আন্ নিসা

১৭৬ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
১৫১ ) তারা সবাই আসলে কট্টর কাফের। ১৭৮ আর এহেন কাফেরদের জন্য আমি এমন শাস্তি তৈরী করে রেখেছি, যা তাদেরকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করবে।
أُو۟لَٰٓئِكَ هُمُ ٱلْكَٰفِرُونَ حَقًّا وَأَعْتَدْنَا لِلْكَٰفِرِينَ عَذَابًا مُّهِينًا ١٥١
১৫২ ) বিপরীত পক্ষে যারা আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলদেরকে মেনে নেয় এবং তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য করে না, তাদেরকে আমি অবশ্যই তার পুরস্কার দান করবো। ১৭৯ আর আল্লাহ‌ বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়। ১৮০
وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ بِٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦ وَلَمْ يُفَرِّقُوا۟ بَيْنَ أَحَدٍ مِّنْهُمْ أُو۟لَٰٓئِكَ سَوْفَ يُؤْتِيهِمْ أُجُورَهُمْ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا ١٥٢
১৫৩ ) এই আহ্‌লি কিতাবরা যদি আজ তোমার কাছে আকাশ থেকে তাদের জন্য কোন লিখন অবতীর্ণ করার দাবী করে থাকে, ১৮১ তাহলে ইতিপূর্বে তারা এর চাইতেও বড় ধৃষ্ঠতাপূর্ণ দাবী মূসার কাছে করেছিল। তারা তো তাঁকে বলেছিল, আল্লাহকে প্রকাশ্যে আমাদের দেখিয়ে দাও। তাদের এই সীমালংঘনের কারণে অকস্মাৎ তাদের ওপর বিদ্যুত আপতিত হয়েছিল। ১৮২ তারপর সুস্পষ্ট নিশানীসমূহ দেখার পরও তারা বাছুরকে উপাস্য রূপে গ্রহণ করেছিল। ১৮৩ এরপরও আমি তাদেরকে ক্ষমা করেছি। আমি মূসাকে সুস্পষ্ট ফরমান দিয়েছি।
يَسْـَٔلُكَ أَهْلُ ٱلْكِتَٰبِ أَن تُنَزِّلَ عَلَيْهِمْ كِتَٰبًا مِّنَ ٱلسَّمَآءِ فَقَدْ سَأَلُوا۟ مُوسَىٰٓ أَكْبَرَ مِن ذَٰلِكَ فَقَالُوٓا۟ أَرِنَا ٱللَّهَ جَهْرَةً فَأَخَذَتْهُمُ ٱلصَّٰعِقَةُ بِظُلْمِهِمْ ثُمَّ ٱتَّخَذُوا۟ ٱلْعِجْلَ مِنۢ بَعْدِ مَا جَآءَتْهُمُ ٱلْبَيِّنَٰتُ فَعَفَوْنَا عَن ذَٰلِكَ وَءَاتَيْنَا مُوسَىٰ سُلْطَٰنًا مُّبِينًا ١٥٣
১৫৪ ) এবং তূর পাহাড়ে তাদের ওপর উঠিয়ে তাদের থেকে (এই ফরমানে আনুগত্যের) অঙ্গীকার নিয়েছি। ১৮৪ আমি তাদেরকে হুকুম দিয়েছি, সিজ্‌দানত হয়ে দরজার মধ্যে প্রবেশ করো। ১৮৫ আমি তাদেরকে বলেছি, শনিবারের বিধান লংঘন করো না এবং এর সপক্ষে তাদের থেকে পাকাপোক্ত অঙ্গীকার নিয়েছি। ১৮৬
وَرَفَعْنَا فَوْقَهُمُ ٱلطُّورَ بِمِيثَٰقِهِمْ وَقُلْنَا لَهُمُ ٱدْخُلُوا۟ ٱلْبَابَ سُجَّدًا وَقُلْنَا لَهُمْ لَا تَعْدُوا۟ فِى ٱلسَّبْتِ وَأَخَذْنَا مِنْهُم مِّيثَٰقًا غَلِيظًا ١٥٤
১৫৫ ) শেষ পর্যন্ত তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের জন্য, আল্লাহর আয়াতের ওপর মিথ্যা আরোপ করার জন্য, নবীদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার জন্য এবং “আমাদের দিল আবরণের মধ্যে সুরক্ষিত” ১৮৭ তাদের এই উক্তির জন্য(তারা অভিশপ্ত হয়েছিল) । অথচ ১৮৮ মূলত তাদের বাতিল পরস্তির জন্য আল্লাহ‌ তাদের দিলের ওপর মোহর মেরে দিয়েছেন এবং এ জন্য তারা খুব কমই ঈমান এনে থাকে।
فَبِمَا نَقْضِهِم مِّيثَٰقَهُمْ وَكُفْرِهِم بِـَٔايَٰتِ ٱللَّهِ وَقَتْلِهِمُ ٱلْأَنۢبِيَآءَ بِغَيْرِ حَقٍّ وَقَوْلِهِمْ قُلُوبُنَا غُلْفٌۢ بَلْ طَبَعَ ٱللَّهُ عَلَيْهَا بِكُفْرِهِمْ فَلَا يُؤْمِنُونَ إِلَّا قَلِيلًا ١٥٥
১৫৬ ) তারপর ১৮৯ তাদের নিজেদের কুফরীর মধ্যে অনেক দূর অগ্রসর হয়ে মারয়ামের ওপর গুরুতর অপবাদ লাগাবার জন্য ১৯০
وَبِكُفْرِهِمْ وَقَوْلِهِمْ عَلَىٰ مَرْيَمَ بُهْتَٰنًا عَظِيمًا ١٥٦
