এটা আল্লাহর বিশ্ব-জাহানের অধিপতি এবং সত্যিকার অভিভাবক হওয়ার স্বাভাবিক ও যৌক্তিক দাবী। রাজত্ব ও অভিভাবকত্ব যখন তাঁরই তখন শাসকও অনিবার্যরূপে তিনিই এবং মানুষের পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ ও মতানৈক্যের ফায়সালা করাও তাঁরই কাজ। যারা এ বিষয়টিকে আখেরাতের জন্য নির্দিষ্ট বলে মনে করে তারা ভুল করে। আল্লাহর এই সার্বভৌম মর্যাদা যে এই দুনিয়ার জন্য নয়, শুধু মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য তার কোন প্রমাণ নেই। একইভাবে যারা তাঁকে শুধু এই দুনিয়ার আকীদা-বিশ্বাস এবং কতিপয় ধর্মীয় বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ মনে করে তারাও ভুল করে। কুরআন মজীদের ভাষা ব্যাপক অর্থব্যঞ্জক। তাতে সব রকম বিবাদ ও মতানৈক্যের ক্ষেত্রে তা একমাত্র আল্লাহকেই ফায়সালা করার প্রকৃত অধিকারী বলে পরিষ্কার ও সুনিশ্চিতভাবে আখ্যায়িত করছে। সেই অনুসারে আল্লাহ যেমন আখিরাতের
مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ (প্রতিদান দিবসের মালিক) তেমনি এই পৃথিবীরও
أَحْكَمُ الْحَاكِمِينَ (সব শাসকের চাইতে বড় শাসক)। আকীদাগত মতানৈক্যের ক্ষেত্রে হক কোনটি আর বাতিল কোনটি সে বিষয়ের ফায়সালা যেমন তিনিই করবেন তেমনি আইনগত ক্ষেত্রেও তিনিই ফায়সালা করবেন মানুষের জন্য কোনটি পবিত্র আর কোনটি অপবিত্র, কোনটি বৈধ ও হালাল আর কোনটি হারাম ও মাকরুহ? নৈতিকতার ক্ষেত্রে অন্যায় ও অশোভন কি আর ন্যায় শোভনীয় কি? পারস্পরিক লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনটি কার প্রাপ্য আর কোনটি প্রাপ্য নয়? জীবনাচার, সভ্যতা, রাজনীতি এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে কোন্ পন্থা ও পদ্ধতি বৈধ আর কোনটি ভুল ও অবৈধ তাঁর সবই তিনি স্থির করবেন। এর ওপর ভিত্তি করেই তো আইনের মূলনীতি হিসেবে কুরআন মজীদে একথা বিধিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে যে,
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ (النساء-59)
(যদি কোন ব্যাপারে তোমরা বিবাদে জড়িয়ে পড়ো তাহলে সেটিকে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কাছে ফিরিয়ে দাও)
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ- الاحزاب-36
(আল্লাহ ও তাঁর রসূল যখন কোন ব্যাপারে ফায়সালা করে দেন তখন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারীর জন্য সে ব্যাপারে কোন ইখতিয়ার থাকে না) এবং
اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ-اعراب-3
(তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে যা নাযিল করা হয়েছে তার অনুসরণ করো এবং তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করো না।)
তাছাড়া যে প্রসঙ্গে এ আয়াত এসেছে তার মধ্যেও এটি আরো একটি অর্থ প্রকাশ করছে। সেটি হচ্ছে আল্লাহ শুধু মতবিরোধসমূহের মীমাংসা করার আইনগত অধিকারীই নন, যা মানা আর না মানার ওপর ব্যক্তির কাফের বা মু’মিন হওয়া নির্ভরশীল। বরং প্রকৃতপক্ষে কার্যত তিনিই হক ও বাতিলের ফায়সালা করছেন, যে কারণে বাতিল ও তার পূজারীরা শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয় এবং হক ও তার অনুসারীরা সফলকাম হয়। পৃথিবীর মানুষ যে ফায়সালা কার্যকর হওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব হচ্ছে বলে যতই মনে করুক না কেন তাতে কিছু আসে যায় না। পরবর্তী ২৪ আয়াতেও এ বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে এবং এর আগেও কুরআন মজীদের কতিপয় স্থানে আলোচিত হয়েছে। (দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আর রা’দ, টীকা ৩৪-৬০; সূরা ইবরাহীম, টীকা ২৬-৩৪; সূরা বনী ইসরাঈল, টীকা ১০০; সূরা আম্বিয়া ১৫, ১৮-৪৪, ৪৬)