আয যারিয়াত

৬০ আয়াত

بِسْمِ ٱللّٰهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
৩১ ) ইবরাহীম বললোঃ হে আল্লাহর প্রেরিত দূতগণ, আপনাদের অভিপ্রায় কি? ৩০
قَالَ فَمَا خَطْبُكُمْ أَيُّهَا ٱلْمُرْسَلُونَ ٣١
৩২ ) তারা বললোঃ আমাদেরকে একটি পাপী জাতির কাছে পাঠানো হয়েছে। ৩১
قَالُوٓا۟ إِنَّآ أُرْسِلْنَآ إِلَىٰ قَوْمٍ مُّجْرِمِينَ ٣٢
৩৩ ) যাতে আমরা তাদের ওপর পোড়ানো মাটির পাথর বর্ষণ করি।
لِنُرْسِلَ عَلَيْهِمْ حِجَارَةً مِّن طِينٍ ٣٣
৩৪ ) যা আপনার রবের কাছে সীমালংঘনকারীদের জন্য চিহ্নিত আছে। ৩২
مُّسَوَّمَةً عِندَ رَبِّكَ لِلْمُسْرِفِينَ ٣٤
৩৫ ) অতঃপর ৩৩ ঐ জনপদে যারা মু’মিন ছিলো তাদের সবাইকে বের করে নিলাম।
فَأَخْرَجْنَا مَن كَانَ فِيهَا مِنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ ٣٥
৩৬ ) আমি সেখানে একটি পরিবার ছাড়া আর কোন মুসলিম পরিবার পাইনি। ৩৪
فَمَا وَجَدْنَا فِيهَا غَيْرَ بَيْتٍ مِّنَ ٱلْمُسْلِمِينَ ٣٦
৩৭ ) অতঃপর যারা কঠোর আযাবকে ভয় করে তাদের জন্য সেখানে একটি নিদর্শন রেখে দিয়েছি। ৩৫
وَتَرَكْنَا فِيهَآ ءَايَةً لِّلَّذِينَ يَخَافُونَ ٱلْعَذَابَ ٱلْأَلِيمَ ٣٧
৩৮ ) এছাড়া (তোমাদের জন্য নিদর্শন আছে) মূসার কাহিনীতে। আমি যখন তাকে স্পষ্ট প্রমাণসহ ফেরাউনের কাছে পাঠালাম ৩৬
وَفِى مُوسَىٰٓ إِذْ أَرْسَلْنَٰهُ إِلَىٰ فِرْعَوْنَ بِسُلْطَٰنٍ مُّبِينٍ ٣٨
৩৯ ) তখন সে নিজের শক্তিমত্তার ওপর গর্ব প্রকাশ করলো এবং বললোঃ এ তো যাদুকর কিংবা পাগল। ৩৭
فَتَوَلَّىٰ بِرُكْنِهِۦ وَقَالَ سَٰحِرٌ أَوْ مَجْنُونٌ ٣٩
৪০ ) অবশেষে আমি তাকে ও তার সৈন্যদেরকে পাকড়াও করলাম এবং সবাইকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করলাম। আর সে তিরস্কৃত ও নিন্দিত হলো। ৩৮
فَأَخَذْنَٰهُ وَجُنُودَهُۥ فَنَبَذْنَٰهُمْ فِى ٱلْيَمِّ وَهُوَ مُلِيمٌ ٤٠
৩০.
মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতাদের আগমন যেহেতু কোন বড় গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য হয়ে থাকে তাই তাদের আগমনের উদ্দেশ্য অবহিত হওয়ার জন্য হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম خطب শব্দ ব্যবহার করেছেন। আরবী ভাষায় خطب শব্দটি কোন মামুলি কাজের জন্য ব্যবহৃত হয় না, বরং কোন বড় গুরুত্বপূর্ণ কাজ বুঝাতে ব্যবহৃত হয়।
৩১.