১৫৭ ) এবং তাদের ‘আমরা আল্লাহর রসূল মারয়াম পুত্র ঈসা মসীহ্‌কে হত্যা করেছি’, ১৯১ এই উক্তির জন্য (তারা অভিশপ্ত হয়েছিল) । অথচ ১৯২ প্রকৃতপক্ষে তারা তাকে হত্যাও করেনি এবং শূলেও চড়ায়নি বরং ব্যাপারটিকে তাদের জন্য সন্দিগ্ধ করে দেয়া হয়েছে। ১৯৩ আর যারা এ ব্যাপারে মতবিরোধ করেছে তারাও আসলে সন্দেহের মধ্যে অবস্থান করছে। তাদের কাছে এ সম্পর্কিত কোন জ্ঞান নেই, আছে নিছক আন্দাজ-অনুমানের অন্ধ অনুসৃতি। ১৯৪ নিঃসন্দেহে তারা ঈসা মসীহকে হত্যা করেনি।
وَقَوْلِهِمْ إِنَّا قَتَلْنَا ٱلْمَسِيحَ عِيسَى ٱبْنَ مَرْيَمَ رَسُولَ ٱللَّهِ وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَٰكِن شُبِّهَ لَهُمْ وَإِنَّ ٱلَّذِينَ ٱخْتَلَفُوا۟ فِيهِ لَفِى شَكٍّ مِّنْهُ مَا لَهُم بِهِۦ مِنْ عِلْمٍ إِلَّا ٱتِّبَاعَ ٱلظَّنِّ وَمَا قَتَلُوهُ يَقِينًۢا ١٥٧
১৫৮ ) বরং আল্লাহ‌ তাঁকে নিজের দিকে উঠিয়ে নিয়েছেন। ১৯৫ আল্লাহ জবরদস্ত শক্তিশালী ও প্রজ্ঞাময়।
بَل رَّفَعَهُ ٱللَّهُ إِلَيْهِ وَكَانَ ٱللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا ١٥٨
১৫৯ ) আর আহলি কিতাবদের মধ্য থেকে এমন একজনও হবে না। যে তার মৃত্যুর পূর্বে তার ঈমান আনবে না, ১৯৬ এবং কিয়ামতের দিন সে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। ১৯৭
وَإِن مِّنْ أَهْلِ ٱلْكِتَٰبِ إِلَّا لَيُؤْمِنَنَّ بِهِۦ قَبْلَ مَوْتِهِۦ وَيَوْمَ ٱلْقِيَٰمَةِ يَكُونُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا ١٥٩
১৬০ ) মোটকথা ১৯৮ এই ইহুদী মতাবলম্বীদের এহেন জুলুম নীতির জন্য, তাদের মানুষকে ব্যাপকভাবে আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখার জন্য ১৯৯
فَبِظُلْمٍ مِّنَ ٱلَّذِينَ هَادُوا۟ حَرَّمْنَا عَلَيْهِمْ طَيِّبَٰتٍ أُحِلَّتْ لَهُمْ وَبِصَدِّهِمْ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِ كَثِيرًا ١٦٠
১৭৮.
অর্থাৎ যারা আল্লাহকে মানে না এবং তাঁর রসূলদেরকেও মানে না আবার যারা আল্লাহকে মানে কিন্তু রসূলদেরকে মানে না অথবা রসূলকে মানে কিন্তু আর কাউকে মানে না তারা সবাই কাফের। কাফের হবার ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তাদের কারো কাফের হবার ব্যাপারে সামান্যতম সন্দেহও নেই।
১৭৯.
অর্থাৎ যারা আল্লাহকে নিজেদের একমাত্র মাবুদ ও মালিক বলে স্বীকার করে নেয় এবং তার প্রেরিত সমস্ত নবীর আনুগত্য স্বীকার করে একমাত্র তারাই নিজেদের কাজের প্রতিদান লাভ করার অধিকার রাখে। তারা যে পর্যায়ের সৎকাজ করবে সেই পর্যায়ের প্রতিদান পাবে। আর যারা আল্লাহকে কোনো প্রকার অংশীদারবিহীন মাবুদ ও রব হিসেবে মেনে নেয়নি অথবা যারা আল্লাহর প্রতিনিধিদের মধ্যে কাউকে মেনে নেয়ার ও কাউকে প্রত্যাখ্যান করার বিদ্রোহাত্মক কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেছে, তাদের কোনো কাজের প্রতিদান দেবার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ আল্লাহর দৃষ্টিতে এই ধরনের লোকদের কোনো কাজের আইনগত মূল্য নেই।
১৮০.
অর্থাৎ যারা আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলের ওপর ঈমান আনবে তাদের হিসেব নেবার ব্যাপারে আল্লাহর মোটেই কড়াকড়ি করবেন না। বরং তাদের ব্যাপারে কোমলতা ও ক্ষমার নীতি অবলম্বন করবেন।
১৮১.
মদীনার ইহুদীরা নবী সাল্লাল্লাহু আল্লাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে অদ্ভুত রকমের দাবী দাওয়া পেশ করতো। তাদের এই দাবীগুলোর মধ্যে একটি ছিলঃ যতক্ষণ আমাদের চোখের সামনে একটি লিখিত কিতাব আকাশ থেকে নাযিল না হয় অথবা আমাদের প্রত্যেকর নামে ওপর থেকে এই মর্মে একটি লিখন না আসে যে, “মুহাম্মাদ আমার রসূল, তাঁর ওপর তোমরা ঈমান আনো” ততক্ষণ আমরা আপনার রিসালাত মেনে নিতে প্রস্তুত নই।
১৮২.
এখানে কোন ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পেশ করা উদ্দেশ্য নয় বরং উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইহুদীদের অপরাধের একটি সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি পেশ করা, তাই তাদের জাতীয় ইতিহাসের কতিপয় সুস্পষ্ট ঘটনার দিকে হালকাভাবে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ আয়াতে যে ঘটনার উল্লখ করা হয়েছে তা ইতিপূর্বে সূরা বাকারার ৫৫ নং আয়াতে আলোচিত হয়েছে। (সূরা বাকারা ৭১ নম্বর টীকা দেখুন)।
১৮৩.
‘সুস্পষ্ট নিশানীসমূহ’ বলতে হযরত মূসা আলাইহিস সাল্লামের নবুওয়াত প্রাপ্তির পর থেকে নিয়ে ফেরাউনের সাগরে নিমজ্জিত হওয়া ও বনী ইসরাঈলদের মিসর ছেড়ে বের হয়ে আসা পর্যন্ত একের পর এক যেসব নিশানী তারা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছে সেগুলো বুঝানো হয়েছে। বলা বাহুল্য কোন গো-বৎস মিসর সাম্রাজ্যের বিপুল শক্তিশালী নখর থেকে বনী ইসরাঈলকে রক্ষা করেনি বরং তাদের রক্ষা করেছিলেন আল্লাহ‌ রব্বুল আল্লামীন নিজেই। কিন্তু বনী ইসরাঈল জাতির বাতিল প্রীতি এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যার ফলে আল্লাহর কুদরাত ও তাঁর অনুগ্রহের সুস্পষ্ট নিশানীসমূহ বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জেনে নেবার পরও তারা নিজেদের প্রতি অনুগ্রহশীল আল্লাহর সামনে শির নত না করে একটি কৃত্রিম হাতে গড়া গো-বৎসের মূর্তির সামনে মাথা নত করে।
১৮৪.
‘সুস্পষ্ট ফরমান’ বলতে হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে কাঠের তখতির ওপর যে বিধান লিখে দেয়া হয়েছিল তাই বুঝানো হয়েছে। সামনের দিকে সূরা আ'রাফের ১৭ রুকূ’তে এ সম্পর্কিত আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আর ‘প্রতিশ্রুতি’ বলতে সেই জোরদার শপথকে বুঝানো হয়েছে যা তূর পাহাড়ের পাদদেশে বনী ইসরাঈলদের প্রতিনিধিদের থেকে নেয়া হয়েছিল। সূরা বাকারার ৬৩ আয়াতে ইতিপূর্বে এ সম্পর্কে আলোচনা এসে গেছে এবং আরাফের ১৭১ আয়াতে আবার এর উল্লেখ আসবে।
১৮৫.
সূরা বাকারার ৫৮-৫৯ আয়াত ও ৭৫ নম্বর টীকা দ্রষ্টব্য।
১৮৬.
সূরা বাকার ৬৫ আয়াত এবং ৮২ ও ৮৩ নম্বর টীকা দ্রষ্টব্য।
১৮৭.
সূরা বাকারার ৮৮ আয়াতে ইহুদীদের এই বক্তব্যটির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আসলে দুনিয়ার সমস্ত বাতিল পূজারী জাহেলদের মতো এরাও এই মর্মে গর্ব করতো যে, নিজেদের বাপ-দাদাদের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে তারা যে সমস্ত চিন্তাধারা, বংশ-প্রীতি, গোত্র-প্রীতি, রীতি-নীতি, রসম-রেওয়াজ লাভ করেছে সেসবের ওপর তাদের আকীদা-বিশ্বাস এতো বেশী পাকাপোক্ত হয়ে গেছে যে, কোন ক্রমেই তাদেরকে সেসব থেকে সরানো যাবে না। যখনই আল্লাহর পক্ষ থেকে পয়গাম্বররা এসে তাদের বুঝাবার চেষ্টা করেছেন তখনই তারা তাদের এই একই জবাব দিয়েছেনঃ তোমরা যে কোন যুক্তি-প্রমাণ, যে কোন নিদর্শন আনো না কেন আমরা তোমাদের কোন কথায় প্রভাবিত হবো না। এ পর্যন্ত আমরা যা কিছু মেনে এসেছি ও যা কিছু করে এসেছি এখনো তাই মানবো ও তাই করে যেতে থাকবো। (সূরা বাকারার ৯৪ নম্বর টীকা দেখুন)।
১৮৮.
এটি প্রসঙ্গক্রমে আগত একটি বিচ্ছিন্ন বাক্য।
১৮৯.
এ বাক্যটি মূল ভাষণের ধারাবাহিক বিবরণীর সাথে সংশ্লিষ্ট।
১৯০.
হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে আসলে ইহুদী জাতির মধ্যে বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না। বরং যেদিন তার জন্ম হয়েছিল সেদিনই আল্লাহ‌ সমগ্র জাতিকে এই মর্মে সাক্ষী বানিয়েছিলেন যে, এটি একটা অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন শিশু। তাঁর জন্ম কোন নৈতিক অপরাধের নয় বরং একটি মু’জিযার ফলশ্রুতি। যখন বনী ইসরাঈলের সবচাইতে ভদ্র, শরীফ ও খ্যাতনামা ধর্মীয় পরিবারের একটি কুমারী মেয়ে একটি শিশু পুত্র কোলে নিয়ে এগিয়ে এলেন এবং জাতির ছোট বড় শত শত হাজার হাজার লোক তার ঘরে ভিড় জমালো, তখন কুমারী মেয়েটি তাদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নীরবে নবজাত সন্তানের দিকে অংগুলি নির্দেশ করলেন। অর্থাৎ এই নবজাতকেই তোমাদের সব প্রশ্নের জবাব দেবে। লোকেরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলোঃ একে আমরা কি জিজ্ঞেস করবো, এতো দোলনায় শুয়ে আছে? কিন্তু হঠাৎ শিশুটি বোল ফুটলো এবং সে সুস্পষ্টও বলিষ্ট কণ্ঠে বলে উঠলোঃ

إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا

“আমি আল্লাহর বান্দা, আল্লাহ‌ আমাকে কিতাব দিয়েছেন ও নবী বানিয়েছেন।”(সূরা মারয়াম, ২য় রুকূ’)

এভাবে ঈসা মসীহ আলাইহিস সালামের জন্ম সম্পর্কে যে সংশয় জমে ওঠার সম্ভাবনা ছিল আল্লাহ‌ নিজেই তার মূলোৎপাটন করেন। এজন্য হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের যৌবনে পদার্পণ করা পর্যন্ত কেউ কোন দিন হযরত মারয়ামের বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ আনেনি এবং হযরত ঈসাকে অবৈধ সন্তানও বলেনি। কিন্তু তিরিশ বছর বয়স হবার পর যখন তিনি নবুওয়াতের কাজের সূচনা করলেন এবং যাবতীয় অসৎকাজের জন্য ইহুদীদের তিরস্কার করতে শুরু করলেন, তাদের আলেমও ফকীহদের রিয়াকারীর সমালোচনা করতে থাকলেন তাদের সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও সাধারণ মানুষকে তাদের নৈতিক ও চারিত্রিক অবনতির জন্য সতর্ক করতে লাগলেন এবং আল্লাহ‌র দ্বীনকে বাস্তবে কায়েম করার জন্য নিজের জাতিকে সব রকমের ত্যাগ স্বীকার করার ও সব ক্ষেত্রে শয়তানি শক্তির সাথে লড়াই করার আহবান জানালেন, তখন এই নির্লজ্জ অপরাধীরা সত্য ও সততার কণ্ঠরোধ করার জন্য সব রকমের নিকৃষ্ঠতম অস্ত্র ব্যবহার করতে এগিয়ে এলো। তখন তারা এমন সব কথা বলতে থাকলো যা তারা তিরিশ বছর পর্যন্ত বলেনি। অর্থাৎ মারয়াম আলাইহাস সালাম (নাউযুবিল্লাহ) একজন ব্যভিচারিণী এবং ঈসা ইবনে মারয়াম তার অবৈধ সন্তান। অথচ এই জালেমরা নিশ্চিতভাবেই জানতো, এই মাতা ও পুত্র উভয়েই এই ধরনের কলুষতা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। কাজেই তাদের মনে যথার্থই এ ধরনের কোন সন্দেহ পুঞ্জিভূত ছিল না যার ভিত্তিতে তারা এই দোষারোপ করেছিল। এটা ছিল তাদের একটা স্বেচ্ছাকৃত দোষারোপ। জেনে বুঝে নিছক হকের বিরোধিতা করার জন্য তারা তাদের মাতা পুত্রের বিরুদ্ধে এই মিথ্যাটি তৈরী করেছিল। তাই আল্লাহ‌ একে জুলুম ও মিথ্যার পরিবর্তে কুফরী গণ্য করেছেন। কারণ এই দোষারোপের মাধ্যমে তারা আসলে আল্লাহর দ্বীনের পথে বাধা সৃষ্টি করতে চাচ্ছিল। একজন নিষ্পাপ ও নিরপরাধ মহিলার বিরুদ্ধে দোষারোপ করা তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল না।

১৯১.
অর্থাৎ তাদের অপরাধ করার দুঃসাহস এতই বেড়ে গিয়েছিল যার ফলে তারা আল্লাহর রসূলকে রসূল জেনেও হত্যা করার পদক্ষেপ নিয়েছিল এবং গর্ব করে বলেছিলঃ আমরা আল্লাহর রসূলকে হত্যা করেছি। ওপরে আমরা দোলনার ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছি তা থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ইহুদীদের জন্য ঈসা আলাইহিস সালামের নবুওয়াতে সন্দেহ করার কোন অবকাশই ছিল না। এছাড়াও তারা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে থেকে যে উজ্জ্বল নিশানীগুলো প্রত্যক্ষ করেছিল (সূরা আলে ইমরানের ৫ম রুকূ’তে ইতিপূর্বে এটি আলোচিত হয়েছে) তা থেকে তিনি যে আল্লাহর রসূল এ বিষয়টি সকল প্রকার সন্দেহের ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছিল। কাজেই দেখা যাচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে তারা তাঁর সাথে যা কিছু করেছিল তা কোন ভুল বুঝাবুঝির ভিত্তিতে করেনি বরং তারা ভালোভাবেই জানতো যে, এই অপরাধ তারা এমন এক ব্যক্তির সাথে করছে যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে পয়গাম্বর হয়ে এসেছেন।

কোন জাতি এক ব্যক্তিকে নবী বলে জানার ও মেনে নেয়ার পরও তাকে হত্যা করেছে, আপাতঃ দৃষ্টিতে এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার বলে মনে হয়। কিন্তু দুনিয়ার বিকৃত জাতিদের রীতিনীতি, কাজ-কারবার এমনই বিস্ময়করই হয়ে থাকে। যে ব্যক্তি তাদের অন্যায় ও পাপ কাজের সমালোচনা করে এবং তাদের অবৈধ কাজে বাধা দেয়, এমনকোন ব্যক্তিকে তারা নিজেদের মধ্যে বরদাশ্‌ত করতে পারে না। নবী হলেও এই ধরনের লোকেরা হামেশা অসৎ, দুশ্চরিত্র ও পাপাচারী জাতিদের হাতে কারাযন্ত্রণা ও মৃত্যুদণ্ড ভোগ করে এসেছেন। তালমুদে লিখিত হয়েছেঃ বখতে নসর বায়তুল মাক্‌দিস জয় করে সুলাইমানী হাইকেলে প্রবেশ করলেন এবং সেখানে ঘুরে ফিরে দেখতে লাগলেন। যে স্থানে কুরবানী করা হয় সে স্থানের ঠিক সামনে দেয়ালে এক জায়গায় তিনি একটি তীরের নিশানী দেখলেন। তিনি ইহুদীদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কিসের নিশানী? ইহুদীরা জবাব দিল, “এখানে আমরা যাকারিয়া নবীকে হত্যা করেছিলাম। তিনি আমাদের অসৎকাজের জন্য তিরস্কার করতেন। অবশেষে তার তিরস্কারে অতিষ্ঠ হয়ে আমরা তাকে হত্যা করেছি।” বাইবেলে ইয়ারমিয়াহ নবী সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ বনী ইসরাইলদের অসৎ কর্মসীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার পর হযরত ইয়ারমিয়াহ তাদের এই মর্মে সতর্ক করে দিলেন যে, এসব বদ কাজের প্রতিফল হিসেবে আল্লাহ‌ অন্য জাতিদের হাতে তোমাদের ধ্বংস করে দেবেন। এর জবাবে তার বিরুদ্ধে দোষারোপ করলোঃ “এই ব্যক্তি ‌‌‘কালদানী’ জাতির সাথে হাত মিলিয়েছে, তাদের সাথে যোগসাজশ করেছে। এই ব্যক্তি জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।” এই অভিযোগে তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হলো। এমনকি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের শূলে চড়াবার ঘটনার মাত্র দুই আড়াই বছর পূর্বে হযরত ইয়াহ্‌ইয়ার (আ) ব্যাপারটি ঘটে গিয়েছিল। ইহুদীরা সাধারণভাবে তাকে নবী বলে জানতো। অন্তত তাকে জাতির সবচাইতে সৎলোক হিসেবে মানতো। কিন্তু যখন তিনি হিরোডিয়াসের (ইহুদী রাষ্ট্র প্রধান) দরবারের অন্যায় ও অসৎকাজের সমালোচনা করলেন তখন আর তাকে বরদাশত করা হলো না। প্রথমে তাকে কারারুদ্ধ করা হলো তারপর রাষ্ট্র প্রধানের প্রেমিকার দাবী অনুযায়ী তার গর্দান উড়িয়ে দেয়া হলো। ইহুদী জাতির এই অতীত রেকর্ডগুলো পর্যবেক্ষণ করার পর একথা মোটেই বিস্ময়কর মনে হয় না যে, তাদের ধারণা মতে তারা হযরত ঈসা মসীহকে (আ) শূলে চড়াবার পর বুকে ঠুকে একথা বলেছেঃ “আমরা আল্লাহর রসূলকে হত্যা করেছি।”

১৯২.
এটি আবার প্রসঙ্গক্রমে আগত একটি অন্তরবর্তী বিচ্ছিন্ন বাক্য।
১৯৩.
এ আয়াতটি দ্ব্যর্থহীনভাবে একথা প্রমাণ করে যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে শূলে চাড়াবার আগেই উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল। আর ঈসা মসীহ (আ) শূলবিদ্ধ হয়ে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন বলে খৃস্টান ও ইহুদীরা যে ধারণা পোষণ করে তা নিছক একটি ভুল বুঝাবুঝি ছাড়া আর কিছুই নয়। কুরআনে ও বাইবেলের তুলনামূলক অধ্যয়ন করে আমরা জানতে পারি, সম্ভবত পীলাতুসের আদালতে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকেই পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু যখন সে তার মৃত্যুদণ্ডের রায় শুনিয়ে দিল এবং ইহুদীরা ঈসা মসীহের মতো পূণ্যাত্মার প্রাণের চাইতে একজন দস্যূর প্রাণকে অধিক মূল্যবান গণ্য করে নিজেদের সত্য বিরোধিতা ও বাতিল প্রীতির চূড়ান্ত প্রমাণটিও পেশ করে দিলো, তখন কোন এক সময় আল্লাহ‌ তাকে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। পরে ইহুদীরা যে ব্যক্তিকে শূলে চড়ালো সে ঈসা ইবনে মারয়াম ছিল না। সে ছিল অন্যকোন ব্যক্তি। কোন অজ্ঞাত কারণে তারা তাকে ঈসা ইবনে মারয়াম মনে করে নিয়েছিলেন। তবুও এতে তাদের অপরাধের পরিমাণ হ্রাস হবে না। কারণ যাকে তারা কাঁটার টুপি পরিয়ে ছিলেন, যার মুখে থু থু নিক্ষেপ করেছিল এবং যাকে লাঞ্ছনা সহকারে শূলে চড়িয়েছিল তাকে তো তারা ঈসা ইবনে মারয়ামই মনে করছিল। ব্যাপারটি কিভাবে তাদের কাছে সংশয়িত হয়ে গিয়েছিল তা জানার কোন উপায় আমাদের আয়ত্বে নেই। যেহেতু এই পর্যায়ে সঠিক তথ্য সংগ্রহের কোন উৎস আমাদের জানা নেই তাই ঈসা ইবনে মারয়াম ইহুদীদের কবলমুক্ত হয়ে যাওয়ার পরও তারা ঈসা ইবনে মারয়ামকেই শূলবিদ্ধ করেছে বলে যে সংশয় পোষণ করছিল নিছক ধারণা, আন্দাজ-অনুমান ও জনশ্রুতির ভিত্তিতে তার স্বরূপ নির্ধারণ করা কোনক্রমেই সম্ভবপর নয়।
১৯৪.
মতবিরোধকারী বলে এখানে খৃস্টানদেরকে বুঝানো হয়েছে। ঈসা আলাইহিস সালামকে শূলে চড়াবার ব্যাপারে তাদের কোন একটি সর্বসম্মত মত বা বক্তব্য নেই। এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে বহু মতের প্রচলন রয়েছে। তাদের এই অসংখ্য মতই প্রমাণ করে যে, আসল ব্যাপারটি তাদের কাছেও সংশয়পূর্ণই রয়ে গেছে। তাদের একদল বলেঃ যে ব্যক্তিকে শূলে চড়ানো হয়েছিল সে ঈসা মসীহ ছিল না। ঈসার চেহারায় সে ছিল অন্য এক ব্যক্তি। ইহুদী ও রোমীয় সৈন্যরা তাকে লাঞ্ছনার সাথে শূলে চড়াচ্ছিল। আর ঈসা মসীহ সেখানে কোনো এক স্থানে দাঁড়িয়ে তাদের নির্বুদ্ধিতায় হাসছিলেন। অন্য এক দল বলেঃ শূলদণ্ডে ঈসা মসীহকেই চড়ানো হয়েছিলো। কিন্তু শূলদণ্ডে তাঁর মৃত্যু হয়নি বরং নামিয়ে নেয়ার পর তাঁর মধ্যে প্রাণ ছিল। আর একদল বলেঃ তিনি শূলে মৃত্যুবরণ করেছিলেন আবার প্রাণ লাভ করেছিলেন। এরপর কমপক্ষে দশবার নিজের বিভিন্ন ‘হাওয়ারী’দের সাথে সাক্ষাত করে তাদের সাথে আলাপ করেছিলেন। চতুর্থ আর একদল বলেঃ শূলের ওপর ঈসার মানবিক দেহের মৃত্যু ঘটেছিলো এবং তাকে দাফনও করা হয়েছিল। কিন্তু তার মধ্যে খোদায়ীর যে আত্মা ছিল তাকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল। পঞ্চম দলটি বলেঃ মরার পর ঈসা মসীহ আলাইহিস সালাম এই জড়দেহসহ জীবিত হয়ে গিয়েছিলেন এবং সশরীরেই তাকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে বলা যায়, আসল সত্য ঘটনাটি তাদের জানা থাকলে সে সম্পর্কে এতগুলো পরস্পর বিরোধী কথা ও মত তাদের মধ্যে প্রচলিত থাকতো না।
১৯৫.
এ প্রসঙ্গে এটিই হচ্ছে প্রকৃত সত্য। আল্লাহ‌ সুস্পষ্ট ভাষায় এটি ব্যক্ত করেছেন। এ ব্যাপারে দৃঢ়তা সহকারে যে সুস্পষ্ট বক্তব্য পেশ করা হয়েছে তা কেবল এতটুকু যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে হত্যা করতে ইহুদীরা কামিয়াব হয়নি এবং আল্লাহ‌ তাকে নিজের দিকে উঠিয়ে নিয়েছেন। এখন প্রশ্ন ওঠে কিভাবে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল। কুরআনে এর কোন বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়নি। কুরআন যেমন একথা বলে না যে, আল্লাহ‌ তাকে এই জড়দেহ ও আত্মাসহকারে পৃথিবী থেকে তুলে নিয়ে আকাশ রাজ্যের কোথাও রেখে দিয়েছেন আবার তেমনি একথাও বলে না যে, পৃথিবীতে তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছিল কেবল তাঁর রূহটি ওপরে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল। তাই কুরআনের ভিত্তিতে এর কোন একটি দিককে চূড়ান্তভাবে গ্রহণ ও অন্য দিকটিকে চূড়ান্তভাবে বর্জন করা যেতে পারে না। কিন্তু কুরআনের বর্ণনাভংগী সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করলে একথা সুস্পষ্ট অনুভূত হয় যে, উঠিয়ে নেবার ধরণ ও অবস্থা যাই হোক না কেন ঈসা আলাইহিস সালামের সাথে আল্লাহ‌ অবশ্যি এমন কিছু ব্যাপার করে থাকবেন যা নিঃসন্দেহে অস্বাভাবিক পর্যায়ের। তিনটি বিষয় থেকে এই অস্বাভাবিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।

একঃ ঈসা আলাইহিস সালামকে এই জড় দেহ ও প্রাণ সহকারে উঠিয়ে নেবার ধারণা খৃস্টানদের মধ্যে আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। আর খৃস্টানদের একটি বড় দল যে হযরত ঈসাকে ‘খোদা’ বলে ধারণা করতো এটিই ছিল তার একটি অন্যতম কারণ। কিন্তু এতদসত্ত্বেও কুরআন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় শুধু যে এর প্রতিবাদই জানায়নি তাই নয় বরং খৃস্টানরা এ ঘটনাটির জন্য যে ‘উঠিয়ে নেয়া’ (Ascension) শব্দটি ব্যবহার করে থাকে কুরআনেও হুবহু সেই একই শব্দ ব্যবহার করেছে। কোন একটি চিন্তার প্রতিবাদ করতে চেয়েও তার জন্য এমন ভাষা ব্যবহার করা যা ঐ চিন্তাকে আরো শক্তিশালী করে-এটা কুরআনের মতো দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য উপস্থাপনকারী কিতাবের রীতি ও মর্যাদার সাথে মোটেই খাপ খায় না।

দুইঃ যদি ঈসা আলাইহিস সালামকে উঠিয়ে নেয়া তেমন ধরনের কোন উঠিয়ে নেয়া হতো যেমন প্রত্যেক মৃত্যুবরণকারীকে দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়ে থাকে অথবা এই উঠিয়ে নেয়ার অর্থ যদি শুধু সম্মান ও মর্যাদার উন্নতি হতো যেমন হযরত ইদরীস আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ ورفعنآه مكاناعايا (আর তাঁকে আমি উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করেছিলাম) তাহলে এখানে কথাটা বলা অধিক যুক্তিযুক্ত হতো। যেমনঃ “নিঃসন্দেহে তারা ঈসাকে হত্যা করেনি বরং আল্লাহ‌ তাঁকে প্রাণে বাঁচিয়ে নিয়েছেন। তারপর তাঁকে স্বাভাবিক মৃত্যুদান করেছেন। ইহুদীরা তাঁকে হত্যা করতে চাইছিল কিন্তু আল্লাহ‌ তাঁকে উন্নত মর্যাদা দান করেছেন।”

তিনঃ যদি এই উঠিয়ে নেয়াটা যেমন তেমন মামুলি ধরনের উঠিয়ে নেয়া হতো, যেমন প্রচলিত নিয়মে কোন মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে আমরা বলে থাকিঃ “আল্লাহ তায়ালা তাকে উঠিয়ে নিয়েছেন”, তাহলে এর উল্লেখ করার পর আবার “আল্লাহ মহাশক্তিধর ও জ্ঞানী” এই বাক্যটি বলা সম্পূর্ণ অসমীচীন ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়তো। যে ঘটনায় আল্লাহর জবরদস্ত শক্তি ও জ্ঞানের অস্বাভাবিক প্রকাশ ঘটে একমাত্র তেমন কোন ঘটনার পরই এ ধরনের বাক্য উচ্চারণ করা উপযোগী ও সমীচীন হতে পারে।

এর জবাবে কুরআন থেকে কোন যুক্তি প্রমাণ পেশ করতে চাইলে বড় জোর এতটুকু বলা যায় যে, সূরা আলে ইমরানে আল্লাহ متوفيك শব্দটি ব্যবহার করেছেন (৫৫ আয়াত)। কিন্তু সেখানে ৫১ নং টীকায় আমরা একথা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছি যে, স্বাভাবিক মৃত্যু অর্থে এ শব্দটির ব্যবহার তেমন সুস্পষ্ট নয়। বরং এ শব্দটি থেকে ‘প্রাণ হরণ’ এবং ‘প্রাণ ও দেহ উভয়টি হরণ’ করা অর্থ হতে পারে। কাজেই আমরা ওপরে যে সমস্ত কারণ ও নিদর্শন বর্ণনা করেছি সেগুলো নাকচ করে দেবার জন্য এটি মোটেই যথেষ্ট নয়। ঈসা আলাইহিস সালাম স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন বলে যারা দাবী জানিয়ে আসছে তারা হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে, প্রাণ ও দেহ হরণ করার ব্যাপারে توني শব্দটির ব্যবহারের আর কোন নজির আছে কি? কিন্তু মানব জাতির সমগ্র ইতিহাসে প্রাণ ও দেহ হরণ করার ব্যাপারটি যখন মাত্র একবারই সংঘটিত হয়েছে তখন এই অর্থে মানুষের ভাষায় এ শব্দটির ব্যবহারের নজির দাবী করা একবারেই অর্থহীন। ভাষার মূল আভিধানিক পরিসরে এ শব্দটির এ ধরনের অর্থ ব্যবহারের অবকাশ আছে কি না এখানে কেবল এতটুকুই দেখা দরকার। যদি অবকাশ থেকে থাকে তাহলে একথা মানতে হবে যে, কুরআন সশরীরে উঠিয়ে নেয়ার আকীদার দ্ব্যর্থহীন প্রতিবাদ জানাবার পরিবর্তে এ শব্দটি ব্যবহার করে এই আকীদাটির সহায়ক কারণ ও নির্দশনগুলোর সংখ্যা আরো একটি বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যথায় যেখানে পূর্ব থেকেই সশরীরে উঠিয়ে নেবার আকীদা বর্তমান ছিল এবং যার ফলে ঈসাকে খোদায়ী শক্তির অধিকারী মনে করার আকীদা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল, সেখানে, ‘মৃত্যু-এর ন্যায় সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন শব্দ ব্যবহার না করে ‘ওফাত’-এর ন্যায় দ্ব্যর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করার কোন কারণ ছিল না।

অসংখ্যা হাদীসেও সশরীরে উঠিয়ে নেবার আকীদাকে আরো শক্তিশালী করেছে। এ হাদীসগুলোতে হযরত ঈসা ইবনে মারয়াম আলাইহিস সালামের পুনর্বার দুনিয়ার আগমন ও দাজ্জালকে হত্যা করার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। (সূরা আহযাবের তাফসীরের পরিশিষ্টে আমি এ ধরনের সমস্ত হাদীস একত্র করে দিয়েছি)। এগুলো থেকে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের দ্বিতীয় বার আগমনের ব্যাপারটি অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে। মৃত্যুর পর তিনি পুনর্বার জীবিত হয়ে এই মরজগতে ফিরে আসবেন অথবা আল্লাহর এই বিশাল সাম্রাজ্যের কোথাও তিনি আছেন এবং সেখানে থেকে আবার এই দুনিয়ার ফিরে আসবেন-এ দু’টির মধ্যে কোন্‌টি এখন অধিকতর যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়? যে কোন বিবেকবান ব্যক্তি নিজেই এর মীমাংসা করতে পারেন।

১৯৬.
এ বাক্যটির দু’টি অর্থ করা হয়েছে। দু’টি অর্থের সমান অবকাশও এখানে রয়েছে। এর একটি অর্থ আমরা আয়াতের তরজমায় বর্ণনা করেছি। আর এর দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছেঃ “আহলে কিতাবের মধ্যে এমন একজনও নেই যে মৃত্যুর পূর্বে ঈসার ওপর ঈমান আনবে না।” আহলে কিতাব অর্থ হচ্ছে ইহুদী। এর অর্থ খৃস্টানও হতে পারে। প্রথম অর্থটির পরিপ্রক্ষিতে বাক্যটির মূল বক্তব্য হবেঃ ঈসার যখন স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটবে সে সময় যত আহলে কিতাব থাকবে তারা সবাই তাঁর ওপর (অর্থাৎ তাঁর রিসালাতের ওপর) ঈমান আনবে। দ্বিতীয় অর্থটির দৃষ্টিতে এর মূল বক্তব্য হবেঃ মৃত্যুর পূর্বে সমস্ত আহলে কিতাবের সামনে ঈসা আলাইহিস সালামের রিসালাতের সত্যত্য সুস্পষ্ট হয়ে যায় এবং তারা ঈসার (আ) ওপর ঈমান আনে। কিন্তু তারা এমন এক সময় এ ঈমান আনে যখন ঈমান ফলপ্রসূ হতে পারে না। এই দু’টি অর্থই বিপুল সংখ্যক সাহাবা, তাবেঈ ও প্রধান মুফাস্‌‌সিরদের থেকে বর্ণিত হয়েছে। তবে এর সঠিক অর্থ একমাত্র আল্লাহই জানেন।
১৯৭.
অর্থাৎ ইহুদী ও খৃস্টানরা ঈসা আলাইহিস সালামের সাথে এবং তিনি যে বাণী এনেছিলেন তার সাথে যে ব্যবহার করেছে তার ওপর তিনি আল্লাহর দরবারে সাক্ষ্য দেবেন। এই সাক্ষ্যের ওপর কিছু বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে সূরা মায়েদার শেষ রুকূ’তে।
১৯৮.
মধ্যবর্তী প্রাসঙ্গিক বিচ্ছিন্ন বাক্য খতম হবার পর এখান থেকে আবার পূর্বে বর্ণিত ভাষণের সিলসিলা শুরু হচ্ছে।
১৯৯.
অর্থাৎ তারা কেবল নিজেরা আল্লাহর পথ থেকে সরে গিয়ে ক্ষান্ত হয়নি বরং এই সঙ্গে তারা এতবড় দুঃসাহসিক অপরাধ প্রবণতায় লিপ্ত হযে পড়েছে যে, দুনিয়ায় আল্লাহর বান্দাদের পথভ্রষ্ট করার জন্য যতগুলো আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে তাদের অধিকাংশের পেছনে ইহুদী মস্তিষ্ক ও ইহুদী পুঁজিকে সক্রিয় দেখা গেছে। হকের পথে ও সত্যের দিকে আহবান করার জন্য যে আন্দোলনই শুরু হয়েছে তার বিরুদ্ধে ইহুদীরাই সবচেয়ে বড় বাধার প্রাচীর দাঁড় করিয়েছে। অথচ এই দুর্ভাগা জাতিটির কাছে আল্লাহর কিতাব আছে এবং তারা নবীদের উত্তরাধীকারী। তাদের সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে বড় অপরাধ হচ্ছে কমিউনিষ্ট আন্দোলন। ইহুদী মস্তিস্ক এ আন্দোলনটির স্রষ্টা। ইহুদী নেতৃত্বের ছত্রছায়ায় এ আন্দোলন অগ্রগতি লাভ করেছে। আল্লাহকে সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করে, প্রকাশ্যে আল্লাহর সাথে শত্রুতা করে এবং আল্লাহর আনুগত্য ব্যবস্থাকে মিটিয়ে দেবার বিঘোষিত সংকল্পের ভিত্তিতে সমগ্র মানবতার ইতিহাসে দুনিয়ার বুকে প্রথম খোদাদ্রোহী জীবন বিধান ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাটি প্রতিষ্ঠার অপরাধও এই তথাকথিত আহলে কিতাব জাতিটির দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল। হযরত মুসা আলাইহিস সালামের উম্মত এই ইহুদীজাতিই ছিল এর উদগাতা, প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক। আধুনিক যুগে কমিউনিজমের পরে গোমরাহীর সবচেয়ে, বড় খুঁটি ফ্রয়েডের দর্শন, মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ফ্রয়েডও বনী ইসরাঈলেরই এক সন্তান।
অনুবাদ: