وَمَا تَفَرَّقُوٓا۟ إِلَّا مِنۢ بَعْدِ مَا جَآءَهُمُ ٱلْعِلْمُ بَغْيًۢا بَيْنَهُمْ ۚ وَلَوْلَا كَلِمَةٌۭ سَبَقَتْ مِن رَّبِّكَ إِلَىٰٓ أَجَلٍۢ مُّسَمًّۭى لَّقُضِىَ بَيْنَهُمْ ۚ وَإِنَّ ٱلَّذِينَ أُورِثُوا۟ ٱلْكِتَـٰبَ مِنۢ بَعْدِهِمْ لَفِى شَكٍّۢ مِّنْهُ مُرِيبٍۢ
মানুষের কাছে যখন জ্ঞান এসে গিয়েছিল তারপরই তাদের মধ্যে বিভেদ দেখা দিয়েছে। ২২ আর তা হওয়ার কারণ তারা একে অপরের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করতে চাচ্ছিলো। ২৩ একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মূলতবী রাখা হবে একথা যদি তোমার রব পূর্বেই ঘোষণা না করতেন তাহলে তাদের বিবাদের চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেয়া হতো। ২৪ প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, পূর্ববর্তীদের পরে যাদের কিতাবের উত্তরাধিকারী করা হয়েছে তারা সে ব্যাপারে বড় অস্বস্তিকর সন্দেহের মধ্যে পড়ে আছে। ২৫
২২
অর্থাৎ বিভেদের কারণ এ ছিল না যে, আল্লাহ নবী-রসূল পাঠাননি এবং কিতাবও নাযিল করেননি, তাই সঠিক পথ না জানার কারণে মানুষ নিজেদের জন্য আলাদা আলাদা ধর্ম, চিন্তা, গোষ্ঠী ও জীবন আদর্শ আবিষ্কার করে নিয়েছে। বরং তাদের মধ্যে এই বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্ঞান আসার পর। তাই সেজন্য আল্লাহ দায়ী নন, বরং সেই সব লোক নিজেরাই দায়ী যারা দ্বীনের সুস্পষ্ট নীতিমালা এবং শরীয়তের সুস্পষ্ট বিধি-নিষেধ থেকে দূরে সরে গিয়ে নতুন নতুন ধর্ম ও পথ বানিয়ে নিয়েছে।
২৩
অর্থাৎ কোন প্রকার সদিচ্ছা এই মতভেদ সৃষ্টির চালিকা শক্তি ছিল না। এটা ছিল তোমাদের অভিনব ধারণা প্রকাশের আকাংখা। নিজের নাম ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চিন্তা, পারস্পরিক জিদ ও একগুঁয়েমি, একে অপরকে পরাস্ত করার প্রচেষ্টা এবং সম্পদ ও মর্যাদা অর্জন প্রচেষ্টার ফল। ধূর্ত ও উচ্চাভিলাসী লোকগুলো দেখলো, আল্লাহর বান্দারা যদি সোজাসুজি আল্লাহর দ্বীন অনুসরণ করতে থাকে তাহলে একজনই মাত্র খোদা হবেন মানুষ যার সামনে মাথা নত করবে, একজন রসূল হবেন মানুষ নেতা ও পথপ্রদর্শক হিসেবে যাকে মেনে চলবে, একখানা কিতাব থাকবে যেখান থেকে মানুষ পথনিদের্শনা লাভ করবে এবং একটি পরিচ্ছন্ন ও সুস্পষ্ট আকীদা-বিশ্বাস ও নির্ভেজাল বিধান থাকবে মানুষ যা অনুসরণ করতে থাকবে। এই ব্যবস্থায় তাদের নিজেদের জন্য কোন বিশেষ মর্যাদা থাকতে পারে না যে কারণে তাদের পৌরহিত্য চলবে, লোকজন তাদের পাশে ভিড় জমাবে তাদের সামনে মাথা নত করবে এবং পকেটও শূন্য করবে। এটাই সেই মূল কারণ যা নতুন নতুন আকীদা ও দর্শন, নতুন নতুন ইবাদত-পদ্ধতি ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং নতুন নতুন জীবনাদর্শ উদ্ভাবনের উৎসাহ যুগিয়েছে এবং আল্লাহর বান্দাদের একটি বড় অংশকে দ্বীনের সুস্পষ্ট রাজপথ থেকে সরিয়ে বিভিন্ন পথে বিক্ষিপ্ত করে দিয়েছে। তারপর এ বিক্ষিপ্ততা এসব দল-উপদলের পারস্পরিক বিতর্ক ও বিবাদ এবং ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কলহের কারণে চরম তিক্ততায় পর্যবসিত হয়েছে। এমনকি এ থেকে এমন রক্তপাতও ঘটেছে যেজন্য মানবেতিহাস রক্ত রঞ্জিত হয়ে চলেছে।
২৪
অর্থাৎ যারা গোমরাহী উদ্ভাবন করার এবং জেনে বুঝে তা অনুসরণ করার অপরাধে অপরাধী ছিল তাদেরকে দুনিয়াতেই আযাব দিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হতো এবং শুধু সঠিক পথ অনুসরণকারীদের বাঁচিয়ে রাখা হতো যার মাধ্যমে কে ন্যায় ও সত্যের অনুসারী আর কে বাতিলের অনুসারী তা সুস্পষ্ট হয়ে যেতো। কিন্তু আল্লাহ এই চূড়ান্ত ফায়সালা কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য মূলতবী করে রেখেছেন। কারণ, পৃথিবীতে এ ফায়সালা করে দেয়ার পর মানবজাতির পরীক্ষা অর্থহীন হয়ে যেতো।
২৫
অর্থাৎ প্রত্যেক নবী এবং তাঁর নিকট অনুসারীদের যুগ অতিবাহিত হওয়ার পর আল্লাহর কিতাব পরবর্তী বংশধরদের কাছে পৌঁছলে তারা দৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থার সাথে তা গ্রহণ করেনি, বরং তারা সে সম্পর্কে বড় সন্দেহ সংশয় এবং মানসিক দ্বিধাদ্বন্দ্বের শিকার হয়েছে। তাদের এ পরিস্থিতি শিকার হওয়ার অনেকগুলো কারণ ছিল। তাওরাত ও ইনজীলে ঐ সব পরিস্থিতি সম্পর্কে যেসব বিষয় বর্ণিত হয়েছে তা অধ্যয়নের মাধ্যমে আমরা অতি সহজেই সেই সব কারণ অনুধাবন করতে পারি। পূর্ববর্তী প্রজন্মের লোকেরা এ দু’টি গ্রন্থকে তার মূল অবস্থায় মূল রচনাশৈলী ও ভাষায় সংরক্ষিত করে পরবর্তী প্রজন্মের লোকদের কাছে পৌঁছায়নি। তার মধ্যে আল্লাহর বাণীর সাথে ব্যাখ্যা, ইতিহাস এবং জনশ্রুতিমূলক ঐতিহ্য ও ফিকাহবিদদের উদ্ভাবিত খুঁটিনাটি বিষয়সমূহের আকারে মানুষের কথাও মিশিয়ে একাকার করে দিয়েছে। এ দু’টি গ্রন্থের অনুবাদের এত অধিক মাত্রায় প্রচলন করেছে যে, মূল গ্রন্থ হারিয়ে গিয়েছে এবং কেবল তার অনুবাদই টিকে আছে। এর ঐতিহসিক প্রমাণসমূহকেও এমনভাবে ধ্বংস করে ফেলেছে যে, এখন আর কেউই পুরো নিশ্চয়তার সাথে বলতে পারে না তার কাছে যে কিতাব আছে পৃথিবীবাসী সেটিই হযরত মূসা বা হযরত ঈসার মাধ্যমে লাভ করেছিলো। তাছাড়া মাঝে মধ্যে তাদের ধর্মীয় পণ্ডিতরা ধর্ম, অধিবিদ্যা, দর্শন, আইন, পদার্থবিদ্যা, মনস্তত্ব এবং সমাজবিজ্ঞানের এমন সব আলোচনা করেছেন এবং চিন্তাদর্শ গড়ে তুলেছেন যার গোলক ধাঁধাঁয় পড়ে মানুষের জন্য এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়েছে যে, আঁকাবাঁকা এসব পথের মধ্যে ন্যায় ও সত্যের রাজপথ কোনটি। আল্লাহর কিতাব যেহেতু মূল ও নির্ভরযোগ্য অবস্থায় বর্তমান ছিল না তাই মানুষ নির্ভরযোগ্য এমন কোন প্রমাণের স্মরণাপন্ন হতেও পারতো না যা বাতিল থেকে হককে আলাদা করার ব্যাপারে তাদের সাহায্য করতে পারতো।