অর্থাৎ লূতের (আ) জাতি। তাদের অপরাধ এতটা বৃদ্ধি পেয়েছিলো যে, ‘অপরাধী জাতি’ শুধু এ শব্দটাই জাতি হিসেবে তাদের পরিচয়ের জন্য যথেষ্ট ছিল। এর আগে কুরআন, মজীদের নিম্ন বর্ণিত স্থানসমূহে এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। তাফহীমুল কুরআন, সূরা সা’দ আয়াত ৮০ থেকে ৮৪; হূদ, ৭৩ থেকে ৮৩ সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৭৪, ৭৫; সূরা আশ’শুয়ারা, ১৬০ থেকে ১৭৫; আন নামল, ৫৪ থেকে ৫৮ ও ৬৩ থেকে ৬৮; সূরা সাফফাত, ১৩৩ থেকে ১৩৮ টীকাসহ।
৩২.
অর্থাৎ কোন্ পাথরটি কোন অপরাধীর মস্তক চূর্ণ করবে আপনার রবের পক্ষ থেকে তা ঐ পাথরের গায়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। সূরা হূদ ও আল হিজরে এ আযাবের যে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে, তাদের জনপদসমূহ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে এবং ওপর থেকে পোড়ানো মাটির পাথর বর্ষণ করা হয়েছে। এ থেকে ধারণা করা যায় যে, প্রচণ্ড ভূমিকম্পে গোটা অঞ্চল উলটপালট করে দেয়া হয়েছে এবং যারা ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পেয়ে পালিয়েছিলো আগ্নেয়গিরির লাভার সাথে নির্গত পাথর-বৃষ্টি তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
৩৩.
এ ফেরেশতারা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের নিকট থেকে কিভাবে হযরত লূতের (আ) কাছে পৌঁছলো এবং সেখানে তাদের ও লূতের (আ) জাতির মাঝে কি ঘটলো সেসব কাহিনীর বর্ণনা এখানে বাদ দেয়া হয়েছে। সূরা হূদ আল হিজর ও আল আনকাবূতে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আগেই করা হয়েছে। যে সময় এ জাতির ওপর আযাব নাযিল হতে যাচ্ছে এখানে শুধু সেই চরম মুহূর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
৩৪.
অর্থাৎ গোটা জাতি ও এলাকায় একটি মাত্র পরিবার ছিল যেখানে ইসলামের আলো বিদ্যমান ছিল। আর সেটা ছিল হযরত লূত আলাইহিস সালামের পরিবার। এছাড়া গোটা জাতি অশ্লীলতা ও পাপাচারে ডুবে ছিল এবং তাদের গোটা দেশ পঙ্কিলতায় ভরে উঠেছিলো। তাই আল্লাহ তা’আলা সেই একটি পরিবারের লোকজনকে রক্ষা করে বের করে নিলেন এবং তারপর সেই দেশে এমন প্রলয়ঙ্কারী আযাব নাযিল করলেন যে, এ দুশ্চরিত্র জাতির একটি লোকও রক্ষা পায়নি। এ আয়াতটিতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বর্ণিত হয়েছেঃ

একঃ আল্লাহর প্রতিফল বিধান কোন জাতিকে ততদিন পরিপূর্ণরূপে ধ্বংস করার ফায়সালা করে না যতদিন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোন ভালো গুণ বিদ্যমান থাকে। খারাপ লোকদের সংখ্যাধিক্যের মধ্যে নগণ্য সংখ্যক কিছু লোকও যদি অকল্যাণকে প্রতিরোধ করার এবং কল্যাণের পথের দিকে ডাকার জন্য তৎপর থাকে এবং তাদের কল্যাণকারিতা এখনো নিঃশেষ হয়ে না থাকে তাহলে তাদেরকে আরো কিছুকাল কাজ করার সুযোগ দেন এবং তাদের অবকাশকাল বাড়িয়ে দিতে থাকেন। কিন্তু অবস্থা যদিও এই দাঁড়ায় যে, কোন জাতির মধ্যে যৎসামান্য সদগুণও অবশিষ্ট না থাকে সেক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান হচ্ছে, উক্ত জনপদে যে দু’চারজন লোক অকল্যাণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে পড়েছে, তিনি তার মহা ক্ষমতাধীনে কোন না কোনভাবে রক্ষা করে নিরাপদে বের করেন এবং অবশিষ্ট লোকদের সাথে ঠিক তেমনি আচরণ করেন, যে আচরণ একজন সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন লোক পঁচা ফলের সাথে করে থাকে।

দুইঃ ‘মুসলমান’ কেবল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতের নাম নয়। তাঁর পূর্বের সমস্ত নবী-রসূল ও তাঁদের উম্মতও মুসলমান ছিলেন। তাঁদের দ্বীনও ভিন্ন ভিন্ন ছিল না যে, কোনটা ইবরাহীমের দ্বীন, কোনটা মূসার দ্বীন আবার কোনটা ঈসার দ্বীন বলে আখ্যায়িত হতে পারে। তারা সবাই ছিলেন মুসলমান এবং তাদের দ্বীনও ছিল এ ইসলাম। কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় এ সত্যটি এমন সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। উদাহরণস্বরূপ নিম্নবর্ণিত আয়াতগুলো দেখুনঃ আল বাকারা, ১২৮, ১৩১, ১৩২ ও ১৩৩; আলে ইমরান, ৬৭; আল মায়েদা, ৪৪ ও ১১১; ইউনুস, ৭২ ও ৮৪ ; ইউসূফ, ১০১; আল আ’রাফ, ১২৬ ও আল নাহল, ৩১, ৪২ ও ৪৪।

তিনঃ ‘মু’মিন’ ও ‘মুসলিম’ শব্দ দু’টি এ আয়াতে সম্পূর্ণ সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এ আয়াতটি যদি সূরা হুজুরাতের ১৪ আয়াতের সাথে মিলিয়ে পড়া যায় তাহলে সেসব লোকদের ধারণার ভ্রান্তি পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যারা মু’মিন ও ‘মুসলিম’ শব্দকে কুরআন মজীদের এমন দু’টি স্বতন্ত্র পরিভাষা বলে মনে করে যা সবখানে একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এও মনে করে যে, ঈমান ছাড়াই যে ব্যক্তি বাহ্যত ইসলামের গণ্ডির মধ্যে প্রবেশ করেছে সে-ই নিশ্চিত মুসলিম। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা হুজুরাতের ব্যাখ্যা, টীকা ৩১)।

৩৫.
এ নিদর্শন অর্থ মরু সাগর (Dead Sea)। বর্তমানেও যার দক্ষিণাঞ্চল এক সাংঘাতিক ধ্বংসের নিদর্শন পেশ করছে। প্রত্নতাত্মিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা এই যে, লূতের (আ) জাতির বৃহৎ শহর খুব সম্ভবত প্রচণ্ড ভূমিকম্পে ধসে ভূগর্ভে তলিয়ে গিয়েছিলো এবং তার উপরিভাগে মরু সাগরের পানি ছেয়ে গিয়েছিলো। কারণ, এই সাগরের যে অংশ اللسان (আল লিসান) নামক ক্ষুদ্র উপদ্বীপের দক্ষিণে অবস্থিত তা পরবর্তী সময়ে সৃষ্ট বলে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় এবং এ উপদ্বীপের উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত প্রাচীন মরু সাগরের যেসব নিদর্শন দেখা যায় তা দক্ষিণের নিদর্শন থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। এ থেকে অনুমান করা হয় যে, উপদ্বীপের দক্ষিণের অংশ আগে মরু সাগর পৃষ্ঠ থেকে উঁচু ছিল। পরবর্তীকালে কোন এক সময় ধসে নীচে দেবে গিয়েছে। এর ধসে যাওয়ার সময়টাও খৃস্টপূর্ব দু’হাজার সনের সম-সাময়িক বলে মনে হয়। ঐতিহাসিকভাবে এটাই হযরত ইবরাহীম ও হযরত লূতের (আ) যুগ। ১৯৬৫ সালে একদল আমেরিকান প্রত্মতাত্বিক অনুসন্ধানী আল লিসানে এক বিশাল কবরস্থান আবিষ্কার করেছে যেখানে ২০ হাজারের অধিক কবর আছে। এ থেকে অনুমিত হয় যে, নিকটেই কোন বড় শহর অবশ্যই থাকবে। কিন্তু আশেপাশে কোথাও এমন কোন শহরের নিদর্শন নেই যার পাশেই এত বড় কবরস্থান গড়ে উঠতে পারে। এ থেকেও এ সন্দেহ দৃঢ়মূল হয় যে, এটি যে শহরের কবরস্থান ছিল তা সাগরে নিমজ্জিত হয়েছে। সাগরের দক্ষিণে যে এলাকা অবস্থিত সেখানে এখনো যত্রযত্র ধ্বংসের নিদর্শন বিদ্যমান এবং ভূমিতে গন্ধক, আলকাতরা, কয়লাজাত পিচ ও প্রাকৃতিক গ্যাসের এমন বিপুল মজুদ বর্তমান যা দেখে ধারণা জন্মে যে, এখানে কোন এক সময় বজ্রপাত হওয়ার কিংবা ভূমিকম্পের কারণে লাভা উদগীরণ হওয়ার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হয়ে থাকবে (অধিক ব্যখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আশ’শুআরা, টীকা ১১৪)।
৩৬.
অর্থাৎ এরূপ সুস্পষ্ট মু’জিযা এবং প্রকাশ্য নিদর্শনসহ পাঠিয়েছিলেন যে, তিনি যে আসমান ও যমীনের স্রষ্টার পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়ে এসেছিলেন সে বিষয়টি আর সন্দেহযুক্ত ছিল না।
৩৭.
অর্থাৎ কোন সময় সে তাঁকে যাদুকর বলে আখ্যায়িত করেছিলো আবার কখনো বলেছিলো এ ব্যক্তি পাগল।
৩৮.
এ ক্ষুদ্র বাক্যাংশটিতে ইতিহাসের একটি পূর্ণাংগ ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। ঘটনাটা বুঝার জন্য কল্পনার চোখের সামনে এ চিত্রটি একটু নিয়ে আসুন যে, ফেরাউন তৎকালীন পৃথিবীর সভ্যতা ও সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় কেন্দ্রের শক্তিধর শাসক ছিল, যার জাঁকজমক ও প্রভাব প্রতিপত্তিতে আশেপাশে সমস্ত জাতি ভীত সন্ত্রস্ত ছিল। এ কথা সুবিদিত যে, হঠাৎ একদিন যখন সে তার সৈন্য সামন্তসহ পানিতে ডুবে মরলো, তখন শুধু মিশরেই নয়, আশেপাশের সমস্ত জাতির মধ্যে এ ঘটনা ব্যাপক প্রচার লাভ করে থাকবে। কিন্তু এতে ডুবে মরা লোকদের নিকটাত্মীয় ছাড়া আর কেউই এমন ছিলো না যারা তাদের নিজের দেশে কিংবা পৃথিবীর অন্য কোন জাতির মধ্যে তাদের জন্য শোক প্রকাশ করতো, কিংবা অন্তত এতোটুকুই বলতো যে, হায়! এ দুর্ঘটনার শিকার লোকেরা কত ভাল মানুষ ছিল। পক্ষান্তরে পৃথিবী যেহেতু তাদের জুলুম-অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো তাই তাদের এ দৃষ্টান্তমূলক পরিণতি লাভের কারণে প্রতিটি মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলো। প্রতিটি মুখই তাদের ওপর তিরস্কার ও নিন্দাবাদ বর্ষণ করেছে এবং যে-ই খবরটি শুনেছে সে-ই বলে উঠেছে, এ দূরাচার তার উপযুক্ত পরিণতিই ভোগ করেছে। সূরা দুখানে এ অবস্থাটা এভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ فَمَا بَكَتْ عَلَيْهِمُ السَّمَاءُ وَالْأَرْضُ “অতঃপর না আসমান তাদের জন্য কেঁদেছে না যমীন তাদের জন্য অশ্রু বর্ষণ করেছে।” ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা দুখান, টীকা ২৫)।
অনুবাদ: