চিন্তা –ভাবনা, আচার-ব্যবহার, রুচি-প্রকৃতি ইত্যাদি সবদিক দিয়ে তোমাদের সাথে আমাদের গভীর মিল। তাছাড়া ইসলাম ও কুফরীর সংঘর্ষে আমরা তোমাদের পক্ষই অবলম্বন করবো।
১৭২.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জামানায়কোন ব্যক্তি নিয়মিত নামায না পড়ে মুসলমানদের দলের অন্তর্ভুক্ত হতে পারতো না। দুনিয়ার বিভিন্ন দল ও মজলিস যেমন তাদের বৈঠকগুলোতে কোন সদস্যের বিনা ওজরে অনুপস্থিত থাকাকে দলের প্রতি তার অনাগ্রহ মনে করে থাকে এবং পরপর কয়েকটি সভায় অনুপস্থিত থাকলে তার সদস্যপদ বাতিল করে তাকে দল থেকে বের করে দেয়, ঠিক তেমনি ইসলামী জামায়াতের কোন সদস্যের জামায়াতের সাথে নামাযে গরহাযির থাকাকে সে জামানায় সে ব্যক্তির ইসলামের প্রতি অনাগ্রহের সুস্পষ্ট প্রমাণ মনে করা হতো। আর যদি সে অনবরত কয়েক বার জামায়াতে গরহাযির থাকতো তাহলে ধরে নেয়া হতো সে মুসলমান নয়। তাই বড় বড় কট্টর মুনাফিকদেরও সে যুগে পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে হাযিরি দিতে হতো। কারণ এছাড়া তাদের মুসলমানদের দলের অন্তর্ভুক্ত থাকার আর দ্বিতীয় কোন পথ ছিল না। তবে যে জিনিসটা তাদের সাচ্চা ঈমানদার থেকে আলাদা করতো সেটি হচ্ছে এই যে, সাচ্চা মু’মিনরা বিপুল উৎসাহ আগ্রহ নিয়ে মসজিদে আসতো, জামায়াতের সময়ের পূর্বেই মসজিদে পৌঁছে যেতো এবং নামায শেষ হবার পরও মসজিদে বসে থাকতো। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে একথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠতো যে নামাযের প্রতি তাদের যথার্থই হৃদয়ের টান ও আগ্রহ রয়েছে। বিপরীত পক্ষে আযানের আওয়াজ কানে আসতেই মুনাফিকদের যেন জান বেরিয়ে যেতো। মন চাইতো না তবুও নেহাত দায়ে ঠেকে তারা উঠতো। তাদের মসজিদের দিকে আসার ধরনর দেখে পরিষ্কার বুঝা যেতো যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা আসছে না বরং অনিচ্ছায় নিজেদের টেনে টেনে আনছে। জামায়াত শেষ হবার পর এমনভাবে মসজিদ থেকে পালাতো যেন মনে হতো কয়েদীরা বন্দীশালা থেকে মুক্তি পেয়েছে। তাদের ওঠাবসা চলাফেরা তথা প্রতিটি পদক্ষেপ সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতো যে, আল্লাহর যিকিরের প্রতি তাদের বিন্দুমাত্রও মানসিক টান ও আগ্রহ নেই।
১৭৩.
অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর কালাম ও রসূলের জীবন চরিত্র থেকে হিদায়াত লাভ করেনি, যাকে সত্য বিমুখ ও বাতিলের প্রতি গভীর অনুরাগী দেখে আল্লাহও তাকে সেদিকেই ফিরিয়ে দিয়েছেন যেদিকে সে নিজে ফিরে যেতে চায় এবং তার গোমরাহীকে আঁকড়ে ধরার কারণে আল্লাহ তার জন্য হিদায়াতের দরজা বন্ধ করে কেবল মাত্র গোমরাহীর দরজা খুলে দিয়েছেন। এহেন ব্যক্তিকে সঠিক পথ দেখানো আসলে কোন মানুষের সাধ্যের অতীত। রিযিকের দৃষ্টান্ত থেকে এ বিষয়টি অনুধাবন করা যেতে পারে।
রিযিকের সমস্ত সম্পদ মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর ক্ষমতা ও কুদরতের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন, এটা একটা জাজ্জ্বল্যমান সত্য। মানুষ যা কিছু পায়, যতটুকু পায় আল্লাহর কাছ থেকেই পায়। কিন্তু যে ব্যক্তি যে পথে রিযিক চায় আল্লাহ তাকে সেই পথেই রিযিক দান করেন। যদি কোন ব্যক্তি হালাল পথে রিযিক চায় এবং সেজন্য প্রচেষ্টাও চালাতে থাকে তাহলে আল্লাহ তার জন্য রিযিকের হালাল পথগুলো খুলে দেন। তার নিয়ত যে পরিমাণ সৎ ও নিষ্কলুষ হয় সেই পরিমাণ হারাম পথ তার জন্য বন্ধ করে দেন। বিপরীত পক্ষে যে ব্যক্তি হারাম খাবার জন্য উঠে পড়ে লাগে এবং এ জন্য চেষ্টা-চরিত্র করতে থাকে, আল্লাহর হুকুমে সে হারাম খাবারই পায়। এরপর তার ভাগ্যে হালাল রুজি লিখে দেবার ক্ষমতা আর কারো থাকে না। অনুরূপভাবে এটাও একটা জাজ্জ্বল্যমান সত্য যে, এই দুনিয়ায় চিন্তা ও কর্মের সমস্ত পথ আল্লাহর ক্ষমতা ও ইখতিয়ারের অধীন। আল্লাহর হুকুম, অনুমতি ও তাওফীক তথা সুযোগ দান ছাড়া কোন একটি পথেও চলার ক্ষমতা মানুষের নেই। তবে কোন্ ব্যক্তি কোন পথে চলার অনুমতি পায় এবং কোন্ পথে চলার উপকরণ তার জন্য সংগ্রহ করে দেয়া হয় এটা পুরোপুরি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিজের চাহিদা, প্রচেষ্টা ও সাধনার ওপর। যদি আল্লাহর সাথে তার মানসিক সংযোগ থাকে, সে সত্যানুসন্ধানী হয় এবং সাচ্চা নিয়তে আল্লাহর পথে চলার জন্য প্রচেষ্টা চালায় তাহলে আল্লাহ তাকে তারই অনুমতি ও সুযোগ দান করেন। তখন এ পথে চলার যাবতীয় উপকরণ ও সরঞ্জাম তার আয়ত্তাধীন হয়ে যায়। বিপরীত পক্ষে যে ব্যক্তি গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতা পছন্দ করে এবং ভুল পথে চলার জন্য চেষ্টা-সাধনা করে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্য হিদায়াতের সমস্ত দরজা বন্ধ হয়ে যায় এবং সেই সমস্ত পথ তার জন্য খুলে দেয়া হয় যেগুলো সে নিজের জন্য বাছাই করে নিয়েছে। এহেন ব্যক্তিকে ভুল চিন্তা করার, ভুল কাজ করার ও ভুল পথে নিজের শক্তি-সামর্থ্য ব্যয় করা থেকে নিরস্ত রাখার ক্ষমতা কারো নেই। যে ব্যক্তি নিজেই তার ভাগ্যের সঠিক পথ হারিয়ে বসে এবং আল্লাহ যাকে সঠিক পথ থেকে বঞ্চিত করেন, কেউ তাকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে এবং এই হারানো নেয়ামত খুঁজে দিতে পারে না।
১৭৪.
নিজের দ্বীনকে একান্তভাবে আল্লাহর জন্য করে নেয়ার অর্থ হচ্ছে, মানুষ আল্লাহ ছাড়া আর কারো আনুগত্য করবে না, একমাত্র আল্লাহর প্রতি অনুগত ও বিশ্বস্ত হবে। তার সমস্ত আগ্রহ আকর্ষণ, প্রীতি-ভালোবাসা, ভক্তি-শ্রদ্ধা একমাত্র আল্লাহর প্রতি নিবেদিত হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোন জিনিসকে যে কোন মুহূর্তে বিসর্জন দিতে কুন্ঠিত হবে এমন ধরনের কোন ভালোবাসা বা হৃদয়ের টান তার কোন জিনিসের প্রতি থাকবে না।
১৭৫.
মূল আয়াতে ‘শোকর’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ‘শোকর’ শব্দের আসল অর্থ হচ্ছে নেয়ামতের স্বীকৃতি দেয়া ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা এবং অনুগৃহীত হওয়া। এক্ষেত্রে আয়াতের অর্থ হচ্ছে, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ না হও এবং তার সাথে নিমকহারামী না করো বরং যথার্থই তার প্রতি কৃতজ্ঞ ও অনুগৃহীত থাকো, তাহলে আল্লাহ অনর্থক তোমাদের শাস্তি দেবেন না।
একজন অনুগ্রহকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সঠিক পদ্ধতি কি? হৃদয়ের সমগ্র অনুভূতি দিয়ে তার অনুগ্রহের স্বীকৃতি দেয়া, মুখে এই অনুভূতির স্বীকারোক্তি করা এবং নিজের কার্যকলাপের মাধ্যমে অনুগৃহীত হবার প্রমাণ পেশ করাই হচ্ছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সঠিক উপায়। এই তিনটি কাজের সমবেত রূপই হচ্ছে ‘শোকর’। এই শোকরের দাবী হচ্ছে, প্রথমত অনুগ্রহকে অনুগ্রহকারীর অবদান বলে স্বীকার করতে হবে। অনুগ্রহের শোকরগুজারী করার এবং নেয়ামতের স্বীকৃতি দেবার ক্ষেত্রে অনুগ্রহকারীর সাথে আর কাউকে শরীক করা যাবে না। দ্বিতীয়, অনুগ্রহকারীর প্রতি প্রেম, প্রীতি, বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের অনুভূতিতে নিজের হৃদয় ভরপুর থাকবে এবং অনুগ্রহকারীর বিরোধীদের প্রতি এ প্রসঙ্গে বিন্দুমাত্র প্রীতি, আন্তরিকতা, আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার সম্পর্ক থাকবে না। তৃতীয়ত, কার্যত অনুগ্রহকারীর আনুগত্য করতে হবে, তার হুকুম মেনে চলতে হবে এবং তিনি যে নেয়ামতগুলো দান করেছেন সেগুলো তার মর্জীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না।
১৭৬.
কুরআনের আয়াতে এখানে মূলত ‘শাকির’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর অনুবাদ করতে গিয়ে আমি ‘বড়ই পুরস্কারদানকারী’ শব্দ ব্যবহার করেছি। আল্লাহর তরফ থেকে যখন বান্দার প্রতি শোকর করার কথা বলা হয় তখন এর অর্থ হয় ‘কাজের স্বীকৃতি দেয়া বা কদর করা, মূল্য দান করা ও মর্যাদা দেয়া’। আর যখন বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর প্রতি শোকর করার কথা বলা হয় তখন এর অর্থ হয়, নেয়ামতের স্বীকৃতি দান বা অনুগৃহীত হবার কথা প্রকাশ করা। আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার শোকরিয়া আদায় করার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ বান্দার কাজের যথার্থ মূল্যদান করার ব্যাপারে কুণ্ঠিত নন। বান্দা তাঁর পথে যে ধরনের যতটুক কাজ করে আল্লাহ তার কদর করেন, তার যথার্থ মূল্য দেন। বান্দা কোন কাজ, পারিশ্রমিক ও পুরস্কার লাভ থেকে বঞ্চিত থাকে না। বরং তিনি মুক্ত হস্তে তার প্রত্যেকটি কাজের তার প্রাপ্যের চাইতে অনেক বেশী প্রতিদান দেন। মানুষের অবস্থা হচ্ছে, মানুষ যা কিছু কাজ করে তার প্রকৃত মূল্যের চাইতে কম মূল্য দেয় আর যা কিছু করে না সে সম্পর্কে কঠোরভাবে পাকড়াও করে। বিপরীত পক্ষে আল্লাহর অবস্থা হচ্ছে, মানুষ যে কাজ করেনি সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত কোমল, উদার ও উপেক্ষার নীতি অবলম্বন করেন। আর যে কাজ সে করেছে তার মূল্য তার চাইতে অনেক বেশী দেন, যা তার প্রকৃতপক্ষে পাওয়া উচিত।
১৭৭.
এ আয়াতে মুসলমানদের একটি অত্যন্ত উন্নত পর্যায়ের নৈতিক শিক্ষা দান করা হয়েছে। সে সময় মুনাফিক, ইহুদী ও মূর্তি পূজারী সবাই একই সঙ্গে সম্ভাব্য যাবতীয় উপায়ে ইসলামের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্ট করার ও ইসলাম গ্রহণকারীকে কষ্ট দেবার ও হয়রানী করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। এই নতুন আন্দোলনটির বিরুদ্ধে এমন কোন নিকৃষ্টতম কৌশল ছিল না যা তারা অবলম্বন করেনি। কাজেই মুসলমানদের মধ্যে এর বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ক্রোধের অনুভূতি সৃষ্টি হওয়া একটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। তাদের মনে এই ধরনের অনুভূতির প্রবল জোয়ার সৃষ্টি হতে দেখে আল্লাহ বলেন তোমাদের খারাপ কথা বলা ও অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ করা আল্লাহর কাছে কোন পছন্দনীয় কাজ নয়। তোমরা মজলুম, এতে সন্দেহ নেই। আর মজলুম যদি জালেমদের বিরুদ্ধে অশ্লীল কথা বলে, তাহলে তাদের সে অধিকার আছে। কিন্তু তবুও প্রকাশ্যে গোপণে সর্বাবস্থায় ভাল কাজ করে যাওয়া ও খারাপ কাজ পরিহার করাই উত্তম। কারণ তোমাদের চরিত্র আল্লাহর চরিত্রের নিকটতর হওয়া উচিত। তোমরা যার নৈকট্য লাভ করতে চাও তাঁর অবস্থা হচ্ছে এই যে, তিনি অত্যন্ত ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু। মারাত্মক অপরাধীদেরও তিনি রিযিক দান করেন এবং বড় বড় পাপ ও ত্রুটি-বিচ্যুতিও তিনি ক্ষমা করে দেন। কাজেই তাঁর নিকটতর হবার জন্য তোমরাও উচ্চ মনোবল, বুলন্দ হিম্মত ও উদার হৃদয়ের অধিকারী হও।