أَفَلَمْ يَنظُرُوٓا۟ إِلَى ٱلسَّمَآءِ فَوْقَهُمْ كَيْفَ بَنَيْنَـٰهَا وَزَيَّنَّـٰهَا وَمَا لَهَا مِن فُرُوجٍۢ
আচ্ছা, ৬ এরা কি কখনো এদের মাথার ওপরের আসমানের দিকে তাকায়নি? আমি কিভাবে তা তৈরী করেছি এবং সজ্জিত করেছি। ৭ তাতে কোথাও কোন ফাটল নেই। ৮
৬
উপরোল্লেখিত পাঁচটি আয়াতে মক্কার কাফেরদের ভূমিকার অযৌক্তিকতা স্পষ্ট করে দেয়ার পর মুহাম্মাদ ﷺ আখেরাতের যে খবর দিয়েছেন তার সত্যতার প্রমাণাদি কি তা বলা হচ্ছে। এখানে একথাটি ভালভাবে বুঝে নেয়া প্রয়োজন যে, কাফেররা যে দু’টি বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলো তার মধ্যে একটি অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের সত্যতা সম্পর্কে প্রারম্ভেই দু’টি প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। প্রথম প্রমাণটি হলো, তিনি তোমাদের সামনে কুরআন মজীদ পেশ করেছেন যা তাঁর নবী হওয়ার খোলাখুলি প্রমাণ। দ্বিতীয় প্রমাণ হচ্ছে তিনি তোমাদের নিজদের স্বজাতি ও জ্ঞাতি গোষ্ঠীর লোক। তিনি হঠাৎ আসমান থেকে কিংবা অন্য কোন অঞ্চল থেকে এসে হাজির হননি যে, তিনি নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি কিনা আর এ কুরআন তাঁর নিজের রচিত কথা হতে পারে কিনা তা তাঁর জীবন, চরিত্র ও কর্ম যাঁচাই-বাছাই করে বিশ্লেষণ করা কঠিন। অতএব তাঁর নবুওয়াত দাবী সম্পর্কে তোমাদের বিস্ময় অনর্থক। এ যুক্তি-প্রমাণ সবিস্তারে পেশ করার পরিবর্তে সংক্ষিপ্ত দু’টি ইঙ্গিত আকারে বর্ণনা করা হয়েছে। কেননা, মুহাম্মাদ ﷺ যে সময় মক্কায় দাঁড়িয়ে নিজে সেসব লোকদের কুরআন শুনাচ্ছিলেন যারা তাঁর শৈশব থেকে শুরু করে যৌবন এবং পৌঢ়ত্ব পর্যন্ত তাঁর গোটা জীবন দেখেছিল, সে সময়ের প্রতিটি ব্যক্তির কাছে এসব ইঙ্গিতের বিস্তারিত পরিবেশ ও পটভূমি আপনা থেকেই সুস্পষ্ট ছিল। তাই তাঁর বর্ণনা বাদ দিয়ে দ্বিতীয় যে জিনিসটিকে ঐ সব লোক অদ্ভূদ ও বিবেক-বুদ্ধির পরিপন্থী বলছে তার সত্যতার বিস্তারিত যুক্তি-প্রমাণ পেশ করা হচ্ছে।
৭
এখানে আসমান বলতে পুরো ঊর্ধ্বজগতকে বুঝানো হয়েছে। যা মানুষ রাত-দিন তার মাথার ওপর ছেয়ে থাকতে দেখে। যেখানে দিনের বেলা সূর্য দীপ্তি ছড়ায়, রাতের বেলা চাঁদ এবং অসংখ্য তারকারাজি উজ্জল হয়ে দেখা দেয়। মানুষ যদি এগুলোকে খালি চোখেই দেখে তাহলেও সে বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে পড়ে। আর দূরবীন লাগিয়ে দেখলে এমন একটি বিশাল সুবিস্তৃত সৃষ্টিজগত তার সামনে ভেসে ওঠে যার কোন সীমা পরিসীমা নেই। কোথায় শুরু এবং কোথায় শেষ হয়েছে বুঝা যাবে না। আমাদের পৃথিবীর চেয়ে লক্ষ লক্ষ গুণ বড় বিশালকার গ্রহসমূহ এর মধ্যে বলের মত ঘুরপাক খাচ্ছে। আমাদের সূর্যের চেয়ে হাজার হাজার গুণ অধিক উজ্জল তারকা তার মধ্যে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। আমাদের এ সৌরজগত তার একটি মাত্র ছায়াপথের এক কোণে পড়ে আছে। এ একটি মাত্র ছায়াপথে আমাদের সূর্যের মত কমপক্ষে আরো ৩ শত কোটি তারকা (স্থির বস্তু) বিদ্যমান এবং মানুষের পর্যবেক্ষণ এ পর্যন্ত এরূপ দশ লাখ ছায়াপথের সন্ধান দিচ্ছে। এ লক্ষ লক্ষ ছায়াপথের আমাদের সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী প্রতিবেশী ছায়াপথটি এত দূরে অবস্থিত যে, তার আলো সেকেণ্ডে এক লাখ ছিয়াশি হাজার মাইল গতিতে অগ্রসর হয়ে দশ লাখ বছরে আমাদের পৃথিবী পর্যন্ত পৌঁছে। এটা হচ্ছে সৃষ্টিজগতের সেই অংশের বিস্তৃতির অবস্থা যা এ পর্যন্ত মানুষের জ্ঞান ও পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে। আল্লাহর কর্তৃত্ব কত ব্যাপক ও বিস্তৃত তার কোন অনুমান আমরা করতে পারি না। হতে পারে, সমুদ্রের তুলনায় এক বিন্দু পানি যতটুকু মানুষের জানা সৃষ্টিজগত গোটা সৃষ্টিজগতের অনুপাতের ততটুকুও নয়। যে আল্লাহ এ বিশাল সৃষ্টিজগতকে অস্তিত্ব দান করেছেন, ভুপৃষ্ঠের ধীরগতি ও বাকশক্তি সম্পন্ন মানুষ নামে অভিহিত অতি ক্ষুদ্র জীব যদি সেই আল্লাহ সম্পর্কে মত প্রকাশ করে যে, মৃত্যুর পর তিনি তাকে পুনরায় জীবিত করতে পারবেন না তাহলে সেটা তার নিজের জ্ঞান-বুদ্ধির সংকীর্ণতা মাত্র। তাতে বিশ্ব-জাহানের সৃষ্টিকর্তার ক্ষমতা কি করে সীমিত হতে পারে!
৮
অর্থাৎ এ বিস্ময়কর বিস্তৃতি সত্ত্বেও এ বিশাল ও জাঁকজমকপূর্ণ বিশ্ব ব্যবস্থা এমন সুশৃংখল ও মজবুত এবং তার বন্ধন এমন অটুট যে, তাতে কোথাও কোন চিড় বা ফাটল এবং কোথাও গিয়ে এর ধারাবাহিকতা ছিন্ন হয় না। একটি উদাহরণের সাহায্যে এ বিষয়টি ভালভাবে বুঝা যেতে পারে, আধুনিক যুগের বেতার সংকেত ভিত্তিক জ্যোতির্বিজ্ঞান-গবেষকগণ একটি ছায়াপথ পর্যবক্ষেণ করেছেন যাকে তারা উৎস ৩গ ২৯৫ (Source 3c 295) নামে আখ্যায়িত করে থাকেন। উক্ত ছায়াপথ সম্পর্কে তাদের ধারণা হচ্ছে, বর্তমানে আমাদের কাছে তার যে আলো এসে পৌঁছেছে তার চারশ’ কোটি বছরেরও বেশী সময় পূর্বে সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে থাকবে। এত দূর থেকে এসব আলোক রশ্মির পৃথিবী পর্যন্ত পৌঁছা কি করে সম্ভব হতো যদি পৃথিবী এবং উক্ত ছায়াপথের মাঝে বিশ্ব ব্যবস্থার ধারাবাহিকতার কোথাও ছিন্ন থাকতো এবং বন্ধনে ফাটল থাকতো। আল্লাহ তা’আলা এ সত্যের দিকে ইঙ্গিত করে প্রকৃতপক্ষে মানুষের সামনে এ প্রশ্নই রেখেছেন যে, আমার সৃষ্ট বিশ্ব-জাহানের এ ব্যবস্থাপনায় যখন তোমরা একটি সামান্য ছিদ্রও দেখিয়ে দিতে পারো না তখন তোমাদের মগজে আমার দূর্বলতার এ ধারণা কোথা থেকে আসে যে, তোমাদের পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ শেষ হয়ে যাওয়ার পর হিসেব-নিকেশ নেয়ার জন্য আমি তোমাদের জীবিত করে আমার সামনে হাজির করতে চাইলে তা করতে পারবো না।
এটা শুধু আখেরাতের সম্ভাবনার প্রমাণই নয় বরং তাওহীদেরও প্রমাণ। চারশত কোটি আলোক বর্ষের (Light Year) দূরত্ব থেকে এসব আলোক রশ্মির পৃথিবী পর্যন্ত পৌঁছা এবং এখানে মানুষের তৈরী যন্ত্রপাতিতে ধরা পড়া খোলাখুলি একথা প্রমাণ করে যে, ঐ ছায়াপথ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত গোটা সৃষ্টিজগত একই বস্তুর তৈরী, তার মধ্যে একই রকম শক্তিসমূহ কর্মতৎপর রয়েছে এবং কোন প্রকার পার্থক্য ও ভিন্নতা ছাড়া তা একই রকম নিয়ম-কানুন অনুসারে কাজ করছে। তা না হলে এসব আলোক রশ্মি এ পৃথিবী পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হতো না এবং পৃথিবী ও তার পরিবেশে ক্রিয়াশীল নিয়ম-কানুন সম্পর্কে অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিতে মানুষ যেসব যন্ত্রপাতি তৈরী করেছে তাতেও ধরা পড়তো না। এতে প্রমাণিত হয়, একই আল্লাহ গোটা এ বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা, মালিক, শাসক ও ব্যবস্থাপক।